বিষয়বস্তুতে চলুন

চরক

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে
যোগপীঠ ক্যাম্পাসে চরকের মূর্তি, যিনি চিকিৎসা ও শল্যচিকিৎসার জনক হিসেবে পরিচিত।

চরক (সংস্কৃত: चरक, রোমান: Caraka, আনু. খ্রিস্টপূর্ব ১০০ – ২০০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের একজন চিকিৎসক। আয়ুর্বেদ হল চিকিৎসাশাস্ত্র ও জীবনধারার একটি প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতি। চরক 'চরক সংহিতা' (সংস্কৃত: चरकसंहिता, রোমান: Carakasaṁhitā) নামক চিকিৎসা-গ্রন্থের সংকলক বা সম্পাদনাকারী (সংস্কৃত: प्रतिसंस्कर्ता, রোমান: pratisaṁskartā) হিসেবে পরিচিত। তাকে সাধারণত কাশ্মীরের অধিবাসী হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি যে সংহিতাটি সংকলন করেছিলেন, তা আয়ুর্বেদের প্রাচীন ও মূলগ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম, এবং এই গ্রন্থটি বৃহত্ত্রয়ী (আয়ুর্বেদের তিনটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ) এর একটি বলে বিবেচিত।

উক্তি

[সম্পাদনা]
  • শাস্ত্রং জ্যোতিঃ প্রকাশার্থং দর্শনং বুদ্ধিঃ আত্মনঃ।
    তাভ্যাং ভিষক্ সুযুক্তাভ্যাং চিকিৎসৎ ন অপরাধ্যতি॥
    • শাস্ত্র হল আলো বা জ্যোতির মতো, যা বস্তুকে প্রকাশ করে বা দেখতে সাহায্য করে। বুদ্ধি হল দৃষ্টিশক্তির মতো। যে বৈদ্য এই দুই গুণ—শাস্ত্রজ্ঞান ও বুদ্ধি—দ্বারা সম্মৃদ্ধ থাকে, সে চিকিৎসা করার সময় ভুল করে না।
      • চরক সংহিতা
  • আয়ুরস্মিন্ বিদ্যতে অনেন বা আয়ুর্বিন্দতীত্যায়ুর্বেদঃ।
    • যেখানে আয়ু বিদ্যমান, অথবা যার দ্বারা আয়ুর জ্ঞান লাভ হয়, তাকেই আয়ুর্বেদ বলা হয়।
      • চরকসূত্র ১/১৩
  • শরীরেন্দ্রিয়সত্ত্বাত্মসংযোগো ধারি জীবিতম্।
    • শরীর, ইন্দ্রিয়, মনঃশক্তি এবং আত্মার সংযুক্তিই ‘জীবন’ বা ‘আয়ু’ নামে পরিচিত।
  • হিতাহিতং সুখং দুঃখং আয়ুস্তস্য হিতাহিতম্।
    নং চ তচ্চ যত্রোক্তং আয়ুর্বেদঃ স উচ্যতে।
    • অর্থ: হিতকারী আয়ু, অহিতকারী আয়ু, সুখদায়ক আয়ু এবং দুঃখদায়ক আয়ু—এই চার রকমের আয়ুর যে আলোচনা আছে, যেখানে এই আয়ুর উপকারিতা ও ক্ষতির দিক অর্থাৎ সুস্থ ও অস্বাস্থ্যকর বিষয় নিয়ে বলা হয়েছে, আয়ুর পরিমাপ ও তার প্রকৃতি যেখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে—সেই জ্ঞানকেই ‘আয়ুর্বেদ’ বলা হয়।
      • চরক সূত্র ৩.৪১
  • ধর্মার্থ কাম মোক্ষাণাম্ আরোগ্যং মূলমুত্তমম্।
    • ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ—এগুলি পুরুষার্থের মূল বা ভিত্তি হল উত্তম স্বাস্থ্য। শরীর সুস্থ না থাকলে জীবনের এই চারটি উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব নয়।
      • চরক সংহিতা, সূত্রস্থান ১.১৪
  • ব্রহ্মচারিণা শ্মশ্রুধারিণ সত্যবাদিনাʼমাংসাদেন মেধ্যসেবিনা নির্মত্সরেণাশস্ত্রধারিণা চ ভবিতব্যং, ন চ তে মদ্বচনাত্ কিন্চিদকার্যং স্যাদন্যত্র রাজদ্বিষ্টাত্ প্রাণহারাদ্বিপুলাদধর্ম্যাদনর্থসম্প্রযুক্তাদ্ʼবাপ্যর্থাত্;
    • চরক কর্তৃক নির্ধারিত একটি শপথের অংশ, যা চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্রের জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচিত।
    • তুমি ব্রহ্মচারীর জীবন অনুসরণ করবে। তুমি চুল ও দাড়ি কাটবে না, বরং তা বৃদ্ধি করবে। তুমি সর্বদা সত্য কথা বলবে। তুমি মাংস আহার করবে না। তুমি কেবল শুদ্ধ ও পবিত্র খাদ্য গ্রহণ করবে। তোমার মনে কারও প্রতি হিংসা বা ঈর্ষা থাকবে না। তুমি কোনো অস্ত্র গ্রহন করবে না। তুমি আমার আদেশ ব্যতীত অন্য কোনো কাজ করবে না। তবে রাজার প্রতি বিদ্বেষ, কারো প্রাণহানি, বড় কোনো অধার্মিক কাজ, অথবা বিপদ ও ধ্বংসের কারণ হতে পারে এমন কার্য থেকে নিজেকে বিরত রাখা তোমার কর্তব্য। এই ব্যতিক্রমগুলি ছাড়া সব কাজ আমার নির্দেশ অনুসারেই করবে।
  • আহার, স্বপ্ন (ঘুম) এবং ব্রহ্মচর্য—এই তিনটি হল শরীরের প্রধান স্তম্ভ।
  • ধী ধৃতি স্মৃতি বিভ্রষ্টঃ কর্ময়ত্ কুরুত্ঽঅশুভম্।
    প্রজ্ঞাপরাধং তং বিদ্যাৎ সংর্বদোষ প্রকোপণম্॥
    • অর্থ: যখন কারও বুদ্ধি (ধী), ধৈর্য (ধৃতি) এবং স্মরণশক্তি (স্মৃতি) নষ্ট হয়ে যায়, তখন সে অশুভ কর্মে লিপ্ত হয়। এই অশুভ কর্মকেই বলে ‘প্রজ্ঞাপরাধ’। এই প্রজ্ঞাপরাধের ফলে শরীর ও মনের সব দোষ উত্তেজিত বা প্রকোপিত হয়। যে ব্যক্তি প্রজ্ঞাপরাধ করে, তার দেহ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় এবং সে রোগে আক্রান্ত হতেই থাকে।
      • চরক সংহিতা, শরীরস্থান ১/১০২
  • নাত্মার্থং নাপি কামার্থং অতভূত দয়াং প্রতিঃ।
    বর্ততে যশ্চিকিৎসায়াং স সর্বমতি বর্ততে॥
    • যে চিকিৎসক নিজের স্বার্থ বা কামনার জন্য নয়, বরং সমস্ত প্রাণীর প্রতি দয়ার দৃষ্টিতে চিকিৎসা করেন, সে সর্বদিক থেকে সাফল্য লাভ করেন।
      • চরক সংহিতা, চিকিৎসাস্থান ১/৪/৫৮
  • সুখং শেতে সত্যবক্তা সুখং শেতে মিতব্যয়ী।
    হিতভুক্ মিতভুক্ চৈব তথা এব বিজিতেন্দ্রিয়ঃ॥
    • যে ব্যক্তি সত্য কথা বলে, যে কম ব্যয় করে, যে পরিমিত এবং উপকারী আহার গ্রহণ করে, এবং যে নিজের ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণে রেখেছে— সে নিশ্চিন্তে ও শান্তিতে ঘুমায়।
      • চরক সংহিতা
  • শরীরং হি সত্ত্বমনুবিধীয়তে সত্ত্বং চ শরীরম্॥
    • শরীর মনকে (সত্ত্ব) অনুসরণ করে, এবং মনও শরীরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। উভয় একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত।
      • চরক সংহিতা, শরীরস্থান ৪/৩৬
  • অনুপানং হিতং যুক্তং তর্ষয়ত্যাশু মানবম্।
    সুখ পচতি চ আহারম্ আয়ুষে চ বলায় চ॥
    • চরক সংহিতা, সূত্রস্থান ২৭/৩২৬
  • দোষাঃ কদাচিত্কুপ্ত্যন্তি জিতা লঙ্ঘনপাচনৈঃ।
    জিতা সংশোধনৈর্যে তু ন তেষাং পুনরুদ্ধবঃ॥
    • লঘু আহার ও হজমকারী উপায়ে দোষ (দৈহিক সমস্যা) কখনও কখনও সংযত হয়, কিন্তু এগুলির দ্বারা সম্পূর্ণ দমন হয় না, ফলে তারা পরে আবার ফিরে আসে। কিন্তু শোধন চিকিৎসা (যেমন বমন, বিসর্জন ইত্যাদি) দ্বারা দোষ যদি দমন করা যায়, তাহলে তা সহজে ফিরে আসে না।
      • চরক সংহিতা, সূত্রস্থান ১৬/২০-২১
  • বিকারনামাকুশলো ন জিহ্রীয়াত্ কদাচন। ন হি সর্ববিকারাণাং নামতোʼস্তি ধ্রুবা স্থিতিঃ
    স এভ কুপিতো দোষঃ সমুত্থানবিশেষতঃ। স্থানান্তরগতশ্চৈব জনয়ত্যাময়ান্ বহূন্
    তস্মাদ্ বিকারপ্রকৃতীরধিষ্ঠানান্তরাণি চ। সমুত্থানবিশেষাংশ্চ বুদ্ধ্বা কর্ম সমাচরেত্
    যো হ্যেতত্ত্রিতয়ং জ্ঞাত্বা কর্মাণ্যারভতে ভিষক্জ্ঞা। নপূর্বং যথান্যায়ং স কর্মসু ন মূহ্যতি
    • কোনো রোগের নাম বলতে অক্ষম হলে চিকিৎসকের লজ্জা পাওয়া উচিত নয়। কারণ, সব রোগের নির্দিষ্ট নাম নেই বা সব সময় নির্দিষ্ট নামে তাদের চিহ্নিত করা যায় না। কারণ দোষ (বাত, পিত্ত, কফ) যখন হয়, তখন তার অবস্থান ও কারণ অনুযায়ী বহু রকম রোগ সৃষ্টি করে। তাই চিকিৎসার আগে, রোগের প্রকৃতি, তার অবস্থান ও উৎপত্তির বিশেষ কারণগুলি ভালোভাবে বুঝে নেওয়া জরুরি। যে চিকিৎসক এই তিনটি বিষয় (রোগের প্রকৃতি, অবস্থান, উৎপত্তির কারণ) জানার পর চিকিৎসা শুরু করে, সে সঠিক জ্ঞান নিয়ে কাজ করে এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয় না।
      • চরক সংহিতা, সূত্রস্থান ১৮/৪৪-৪৭
  • রোগমাদৌ পরীক্ষেত ততোʼনন্তরং ঔষধম্।
    ততঃ কর্ম ভিষক্ পশ্চাৎ জ্ঞানপূর্বং সমাচরেত্
    যস্তু রোগম্ অবিজ্ঞায় কর্মাণ্যারভতে ভিষক্।
    অপি ঔষধবিধানজ্ঞঃ তস্য সিদ্ধি যদ্রচ্ছয়া ॥
    যস্তু রোগবিশেষজ্ঞঃ সর্বভৈষজ্যকোভিদঃ।
    দেশকালপ্রমাণজ্ঞঃ তস্য সিদ্ধিরসংশয়ম্ ॥
    • চিকিৎসা শুরুর আগে রোগ পরীক্ষা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই পরীক্ষা রোগীরও হতে হবে, রোগেরও। রোগ ও রোগী—উভয়ের শক্তি-দুর্বলতা নির্ণয় করে তবেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত। যে চিকিৎসক রোগ না বুঝেই চিকিৎসা শুরু করে, সে যদি ওষুধ নির্বাচনেও দক্ষ হয়, তবুও তার সাফল্য কেবল সৌভাগ্যের উপর নির্ভর করে। অন্যদিকে, যে চিকিৎসক রোগ বিশেষজ্ঞ, সমস্ত ওষুধ সম্পর্কে অভিজ্ঞ, এবং স্থান, সময় ও পরিমাপ সম্পর্কে জ্ঞান রাখে— তার চিকিৎসা সফল হবেই, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
      • চরক সংহিতা, সূত্রস্থান ২০/২০-২২

চরক ও চরক সংহিতা সম্পর্কে মন্তব্য

[সম্পাদনা]
  • ঔষধবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হিন্দুদের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হলো ‘চরক সংহিতা’।
    • আলবেরুনি
  • যস্য দ্বাদশসাহস্রী হৃদি তিষ্ঠতি সংহিতা।
    সোʼর্থজ্ঞঃ স বিবেচনাজ্ঞঃ চিকিৎসাকুশলশ্চ সঃ॥
    রোগাংস্তেষাং চিকিৎসাং চ স কিমর্থং ন বুধ্যতে।
    চিকিৎসা বহ্নিবেশস্য সুস্থাতুরহিতং প্রতি।
    যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন তৎক্বচিত্।।
    • যার হৃদয়ে দ্বাদশ-সহস্র শ্লোকবিশিষ্ট এই সংহিতা সুসংরক্ষিত আছে, সে ব্যক্তি অর্থজ্ঞ (আয়ুর্বেদের গভীর অর্থ বোঝে), বিবেচনাশীল, এবং চিকিৎসায় পারদর্শী হয়। সে ব্যক্তি রোগ ও তার চিকিৎসা—উভয়কে ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম। এই সংহিতা (চরক সংহিতা) বহ্নিবেশ কর্তৃক রচিত চিকিৎসাশাস্ত্র। এটি স্বাস্থ্যবান ও অসুস্থ—উভয়ের জন্য উপকারী। যা কিছু এখানে আছে, তা অন্যত্রও খুঁজে পাওয়া যায়। আর যা এখানে নেই, তা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
      • চরক সংহিতা, সিধিস্থান ১২/৫৩

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]