ইসলামে মৃত্যুদণ্ড
ইসলামে মৃত্যুদণ্ড একটি বিতর্কিত এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বিভিন্ন অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা হয়। ইসলামী আইন (শরিয়া) অনুযায়ী, কিছু গুরুতর অপরাধ যেমন ইচ্ছাকৃত হত্যা, ব্যভিচার, ধর্মত্যাগ (অপেক্ষাকৃত কিছু ব্যাখ্যায়) এবং রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য মৃত্যুদণ্ড নির্ধারিত হয়েছে। তবে, মৃত্যুদণ্ডের প্রয়োগ এবং এর ন্যায্যতা নিয়ে ইসলামিক পণ্ডিতদের মধ্যে বিভিন্ন মতবিরোধ রয়েছে।
ইসলামী মৃত্যুদণ্ড ব্যবস্থা সাধারণত কুরআন এবং হাদিসের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। কিছু পণ্ডিত মৃত্যুদণ্ডকে ন্যায়বিচারের একটি অপরিহার্য অংশ হিসাবে দেখেন, অন্যরা মানবাধিকার এবং সমসাময়িক নৈতিকতার ভিত্তিতে এর বিপক্ষে অবস্থান নেন। আধুনিক বিশ্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ এবং এর ন্যায়সঙ্গততা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে।
কুরআন
[সম্পাদনা]- যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত-পা কেটে দেওয়া হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে দূর করে দেওয়া হবে। এটা তো তাদের পার্থিব লাঞ্ছনা। আর আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।
- কুরআন, সূরা আল-মায়িদা (৫:৩৩)
- يَآأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلۡقِصَاصُ فِي ٱلۡقَتۡلَىۖ ٱلۡحُرُّ بِٱلۡحُرِّ وَٱلۡعَبۡدُ بِٱلۡعَبۡدِ وَٱلۡأُنثَىٰ بِٱلۡأُنثَىٰۚ فَمَنۡ عُفِيَ لَهُۥ مِنۡ أَخِيهِ شَيۡءࣱ فَٱتِّبَاعُۢ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَأَدَآءٌ إِلَيۡهِ بِإِحۡسَٰنࣲۗ ذَٰلِكَ تَخۡفِيفࣱ مِّن رَّبِّكُمۡ وَرَحۡمَةࣱۗ فَمَنِ ٱعۡتَدَىٰ بَعۡدَ ذَٰلِكَ فَلَهُۥ عَذَابٌ أَلِيمࣱ
হে মুমিনগণ! যাদেরকে (ইচ্ছাকৃত অন্যায়ভাবে) হত্যা করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কিসাস (-এর বিধান) ফরয করা হয়েছে- স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, গোলামের বদলে গোলাম, নারীর বদলে নারী (-কেই হত্যা করা হবে)। অতঃপর হত্যাকারীকে যদি তার ভাই (নিহতের অলি)-এর পক্ষ হতে কিছুটা ক্ষমা করা হয়, তবে ন্যায়ানুগভাবে (রক্তপণ) দাবী করার অধিকার (অলির) আছে। আর উত্তমরূপে তা আদায় করা (হত্যাকারীর) কর্তব্য। এটা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে এক লঘুকরণ এবং একটি রহমত। এরপরও কেউ সীমালংঘন করলে সে যন্ত্রণাময় শাস্তির উপযুক্ত।
- কুরআন, সূরা আল-বাকারা (২:১৭৮), অনুবাদ: মুফতি তাকি ওসমানী
- যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি এটাই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত-পা কেটে দেওয়া হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে দূর করে দেওয়া হবে। এটা তো তাদের পার্থিব লাঞ্ছনা। আর আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।
- কুরআন, সূরা আল-মায়িদা (৫:৩৩)
- এ কারণেই আমি বনী ইসরাঈলের প্রতি বিধান দিয়েছিলাম, কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারও প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সমস্ত মানুষের প্রাণরক্ষা করল। বস্তুত আমার রাসূলগণ তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছে, কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে বহু লোক পৃথিবীতে সীমালংঘনই করে যেতে থাকে।
- কুরআন, সূরা আল-মায়িদা (৫:৩৩)
- ‘‘কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে তার ওয়ারিশকে আমি (আল্লাহ্) ক্বিসাস্ গ্রহণের অধিকার দিয়ে থাকি। তবে (হত্যার পরিবর্তে) হত্যার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে। (যেমন: হত্যাকারীর পরিবর্তে অন্য নির্দোষকে হত্যা, হত্যাকারীর সঙ্গে অন্য নিরপরাধকেও হত্যা অথবা হত্যাকারীকে অমানবিকভাবে হত্যা করা ইত্যাদি)। কারণ, তার এ কথা জেনে রাখা উচিৎ যে, ক্বিসাস্ নেয়ার ব্যাপারে তাকে অবশ্যই সাহায্য করা হবে’’।
- বানী ইস্রা’ঈল : ৩৩
হাদিস
[সম্পাদনা]- عُمَرُ بْنُ حَفْصٍ حَدَّثَنَا أَبِي حَدَّثَنَا الأَعْمَشُ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مُرَّةَ عَنْ مَسْرُوقٍ عَنْ عَبْدِ اللهِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ يَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِلاَّ بِإِحْدَى ثَلاَثٍ النَّفْسُ بِالنَّفْسِ وَالثَّيِّبُ الزَّانِي وَالْمَارِقُ مِنْ الدِّينِ التَّارِكُ لِلْجَمَاعَةِ.
‘আবদুল্লাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ কোন মুসলিম ব্যক্তি যদি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন ইলাহ্ নেই এবং আমি আল্লাহ্র রাসূল, তিন-তিনটি কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করা বৈধ নয়। (যথা) জানের বদলে জান, বিবাহিত ব্যভিচারী, আর নিজের দ্বীন ত্যাগকারী মুসলিম জামাআত থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া ব্যক্তি। ফুটনোট: [১১৬] হাদীসে উল্লেখিত “জামাআত” দ্বারা উদ্দেশ্য (আরবি) তথা মুসলমানদের জামা’আত। অর্থাৎ মুরদাত হওয়ার মাধ্যমে মুসলিমদের থেকে বিছিন্ন হয় অথবা মুরতাদ (স্বধর্মত্যাগী) হওয়ার মাধ্যমে মুসলমানদের ছেড়ে দেয়। সুতরাং (আরবি) শব্দটি ﺗﺎﺭﻙ ও ﺍﻟﻤﻔﺎﺭﻕ শব্দদ্বয়ের বিশেষণ। যা স্বতন্ত্র বিশেষণ নয়। কারণ স্বতন্ত্র বিশেষণ ধরা হলে হাদীসে উল্লেখিত তিনটি বৈশিষ্ট্যের স্থলে চারটি বৈশিষ্ট্য হয়ে যাবে। উল্লেখ্য যে, হাদীসে উল্লেখিত “জামা’আত” দ্বারা “মুসলমানদের মাঝে গড়ে ওঠা ছোট, বড় আঞ্চলিক বা জাতীয় ভিত্তিক কোন সংগঠন” উদ্দেশ্য নেয়া মোটেও ঠিক নয়। বরং তা সহীহ আকীদার পরিপন্থী।
- সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬৮৭৮ (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৩৯৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৪১২), মুসলিম ৬/২৮, হাঃ ১৬৭৬
- আনাস্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
‘‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ক্বিসাস্ সংক্রান্ত কোন ব্যাপার উপস্থাপন করা হলে তিনি সর্বপ্রথম ক্ষমারই আদেশ করতেন’’।
- আবূ দাউদ ৪৪৯৭; ইব্নু মাজাহ্ ২৭৪২
- আবূ শুরাইহ্ খুযা’য়ী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
‘‘আমার এ কথার পর কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা হলে তার ওয়ারিশরা দু’টি অধিকার পাবে। দিয়াত গ্রহণ করবে অথবা হত্যাকারীকে হত্যা করবে’’।
- আবূ দাউদ ৪৫০৪; তিরমিযী ১৪০৬
- আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
‘‘কাউকে হত্যা করা হলে তার পক্ষ থেকে তার ওয়ারিশরা দু’টি অধিকার পাবে। তার মধ্য থেকে ভেবেচিন্তে তারা উত্তমটিই গ্রহণ করবে। তার দিয়াত নেয়া হবে অথবা তার ওয়ারিশদেরকে তার ক্বিসাস্ নেয়ার সুবিধা দেয়া হবে’’।
- বুখারী ১১২; মুসলিম ১৩৫৫; আবূ দাউদ ৪৫০৫; তিরমিযী ১৪০৬
- আ’য়েশা (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
‘‘তিনটি কারণের কোন একটি কারণ ছাড়া অন্য যে কোন কারণে কোন মুসলিমকে হত্যা করা জায়িয নয়। উক্ত তিনটি কারণ হচ্ছে: ব্যভিচারী বিবাহিত স্বাধীন পুরুষ। তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হবে। কেউ কোন মুসলিমকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করলে তাকে তার পরিবর্তে হত্যা করা হবে। কেউ ইসলামের গন্ডী থেকে বের হয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে তাকে হত্যা করা হবে অথবা ফাঁসি দেয়া হবে অথবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে তাড়ানো হবে তথা তাকে কোথাও স্থির হতে দেয়া যাবে না’’।
- আবূ দাউদ ৪৩৫৩ নাসায়ী : ৭/৯১; হা’কিম : ৪/৩৬৭
- আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আম্র (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
‘‘মানব জাতির মধ্য থেকে তিন ব্যক্তিই আল্লাহ্ তা‘আলার সঙ্গে সব চাইতে বেশি গাদ্দারী করে থাকে। তারা হচ্ছে: (মক্কা-মদীনার) হারাম এলাকায় কাউকে হত্যাকারী। যে ব্যক্তি হত্যাকারীর পরিবর্তে অন্যকে হত্যা করে। শত্রুতাবশত: অন্যকে হত্যাকারী। যা বরবর যুগের নিয়ম ছিলো’’।
- আহমাদ : ২/১৭৯, ১৮৭ ইব্নু হিববান : ১৩/৩৪০
বিভিন্ন ব্যক্তির উক্তি
[সম্পাদনা]- "মৃত্যুদণ্ড কোনো সাম্প্রতিক বিধান নয়... সকল আইনপ্রণেতা আত্মরক্ষাকে বৈধ মনে করেন... একজন হত্যাকারী মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য কারণ সে সমাজের একজন সদস্যকে হত্যা করে সমগ্র সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে।"
- শেখ আহমাদ আশ-শারাবাসি, সাবেক অধ্যাপক, ইসলামি আকিদা, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, পড়ুন
- "আমরা আজ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে শারীরিক শাস্তি, পাথর নিক্ষেপ এবং মৃত্যুদণ্ডের উপর একটি আন্তর্জাতিক স্থগিতাদেশের আহ্বান জানাচ্ছি... এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব এবং ধর্মীয় দায়িত্ব যে, হুদুদ প্রয়োগের অবিলম্বে স্থগিতাদেশ দাবি করা।"
- তারিক রমাদান, অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, পড়ুন
- "মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে একটি ইসলামিক অবস্থান গ্রহণ করতে হলে স্বীকার করতে হবে যে, কুরআন স্পষ্টভাবে হত্যাকারীর জীবন নেওয়ার অনুমতি দেয়... [তবে,] এখানে কোনো ন্যায়বিচার নেই। কোনো চাহিদা পূরণ হয় না, কোনো ভয় কমে না। এই ধারণাটি কার্যকর নয়।"
- রাবিয়া টেরি হ্যারিস, সমন্বয়ক, মুসলিম পিস ফেলোশিপ, পড়ুন
- "ইন্দোনেশিয়ার আইন এখনও মানবাধিকার এবং বিশেষ করে জীবনের অধিকারের চেয়ে মৃত্যুদণ্ডকে অগ্রাধিকার দেয়... একটি গতিশীল পরিবর্তনের জন্য মানবাধিকারের সার্বজনীনতা এবং অন্তর্নিহিত মূল্যের ব্যাপক স্বীকৃতি প্রয়োজন।"
- জিমলি আসশিদ্দিকি, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, ইন্দোনেশিয়ার সাংবিধানিক আদালত, পড়ুন
- "যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তা সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করা উচিত, যাতে নাগরিকদের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা করা যায়।"
- দাতুক সেরি ওয়ান সালিম ওয়ান মোহদ নূর, পেনাং মুফতি, পড়ুন
- "ধর্মত্যাগ ইসলামিক আইনে একটি অপরাধ, তবে এটি মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য নয়। ধর্মত্যাগীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত নয়।"
- "যদি তারা ধর্মত্যাগের শাস্তি তুলে দিত, তবে ইসলাম আজ টিকে থাকত না।"
- ইউসুফ আল-কারাদাওয়ি, ইসলামিক পণ্ডিত, পড়ুন
আরও পড়ুন
[সম্পাদনা]বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]
