আবেগ
অবয়ব
আবেগ হলো এক ধরনের মানসিক অবস্থা বা অবস্থা যা স্নায়বিক ও শারীরিক পরিবর্তনের ফলে ঘটে, যার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা, অনুভূতি, আচরণগত প্রতিক্রিয়া এবং কিছু পরিমাণে আনন্দ বা অসন্তুষ্টি জড়িত। বর্তমানে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ঐক্যমত সংজ্ঞা নেই। আবেগ প্রায়শই মনোভাব, মেজাজ, ব্যক্তিত্ব, প্রকৃতি বা সৃজনশীলতার সাথে যুক্ত থাকে।
উক্তি
[সম্পাদনা]- আবেগকে প্রকাশ করতে গেলে কথার মধ্যে আবেগের ধর্ম সঞ্চার করতে হয়। আবেগের ধর্ম হচ্ছে বেগ; সে চলে, চালায়। কথা যখন সেই বেগ গ্রহণ করে তখন স্পন্দিত হৃদয়ভাবের সঙ্গে তার সাধর্ম্য ঘটে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৪৪
- জীবের গতিবিধি কেবলমাত্র বাহিরের আঘাতের দ্বারা পরিমিত হয় না। ভিতর হইতে নানাবিধ আবেগ আসিয়া বাহিরের গতিকে জটিল করিয়া রাখিয়াছে। সেই ভিতরের আবেগ কতকটা অভ্যাস, কতকটা স্বেচ্ছাকৃত। এইরূপ বহুবিধ ভিতর ও বাহিরের আঘাত-আবেগের দ্বারা চালিত মানুষের গতি কে নিরুপণ করিতে পারে? কিন্তু মাধ্যাকর্ষণশক্তি কেহ এড়াইতে পারে না। সেই অদৃশ্য শক্তিবলে বহু বৎসর পরে আজ আমি আমার জন্মস্থানে উপনীত হইয়াছি।
- জগদীশচন্দ্র বসু, অব্যক্ত - জগদীশচন্দ্র বসু, বিজ্ঞানে সাহিত্য, তৃতীয় সংস্করণ, প্রকাশক- বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮৭-৮৮
- ঐক্যের যে কি শক্তি, কি মাহাত্ম্য, তাহা ইংরেজ আমাদের চেয়ে ভাল করিয়াই জানে। ইংরেজ জানে, ঐক্যের অনুভূতির মধ্যে কেবল একটা শক্তিমাত্র নহে, পরন্তু এমন একটা আনন্দ আছে যে, সেই অনুভূতির আবেগে মানুষ সমস্ত দুঃখ ও ক্ষতি তুচ্ছ করিয়া অসাধ্যসাধনে প্রবৃত্ত হয়। ইংরেজ আমাদের চেয়ে ভাল করিয়াই জানে যে, ক্ষমতা-অনুভূতির স্ফূর্ত্তি মানুষকে কিরূপ একটা প্রেরণা দান করে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - আত্মশক্তি, অবস্থা ও ব্যবস্থা ১৯০৫ (পৃ. ১২২-১৫০)
- হাওয়া যেখানে নেই সেখানে শব্দ হয় না, জ্বালালেও আগুন ধরে না, আলো যেখানে নেই রূপ সেখানে থেকেও নেই, তেমনি মন যেখানে নেই কথা সেখানে থেকেও নেই, মনে বেদন এল, নিবেদন হ’ল তবে ছবিতে কবিতায় নাট্যে। মন কার নেই? কিন্তু মনের কথা গুছিয়ে বলার ক্ষমতা যার তার নেই এটা ঠিক। ছাত্র পরীক্ষার দিনে খুব মনের আবেগ ও মনঃসংযোগ দিয়ে লিখছে; সে মন এক, আর সেই ছাত্রই দেশে গিয়ে যাত্রা জুড়েছে, কি মাঠে বসে মন দিয়ে বাঁশী বাজাচ্ছে, সে মন অন্য প্রকার। তেমনই সাধারণ মন আর রসায়িত মন, কবির মন আর্টিষ্টের মন আর তাদের হুঁকোবরদারের মন ও মনের আবেগে তফাৎ আছে।
- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিল্পের সচলতা ও অচলতা, বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৭৬
- পাগল না হলে কেই বড় হইতে পারে না। কিন্তু, সকল পাগল বড় হয় না। All mad men do not become great men of genius. কেন? শুধু পাগল হইলে চলে না। আরও কিছু চাই! পাগলামির ভিতর আত্মসংযম হারাইলে কোন প্রশ্নের মীমাংসা হইতে পারে না। আবেগের ভিতর আত্মস্থ হওয়া চাই। তাহা হইলে (then and only then) জীবনটাকে একটা Constructive basis-এর উপর প্রতিষ্ঠিত করিতে পারা যায়। Emotion বা আবেগ সংযম করে—দীর্ঘ চিন্তা চাই। আবেগ না থাকিলে চিন্তা অসম্ভব। কিন্তু শুধু আবেগ থাকিলে চিন্তার ফল ফলে না। অনেকে আবেগবান কিন্তু ভাবিতে চায় না— অনেকে ভাবিতে জানে না।
- সুভাষচন্দ্র বসু, পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)-সুভাষচন্দ্র বসু, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এন্ড সন্স লিমিটেড, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫১-৫২
- এমনই একটা বিশ্বাস থেকে ’৬০-’৭০ দশকের সন্ধিক্ষণে নকশাল আন্দোলনকে দেখেছি, তা নিয়ে ভেবেছি, জড়িয়ে পড়েছি। এ-দেখার মধ্যে বেহিসেবিপনা ছিল, এ ভাবনার ভিতরে বেপরোয়া ভাবনা ছিল, এভাবে জড়িয়ে পড়ায় অনেকটাই আবেগ যুক্ত ছিল। কিন্তু এসবের মধ্যে আর কোনো হিসেব ছিল না, নির্লিপ্ত শীতল পর্যবেক্ষণ ছিল না, ছক কষার কোনো চেষ্টা ছিল না। নকশাল আন্দোলনকে সামনে রেখে কোনো অঙ্কটঙ্ক কষে ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, কিংবা পদাতিক বানাইনি। ওই অস্থির সময়টার তাপ যখন যেভাবে মনের ওপর ছাপ ফেলেছে, সেভাবেই একের পর এক ছবিগুলো করে গেছি।
- নিরাপদ শাস্তির আওতায় মানুষ বাঁচে না। কেননা, যেটা মানুষের অন্তরতম আবেগ তাহা বাড়িয়া চলিবার আবেগ। মহৎ লক্ষ্যের প্রতি আত্মােৎসর্গ করিয়া দুঃখ স্বীকার করাই সেই বাড়িয়া চলিবার গতি। সকল বড়ো জাতির ইতিহাসেই এই গতির দুর্নিবার আবেগ ব্যর্থতা ও সার্থক্যের উপলবন্ধুর পথে গর্জিয়া, ফেনাইয়া, বাধা ভাঙিয়া-চুরিয়া, ঝরিয়া পড়িতেছে। ইতিহাসের সেই মহৎ দৃশ্য আমাদের মতাে পােলিটিকাল পঙ্গুদের কাছ হইতেও আড়াল করিয়া রাখা অসম্ভব।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছােটো ও বড়াে, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ (১৪২৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮৯
- চলচ্চিত্রনির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের একটা ব্যর্থতা আমার চোখে ধরা পড়েছিল পুনেতে পড়তে এসে, তার সিনেমা দেখে এবং তাকে খুব কাছ থেকে দেখে। উনি ৪৭-এর দেশভাগকে কখনো র্যাশনাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে পারেননি। সবসময় আবেগীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন। শুধু তিনি নন, এই ধরনের নস্টালজিয়া পুনেতে পড়াকালীন কলকাতার অনেক জ্যেষ্ঠদের ভিতরও আমি দেখেছি। তাদের সবার ভিতর এ রকম একটা নস্টালজিয়া: আহা, আমার সেই নারকেল গাছ, সেই তাল গাছ, সেই পুকুর পাড়! ৪৭-এর আগের সবকিছুই যেন তাদের সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো! নিজেদের মধ্যে আবেগ প্রকাশের সময় তারা এ রকম ভিজ্যুয়ালাইজেশন করতেই পারেন, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু ৪৭ নিয়ে সিনেমা বা অন্য কোনো মহাফেজ তৈরির ক্ষেত্রে ও পূর্ণাঙ্গ গবেষণার পথে এই আবেগ অবশ্যম্ভাবী বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ কোনো একটি বিষয়ে প্রকৃত সত্য খুঁজতে গিয়ে যদি তাতে আবেগ চলে আসে, তাহলে সেখান থেকে পরিপূর্ণ কিছু বের করা যায় না, সম্ভবও নয়।
- সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, দ্য বিজনেস স্ট্যাণ্ডার্ড, সৈকত দে, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩
- সুকান্ত কাগজের মানুষ নয়, রক্তমাংসের মানুষ। তার আত্মবিশ্বাস কখনও কখনও অহমিকাকে স্পর্শ করে, তার যুক্তি কখনও কখনও আবেগে ভেঙে পড়ে।
- কাকে পাপ বলে আমি জানি
কাকে পুণ্যজল বলে জানি
মুকুটের কাঁটা কয়খানি।
অভিজ্ঞতায় বৃদ্ধ, আবেগে বালক,
জাত গোত্রহীন হয়ে ভেসে আছি সময়ের নাড়ীর ভিতরে
উলঙ্গ পালক!- পূর্ণেন্দু পত্রী, পূর্ণেন্দু পত্রীর শ্রেষ্ঠ কবিতা [২]
- মানুষ সামনে উপস্থিত হবামাত্রই আমরা এমনি সহজে স্বভাবতই আত্মসম্বৃত হয়ে বসি যে, একটা গুরুতর ঘটনার দ্বারা অকস্মাৎ অভিভূত না হলে কিম্বা একটা অতিপ্রবল আবেগের দ্বারা সর্ববিস্মৃত না হলে আমরা নিজের প্রকৃত আভাস নিজে পাই নে। শেক্স্পীয়রের সময়েও এরকম সব আকস্মিক ঘটনা এবং প্রবল আবেগ সচরাচর উদ্ভব হতে পারত এবং বিদ্যুৎ-আলোকে মানুষের সমগ্র আগাগোড়া এক পলকে দৃষ্টিগোচর হত; এখন সুসভ্য সুসংযত সমাজে আকস্মিক ঘটনা ক্রমশই কমে আসছে এবং প্রবল আবেগ সহস্র বাঁধে আটকা পড়ে পোষ-মানা ভাল্লুকের মতো নিজের নখদন্ত গোপন করে সমাজের মনোরঞ্জন করবার জন্যে কেবল নৃত্য করে—যেন সে সমাজের নট, যেন তার একটা প্রচণ্ড ক্ষুধা এবং রুদ্ধ আক্রোশ ঐ বহুরোমশ আচ্ছাদনের নীচে নিশিদিন জ্বলছে না।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানবপ্রকাশ, সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২২৪
- পশু ও মানুষের মধ্যে একটা বড়োরকমের পার্থক্য হচ্ছে মন। পশু যখন তৃণভূমিতে বিচরণ করে, আমমাংসের লোভে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, অতিভোজনে নিদ্রা যায়, কিংবা প্রজননক্রিয়ার দুর্নিবার আকর্ষণে সঙ্গিনীকে আয়ত্তের মধ্যে আনে, তখন সে নিতান্তই আহার-নিদ্রা-ভয়-মৈথুন প্রভৃতি স্কুল শারীরবৃত্তির দ্বারাই চালিত হয়। কিন্তু মানুষ তদতিরিক্ত প্রয়োজনের বশে অরণ্য ছেড়ে গুহাভ্যন্তরে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে, আমমাংসের বদলে অগ্নিপক মাংসে তার রুচি বাড়ে, স্কুল দেহবাসনা একপ্রকার নির্দেহী আবেগ, আনন্দ ও বেদনার জ্যোতির্ময় ঊর্ধ্বায়ন লাভ করে, যাকে বলা যাবে প্রেম। আসলে মানুষ মনোজীবী, পশুরা দেহজীবী।
- অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙালির ধর্ম ও দর্শনচিন্তা, পৃষ্ঠা ১
- কোরাস’ আমাদের ছবিতে শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়ায় একটি ব্যাপক অর্থে — বিশাল মানুষের এক বিশাল ইচ্ছা — বিস্তর মানুষ, অনেক কথা, বহু লড়াই, সব যখন একীভূত হয়ে যায়, একটা সাংগীতিক মুহূর্তের সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ একটা collective আবেগ বা ইচ্ছা — তারই নাম ‘কোরাস’।
- কর্মের সমাপ্তি হল প্রশান্তি, যা আনন্দের সাথে সদৃশ নয়, কিন্তু কেউ কেউ একটি ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা তাই ভাবে, অথচ প্রশান্তি হচ্ছে এমন একটি মৌন অবস্থা যেখানে আত্মা অমত্ত ও বলিষ্ঠ থাকে, কোনও ভয়, কুসংস্কার বা অন্য কোনও আবেগ দ্বারা বিঘ্নিত হয় না।
- দেমোক্রিতোস, ডায়োজেনিস লার্টিয়াস, খন্ড ৯ (৪), পৃষ্ঠা ৪৫
- "যে কেউ ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিতে চায় তাকে অবশ্যই অতীতের পরামর্শ নিতে হবে, কারণ মানুষের ঘটনাগুলি সর্বদা পূর্ববর্তী সময়ের অনুরূপ। এটি এই সত্য থেকে উদ্ভূত হয় যে এগুলি এমন পুরুষদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছে যারা সর্বদা একই আবেগ দ্বারা প্রাণবন্ত ছিল, এবং সর্বদা থাকবে, এবং এইভাবে তাদের অবশ্যই একই ফলাফল রয়েছে।
- নিক্কোলো মাকিয়াভেল্লি (২০১৭). "দ্য প্রিন্স", রেস পয়েন্ট পাবলিশিং, পৃষ্ঠা ২২২
- ভগবানের আনন্দসৃষ্টি আপনার মধ্য হইতে আপনি উৎসারিত; মানবহৃদয়ের আনন্দসৃষ্টি তাহারই প্রতিধ্বনি। এই জগৎসৃষ্টির আনন্দগীতের ঝংকার আমাদের হৃদয়বীণাতন্ত্রীকে অহরহ স্পন্দিত করিতেছে; সেই-যে মানসসংগীত, ভগবানের সৃষ্টির প্রতিঘাতে আমাদের অন্তরের মধ্যে সেই-যে সৃষ্টির আবেগ, সাহিত্য তাহারই বিকাশ।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, "সাহিত্যের তাৎপর্য", সাহিত্য, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, ১৯৫৮।
- আজকাল সব স্টার অভিনেতাদের আবেগপূর্ণ অভিনয়ের শুটিংয়ে যে দেখি, পরিচালক 'কাট' বলার পর দশ মিনিট পরেও কান্নার আবেগ থামাতে পারেন না। তাই দেখে আবার স্টুডিওর কিছু বোদ্ধারা বলেন, 'কি দারুন অভিনেত্রী, কি ন্যাচারাল দেখেছেন!' আমি বলি অভিনয় খুব বেশি ন্যাচারাল হলে মুশকিল আছে। কারণ কাউকে খুনের সিনে খুব বেশি ন্যাচারাল অভিনয় করতে গিয়ে যদি সজোরে পেটে ছুরি মেরে দেয় তাহলে সেটা বেশ মুশকিলের ব্যাপার হবে।
- ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, আত্মজীবনী, ভানু সমগ্র, পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত,পৃষ্ঠা ৩৫
- খুব খানিক মনের আবেগ নিয়ে লিখে কিম্বা বলে কয়ে চল্লেই কবি চিত্রকর অভিনেতা হয় তা নয়। অভিনেতা যদি মনের আবেগে কাণ্ডাকাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো রুদ্রমূর্তিতে বেরিয়ে সত্যই দ্বিতীয় অভিনেত্রীর গলা কেটে বসে, তবে তাকে নট বলবে, না পাগল, মুর্খ এসব সম্বোধন করবে দর্শকরা! কিম্বা রঙ্গমঞ্চের নাচে দর্শকদের মধ্যে কেউ যদি মনের আবেগে মুগ্ধ হয়ে হঠাৎ কোমর বেঁধে নানা অঙ্গভঙ্গি সুরু করে দেয় তবে তাকে নটরাজ বলে’ ডাকে কেউ! অভিনেত্রী বেশ তাল লয় সুর দিয়ে কেঁদে চলেছে, হঠাৎ উপরের বক্স থেকে আবেগভরে ছেলে-কাঁদা ও ঘুম-পাড়ানো সুরু হলো, তার বেলায় শ্রোতারা ধমকে ওঠে কেন ছেলেকে ও ছেলের মাকে? মনের আবেগ তো যথেষ্ট সেখানে ভাষায় প্রকাশ হচ্ছিল কিন্তু বলে তো চল্লো না সেটা! তবেই দেখ শিল্পের অনুকূল আর তার প্রতিকূল এই দুই রকম মনের পরশ রয়েছে। মালি যেমন বেছে বেছে ফুল নেয়, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফুলের তোড়া ফুলের হার গাঁথে, শিল্পীর মনের পরশ ঠিক সেইভাবে কায করে যায় বাক্য রং রেখা ভঙ্গি ইত্যাদিকে ভাবের সূত্রে ধরে’ ধরে’। নিছক আবেগের উচ্ছৃঙ্খলতা আছে, সংযম নির্বাচন এসব নেই। ছেলে কাঁদার ঠিক উল্টো যে পাকা নটীর কান্নার সুর কৃত্রিম সুরে হলেও সেটা মনোরম হয় শিল্পীর বর্ণন ভঙ্গি নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে। বাষ্পের মতো শুধু খানিক আবেগের সঞ্চয় নিয়ে ছবি বল আর লেখাই বল শিল্প বলে’ যে চলে না তার নমুনা এই—
- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিল্পের সচলতা ও অচলতা, বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৭৬-৭৭
- একজন বলে উঠলেন, সমস্ত ধনতন্ত্রী জগতের বিরুদ্ধতায় বেষ্টিত হয়ে যে বৈপ্লবিক আবেগে এরা সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজমের পথে যাত্রা করেছে তা যখন সিদ্ধিলাভ করবে তখন এই বৈপ্লবিক আবেগ শিথিল হয়ে যাবে। তারপর আজকের এই নিবিড় ঐক্য যাবে ভেঙ্গে আবার শ্রেণীভেদ সমাজে মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠ্বে।
- সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, আমার দেখা রাশিয়া - সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৭১
- সাত পাঁচ ভাবিয়া সীতারাম রুক্মিণীর বাড়ির মুখে চলিল—প্রফুল্ল মনে আবার গান ধরিল। যাইতে যাইতে পথে একজন অভিসারিণীকে দেখিতে পাইল। সীতারামের নজরে এ সকল কিছুই এড়াইতে পায় না। দুইটা রসিকতা করিবার জন্য তাহার মনে অনিবার্য আবেগ উপস্থিত হইল—কিন্তু সময় নাই দেখিয়া সে আবেগ দমন করিয়া হন্ হন্ করিয়া চলিল।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৬৫
- এর মধ্যে আবেগেরও বহু ব্যাপার ছিল। দেশ থেকে অবিরাম খবর আসছে। দেশের জনসাধারনের দুঃখ দুর্দশা বৃহত্তর ভোগান্তি ইত্যাদি নানা কাহিনী শুনে আমাদের মন আবেগে মন আবেগে আপ্লুত হয়ে যেত। সে দিকটি তো ছিলই। তার ওপর আর একটা বড় সমস্যা ছিল আমাদের হাজার হাজার বাঙ্গালী যারা পাকিস্তানে আটকা পড়েছিল। দেশের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার কোন উপায় ছিল না তাদের। দুই তরফ থেকে তারা আমাদের শরাপন্ন হয়েছিলেন।
- সিরাজুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড), প্রকাশক-হাক্কানী পাবলিশার্স, প্রকাশস্থান- ঢাকা, প্রকাশসাল- ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ (১৪১৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩০৩
- ব্রাহ্মণদিগের পুরাতন দার্শনিক কবিতা সকল পাশাপাশি রাখিয়া, বাইব্ল্ গ্রন্থখানি একবার পাঠ করিয়া দেখ। তাহাতে কি দেখিতে পাও? আর কিছুই নহে, কতকগুলি গীতিকবিতা মাত্র; রোষ, দ্বেষ, নিরাশা, উৎসাহ, উচ্ছ্বাস, মনের প্রচণ্ড ভাবসমূহ, আত্মার সমস্ত কম্পন ও আন্দোলন, রূঢ় উপমার দ্বারা ও জ্বলন্ত কল্পনা-সহকারে ব্যক্ত হইয়াছে মাত্র; তাহার লিখনধারাও বিচ্ছিন্ন ও আকস্মিক এবং ভাষাও অতি সরল ও অস্ফুট; সে ভাষায় দার্শনিক চিন্তার তরঙ্গলহরী অনুসরণ করা সুকঠিন—তাহাতে কেবল অস্ফুট কণ্ঠে মানব আত্মার আবেগ প্রকাশ করা যায় মাত্র। মনের আবেগ স্থায়ী ও প্রচণ্ড হইলে তাহার ফল কি হয়?—না, মানুষ আপনার উপর ফিরিয়া আইসে। যখন সে যন্ত্রণা ভোগ করে, যখন সে কাহারো প্রতি দ্বেষ প্রকাশ করে, তখন সে আপনাকে অতিক্রম করিতে পারে না। যে বহির্জগতের সহিত তাহার সংঘর্ষণ উপস্থিত হয়, সে বহির্জগৎকে সে পৃথক্ ভাবে দর্শন করে। যে আত্মা আবেগপূর্ণ তাহাতে আমিত্ব দৃঢ়রূপে সংলগ্ন থাকে ও পৃথক্ভাবে অবস্থান করে; এই অবস্থাতে সে যখন জগতের মূল তলাইয়া দেখিবার চেষ্টা করে, তখন সে সেই মূলকে স্বতন্ত্র ও সর্ব্বশক্তিমান আত্মা বলিয়াই কল্পনা করে।
- আঁদ্রে শেভ্রিয়োঁ, ভারতবর্ষে, ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্রের মায়াবাদ ও অদ্বৈতবাদ, অনুবাদক- জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশসাল ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩১০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৭-২৮
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]
উইকিপিডিয়ায় আবেগ সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।

উইকিঅভিধানে আবেগ শব্দটি খুঁজুন।