আবদুশ শাকুর
অবয়ব
আবদুশ শাকুর (জন্ম: ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ - মৃত্যু: ১৫ জানুয়ারি, ২০১৩) বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, রচনাসাহিত্যিক, রবীন্দ্র-গবেষক, সঙ্গীতজ্ঞ ও গোলাপ-বিশেষজ্ঞ। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে তিনি পেয়েছেন একুশে পদক। তিনি রম্যচনার জন্য বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
উক্তি
[সম্পাদনা]- সকল শিল্পকলার মধ্যে একমাত্র গানই সর্বজনগ্রাহ্য। কারণ এ চারুশিল্পটি সবচেয়ে বিমূর্ত। আঁকা দেখা যায়, লেখাও দেখা যায়। দেখা যায় না কেবল গাওয়া। কারণ ওটা অদৃশ্য হাওয়াজনিত ধ্বনিমাত্র।
- বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (প্রথম পর্ব)[১]
- বোধের উন্মোচন থেকেই আমি অনুভব করে আসছি— আবদুশ শাকুর যেন তার সহজাত প্রবণতাগুলো নিয়ে ঠিক ততখানি প্রতিকূল ভুবনেই জন্মেছে যতখানি অনুকূল ভুবনে জন্মেছেন, ধরুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যাপারটার শাখাপ্রশাখায় বিচরণ না করে এখানে আমি কেবল কাণ্ডখানির দিকে ইঙ্গিত করেই ক্ষান্ত হবো : কর্ণে সুর আর তাল বেজে উঠতেই আমাকে বুঝতে হলো, আমি একটি ঐতিহ্যবাহী আলেম খান্দানের সদস্য। অতঃপর কণ্ঠে ভাষা ও ছন্দ ফুটে উঠতেই আমাকে জানতে হলো, আমি ‘স্বনামঘৃণ্য’ একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষ এবং অবোধ্য এক উপভাষাভাষী। ’
- আবদুশ শাকুরের স্মৃতিকথামূলক রচনা ‘কাঁটাতে গোলাপও থাকে’ থেকে নেয়া।[২]
- বন্যজীবনে মানুষের যখন মাথা গোঁজার জন্য বাসা বাঁধার কথাও চিন্তার অতীত ছিল, তখনই কিন্তু তাঁদের জীবনে গান বাসা বেঁধে ফেলেছিল। কারণ নিরন্তর কঠিন প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি জীবনে শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য প্রাণপণ লড়াইয়ের মধ্যেও গানে তারা প্রাণের আরাম লাভ করত। শিল্পতাত্ত্বিক জর্জ টমসনের ভাবনায় এই কথার আভাস মেলে। গানের উৎসে তিনি বাঁচার জন্য স্থাবর-জঙ্গম সংবলিত প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংগ্রামজনিত ক্লান্তিকর শ্রমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা খুঁজে পেয়েছেন।
- বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (প্রথম পর্ব)[৩]
- ধ্বনির প্রয়োগও নির্দিষ্ট করে দিত মানুষের আনুষঙ্গিক প্রকৃতি। যেমন কণ্ঠস্বর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক উচ্চগ্রামে প্রযুক্ত হত উল্লাস, আহ্বান, বিরক্তি, ক্রোধ ইত্যাদি প্রকাশ করার জন্য। আবার দুঃখ, বেদনা, ক্লান্তি, অবসাদ এবং গোপনীয়তা বোঝাবার জন্য স্বভাবতই নির্দিষ্ট হত নিম্নগ্রামীয় কণ্ঠস্বর। বৈদিক যুগের শুরুতেই স্বরের উচ্চাবচতার তিনটি মাত্রার কথা শোনা যায় — ‘উচ্চ’, ‘নিচু’ এবং ‘মধ্য’। আজকের স্বরসপ্তকও তদনুযায়ীই বিভাজিত হয় — মন্দ্র (নিচু), মধ্য (মধ্য) ও তার (উচ্চ)।
- বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (প্রথম পর্ব)[৪]
- “লেখাটাই তো আমার বিশ্রাম, বাবা! একদিন না লিখলে তো রাতে ঘুম হয় না আমার।”
- ‘স্যার, এই বয়সে এত লেখার কোনো দরকার আছে? লেখার চেয়ে আপনার বিশ্রাম নেওয়াটা জরুরি।’ — স্বকৃত নোমানের প্রশ্নের জবাবে।<ref
- “বাংলাদেশের পাঠক আমাকে মূল্য দিল না। দেখ, কলকাতার প্রকাশকরা ঠিকই আমার বই গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করছে। ওখানে আমার বইয়ের বিক্রি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। পশ্চিমঙ্গে আমার বইয়ের বিক্রি বাড়ছে দিন দিন।”
- কলকাতার একাধিক প্রকাশনা সংস্থা থেকে তাঁর বিভিন্ন বই প্রকাশিত হওয়াতে তার উচ্ছ্বাস আর আক্ষেপ।
- তেমনি প্রতিটি গোলাপও যেন স্বতন্ত্র একটি নন্দনতত্ত্বগত সত্তা, জনৈকা অন্যরূপা নায়িকা। এ জন্য আমার মনে হয়—প্রতিটি গোলাপ যেন একটি গান। আবার প্রতিটি গানই যেন একটি গোলাপ। পুষ্পের ভুবনে যেমন কেবল গোলাপই দৈহিক প্রেমের অবিমিশ্র প্রেরণা, কাব্যের জগতেও তেমনি কেবল গজলই শরীরী প্রেমের অবিমিশ্র অভিব্যক্তি—তবে কেবল অপুরস্কৃত প্রেমের। কিন্তু যত পুরস্কারহীনতার হাহাকারই হোক না কেন গজল, তার কাঙ্ক্ষিত প্রতিদান অবশ্য ইন্দ্রিয়জ বাসনারই। গোলাপও এমনি ইন্দ্রিয়জ বাসনারই প্রতীক।
- প্রাকৃতিক গোলাপ’ – প্রবন্ধ থেকে।[৫]
- প্রথমে গোলাপের লিখিত ইতিহাসটা একনজর দেখা যাক... হাজার বছর ধরে অলখে লুকিয়ে থাকার পরে অবশেষে গোলাপের দেখা মেলে খ্রিষ্টপূর্ব ষোলো শতকের ক্রিটের দেয়ালচিত্রে আর মৃৎপাত্রের গায়ে আঁকা ছবিতে।”
- প্রাকৃতিক গোলাপ’ – প্রবন্ধ থেকে।[৬]
- “পরিবর্তিত রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থায় শ্রোতাসাধারণ আঞ্চলিক ভাষা ও লোকজ সুরভিত্তিক গানের প্রয়োজন বেশি করে উপলব্ধি করতে লাগল... অতঃপর বিলুপ্তির কিনার থেকেও আবার বেঁচে ওঠা।”
- ‘বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী’ (পঞ্চম পর্ব)।[৭]
তার সম্পর্কে উক্তি
[সম্পাদনা]- আজ আমাদের চারপাশে অযত্ন আর অবহেলায় লেখা শিথিল গদ্যভাষার যে 'অলীক কুনাট্যরঙ্গ' মাথা উঁচিয়ে উঠেছে। আবদুশ শাকুরের গদ্য চিরায়ত গদ্যের পক্ষ থেকে তাঁর শক্তিমান প্রতিবাদ, জ্ঞান, মেধা এবং মননের সমবায় তাঁর বৈদগ্ধ্যকে এমন এক পরিশীলিত শ্রী এবং উপভোগ্যতা দিয়েছে, যার কাছাকাছি জিনিস চিরায়ত বাংলাসাহিত্যের ভিতরেই কেবল খুঁজে পাওয়া যাবে।
- অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্বনির্বাচিত প্রবন্ধ ও রচনাগ্রন্থে আবদুশ শাকুর সম্বন্ধে বলেন।[৮]
- প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা তাঁর ছোটগল্পে এক অনুপম চারুতা ও প্রাসঙ্গিকতা যোগ করে। বাগ্মী এই কথাকোবিদের প্রতিটি রচনাকেই আলোকিত করে বিবিধ বিষয়ে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। শাকুরের সমগ্র কথাসাহিত্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বস্তুটি হলো চিন্তাশক্তি আর কল্পনাশক্তির চমৎকার সমবায়।
- অধ্যাপক ড. অমিয় দেব কলকাতার দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের বিশেষ একটি সাহিত্যিক ক্রোড়পত্রে আবদুশ শাকুরের কথাসাহিত্য আলোচনাক্রমে লিখেছেন।[৯]
- নিজের লেখালেখি সম্পর্কে তিনি এতটাই সতর্ক থাকতেন, প্রতিবছর মেলায় যখন তাঁর বই বের হতো, তখন তিনি প্রুফ দেখানোর জন্য কখনো প্রুফরিডারকে পাণ্ডুলিপি দিতেন না, কষ্ট হলেও নিজেই দেখতেন। পাণ্ডুলিপির সফ্ট কপিও প্রকাশককে হস্তান্তর করতেন না, নিজ দায়িত্বে সরাসরি ট্রেসিং বের করে তারপর প্রকাশকের হাতে তুলে দিতেন। যান্ত্রিক জটিলতার কারণে পাছে কোনো শব্দ ভেঙে যায়, বাক্যের ওলটপালট যদি ঘটে যায়! বইগুলোর মেকআপ দেওয়ার জন্য একজন কম্পিউটার অপারেটরও রেখেছিলেন। আর তাঁর বাসাটি হচ্ছে একটি গ্রন্থাগার। বইগুলো সহজে খুঁজে পেতে নম্বর দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখার কাজে সহযোগিতা করতেন সঞ্জয় গাইন।
- প্রকাশনা নিয়ে তার যত্ন এবং সাবধানতা বুঝাতে।<
- একজন মানুষ নিরন্তর জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে প্রজ্ঞার একটা উচ্চতায় যে পৌঁছতে পারেন, সেই সাক্ষ্য বহন করেছিলেন যশস্বী কথাকার আবদুশ শাকুর। জ্ঞানচর্চার নিবিষ্ট এক ধ্যানী মানুষ ছিলেন তিনি। গতানুগতিকতার জোয়ারে গা না ভাসিয়ে, জনপ্রিয়তার ফাঁদে পা না বাড়িয়ে লেখক হিসেবে একটা স্বতন্ত্র ধারা প্রতিষ্ঠার ঘটনা বাংলাদেশে বিরল। কাজটা বিস্তর কঠিন। আবদুশ শাকুর এমনই এক অনন্য প্রতিভা, যিনি নিজেকে সচেতনভাবে জনপ্রিয়তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে নিভৃতে সাহিত্যচর্চায় নিরত থেকেছেন।
- কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান।
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]
উইকিপিডিয়ায় আবদুশ শাকুর সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।