বিষয়বস্তুতে চলুন

দান্তে আলিগিয়েরি

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে
E'n la sua volontade è nostra pace. তাঁর ইচ্ছার মধ্যেই আমাদের শান্তি।

দান্তে আলিগিয়েরি (প্রায় ৩০ মে ১২৬৫১৩ সেপ্টেম্বর ১৩২১), যাঁর পূর্ণ নাম সম্ভবত দুরান্তে দি আলিগিয়েরো দেলি আলিগিয়েরি, ছিলেন একজন ইতালীয় কবি, লেখক এবং দার্শনিক। তাঁর বিখ্যাত রচনা ডিভাইন কমেডি, যা শুরুতে কোমেদিয়া নামে পরিচিত ছিল (আধুনিক ইতালীয়: কোম্মেদিয়া) এবং পরে জিওভান্নি বোচ্চাচ্চো একে ডিভিনা নামে অভিহিত করেন, মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি ইতালীয় ভাষায় রচিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হিসেবেও স্বীকৃত।

আরও দেখুন: ডিভাইন কমেডি

উদ্ধৃতি

[সম্পাদনা]
এইখানেই শুরু এক নতুন জীবনের
সৌন্দর্যের সকল ধারা তার পূর্ণতার দিকে প্রবাহিত।
ভালোবাসা দীর্ঘদিন আমাকে নিজের করে রেখেছে,
তার প্রভুত্বে আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।
  • In quella parte del libro de la mia memoria, dinanzi a la quale poco si potrebbe leggere, si trova una rubrica, la quale dice: Incipit vita nova.' [১]
    • আমার স্মৃতির সেই পাতায়,
      যার আগে খুব বেশি কিছু নেই,
      সেই প্রথম অধ্যায়ে লেখা আছে—
      যখন তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হলো,
      ঠিক তখনই শুরু হলো—
      এক নতুন জীবনের
    • অধ্যায় I, সূচনা পঙ্‌ক্তি (Leslie Pockell সম্পাদিত The 100 Best Love Poems of All Time গ্রন্থ থেকে)। [২]
    • “স্মৃতির সেই অধ্যায়ে, যার আগে খুব কমই পড়া যায়, সেখানে একটি শিরোনামে লেখা: Incipit Vita Nova।” [পাদটীকা: “এখানেই শুরু এক নতুন জীবন।”]
    • অনুবাদ: ডান্টে গ্যাব্রিয়েল রোসেটি [৩]
  • ne le braccia avea
    madonna involta in un drappo dormendo.
    Poi la svegliava, e d'esto core ardendo
    lei paventosa umilmente pascea:
    appresso gir lo ne vedea piangendo.
    • আমার প্রেয়সী শুয়ে ছিলেন তাঁর বাহুতে, এক আবরণে জড়ানো।
      তারপর তিনি তাঁকে জাগালেন, আর তাঁর দগ্ধ হৃদয় তিনি হাত থেকে তুলে দিলেন।
      ভীত ও বিনয়ী হয়ে তিনি তা গ্রহণ করলেন।
      আমি দেখলাম, তিনি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন।
    • অধ্যায় I, প্রথম সনেট (অনুবাদ: মার্ক মুসা)
  • Ella è quanto de ben pò far natura;
    per essemplo di lei bieltà si prova.
    • তিনি প্রকৃতির সকল কল্যাণের সমন্বয়।
      তার মধ্যেই সৌন্দর্যর পরিপূর্ণ উদাহরণ পাওয়া যায়।
    • অধ্যায় XIV, পঙ্‌ক্তি ৪৯–৫০ (অনুবাদ: বারবারা রেইনল্ডস)
  • Amore e 'l cor gentil sono una cosa...
    e così esser l'un sanza l'altro osa
    com'alma razional sanza ragione.
    • ভালোবাসা ও মহৎ হৃদয় একই সত্তা...
      যেমন বুদ্ধিমান আত্মা যুক্তি ছাড়া থাকতে পারে না,
      তেমনই এরা একে অন্যের ছাড়া থাকতে পারে না।
    • অধ্যায় XVI (অনুবাদ: মার্ক মুসা)
  • Sì lungiamente m'ha tenuto Amore
    e costumato a la sua segnoria
    • ভালোবাসা দীর্ঘদিন ধরে আমাকে নিজের করে রেখেছে,
      আর আমি তার শাসনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
    • অধ্যায় XXIV
  • Amor che ne la mente mi ragiona
    de la mia donna disiosamente...
    che lo 'ntelletto sovr'esse disvia.
    • ভালোবাসা আমার মনে আনন্দে কথা বলে
      আমার প্রেয়সীর অসাধারণ গুণাবলি নিয়ে...
      যা মানুষের বুদ্ধির সীমা ছাড়িয়ে যায়।
    • ত্রাত্তাতো তের্‌জো, পঙ্‌ক্তি ১
  • La moralitade è bellezza de la filosofia.
    • নৈতিকতাই দর্শনের প্রকৃত সৌন্দর্য
    • ত্রাত্তাতো তের্‌জো, অধ্যায় ১৫
  • Nam in omni actione principaliter intenditur ab agente, sive necessitate naturae, sive voluntarie agat, propriam similitudinem explicare, unde fit, quod omne agens, in quantum huiusmodi, delectatur; quia, quum omne quod est appetat suum esse, ac in agendo agentis esse quodammodo amplietur, sequiturde necessitate delectatio... Nihil igitur agit, nisi tale existens, quale patiens fieri debet...
    • প্রত্যেক কর্মের মধ্যেই কর্মীর প্রধান উদ্দেশ্য থাকে নিজেকে প্রকাশ করা—সে তা প্রকৃতির বাধ্যতায় করুক বা ইচ্ছাকৃতভাবে। এই কারণে, যে কেউ যখন কিছু করে, সে তাতে আনন্দ পায়; কারণ প্রতিটি সত্তাই নিজ অস্তিত্বকে চায় এবং কাজের মাধ্যমে সেই অস্তিত্ব আরও বিস্তৃত হয়। ফলে, আনন্দ অনিবার্য হয়ে ওঠে।... অতএব, কেউ কোনো কাজ করে না, যদি না সে এমন কিছু হয়ে ওঠে, যা সেই কর্মের ফলে সৃষ্ট হওয়া উচিত।
    • গ্রন্থ iii, অধ্যায় XIII (XV), সম্পাদনা: Johann Heinrich F. Karl Witte (১৮৭৪) পৃষ্ঠা ২৫। অনুবাদ: হান্না আরেন্ট-এর The Human Condition (১৯৫৮) থেকে পৃষ্ঠা ১৭৫

এপিস্তোলায়ে (চিঠিপত্র)

[সম্পাদনা]
এই মহাকাব্যের মূল বিষয়—যদি কেবল আক্ষরিক অর্থে ধরা হয়—হল "মৃত্যুর পর আত্মার অবস্থা", কারণ পুরো রচনার গঠন এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। তবে যদি রূপকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, তবে এর বিষয়বস্তু হচ্ছে "মানুষ—যিনি নিজের ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে সৎ বা অসৎ কাজ করেন এবং সেই অনুযায়ী ন্যায়বিচার দ্বারা পুরস্কার বা শাস্তি লাভের যোগ্য হন।"
  • Hiis visis, manifestum est quod duplex oportet esse subiectum circa quod currant alterni sensus...
    • এ থেকে বোঝা যায়, এই রচনার দুটি ভিন্ন মাত্রার বিষয়বস্তু রয়েছে—একটি আক্ষরিক, অন্যটি রূপক।

প্রথমত, যদি আক্ষরিক অর্থে দেখা যায়, তবে পুরো রচনার বিষয় হচ্ছে—**"মৃত্যুর পর আত্মার অবস্থা"**। কারণ পুরো কাহিনির অগ্রগতি এই ধারণার ওপর নির্ভরশীল। আর যদি রচনাটিকে রূপক অর্থে দেখা হয়, তবে মূল বিষয় হলো—**"মানুষ, যে নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে সৎ বা অসৎ কাজ করে এবং সেই অনুযায়ী ন্যায়বিচার দ্বারা পুরস্কৃত বা দণ্ডিত হয়।"**

    • ক্যান গ্রান্দে-কে লেখা পত্র (চিঠি XIII, অনুচ্ছেদ ২৩–২৫); অনুবাদ: চার্লস সিংলেটন, প্রবন্ধ: "Two Kinds of Allegory", Dante Studies 1 (হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৫৪), পৃ. ৮৭।
  • Genus vero philosophie, sub quo hic in toto et parte proceditur...
    • এই রচনার — এবং এর প্রতিটি অংশের — যে দর্শনের ওপর ভিত্তি, তা হলো **নৈতিক দর্শন** বা **নৈতিকতা (ইথিক্স)**।

কারণ, এটি কেবল চিন্তা বা তত্ত্বের জন্য লেখা হয়নি—**এর উদ্দেশ্য বাস্তব জীবনে নৈতিক কার্যকলাপ ও মানব আচরণের প্রয়োগ**।

    • ক্যান গ্রান্দে-কে লেখা পত্র (চিঠি XIII, অনুচ্ছেদ ৪০); অনুবাদ: চার্লস ল্যাথাম, A Translation of Dante's Eleven Letters (১৮৯১), চিঠি XI, §১৬, পৃ. ১৯৯।

দান্তেকে ঘিরে উক্তি

[সম্পাদনা]
লেখকের নাম অনুযায়ী সাজানো
দান্তে ও শেকসপিয়ার আধুনিক বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন; তৃতীয় কেউ নেই। ~ টি. এস. এলিয়ট
  • আর তোমরা, প্রিয় সন্তানগণ, যারা গির্জার তত্ত্বাবধানে জ্ঞানচর্চার কাজে নিয়োজিত, তোমাদের প্রতি আমাদের আহ্বান—তোমরা যেভাবে এখন দান্তেকে ভালোবাসো ও লালন করছো, তেমনি করে অব্যাহত রেখো। আমরা কোনো দ্বিধা না করে তাকে খ্রিষ্টীয় ভাবনার শ্রেষ্ঠ গীতিকবি বলি।
  • দান্তের নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি জটিল ও বহুস্তরীয়। কারণ বাস্তব জীবনের নারীদের সঙ্গে তার কল্পনার নারীদের পার্থক্য ছিল অনেক। নয় বছর বয়সে তার মনে নারীদের প্রতি একধরনের আদর্শায়নের সূচনা হয়। তিনি মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারান। এরপর বড় হন পিতা ও সৎমায়ের সঙ্গে। তাদের প্রতিবেশী পোর্তিনারি পরিবারের ছয় মেয়ের মধ্যে একজন ছিল বেত্রিচে—দান্তেরই সমবয়সী। একদিন বেত্রিচের চোখে চোখ পড়তেই দান্তে যেন সেই দৃষ্টির জাদুতে আটকে পড়েন। সেই থেকেই ‘নয়’ সংখ্যাটি বেত্রিচের জন্য একটি অর্থবাহী, প্রায় জাদুকরী সংখ্যা হয়ে ওঠে।

এরপর টানা নয় বছর ধরে তিনি বেত্রিচেকে ফ্লোরেন্সের পথে পথে অনুসরণ করেন, যদিও কখনও তার কাছ থেকে উৎসাহ পান না। অবশেষে, আঠারো বছর বয়সে, প্রতিদিন যেখানে বেত্রিচে প্রার্থনায় যেতেন—সান্তা মার্ঘেরিতা দেই চেরকি গির্জার সামনে—একদিন হঠাৎ তিনি থেমে দান্তের দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন, "আমি তোমায় অভিবাদন জানাই।" এটিই ছিল বেত্রিচের কাছ থেকে শোনা দান্তের একমাত্র কথা। এই দৃষ্টিপাত ও সেই একটিমাত্র সম্ভাষণেই দান্তে এতটাই পরিতৃপ্ত হন যে, এটিকে তিনি একটি পূর্ণ সম্পর্কের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেন—যার আর কোনো বাস্তব রূপায়ণ ছিল না।

এই অভিজ্ঞতাই তিনি লিপিবদ্ধ করেন তার অনবদ্য সাহিত্যকর্ম ভিতা নোভা-তে, যা বেত্রিচের মৃত্যুর পর লেখা এক আত্মজৈবনিক কবিতা ও গদ্যের সংকলন।

  • বিশ্বাস ও স্বাধীনতার মধ্যে স্বাভাবিক এক বন্ধনের অনন্য উদাহরণ দান্তে আলিগিয়েরি। তিনি নিঃসন্দেহে ক্যাথলিক সত্যের প্রতি সম্পূর্ণভাবে অনুগত ছিলেন, আর এই নিষ্ঠাই তাকে একটি নিঃশঙ্ক, স্বাধীন বিচারবোধের আলো দিয়েছে—যা কোনো মানবিক ভয় কিংবা প্রভাব থেকে মুক্ত। দান্তে কখনো পোপদের কাজ বা সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি; এমনকি কিছু পোপকে তিনি নরকের গভীর স্তরে স্থান দিয়েছেন। তবুও, "ঊর্ধ্বতম চাবিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা" (ইনফার্নো, গান XIX, পঙ্‌ক্তি ১০১) তার মধ্যে কখনোই ক্ষীণ হয়নি। তিনি যেখানেই সমালোচনা প্রাসঙ্গিক মনে করেছেন, সেখানে কাউকেই রেহাই দেননি—ধর্মযাজক, রাজা, সাধারণ মানুষ কিংবা লায় ব্যক্তি—সবার কাছেই তিনি চান গসপেলের নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতা।
  • দান্তে আমাদের সামনে একজন উদারমনা ক্যাথলিক চিন্তক হিসেবে নয়, বরং এক সংকীর্ণ এবং প্রায় পক্ষপাতদুষ্ট মানসিকতা নিয়ে হাজির হন। এর পেছনে কিছুটা তার সময় ও সামাজিক প্রেক্ষাপট দায়ী, আবার কিছুটা তার ব্যক্তিগত স্বভাব। তবে তার মহত্ত্ব এই ব্যাপ্তির মধ্যে নয়, বরং গভীরতার মধ্যে নিহিত। তিনি বিশ্বজয়ী নন তাঁর বিস্তারের জন্য, বরং তাঁর গভীর উপলব্ধির জন্য। তিনি যেকোনো বিষয়ের গভীরে গিয়ে যেন সত্তার কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেন। দান্তের মতো তীব্র ও অনুপ্রবেশক্ষম উপলব্ধি আর কারও মধ্যে দেখি না।
    • থমাস কার্লাইল, "দ্য হিরো অ্যাজ পোয়েট", হিরোজ অ্যান্ড হিরো-ওয়ারশিপ (১৮৪১)
  • দান্তের জন্য আমি আমার চিত্রগুলো এমনভাবে আঁকতে চেয়েছিলাম, যেন ঈশ্বরীয় পনিরে আর্দ্রতার হালকা ছাপ পড়ে আছে। তাই সেগুলোর মধ্যে দেখা যায় প্রজাপতির পাখার মতো বিচিত্র রঙ ও বুনট। ধ্যান বা মিস্টিসিজম আসলে পনিরের মতো—খ্রিষ্টও তাই; বরং বলা যায়, পনিরের পাহাড়!
  • আমাদের অনিশিনাবেক জনগোষ্ঠীর জন্য "বিস্কাবীয়াং" মানে হলো “বনে ফিরে যাওয়া”—কারণ আমরা মূলত বনাঞ্চলের মানুষ। ছোটবেলা থেকেই আমি কর্ণ, শিম ও কুমড়া—যাকে আমরা “তিন বোন” বলি—এই তিনটি ফসল বন প্রান্তে চাষ করেছি। এখন যাকে 'সিলভান কালচার' বা 'পার্মাকালচার' বলা হয়, সেই ধরনের টেকসই কৃষিচর্চাই আমাদের প্রথাগত পদ্ধতি ছিল। এটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এই জীবনচর্চা ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত; যেমন দান্তে কিংবা পরবর্তীতে রেনেসাঁ যুগের কবি এডমন্ড স্পেনসার বনকে এক ভয়ংকর ও অশুভ জায়গা হিসেবে কল্পনা করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলাদা হওয়াটাই একটি ঔপনিবেশিক মানসচিন্তা ভাঙার প্রক্রিয়া। কারণ আবাসিক বিদ্যালয় ও অন্যান্য ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে বনভীতির যে বীজ রোপণ করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধেই এই প্রত্যাবর্তন।
  • দান্তে ও শেকসপিয়ার আধুনিক বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন; তাদের বাইরেই তৃতীয় কোনো নাম নেই।
  • দান্তে একজন কবি হিসেবে প্রায় অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন, বিশেষ করে তার কিছু গীতিকবিতার শুরুতে কিংবা কমেদিয়া-র নির্দিষ্ট কিছু পঙ্‌ক্তিতে। যখন তার সময়ে সাহিত্যিক রীতিনীতি বেশ কড়াকড়ি ছিল, তখন তিনি প্রাচীন রোমের কবি ভার্জিলকে গুরু হিসেবে বেছে নেন। এক এমন যুগে, যখন কেউ ভাবতেও পারত না এমন নিখুঁত কাঠামো ও রূপের কোনো সাহিত্যকর্ম সম্ভব, দান্তে ঠিক তেমন একটি অনবদ্য সৃষ্টি করেন। তার সাহিত্যিক কৃতিত্ব তার দর্শন বা ভাষাতত্ত্ব চর্চার চেয়েও বহু গুণ এগিয়ে। তবুও তার তাত্ত্বিক দিকগুলো থেকেও বোঝা যায়, তিনি সময়ের দার্শনিক ও অলঙ্কারিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নিজের পথ তৈরি করেছিলেন। তিনি ইতালীয় সাহিত্যের তখনো সদ্য বিকশিত গদ্য ও কবিতাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা খুব কম সময়েই ছোঁয়া গেছে—কখনো ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
    • চেজারে ফোলিনো, বার্ষিক ইতালীয় ভাষণ (১৯২১), "Dante: The Poet"Proceedings of the British Academy, 1921–192310: 81–96।  (উক্তি: পৃষ্ঠা ৯৬)
  • আমি আমার কণ্ঠ যোগ করতে চাই তাঁদের সঙ্গে, যারা দান্তে আলিগিয়েরিকে সর্বজনীনভাবে শ্রদ্ধেয় এক মহান শিল্পী হিসেবে বিবেচনা করেন। তাঁর অমর সাহিত্যকর্ম এখনো আমাদের অনেক কিছু বলার আছে—বিশেষ করে তাদের জন্য, যারা সত্যিকারের জ্ঞানের পথ অনুসরণ করতে চায়, আত্ম-আবিষ্কারে আগ্রহী, এবং যারা খুঁজে পেতে চায় জীবনের গভীর, অতীন্দ্রিয় অর্থ। ... ডিভাইন কমেডি-কে এক মহাযাত্রা হিসেবে দেখা যায়—এটি একধরনের তীর্থযাত্রা, যা ব্যক্তি মাত্রের অন্তর্মুখী অনুসন্ধান যেমন, তেমনি এটি এক সমষ্টিগত, গির্জাভিত্তিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক যাত্রাও। ... দান্তে হলেন আশার একজন ভবিষ্যদ্বক্তা, যিনি মানবজাতির মুক্তি ও পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথা বলেন—প্রতিটি পুরুষ ও নারীর ভিতরে, গোটা মানব সমাজের ভিতরেই সেই রূপান্তর সম্ভব বলে তিনি দেখান।
  • দান্তেই প্রথম যিনি স্বর্গ ও নরকের কথা গীত করেছেন কল্পনার উপাখ্যান হিসেবে নয়, বরং এক গভীর বিশ্বাসের বাস্তবতা হিসেবে। তিনি আমাদের দাঁড়ানো এই মানবিক উপত্যকা থেকে যাত্রা করে বিশাল মহাজগতে প্রবেশ করেন—যাত্রাপথে তিনি অতিক্রম করেন নরকের গহ্বর, দানব ও যন্ত্রণাময় দৃশ্যাবলি, তারপর আরোহন করেন দেবদূতদের রাজ্যে ও অজানা জগতে, যেখানে তিনি এক স্থির দৃষ্টিতে সর্বোচ্চ ঈশ্বরীয় মহিমা প্রত্যক্ষ করেন। ... দান্তে হলেন সেই কলম্বাস, যিনি কাব্যের এক নতুন জগৎ আবিষ্কার করেন। ... সম্ভবত তিনি হোমারকেও ছাড়িয়ে গেছেন।
    • এডমন্ড ডর গ্রিফিন, Remains of the Rev. Edmund D. Griffin (১৮৩১), পৃষ্ঠা ৩৩৫
  • দান্তের সমগ্র সাহিত্যকর্মকে বলা যায় মধ্যযুগের অবসান মুহূর্তের এক নিঃশব্দ দলিল। তাঁর রচনাগুলি যেন দেখিয়ে দেয়—পশ্চিমা বিশ্ব কেমন হতো, যদি সে নিজের ঐতিহ্যের পথ ধরে এগিয়ে যেতে পারত।
  • যদি নরকের ভয় দেখানোকে “শিশু নির্যাতন” হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে দান্তের ডিভাইন কমেডি-ও শিশুদের নাগালের বাইরে রাখা উচিত—কারণ এতে নরকের চিত্র এমনভাবে আঁকা হয়েছে, যা ভীতিকর এবং গ্রাফিক। সে ক্ষেত্রে জাপানে এই গ্রন্থ শিশুদের জন্য নিষিদ্ধ করা উচিত, আর দেশটির ভ্রমণ সংস্থাগুলোর উচিত হবে পরিবারের সঙ্গে শিশুদের নিয়ে পিসার বিখ্যাত মধ্যযুগীয় সমাধিক্ষেত্র কিংবা ইউরোপের সেই সব গির্জা—যেখানে চিত্রকর্মে দেখানো হয়েছে শয়তানরা কীভাবে পাপীদের শাস্তি দিচ্ছে—সেখানে না নিয়ে যাওয়া। (উল্লেখযোগ্য যে, বৌদ্ধ ধর্মের ঠান্ডা নরকের চিত্রাবলীও কিন্তু কম ভয়ংকর নয়।)
  • আমি দান্তেকে ভালোবাসি—প্রায় বাইবেলের মতোই। তিনি আমার আত্মিক খাদ্য; বাকিরা শুধু বোঝা।
    • জেমস জয়েস, উদ্ধৃত: রিচার্ড এলম্যান, James Joyce (১৯৫৯), পৃষ্ঠা- ২২৬
  • দান্তে অন্য কারও অনুসরণ করেননি—তিনি কেবল নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন, নিজের মতো করে সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। তিনি এক বিশাল মানসিক জগৎ নির্মাণ করেছেন, যেটি তাঁর মহৎ মেধা ও চিন্তার গভীরতায় পরিপূর্ণ। তিনি বহুমাত্রিক—কখনো দৃঢ়, কখনো মাধুর্যময়। তাঁর মধ্যে আছে কল্পনাশক্তি, উষ্ণতা, এবং প্রবল আবেগ। তিনি এমনভাবে লিখেছেন, যা পাঠককে কাঁপিয়ে তোলে, চোখে জল আনে, সম্মানের গর্বে বুক ভরে দেয়—এটাই প্রকৃত শিল্প। তিনি কঠোর ও সতর্ক; অপরাধের জন্য তাঁর ভাষা ভয়ংকর, পাপের জন্য কঠোর শাস্তি, আর দুর্ভাগ্যের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করেন। একজন নাগরিক হিসেবে, তিনি প্রজাতন্ত্রের নিয়মে আবদ্ধ হলেও, অবিচারীদের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করেছেন। তবুও, নিজের শহর ফ্লোরেন্সের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কখনো কমেনি। ফ্লোরেন্স তাঁর হৃদয়ের প্রিয়তম। আমি হিংসা করি—আমাদের ফ্রান্সে এমন একজন প্রতিদ্বন্দ্বী কবির জন্ম হয়নি। এই দানবীয় প্রতিভার পাশে আমাদের কেউ দাঁড়াতে পারেনি। সত্যি বলতে, দান্তের খ্যাতির সঙ্গে কাউকে তুলনা করা যায় না।
  • সংস্কৃতির মধ্যে সময়ের অবস্থান বদলাতে পারে অনেকভাবে। আজ আমরা দান্তেকে যে চোখে দেখি, তা তাঁর নিজ যুগের পাঠকদের চোখের থেকে আলাদা—তবু এই বদল দান্তের মধ্যে নয়, নয় তাঁর সত্যের মধ্যেও, যদিও অনেকেই তা বলবে। তাঁর সাহিত্যিক সত্য—যাত্রার, শিহরণ জাগানো আতঙ্কের, শুভ সম্ভাবনার, চিতাবাঘের, নক্ষত্রের, এবং বিশ্বাসের—সবই এখনো জীবন্ত। এখানে মৃত্যু কোনো আলাদা প্রশ্ন নয়, কারণ আমরা এমন এক জীবনের মধ্যে বাস করি, যেখানে কল্পনার অভিজ্ঞতা সবসময় লেনদেনের মতো চলে।
  • ডিভাইন কমেডি-তে দান্তে নরকের সপ্তম স্তরে একটি বিশেষ স্থান রেখেছেন তাঁদের জন্য, যারা চড়া হারে সুদ আরোপ করে—অর্থাৎ সুদখোরদের জন্য। আজ আর আমাদের আগুনে দগ্ধ নরক, কাঁটাওয়ালা বর্শা বা ফুটন্ত রক্তনদীর দরকার নেই। তবে এখনো আমাদের প্রয়োজন এমন একটি জাতীয় আইন, যা ক্রেডিট কার্ড ও ভোক্তা ঋণের সুদের হার সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখবে।
  • দান্তের প্রতিটি শব্দ যেন প্রাণভরে পরিপূর্ণ; প্রতিটিই যেন একটুকরো জ্বলন্ত অণু, নিঃশেষ না হওয়া চিন্তার অগ্নিকণা। অনেক শব্দ এখনো জন্মের ছাইয়ে ঢাকা—তবুও তারা বজ্রের মতো শক্তি ধারণ করে, যা এখনো প্রকাশের মাধ্যম খুঁজে পায়নি।
  • সেই মহান প্রতিভা তাঁর অসীম কল্পনাশক্তিতে অদৃশ্য সৃষ্টির রহস্য ধারণ করেছিলেন—আর সেগুলো তিনি বিস্মিত বিশ্বের চোখের সামনে উন্মোচন করেছিলেন।
  • দান্তে আলিগিয়েরি চতুর্দশ শতকে লিখেছিলেন—কবিতার প্রাণ নিহিত থাকে সেইসব কথ্য ভাষার জটিল গঠন ও ভাঙা উচ্চারণে, যেখানে ভাষা নতুন রূপে জন্ম নেয় ও বদলে যেতে থাকে। আজকের পৃথিবীতেও তাঁর এই ভাবনা প্রতিধ্বনিত হয়—বিশেষ করে অভিবাসীদের ভাঙা, টুকরো টুকরো বাক্যে, যেখানে তৈরি হচ্ছে ভবিষ্যতের নতুন সুর, নতুন ভাষা।
  • দান্তের খ্যাতি চিরকাল অটুট থাকবে—আসলে, কারণই হলো তাঁকে খুব কম মানুষ পড়ে। তাঁর লেখার কয়েকটি তীক্ষ্ণ উদ্ধৃতি বহু মানুষের মুখে মুখে ফেরে, আর সেটুকুই যেন যথেষ্ট—আর বাকিটুকু জানার প্রয়োজন আর কেউ বোধ করে না।
    • ভলতেয়ার, Dictionnaire Philosophique (১৭৬৫), অনুবাদ: উইলিয়াম এফ. ফ্লেমিং
    • বিকল্প অনুবাদ: তিনি অমর খ্যাতি অর্জন করেছেন, কারণ তাঁকে খুব কমই পড়া হয়। তাঁর লেখার প্রায় বিশটি উদ্ধৃতি সবাই মুখস্থ জানে—আর সে কারণেই কেউ আর বাকিটা খুঁজে দেখার প্রয়োজন মনে করে না।
  • দান্তের ইনফার্নো-ই ছিল আমার জীবনে সেই প্রথম বই, যা আমাকে সত্যিকারের শিহরণ দিয়েছিল। ডোরের ছবিগুলো আমার চোখে দারুণ লেগেছিল, আর সেখান থেকেই তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে আমার গভীর কৌতূহলের শুরু।

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]