দেশলাই
অবয়ব
দেশলাই বা দিয়াশলাই হলো আগুন জ্বালানোর লক্ষ্যে ব্যবহৃত কাষ্ঠ শলাকাবিশেষ যার অগ্রভাগে সামান্য বারুদ লাগানো থাকে। শলাকার বারুদ প্রান্তটি উপযুক্ত খসখসে তলে ঘষা দিলে আগুন জ্বলে ওঠে। এটি একটি পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রিত পন্থায় আগুন জ্বালানোর ঘরোয়া পদ্ধতি। সাধারণত: ছোট বাক্সে দেশলাইয়ের শলাকা বা কাঠিগুলো সাজিয়ে রাখা হয়। দেশলাইয়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ম্যাচ যা প্রাচীন ফরাসী শব্দ মেসে থেকে উদ্ভূত। মেসে মোমবাতির সলতে-কে নির্দেশ করতো।
উক্তি
[সম্পাদনা]- আমি একটা ছােট্ট দেশলাইয়ের কাঠি;
এতে নগণ্য হয়তাে চোখেও পড়ি না:
তবু জেনাে
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।- সুকান্ত ভট্টাচার্য, দেশলাই কাঠি, ছাড়পত্র- সুকান্ত ভট্টাচার্য, প্রকাশক- সারস্বত লাইব্রেরী, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪৩
- দেশের লোকেরা কলম চালায়, রসনা চালায় কিন্তু জাহাজ চালায় না, বোধ করি এই ক্ষোভ তাঁহার মনে ছিল। দেশে দেশলাই কাঠি জ্বালাইবার জন্য তিনি একদিন চেষ্টা করিয়াছিলেন দেশলাই কাঠি অনেক ঘর্ষণেও জ্বলে নাই; দেশে তাঁতের কল চালাইবার জন্যও তাহার উৎসাহ ছিল কিন্তু সেই তাঁতের কল একটিমাত্র গামছা প্রসব করিয়া তাহার পর হইতে স্তব্ধ হইয়া আছে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাহাজের খোল, জীবন-স্মৃতি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৬৬
- লাল দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে এক রকম জিনিস মাখানো থাকে, তাহাকে ফস্ফরস্ বলে। ফস্ফরসের গায়ে বাতাস লাগিলেই উহা জ্বলিয়া উঠে। দেওয়ালের গায়ে লাল দিয়াশলাইয়ের কাঠি ঘসিলে দেওয়াল কি-রকম উজ্জ্বল হয়, তোমাদের মধ্যে কেহ কেহ হয় ত তাহা দেখিয়াছ। জোনাক পোকার আলো কতকটা ফস্ফরসের আলোরি মত। তফাতের মধ্যে ফস্ফরসের আলোতে তাপ থাকে, জোনাকের আলোতে মোটেই তাপ থাকে না।
- জগদানন্দ রায়, জোনাক পোকা, পোকা-মাকড়- জগদানন্দ রায়, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান প্রেস লিমিটেড, এলাহাবাদ, প্রকাশসাল- ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩১ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৭২-২৭৩
- বাপ্ রে কি ডানপিটে ছেলে!—
শিলনোড়া খেতে চায় দুধভাত ফেলে!
একটার দাঁত নেই, জিভ দিয়ে ঘ’ষে,
এক মনে মোমবাতি দেশলাই চোষে!
আরজন ঘরময় নীল কালি গুলে,
কপ্ কপ্ মাছি ধ’রে মুখে দেয় তুলে!- সুকুমার রায়, ডানপিটে, আবোল তাবোল, সুকুমার সমগ্র রচনাবলী- প্রথম খণ্ড, সম্পাদনা- পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫২
- ডোমচিতি, গোয়ালবাগি ছাড়িয়েছি। রাস্তার দু’ধারে ঘন ঘন বাগান। আরও আট-দশ মাইল রাস্তা যেতে হবে। একটা বাঁধানো সাঁকোর ওপর বিশ্রাম করব বলে বসেছি, এমন সময় আর একজন পথ-চল্তি লোক এসে আমার সামনের সাঁকোটাতে বসল। খানিকটা বসে সে আমার দিকে একবার চাইলে, তারপর একটু সঙ্কোচের সুরে বলে—বাবু, আপনার কাছে দেশলাই আছে? তারপর দেশলাই নিয়ে বললে—আমার সঙ্গে তামাক আছে, হুঁকো কলকেও আছে। একটু তামাক সাজব, খাবেন?
বললুম—না দরকার নেই। আমি—- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বায়ুরোগ, জন্ম ও মৃত্যু - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬৫
- স্বদেশে দিয়াশালাই প্রভৃতির কারখানা স্থাপন করা আমাদের সভার উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি ছিল। এজন্য সভ্যেরা তাঁহাদের আয়ের দশমাংশ এই সভায় দান করিতেন। দেশালাই তৈরি করিতে হইবে, তাহার কাঠি পাওয়া শক্ত। সকলেই জানেন আমাদের দেশে উপযুক্ত হাতে খেংরা কাঠির মধ্য দিয়া সস্তায় প্রচুরপরিমাণে তেজ প্রকাশ পায় কিন্তু সে তেজে যাহা জ্বলে তাহা দেশালাই নহে। অনেক পরীক্ষার পর বাক্সকয়েক দেশালাই তৈরি হইল। ভারতসন্তানদের উৎসাহের নিদর্শন বলিয়াই যে তাহারা মূল্যবান তাহা নহে—আমাদের এক বাক্সে যে খরচ পড়িতে লাগিল তাহাতে একটা পল্লীর সম্বৎসরের চুলাধরানো চলিত। আরও একটু সামান্য অসুবিধা এই হইয়াছিল যে, নিকটে অগ্নিশিখা না থাকিলে তাহাদিগকে জ্বালাইয়া তোলা সহজ ছিল না।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বাদেশিকতা, জীবন-স্মৃতি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৪
- বিকেলে সে বাড়ি এসেই চটপট ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে ছাতের উপর উঠল। মনে মনে বলল, ‘ডাক্তারের পো আজ একবার অসুক-না, দেখিয়ে দেব প্যাঁচ খেলাটা কাকেবলে।’ এমন সময়ে পাঁচকড়ি এসে বড়ো-বড়ো চোখ করে বলল, “শুনেছিস?” ব্যোমকেশ বললে, “না-কি হয়েছে?” পাঁচু বললে, “ওদের সেই ছেলেটাকে দেখে এলুম, সে নিজে নিজে দেশলাইয়ের মসলা বানিয়েছে, আর চমৎকার লাল নীল দেশলাই তৈরি করেছে।” ব্যোমকেশ হঠাৎ লাটাই-টাটাই রেখে, এত বড়ো হাঁ করে জিজ্ঞেস করল, “দেশলাই কিরে। মাঞ্জা বল?” শুনে পাঁচু বেজায় চটে গেল, “বলছি লাল নীল আলো জ্বলছে, তবু বলবে মাঞ্জা, আচ্ছা গাধা যা হোক।” ব্যোমকেশ কোনো জবাব না দিয়ে, দেশলাইয়ের মসলা মাখানো সুতোটার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সেই সময়ে ডাক্তারদের বাড়ি থেকে লাল রঙের ঘুড়ি উড়ে এসে ঠিক ব্যোমকেশের মাথার উপরে ফরফর করে তাকে যেন ঠাট্টা করতে লাগল। তখন সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল, বলল, “আমার অসুখ করেছে।”
- সুকুমার রায়, ব্যোমকেশের মাঞ্জা, সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, সম্পাদনা- পুণ্যলতা চক্রবর্তী ও কল্যাণী কার্লেকর, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৪০
- মাথায় এল ন্যাশনাল কলেজ কী করে করা যাবে। তারক পালিত দিলেন লক্ষ টাকা, স্বদেশী যুগের টাকাও ছিল কিছু, তাই দিয়ে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্স্টিটিউট নামে কলেজ খোলা হল। তাতে তাঁত চলবে, দেশলাইয়ের কারখানা আরো সব-কিছু থাকবে।
- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঘরোয়া, ঘরোয়া-অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক-বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশসাল- ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৭৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১২৯
- বহু মানবকে মিলাইয়া এক-একটি প্রতিষ্ঠান রচনা করিয়া তোলা বিশেষ এক-প্রকার প্রতিভার কাজ। আমাদের দেশে সেই প্রতিভা কেবল এক-একটি বড়ো বড়ো পরিবারের মধ্যে অখ্যাতভাবে আপনার কাজ করিয়া বিলুপ্ত হইয়া যায়। আমার মনে হয়। এমন করিয়া শক্তির বিস্তর অপব্যয় ঘটে—এ যেন জ্যোতিষ্কলোক হইতে নক্ষত্রকে পাড়িয়া তাহার দ্বারা দেশলাই কাঠির কাজ উদ্ধার করিয়া লওয়া।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাড়ির আবহাওয়া, জীবন-স্মৃতি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১২৫
- দেশলাইয়ের কল্পনা চকমকি থেকে এখন মেঘের কোলের বিদ্যুতে গিয়ে ঠেকেছে কিন্তু এখনো নিষ্প্রভ আলো তাপহীন আগুন এ সমস্তই অবিদ্যমানের কোলে দুলছে একদিন বিদ্যমান হবার প্রতীক্ষায়। অবিদ্যমান হচ্ছে বিদ্যমান সমস্তের জননী, অজানা প্রসব করছে জানা জগৎ, অসম্ভব চলেছে সম্ভব হ’তে কল্পনার সোপান বেয়ে। “অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল, সমস্তই চিহ্নবর্জিত ছিল, অবিদ্যমান বস্তুর দ্বারায় সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিলেন, বুদ্ধিমানগণ বুদ্ধিদ্বারা আপন হৃদয়ে পর্যালোচনাপূর্বক অবিদ্যমান বস্তুতে বিদ্যমান বস্তুর উৎপত্তিস্থানে নিরূপণ করিলেন।” আগে সৃষ্টির কল্পনা তবে তো সৃষ্টি!
- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্তর বাহির, বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১২২
- আজকালকার সভ্য মানুষ, যাহারা দিব্য আরামে ঘরে বসিয়া দিয়াশলাই ঠুকিয়া আগুন জ্বালায়, তাহারা ভাবিয়াই দেখে না যে এই আগুন মানুষের কত তপস্যার ধন। যে-আগুন বনে জঙ্গলে দাবানল হইয়া জ্বলে, যে আগুন আগ্নেয় পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় জিভ মেলিয়া ধুঁকিতে থাকে-সেই আগুনকে মানুষ যখন আপনার শক্তিতে জ্বালাইতে শিখিল, সেইদিন মানুষ এমন বিদ্যা শিখিল যাহা মানুষ ছাড়া আর কেহ জানে না।
- সুকুমার রায়, আগুন, সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, সম্পাদনা- পুণ্যলতা চক্রবর্তী ও কল্যাণী কার্লেকর, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৩০
- একটী একটী করিয়া অনেকগুলি দিয়াশলাই পোড়াইলাম, কিন্তু সে স্থান হইতে বহির্গত হইবার কোন উপায় দেখিতে পাইলাম না। ভাবিলাম, এইরূপেই কি আমার জীবন শেষ হইবে? যেমন করিয়া পারি, সেখান হইতে উদ্ধার হইব, মনে মনে এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিলাম।
- প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, জোড়া পাপী - প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, প্রকাশক- দারোগার দপ্তর কার্য্যালয়, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৭
- মনে আছে সেদিন হুলুস্থুল বেধেছিল?
ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন—
আমাকে অবজ্ঞা-ভরে না-নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়!
কতো ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে,
কতো প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাৎ;
আমি একা-ই ছােট্ট একটা দেশলাই কাঠি।- সুকান্ত ভট্টাচার্য, দেশলাই কাঠি, ছাড়পত্র- সুকান্ত ভট্টাচার্য, প্রকাশক- সারস্বত লাইব্রেরী, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪৩
- ‘নাম বুঝি লাবণ্য?’
‘হাঁ।’
‘গট্ ম্যাচেস্?’
হঠাৎ দেশলাইয়ের প্রয়োজন আন্দাজ করতে না পেরে সুরমা কথাটার মানেই বুঝল না। মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
কেটি বললে, ‘দেশালাই।’
সুরমা দেশালাইয়ের বাক্স নিয়ে এল। কেটি সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে সুরমাকে জিজ্ঞাসা করলে, ‘ইংরেজি পড়?’ সুরমা স্বীকৃতিসূচক মাথা নেড়েই ঘরের দিকে দ্রুত চলে গেল। কেটি বললে, ‘গবর্নেসের কাছে মেয়েটা আর যাই শিখুক ম্যানার্স্ শেখে নি।’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্যাঘাত, শেষের কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশসাল- ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৫৪
- এইরূপে আরও খানিক দূর গমন করিয়া একটী ভাঙ্গা দরজা আমার নয়নপথে পতিত হইল। প্রজ্বলিত দিয়াশলাই এর কাটীর সাহায্যে আমি সেই দ্বারের নিকট উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, একটা প্রকাণ্ড নারিকেল বৃক্ষ ভাঙ্গিয়া সেই দ্বারে পতিত, সম্ভবত সেই পতনশীল নারিকেলবৃক্ষের ভরেই দরজাটা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে।
- প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, জোড়া পাপী- প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, পঞ্চম পরিচ্ছেদ, প্রকাশক- দারোগার দপ্তর কার্য্যালয়, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৮
- দাদা হাউইটাকে হাতে নিয়ে, একটুখানি বেঁকিয়ে ধরে বিজ্ঞের মতো বলতে লাগল, “এই সলতের মতো দেখছিস, এইখানে আগুন ধরাতে হয়। সলতেটা জ্বলতে জ্বলতে যেই হাউই ভসভস করে ওঠে, অমনি, ঠিক সময়টি বুঝে—এই এমনি করে হাউইটিকে ছেড়ে দিতে হয়। এইখানেই হচ্ছে আসল বাহাদুরি। কাল দেখলি তো, প্রকাশটা কিরকম আনাড়ির মতো করছিল। হাউই জ্বলতে না জ্বলতে ফস করে ছেড়ে দিচ্ছিল। সেইজন্যই হাউইগুলো আকাশের দিকে না উঠে নিচু হয়ে এদিক-সেদিক বেঁকে যাচ্ছিল।”
এই বলে সবজান্তা দাদা একটি দেশলাইয়ের কাঠি ধরালেন। ভাইবোনেরা সব অবাক হয়ে হাঁ করে দেখতে লাগল। দেশলাইয়ের আগুনটি সলতের কাছে নিয়ে দাদা ঘাড় বেঁকিয়ে, মুচকি হেসে আর একবার টেঁপিদের দিকে তাকালেন। ভাবখানা এই যে, আমি থাকতে রাজুমামা-ফাজুমামার দরকার কি?- সুকুমার রায়, সবজান্তা দাদা, আবোল তাবোল, সুকুমার সমগ্র রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, সম্পাদনা- পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৮৯-১৯০
- ভারতবর্ষে সন্ন্যাসধর্ম্ম বলে একটা প্রকাণ্ড শক্তি আছে, তার ছাই ঝেড়ে তার ঝুলিটা কেড়ে নিয়ে তার জটা মুড়িয়ে তাকে সৌন্দর্য্য এবং কর্ম্মনিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত করাই চিরকুমার সভার একমাত্র উদ্দেশ্য। ছেলে পড়ান এবং দেশলাইয়ের কাটি তৈরি করবার জন্যে আমাদের মত লোক চিরজীবনের ব্রত অবলম্বন করে নি। বল বিপিন, তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি আছ কি না?
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রজাপতির নির্বন্ধ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- মজুমদার লাইব্রেরি, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ (১৩০৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫৬
- একদিন রাত্রে কলম্বোর একটা পার্কের মধ্যে আমরা দুজনে বেড়া ডিঙিয়ে আশ্রয় নিই। গাছতলার একটা বেঞ্চের উপর শুতে গিয়ে দেখি আর একজন শুয়ে আছে। মানুষের সাড়া পেয়ে সে জল জল করতে লাগলো, চারিদিকে ভয়ানক দুর্গন্ধ বেরিয়েছে,—দেশলাই জ্বেলে তার মুখের পানে তাকিয়েই বোঝা গেল, কলেরা।
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এণ্ড সন্স লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৮৯-১৯০
- আমার হাতেই দেশলাই ছিল; আমি তৎক্ষণাৎ জ্বালিয়া ফেলিলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল। এক ভয়ানক বিষাক্ত কৃষ্ণবর্ণ কেউটে সাপ সেই নলের মুখ হইতে ফোঁস ফোঁস শব্দ করিতে করিতে ধীরে ধীরে বাহির হইতেছে।
- প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, বাঁশী - প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, দশম পরিচ্ছেদ, প্রকাশক- দারোগার দপ্তর কার্য্যালয়, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৩ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪৪
- ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল। প্রভাত উঠিল। তখন রাজপথে আলোকমালা সুদীর্ঘ পন্নগের মত দেখাইতেছে। ভাবিতে ভাবিতে প্রভাত গৃহে আসিল। ছাত্রাবাসে সে একা একটি ক্ষুদ্রায়তন কক্ষে থাকিত। দ্বারের চাবি খুলিয়া সে কক্ষে প্রবেশ করিল; টেবলের উপর দেশলাই সন্ধান করিয়া লইয়া আলোক জ্বালিল, তাহার পর পড়িতে বসিল। কিন্তু পড়িতে ভাল লাগিল না; সে পুস্তক বন্ধ করিয়া সে আর একখানা পুস্তক খুলিল; তাহাও ভাল লাগিল না।
- হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, নাগপাশ - হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, প্রকাশক- বসুমতী পুস্তকবিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৭
- দু’ঘণ্টা হাঁটবার পরে শঙ্করের খুব ভয় হোল। ততক্ষণে সে বুঝেচে যে, সে সম্পূর্ণরূপে পথ হারিয়েছে এবং ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। একা তাকে রোডেসিয়ার এই জনমানবশূন্য, সিংহসঙ্কুল অজানা প্রান্তরে রাত কাটাতে হবে,—অনাহারে এবং এই কন্কনে শীতে বিনা কম্বলে ও বিনা আগুনে। সঙ্গে একটা দেশলাই পর্য্যন্ত নেই।
- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ, চাঁদের পাহাড় - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এন্ড সন্স লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৭৩
- দ্বিতীয়বার যখন এলেন দশ বছর পরে, তখন আমি আর্টের লাইনে ঢুকেছি। প্রায়ই আমাদের জোড়াসাঁকোর স্টুডিয়োতে বসে শিল্প সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হত। নন্দলালদের তিনি আর্টের ট্র্যাডিশন অবসার্ভেশন ও ওরিজিনালিটি বোঝাতেন তিনটি দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে। দেবতার মত ভক্তি করত ওকাকুরাকে জাপানীরা।
- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জোড়াসাঁকোর ধারে, জোড়াসাঁকোর ধারে- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫১ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১০৬
- তাহার ট্যাঁক হইতে একটি টাকা ও গণ্ডা ছয়েক পয়সা বাহির হইল, পকেট হইতে একটা লোহার কম্পাস, মাপ করিবার কাঠের একটা ফুটরুল, কয়েকটা বিড়ি, একটা দেশলাই ও একটা গাঁজার কলিকা বাহির হইয়া পড়িল।
নিমাইবাবু কহিলেন, তুমি গাঁজা খাও?
লোকটি অসঙ্কোচে জবাব দিল, আজ্ঞে না।- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এণ্ড সন্স লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫০
- তখন অন্ধকারে কে একজন আমার মশারির কাছে দাঁড়াইয়া সুষুপ্ত মনোরমার দিকে একটিমাত্র দীর্ঘ শীর্ণ অস্থিসার অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া যেন আমার কানে কানে অত্যন্ত চুপিচুপি অস্ফুটকণ্ঠে কেবলই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, “ও কে। ও কে। ও কে গো।”
তাড়াতাড়ি উঠিয়া দেশলাই জ্বালাইয়া বাতি ধরাইলাম। সেই মুহূর্তেই ছায়ামূর্তি মিলাইয়া গিয়া, আমার মশারি কাঁপাইয়া, বোট দুলাইয়া, আমার সমস্ত ঘর্মাক্ত শরীরের রক্ত হিম করিয়া দিয়া হাহা-হাহা-হাহা করিয়া একটি হাসি অন্ধকার রাত্রির ভিতর দিয়া বহিয়া চলিয়া গেল।- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নিশীথে, গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড)- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২৭২
- পার্কের বেঞ্চিটার ও-কোণে একটা চানাচুর ভাজাওয়ালা এসে বসলো। আমায় বললে—বাবু, দেশলাই আছে? আমি তাকে দেশলাই দিলাম। চলে যা না কেন বাপু, তা নয় সে আবার আমার সঙ্গে খোসগল্পে প্রবৃত্ত হয়, এমন ভাব করে তুললে। আমায় কি এখন ওই সব বাজে কথা ভাল লাগচে?
- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অথৈজল - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকাশক- ডি. এম. লাইব্রেরী, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৯৩
- দেশলাইয়ের বাক্স একটা, সিগারেটের টিন একটা, লোহার সিন্দুক একটা এবং কালীঘাটের কৌটা একটা—এদের ভাল-মন্দের হিসেব এদের রূপের মধ্যেই রয়েছে। দেশলাইয়ের বাক্সর কবি বাক্সটার রূপ বড় উপমার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে হয়তো কালীঘাটের কৌটোর চেয়ে তাকে ভাল বলে’ প্রমাণ করতে পারেন কারো কাছে, কিন্তু আর্টিষ্ট রূপ দিয়েই রূপের পরিমাপ করে দেখবে, উপমার ভাল-মন্দ দিয়ে নয়।
- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরূপ না রূপ, বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৪৫
- জাল উঁচু করিয়া রাখিয়া কুবের ও গণেশ ছইয়ের সামনে বসিল। ছইয়ের গায়ে আটকানাে ছােটো হুঁকাটি নামাইয়া টিনের কৌটা হইতে কড়া দা-কাটা তামাক বাহির করিয়া দেড় বছর ধরিয়া ব্যবহৃত পুরাতন কল্কিটিতে তামাক সাজিল কুবের। নারিকেল ছােবড়া গােল করিয়া পাকাইয়া ছাউনির আড়ালে একটিমাত্র দেশলাইয়ের কাঠি খরচ করিয়া সেটি ধরাইয়া ফেলিল। বারাে বছর বয়স হইতে অভ্যাস করিয়া হাত একেবারে পাকিয়া গিয়াছে।
- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সংস্করণ- ৩৫, প্রকাশক- বেঙ্গল পাবলিশার্স , প্রকাশস্থান- কলকাতা, পৃষ্ঠা ৯
- মেজের এক কোণ হইতে কেবল একটা কাতরোক্তি শুনিতে পাওয়া যাইতেছিল। একজনের হাতে একটা দিয়াশলাই ছিল; সে একটা কাঠি জ্বালিতেই ঘরের মধ্যের অন্ধকার দূর হইল। সকলে সভয়ে দেখিল, মানদা ঘরের মেজের উপর পড়িয়া আছেন। তাঁহারই কণ্ঠ হইতে অব্যক্ত কাতরোক্তি বাহির হইতেছে। ঘরের চারিদিকে দেখিবার পূর্ব্বেই দিয়াশলাই নিবিয়া গেল। চণ্ডী বাবু বলিলেন “খবরদার, তোমরা দোর আগ্লে, দাঁড়াও, পাজিটা যেন পালাতে না পারে। আর একটা দিয়াশলাই জ্বাল।”
- জলধর সেন, ষোল আনি- জলধর সেন, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৩
- শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রি। থম্থমে মেঘ করিয়া আছে, আকাশে একটি তারা দেখা যায় না; অন্ধকার ঘরে দুইজনে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। একজনের চাদরে দিয়াশলাই এবং বাতি বাঁধা ছিল। বর্ষাকালের দিয়াশলাই বহু চেষ্টাতেও জলিল না— যে লণ্ঠন সঙ্গে ছিল তাহাও নিবিয়া গেছে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবিত ও মৃত, গল্পগুচ্ছ (প্রথম খণ্ড)- প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৪১
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]
উইকিপিডিয়ায় দিয়াশলাই সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।

উইকিঅভিধানে দেশলাই শব্দটি খুঁজুন।

উইকিমিডিয়া কমন্সে দেশলাই সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে।