বিষয়বস্তুতে চলুন

নরক

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে

নরক ধর্ম ও লোককথায় একটি পরলৌকিক স্থান যা কোথাও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির জায়গা হিসেবে বর্ণিত। যেসব ধর্মের ঐশ্বরিক ইতিবৃত্ত রৈখিক (যেমন ইব্রাহিমীয় ধর্মসমূহ) সেসব ধর্মমতে প্রায়ই নরককে চিরস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। আবর্তনশীল ইতিবৃত্ত বিশিষ্ট ধর্মমতে (যেমন ভারতীয় ধর্মসমুহে) প্রায়ই নরককে দুই জন্ম বা অবতারত্বের অন্তর্বর্তী সময় হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সাধারণত এসব ধর্মসংস্কৃতিতে নরকের অবস্থান অপর মাত্রায় কিংবা মাটির নিচে।

উক্তি

[সম্পাদনা]
  • দয়া ধর্ম্মের মূল; আর নরকের মূল কি—না অভিমান। অবশ্য আমাদের ভিতর কেহই নরক নামক সুখের আলয়ে সাধ করিয়া যাইতে চাহেন না, ও চাহিবেন না। কিন্তু আমরা কত সাধে অভিমানকে হৃদয়ে স্থান দান করিয়া থাকি, আমাদের সেই অভিমানই যে নরকের মূল তাহা জানি না অথবা জানিয়াও তাহাকে পরিত্যাগ করিতে পারি না। অভিমান পরিত্যাগ করিবার উপায় আমাদের বিবেকবুদ্ধির দ্বারা বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে। অহঙ্কার হইতেই আমাদের এ পচা আমির উৎপত্তি।
    • ইন্দিরা দেবী, দয়া, আমার খাতা - ইন্দিরা দেবী, প্রকাশক-শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৯২
  • দেবর্ষি নারদ এতক্ষণ অলক্ষ্যে বসিয়াছিলেন। এখন আত্মপ্রকাশ করিয়া কহিলেন— ‘আমার কাছে বিশুদ্ধ চৈনিক হলাহল আছে। তাহা সর্ষপপ্রমাণ সেবনে দিব্যজ্ঞান লাভ হয়, দুই সর্ষপে বুদ্ধিভ্রংশ, চতুর্মাত্রায় নরকভোগ, এবং অষ্টমাত্রায় মোক্ষলাভ হয়। জাবালিকে চতুর্মাত্রা সেবন করাও; সাবধান, যেন অধিক না হয়।’
    • রাজশেখর বসু, জাবালি, কজ্জলী - পরশুরাম, ষষ্ঠ সংস্করণ, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এণ্ড সন্স লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৭৪
  • ইন্দ্র যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, “মহারাজ! দেবতারা তোমার উপর অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছে। আর তোমাকে কষ্ট পাইতে হইবে না; তোমার পুণ্যের বলে সর্বাপেক্ষা উচ্চ ফল লাভ হইয়াছে। নরক দেখিতে হইল বলিয়া তুমি বিরক্ত হইও না। সকল রাজাকেই একবার নরক দেখিতে হয়। পাপ-পুণ্য সকলেরই থাকে। যাহার পাপ অধিক, সে আগে অল্পকাল স্বর্গে থাকিয়া, পরে নরক ভোগ করে। যাহার পুণ্য অধিক, সে আগে নরকে থাকিয়া, শেষে স্বর্গ ভোগ করে। এইজন্যই তোমাকে আগে নরক দেখাইয়াছি। তুমি যে অশ্বত্থামার বধের কথা বলিয়া দ্রোণকে ফাকি দিয়াছিলে, সেই পাপে তােমাকে নরক দেখিতে হইল। এইরূপ অল্প অল্প পাপ ভীমার্জুন, দ্রৌপদী প্রভৃতি সকলেরই ছিল, তাই সকলকেই কিছু কিছু কষ্ট পাইতে হইয়াছে।
    • উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, স্বর্গারোহণপর্ব, ছেলেদের মহাভারত, উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র- উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, প্রকাশক- বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল-১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬১ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৪৫-৩৪৬
  • মাতৃভবন ছাড়া আর কোনো অপরিচিত স্থান বালকের পক্ষে নরক। চারি দিকের স্নেহশূন্য বিরাগ তাহাকে পদে পদে কাঁটার মতো বিঁধে। এই বয়সে সাধারণত নারীজাতিকে কোনো-এক শ্রেষ্ঠ স্বর্গলোকের দুর্লভ জীব বলিয়া মনে ধারণা হইতে আরম্ভ হয়, অতএব তাঁহাদের নিকট হইতে উপেক্ষা অত্যন্ত দুঃসহ বোধ হয়।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছুটি, পূর্ব-বাংলার গল্প - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ (১৩৭৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪
  • তারার মস্তকে, হৃদয়ে সহস্র নরকজ্বালা, চক্ষের সম্মুখে নরক নৃত্য করিতেছিল। নরক হইতে কে আসিয়া তাহার কাণে কাণে কহিল, এ অপমানের একমাত্র প্রতিবিধান আছে। শম্ভূজীকে দেখিয়া তারার শিরার মধ্যে রক্তস্রোত বেগে প্রবাহিত হইয়া তাহার মুখ অন্ধকার করিয়া তুলিল। চক্ষে একবার মাত্র লোহিত বিদ্যুৎ জ্বলিয়া উঠিল।
    • নগেন্দ্র নাথ গুপ্ত, পর্ব্বতবাসিনী - নগেন্দ্র নাথ গুপ্ত, প্রকাশক- শ্রী রাখাল চন্দ্র ঘোষ, কলকাতা, প্রকাশসাল-১৯০১ খ্রিস্টাব্দ (১৩০৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৬৩-১৬৪
  • সংসার রূপ কর্মভূমিতে শুভাশুভ কর্ম ক’রে কেউ এখানেই ফলভোগ করে, কেউ পুণ্যবলে স্বর্গে যায়, কেউ অসৎ কর্মের ফলে নরকে পতিত হয়; সেই নরক থেকে মুক্তিলাভ অতি দুরূহ। মৃত্যুর পর পুণ্যাত্মারা চন্দ্র সূর্যে অথবা নক্ষত্রলোকে যান, কর্মক্ষয় হ’লে আবার তাঁরা মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন; এইরূপ যাতায়াত বার বার ঘটে। স্বর্গেও উচ্চ মধ্যম ও নীচ স্থান আছে।
    • কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস, অনুগীতাপর্বাধ্যায়, অনুবাদক- রাজশেখর বসু, মহাভারত - রাজশেখর বসু, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এন্ড সন্স লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬০৬
  • স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
    কে বাঁচিতে চায়?
    দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
    কে পরিবে পায়?
    কোটিকল্প দাস থাকা নরকের প্রায় হে,
    নরকের প্রায়।
    দিনেকের স্বাধীনতা, স্বর্গ-সুখ তায় হে,
    স্বর্গসুখ তায়।৷
    • রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মিনী উপাখ্যান- রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীপূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত, কলিকাতা, প্রকাশসাল- ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩১২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৭৪
  • এই পৃথিবীতেই আমরা স্বর্গ নরক উভয়েরই আভাস পাইতেছি। আত্মার প্রকৃত সুস্থবস্থা—তাহার নির্মল সুশৃঙ্খল ভাবই স্বর্গ। আত্মার বিকৃতাবস্থা, তাহার সমল দূষিত ভাবই নরক। পাপাত্মাকে স্বর্গলোকে রাখিলে তাহার কি হইতে পারে? চির রোগীকে তাহার অন্ধকার কুটীর হইতে সুসজ্জিত প্রাসাদে আলিয়া রাখি বল তাহার কি হইবে? সে যে স্থানে থাকুক, সকল স্থানই তাহার নরক তুল্য বোধ হয়। যে ব্যক্তি কোন দুঃসহ মনস্তাপ ভোগ করিতেছে, বসন্ত কালের মলয়ানিল, যাহা সুস্থ ব্যক্তির প্রাণ-তুল্য, তাহা তাহার যন্ত্রণাদায়ক। পাপীরও সেই প্রকার। যদি পাপাত্মাকে স্বর্গলোকে দের মণ্ডলীর মধ্যে রাখা যায়, তবে তাহার স্বর্গভোগ নহে, তাআই তাহার অতি কঠোর শাস্তি।
    • দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দশম উপদেশ, ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস- দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তৃতীয় সংস্করণ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ (১২৭৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮৯
  • সত্যই ব্রহ্ম ও তপস্যা, সত্যই প্রজাগণকে সৃষ্টি ও পালন করে। ধর্ম ও অর্থ হ’তেই সুখের উৎপত্তি হয়, যার শারীরিক ও মানসিক দুঃখ নেই সেই সুখ অনভেব করে। স্বর্গে নিত্য সুখ, ইহলোকে সুখদুঃখ দুইই আছে, নরকে কেবল দুঃখ। সুখই পরমপদার্থ।
    • কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস, মোক্ষধর্মপর্বাধ্যায়, অনুবাদক- রাজশেখর বসু, মহাভারত - রাজশেখর বসু, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এন্ড সন্স লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫৮০
  • জ্ঞানী, বিজ্ঞ ব্যক্তিরা লিখেন লোক শিক্ষার জন্য, পরোপকারের জন্য, আমি লিখিলাম, আমার নিজের সান্ত্বনার জন্য, হয় তো প্রতারণা বিমুগ্ধ নরক পথে পদ বিক্ষেপোদ্যতা কোন অভাগিনীর জন্য। কেননা আমার আত্মীয় নাই, আমি ঘৃণিতা, সমাজ বর্জ্জিতা, বারবনিতা; আমার মনের কথা বলিবার বা শুনিবার কেহ নাই!
    • বিনোদিনী দাসী, আমার কথা (প্রথম খণ্ড) - বিনোদিনী দাসী, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩২০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১০৯-১১০
  • ব’ল্‌লে আর এক—কেউ বা তারে
    ব’ল্‌ছে পাজী যাচনদার,
    মুখখানা তার আঁকছে দিয়ে
    নরক-ধোঁয়ার অন্ধকার;
    যাচাই মোদের ক’র্‌বে সে জন
    কথার কথা ফক্কিকার—
    লোকটা নেহাৎ মন্দ সে নয়,
    মন্দ কি হয় তার বিচার!
    • ওমর খৈয়াম, রোবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম, লেখক- ওমর খৈয়াম, অনুবাদক- কান্তিচন্দ্র ঘোষ, প্রকাশক- কমলা বুক ডিপো, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৩
  • টাকাই বাহ্য সম্পদ। হর হর বম্ বম্‌! বাহ্য সম্পদের পূজা কর। এ পূজার তাম্রশ্মশ্রুধারী ইংরেজ নামে ঋষিগণ পুরোহিত; এডাম স্মিথ পুরাণ এবং মিল তন্ত্র হইতে এ পূজার মন্ত্র পড়িতে হয়; এ উৎসবে ইংরেজি সম্বাদ-পত্র সকল ঢাক ঢোল, বাঙ্গালা সম্বাদ-পত্র কাঁশীদার; শিক্ষা এবং উৎসাহ ইহাতে নৈবেদ্য, এবং হৃদয় ইহাতে ছাগবলি। এ পূজার ফল, ইহলোকে ও পরলোকে অনন্ত নরক।
    • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আমার মন, কমলাকান্তের দপ্তর, কমলাকান্ত - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ (১২৯২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮
  • যুধিষ্ঠিরের নরকদর্শনের গল্পটা সবাই জানে। ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ’—এইমাত্র বলার জন্যে তাকে নরক দেখতে হয়েছিল। কিন্তু আমরা যারা মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা বানাচ্ছি অহরহ, এমন কী নিজেদের নরক নিজেরাই তৈরি করে চলেছি প্রতিদিন—আমাদের জন্যে কী ব্যবস্থা? ৫ সেপ্টেম্বর ঘটা করে শিক্ষক দিবস করি এখনো, ইনিয়ে-বিনিয়ে সাত-সতেরো কথা বলি জাতির মেরুদণ্ড সম্পর্কে—তারপর, আবারও ফিরে যাই ‘নরক’ তৈরির কার্যক্রমে।
    • তপোধীর ভট্টাচার্য, জনৈক শিক্ষাজীবীর আত্মদর্শন, সময় অসময় নিঃসময়- তপোধীর ভট্টাচার্য, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- একুশশতক, কলকাতা, প্রকাশসাল-২০১০ খ্রিস্টাব্দ (১৪১৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৭
  • চিতার পোড়া কয়লার স্তুপ জমিতে জমিতে আদি গঙ্গার গর্ভ ভরিয়া ওঠে, হিন্দুর পাপ ক্ষালনের বোঝা টানিতে টানিতে জননী ভাগীরথী শীর্ণা হইতে শীর্ণতরা হইয়া আসেন। ভাঁটায় নামিয়া যাওয়া ঘোলাটে জল আর পঙ্কিল তীরের অশ্বাস্থ্যকর দুর্গন্ধ স্বর্গযাত্রার পথে নরকের কথায় স্মরণ করিয়া দেয়।
  • মথিয়া নরক যেন নরকের কীট
    করে শত আস্ফালন। অঙ্কুশের ঘায়
    ডুবায় পুরীষ কুণ্ডে মুণ্ড পুনরায়।—
    কুটুম্বের কলেবরে রাখি পদভর
    নিষ্কলঙ্ক চিতে চিন্তে স্বার্থপর নর
    কোথায় সে লক্ষ্যমণি হায় কতদূর
    কত ঊৰ্দ্ধে অবস্থিত; বাসনা নিঠুর
    লয়ে যায় ফেলে দেয় নরকের দ্বারে।
    • নরেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, শ্মশান, শ্মশানের ফুল - নরেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩১২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৮
  • আমি একটি পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করি না, তাই আমাকে আমার সারা জীবন নরক ভয়ে কাটাতে হবে না, বা স্বর্গকে আরও ভয় করে কাটাতে হবে না। নরকের নির্যাতন যাই হোক না কেন, আমি মনে করি স্বর্গের একঘেয়েমি আরও খারাপ হবে।
    • আইজাক আসিমভ, ফিলোসফি অন দি গো (২০০৭) জোই গ্রিনের দ্বারা, পৃষ্ঠা ২২২
  • ঈশ্বরের অমূল্য দান দয়া, তাহা যদি আমরা রত্ন ভাবিয়া কণ্ঠে স্থান দিই তাহা হইলে অনায়াসে আমরা ধর্ম্মকে লাভ করিব কারণ দুইটি এক সূত্রে গ্রথিত জিনিষ। এই জন্য ভক্ত তুলসী দাস গাহিয়াছেন—দয়া ধরম কি মূল হ্যায় নরক মূল অভিমান, তুলসী কহে মৎ ছোড় দয়া যাবৎ কণ্ঠাগত প্রাণ। ধর্ম্ম আমাদের স্বর্গসুখ ভোগ করায় ও আমাদের জীবন মরণের সঙ্গী হইয়া থাকে ও মৃত্যুকালে পরলোকের অচেনা পথের পথ প্রদর্শক হইয়া আমাদের পরলোকে লইয়া যায়—এই দয়া বৃত্তিকে অনুশীলন দ্বারা আমরা স্বর্গের দ্বারকে মুক্ত করিয়া থাকি।
    • ইন্দিরা দেবী, দয়া, আমার খাতা - ইন্দিরা দেবী, প্রকাশক-শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৯৩-৯৪
  • তারা হস্তোত্তলন করিয়া কহিল, আমার হৃদয়ের মধ্যে যে নরক জ্বলিতেছে, সেই নরক সাক্ষী করিয়া কহিতেছি, আমি তোমায় বিবাহ করিব। পূর্ব্বে আমার ভ্রম হইয়াছিল, নহিলে এতদিন তোমাকে বিবাহ করিতাম। আমার এ নরকাগ্নি কোন দিন আমাকেই ভস্মীভূত করিত। এখন আমরা দুইজনে মিলিত হইয়া এ অগ্নিতে হবিঃপ্রদান করিব। গোকুলজী মরুক, তাহার শোণিতে এ অনল নিভাইব।
    • নগেন্দ্র নাথ গুপ্ত, পর্ব্বতবাসিনী - নগেন্দ্র নাথ গুপ্ত, প্রকাশক- শ্রী রাখাল চন্দ্র ঘোষ, কলকাতা, প্রকাশসাল-১৯০১ খ্রিস্টাব্দ (১৩০৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৬৫
  • হরিমোহন অগ্রসর হইয়া দেখিল, তিনকড়ি শীল দালানে বসিয়া সেই জনতার মধ্যে অশেষ ধন বিতরণ করিতেছেন, কেহই নিরাশ হইয়া ফিরিতেছে না। হরিমোহন উচচহাস্য করিল। সে ভাবিল, “একি স্বপ্ন! তিনকড়ি শীল আবার দাতা?” তাহার পরে সে তিনকড়ির মন দেখিল। বুঝিল, সেই মনে লোভ, ঈর্ষা, কাম, স্বার্থ ইত্যাদি সহস্র অতৃপ্তি ও কুপ্রবৃত্তি দেহি দেহি রব করিতেছে। তিনকড়ি পুণ্যের খাতিরে, যশের খাতিরে, গর্ব্বের বশে সেই ভাবগুলি ছাপাইয়া রাখিয়াছেন, অতৃপ্ত রাখিয়াছেন, চিত্ত হইতে তাড়াইয়া দেন নাই। এই সময় আবার কে হরিমোহনকে ধরিয়া তাড়াতাড়ি পরলোক ভ্রমণ করাইয়া আনিল। হরিমোহন হিন্দুর নরক, মুসলমানের নরক, গ্রীকদের নরক, হিন্দুর স্বর্গ, খৃষ্টানের স্বর্গ, মুসলমানের স্বর্গ, গ্রীকদের স্বর্গ, আর কত নরক, কত স্বর্গ দেখিয়া আসিল। তাহার পরে দেখিল, সে নিজ বাড়ীতে পরিচিত ছেঁড়া মাদুরে ময়লা তোসকে ভর দিয়া বসিয়া আছে, সন্মুখে শ্যামসুন্দর। বালক বলিল, “বড় রাত্রি হইয়াছে, বাড়ীতে না ফিরিলে সকলে আমাকে বকিবে, মারামারি আরম্ভ করিবে। সংক্ষেপে বলি। যে স্বর্গ নরক দেখিলে, সে স্বপ্নজগতের, কল্পনাসৃষ্ট। মানুষ মরিলে স্বর্গ নরকে যায়, গত জন্মের ভাব অন্যত্র ভোগ করে।
    • অরবিন্দ ঘোষ, স্বপ্ন, জগন্নাথের রথ - শ্রী অরবিন্দ, তৃতীয় সংস্করণ, প্রকাশক- শ্রী অরবিন্দ আশ্রম, প্রকাশস্থান- পণ্ডিচেরী, প্রকাশসাল- ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪৩-৪৪
  • বিষয়-সুখ যদি ধর্ম্মের লক্ষ্য হয়,তবে সে বিপরীত লক্ষ্য; সে লক্ষ্য সিদ্ধিতেও বিস্তর ব্যাঘাত। বিষয়-সুখ বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত হইয়াই ধর্ম্ম-পথে গমন করিতে হয়; আনুষঙ্গিক যদি বিষয়-মুখ রক্ষা পায়, তবে ভালই। ধর্ম্ম কিছু বিষয়-সুখের অনুচর নহে—কিন্তু ধর্মের অনুচর যদি বিষয়সুখ হয়, তবে তাহা অবশ্য সেব্য। আমরা আত্মসুখের জন্য ধর্ম্মকে প্রার্থনা করিলে সে কেবল স্বার্থপরতা মাত্র। স্বর্গের লোভে বা নরকের ভয়ে নিরাহারে দিন যাপন করাতে ধর্ম্ম হয় না। ধর্ম্মের ভাব নিঃস্বার্থ ভাব। বিষয়সুখ যে ধর্ম্মের অব্যর্থ পুরস্কার তাহা নহে; কিন্তু সুবিমল আত্ম-প্রসাদই ধর্ম্মের পুরস্কার,ঈশ্বর ধর্ম্মের শেষ পুরস্কার। ধর্ম্মের স্বর্গীয় জ্যোতির নিকটে স্বর্ণ রৌপ্য হীরকের পার্থিব জ্যোতি কোথায় থাকে? কেবল এক লক্ষ্যের দোষে ধর্ম্মকেও দূষিত মনে হয়। বিষয়-সুখই যাহার লক্ষ্য থাকে, সে পৃথিবীতে ধর্ম্মের হীনাবস্থা ও পাপের স্ফীতভাব দেথিয়া ঈশ্বরের অখণ্ড মঙ্গল স্বরূপেতেও দোষারোপ করিতে প্রবৃত্ত হয়।
    • দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস- দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তৃতীয় সংস্করণ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ (১২৭৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৬
  • ভাবিতে হয় এ জীবন প্রথম ঘৃণিত করিল কে? হইতে পারে কেহ কেহ স্বেচ্ছায় অন্ধকারে ডুবিয়া নরকের পথ পরিকার করে? কিন্তু আবার অনেকেই পুরুষের ছলনায় ভুলিয়া তাহাদের বিশ্বাস করিয়া চির কলঙ্কের বোঝা মাথায় লইয়া অনন্ত নরক যাতনা সহ্য করে। সে সকল পুরুষ কাহারা? যাঁহারা সমাজ মধ্যে পূজিত আদৃত তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ নন্ কি?
    • বিনোদিনী দাসী, আমার কথা (প্রথম খণ্ড) - বিনোদিনী দাসী, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩২০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১০৫-১০৬
  • বহু প্রাচীন যুগ থেকে একধরনের সুবিধাভোগীরা তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রচার করেছিল—তুমি এই জন্মে ত্যাগ স্বীকার কর, রাজাকে মান্য কর, পুরোহিতকে শ্রদ্ধা কর—মৃত্যুর পর তোমার আত্মার স্থান হবে স্বর্গে। এর অন্যথায় পতিত হবে নরকে। নরক ভোগের পরে তোমার আত্মা পৃথিবীতে ফিরে এসে আবার জন্ম নেবে, ভোগ করবে পূর্বজন্মের কর্মফল। কিন্তু, আজ পর্যন্ত কেউই স্বর্গে মৃতের আত্মাকে সুখ ভোগ করতে দেখেনি, দেখেনি আত্মাকে নরকের যন্ত্রণা ভোগ করতে। হাজার হাজার বছর ধরে আত্মা, পূর্বজন্মের কর্মফল, স্বর্গ নরক এইসব নিয়ে যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে তা একান্তভাবেই বিশ্বাসের ব্যাপার মাত্র। বাস্তবে স্বর্গ, নরক এবং আত্মা কোনওটারই অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি কারণ অস্তিত্ব নেই।
    • প্রবীর ঘোষ, অলৌকিক নয় লৌকিক (প্রথম খণ্ড) - প্রবীর ঘোষ, প্রকাশক- দে’জ পাবলিশিং, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- প্রকাশসাল ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ (১৪১৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩০৩
  • —না। জুয়ো হল অকর্মণ্য বড়লোকের খেলা, তোমার মতন নিঃস্বের কর্ম নয়। বেশ ভেবে চিন্তে বল— বিবেকের উপদ্রব আছে? নরকের ভয়? মিছে কথা বলতে বাধে? এসব থাকলে কিছুই হবে না বাপু!
    একটু ভেবে দিবাকর বলল, স্বর্গ নরক মানি না, তবে ধর্মভয় একটু আছে, চিরকালের সংস্কার কিনা। দরকার হলে অল্প স্বল্প মিছে কথাও বলি, প্র্যাকটিস করলে হয়তো অনর্গল বলতে পারব। দারিদ্র্য আর সইতে পারি না, এখন মরিয়া হয়ে উঠেছি। বাঁচতে চাই, তার জন্যে শয়তানের গোলাম হতেও রাজী আছি।
    • রাজশেখর বসু, মাৎস্য ন্যায়, চমৎকুমারী ইত্যাদি গল্প - পরশুরাম, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এণ্ড সন্স লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২১-২২
  • লোকে দেবতার পূজা করে না, পূজা করে দেবতারূপী ভয়কে। ভক্তি হ’ল ভয়ের একটা অংগ। ভক্তিভরে পাথরের দেবতার চরণসেবা করি কেন? অন্তিমে সুখশান্তি পাব বলেই। পেছনে রয়েছে নরকের সেই চিত্র দেখিয়ে দেয় স্বর্গের সুখশাস্তি। কল্পিত নরক যদি না সৃষ্টি করা হত, তবে কল্পনায় স্বর্গের সৃষ্টিও মানুষের দ্বারা হত না। হয়তো পূজারী ঠাকুরের কাছে মূর্তিমান নারকীয় জীব বলেই প্রতিপয় হয়েছিলাম, কিন্তু আমার সহায় ছিল রাজানুগ্রহ। সেজন্যই পূজারী আমার প্রতি মনে মনে ঘৃণার ভাব পোষণ করলেও বাইরে দেবতার মতই ভক্তি প্রদর্শন করতে বাধ্য হলেন।
    • রামনাথ বিশ্বাস, আফগানিস্থান ভ্রমণ - রামনাথ বিশ্বাস, তৃতীয়- সংস্করণ, প্রকাশক- অশোক পুস্তকালয়, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১০১
  • পুরাতন কয়েদীরা জানিত যে, জেলারের তর্জ্জন-গর্জ্জনকে যত না ভয়, সে চিবাইয়া চিবাইয়া মৃদু মৃদু কথা কহিলে তাহার অপেক্ষা অধিক ভয়। এই দুইজন কয়েদী সবে শ্রীঘরে শুভাগমন করিয়াছে, তাহারা সে-কথা কেমন করিয়া জানিবে? একজন দাঁত বাহির করিয়া রহস্য করিয়া বলিল,—এমন হয়েই থাকে, উদোর বোঝা অনেক সময় বুদোর ঘাড়ে পড়ে।
    জেলার আরও মৃদুস্বরে বলিল,—নরকে যাবার আগেই নরক কাকে বলে তোমরা জান্‌তে পারবে।
    জেলার চলিয়া গেল, কালীচরণও সেই সঙ্গে গেল।
    • নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, বন্দী, রথযাত্রা ও অন্যান্য গল্প - নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান প্রেস লিমিটেড , প্রকাশস্থান- প্রয়াগরাজ, প্রকাশসাল- ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৮ বঙ্গাব্দ),পৃষ্ঠা ২০১
  • মিল্‌টনের ন্যায় মধুসূদন দত্তও শীঘ্রই বুঝিতে পারিলেন যে, সাহিত্যে স্থায়ী আসন এবং যশোলাভ করিতে হইলে, তাঁহাকে মাতৃভাষাতেই কাব্য রচনা করিতে হইবে। তাহার ফলে তিনি বাংলা ভাষায় তাঁহার অমর কাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ দান করিয়া গিয়াছেন। অবশ্য, এই অমর কাব্যে স্বর্গ ও নরকের বর্ণনা এবং কয়েকটি চরিত্র চিত্রনে আমরা হোমর, ভার্জিল, দান্তে, তাসো, মিল্‌টন প্রভৃতি পাশ্চাত্য কবিদের ভাবের ছায়াপাত দেখিতে পাই।
    • প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আত্মচরিত- প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রকাশক- ওরিয়েণ্ট বুক কোম্পানি, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৯৬
  • মন নরককে স্বর্গে এবং স্বৰ্গকে নরকে পরিণত করিতে পারে। যদি আমরা মনে করিতে আরম্ভ করি যে, ইন্দ্রিয়সেবা দরকার, ইহা অনিষ্টকর অথবা পাপজনক নহে, তবে আমরা নিরন্তর ইহা তৃপ্তি করিতে চেষ্টা করিব এবং ইহাকে দমন করা অসম্ভব হইবে। পরন্তু যদি আমরা বিশ্বাস করিতে পারি যে, ইন্দ্রিয়সেবা অনিষ্টকর, পাপজনক এক অনাবশ্যক ও ইহা সংযত করা যায়, তবে আমরা দেখিব যে পূর্ণভাবে ইন্দ্রিয়দমন করা সম্ভব।
    • মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, দুর্নীতির পথে - মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, অনুবাদক- বিনয়কৃষ্ণ সেন, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪৪
  • আজ দু তিন বৎসর ধ’রে মাসিমা তাঁকে কথা দিয়ে রেখেছেন, তিনি তোমার জন্য নিজের প্রাণোৎসর্গ ক’রে মানুষ হবার চেষ্টা করছেন। এখন হঠাৎ এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা কর‍্লে সে কি ধর্ম্মেই সইবে?” সুমিত্রা হঠাৎ সেলাইটা ফেলিয়া দিয়া বোনের কাঁধে মুখ লুকাইল। “কলী, চুপ কর ভাই! তাঁকে বলিস, দিদি তার বাপ মাকে রক্ষা করবার জন্য আত্মবলি দিয়েছে। জীবনে যে নরক যন্ত্রণা সইতে যাচ্চে, তার মরণের পরে নরকের ভয় কোথা?” কল্যাণী চুপ করিয়া রহিল।
    • অনুরূপা দেবী, অযাচিত, মধুমল্লী - অনুরূপা দেবী, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৪ বঙ্গাব্দ),পৃষ্ঠা ১১৪-১১৫

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]