নিকিতা খ্রুশ্চেভ
নিকিতা সের্গেইভিচ খ্রুশ্চেভ (১৭ এপ্রিল ১৮৯৪ – ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১) ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। তিনি ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সচিব ছিলেন এবং ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মন্ত্রীপরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর শাসনকাল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে যেহেতু তিনি জোসেফ স্ট্যালিনের অপরাধ ও একনায়কতন্ত্রের প্রকাশ্য সমালোচনা করে গোটা কমিউনিস্ট বিশ্বকে বিস্মিত করেছিলেন। তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী আনাস্তাস মিকোয়ানের সঙ্গে মিলে "ডি-স্ট্যালিনাইজেশন" নীতি বাস্তবায়ন করেন, যার মাধ্যমে সোভিয়েত সমাজে উদারনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা ঘটে।
খরুশ্চেভ সোভিয়েত মহাকাশ কর্মসূচির সূচনালগ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থায় কিছু প্রগতিশীল সংস্কার চালু করেন। তবে তাঁর কিছু অবিচক্ষণ সিদ্ধান্ত—বিশেষ করে কিউবা সংকটের সময় পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা—তাঁর নেতৃত্বের ওপর প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে শীতল যুদ্ধের উত্তেজনা হ্রাসে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তবু তাঁর স্বভাবগত তীব্রতা এবং নীতিনির্ধারণে অস্থিরতার কারণে, ক্রেমলিনের শীর্ষ নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত তাঁকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে। তাঁর স্থানে লিওনিদ ব্রেজনেভ প্রথম সচিব এবং আলেক্সি কোসিগিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োজিত হন।
উক্তি
[সম্পাদনা]- অনেকেই মন্তব্য করেন যে সোভিয়েত প্রতিনিধিরা সর্বদাই হাস্যমুখ। কিন্তু সেই হাসি আসল—কৃত্রিম নয়। আমরা শান্তি ও প্রশান্তির সাথে বসবাস করতে চাই। কিন্তু যদি কেউ বিশ্বাস করে যে আমাদের এই হাসির মধ্যে মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনের শিক্ষাকে পরিত্যাগ করা হয়েছে, তাহলে সে নিজেকেই প্রতারণা করছে।
- মস্কোতে সফররত পূর্ব জার্মান বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জন্য এক নৈশভোজে তাৎক্ষণিক ভাষণ (১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৫), দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস (১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৫), পৃ. ১৯-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী।
- হ্যাঁ, আজ আমাদের এখানে প্রকৃত রুশ অভিমুখী হাওয়া বিরাজ করছে। গতকাল পর্যন্ত আবহাওয়া ছিল ছিল সুইডিশ অভিমুখী। আমি বুঝতে পারছি না কেন রুশের আবহাওয়া তোমাদের এত খারাপ লাগে। সম্ভব তোমরা ন্যাটোর সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশী হওয়ার কারনেই এই কথা মনে হয়।
- ১৩ মার্চ ১৯৫৬, মস্কোতে শুরু হওয়া সুইডিশ-সোভিয়েত শীর্ষ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য। পরবর্তীতে স্টেনোগ্রাফ করা আলোচনাটি সুইডিশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত হয়। উদ্ধৃতি: এরিক সজোকুইস্ট, রাউল ওয়ালেনবার্গ (১৯৮৫), পৃষ্ঠা ১১৯, আইএসবিএন 9153650875।
- তুমি পছন্দ করো বা না করো, ইতিহাস আমাদের পক্ষে। আমরা তোমাকে কবর দেব।
- মস্কোতে কূটনৈতিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের প্রতি মন্তব্য (১৮ নভেম্বর, ১৯৫৬)। উদ্ধৃতি: নিকিতা খরুশ্চেভের স্মৃতিকথা: স্টেটসম্যান, ১৯৫৩–১৯৬৪, পেন স্টেট প্রেস, ২০০৭, পৃষ্ঠা ৮৯৩।
- যখন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা আসে, তখন আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি—আমরা সবাই স্তালিনবাদী। আমরা এই বিষয়ে গর্ব করতে পারি যে আমরা আমাদের মহান লক্ষ্যে পৌঁছাতে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি গর্বিত যে আমি একজন স্তালিনবাদী।
- ক্রেমলিনে নববর্ষের প্রাক্কালে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে করা মন্তব্য ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫৬ সাল। উদ্ধৃতি: এডওয়ার্ড ক্র্যাঙ্কশ, আইএসবিএন 9781448205059।
- আমি এটা শুনে খুব খুশি হলাম। যেহেতু আমি ইউক্রেন থেকে এসেছি; তাই এখন থেকে আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারব। আমি অবিলম্বে আমার মেয়েকে কিয়েভে একটি টেলিগ্রাম বার্তা পাঠাব।
- সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী এরল্যান্ডার যখন খ্রুশ্চেভকে আশ্বস্ত করেন যে তাদের ১৭০৯ সালে সুইডেন ও ইউক্রেনের মধযে সংঘটিত পোলতাভার যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি করার কোনো ইচ্ছা নেই, তখন খ্রুশ্চেভ এই মন্তব্য করেন। ১৯৫৬ সালের ৩০শে মার্চ মস্কোতে শুরু হওয়া সুইডিশ-সোভিয়েত শীর্ষ সম্মেলন থেকে এই বার্তা দেওয়া হয়। রাউল ওয়ালেনবার্গ (১৯৮৫)-এ এরিক সজোকুইস্টের উদ্ধৃতি, পৃষ্ঠা ১২৫, আইএসবিএন 9153650875।
- যদি অ্যাডেনাওয়ার আমাদের সঙ্গে সাউনায় থাকতেন, তাহলে তিনিও নিজের চোখে দেখতে পেতেন যে জার্মানি বিভক্ত ছিল এবং বিভক্তই থাকবে। তবে জার্মানি আর কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেনা।
- সূত্র: ১৯৫৭ সালের জুন মাসে ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি উরহো কেক্কোনেন-এর সঙ্গে গভীর রাতে একটি সাউনা পরিদর্শনের সময় খরুশ্চেভের মন্তব্য। উদ্ধৃত: ম্যাক্স জ্যাকবসন, ভোলদেতস ওরহুন্দ্রেদে (২০০১), পৃষ্ঠা ২২০, আইএসবিএন 9174866389।
- গুরুতর অসুস্থ একজন রুগ্ন মানুষের ডাক্তাররা প্রথমে ধীরে ধীরে চিকিৎসা করেন। তাকে অল্প পরিমাণে খাবার দেওয়া হয়। যদি তাকে হঠাৎ অতিরিক্ত খাওয়ানো হয় তবে তার মৃত্যু হতে পারে। ঠিক তেমনি আমরা নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া পূর্ণমাত্রায় শুরু করতে চাই না—যদিও আমরা তার জন্য প্রস্তুত। আমি ইতোমধ্যে বলেছি, পশ্চিমা শক্তিগুলো আমাদের প্রতি অতিরিক্ত অবিশ্বাস করে। আমরাও সব বিষয়ে তাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি না। এই কারণেই মানবজাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়—নিরস্ত্রীকরণ-ধ্বংস হওয়া উচিত নয়। আমরা কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত দিয়ে নয়, বরং ধাপে ধাপে নিরস্ত্রীকরণের সমস্যার সমাধান শুরু করার প্রস্তাব দিচ্ছি।
- সূত্র: ইভেরাক ম্যাকডোনাল্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, দ্য টাইমস, লন্ডন (জানুয়ারি ১৯৫৮)।
- মাঝে মাঝে আমার মনে এক অস্বস্তিকর চিন্তা ঘুরপাক খায়—হয়তো খ্রুশ্চেভকে এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এই উদ্দেশ্যে যে, তোমরা তাকে তোমাদের রুচি ও সংস্কৃতিতে মিলিয়ে দিতে পারো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ও সামর্থ্য প্রদর্শন করে তাকে একরকমভাবে চমকে দিতে পারো—যাতে সে আতঙ্কে তার হাঁটুতে কেঁপে ওঠে। যদি তাই হয় তবে যেহেতু এখানে আসতে আমার প্রায় বারো ঘণ্টা লেগেছে, আমার মনে হয়, ফিরে যেতে সাড়ে দশ ঘণ্টার বেশি লাগবে না।
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁর প্রতি শীতল অভ্যর্থনা নিয়ে খ্রুশ্চেভের মন্তব্য।[১]
- আমি সম্প্রতি আমেরিকান পারমাণবিক পদার্থবিদ ডব্লিউ. ডেভিডসনের একটি মন্তব্য পড়েছি, যেখানে তিনি বলেছিলেন, একটি হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ মানব ইতিহাসে সকল যুদ্ধে সংঘটিত সকল বিস্ফোরণের চেয়েও অধিক শক্তি নির্গত করে। এবং তিনি নিঃসন্দেহে ঠিকই বলেছেন।
- জাতিসংঘে ভাষণ, নিউ ইয়র্ক সিটি (১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৯ সাল), দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ১৯ সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী যে পদার্থবিদের উল্লেখ খ্রুশ্চেভ করেন, তার পুরো নাম উইলিয়াম ডেভিডন। তিনি ইলিনয়ের লেমন্টে আর্গোন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির সহযোগী পদার্থবিদ ছিলেন।
- আমরা এমন এক শহরে এসেছি, যেখানে আমেরিকার অন্য্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা বাস করেন। … কিন্তু এখন আমাকে বলা হয়েছে যে আমি ডিজনিল্যান্ডে যেতে পারবো না। আমি জিজ্ঞাসা করেছি, কেন আমি সেখানে যেতে পারবনা? সেখানে কি রকেট উৎক্ষেপণের মঞ্চ আছে? আমি কিছুই জানি না। শুনুন আমাকে ঠিক কী বলা হয়েছে। আমেরিকান কর্তৃপক্ষ আমায় বলছে, "তুমি যদি সেখানে যাও, তবে আমরা তোমার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারবো না।" এটা কিধরনের কথা? সেখানে কি কলেরার মহামারী ছড়িয়েছে? নাকি সন্ত্রাসীরা সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে? তাহলে আমি কী করব? আত্মহত্যা করব? … আমার কাছে এ অবস্থা অকল্পনীয়। আমি আমার জনগণের কাছে এই ঘটনাটি কীভাবে ব্যাখ্যা করব, সেটাই বুঝতে পারছি না।
- হলিউডে মধ্যাহ্নভোজের সময় খ্রুশ্চেভের মন্তব্য (১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৯ সাল), নিউ ইয়র্ক টাইমস (২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৯ সাল)-এর স্কৌরাসের সাথে খ্রুশ্চেভের বিতর্ক শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে।
- মি. প্রেসিডেন্ট, অনুগ্রহ করে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের চাটুকারদের থামানোর নির্দেশ দিন।
- সূত্রঃজাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নিকিতা খ্রুশ্চেভের মন্তব্য (১২ অক্টোবর, ১৯৬০ সাল); ফিলিপাইনের প্রতিনিধি লরেঞ্জো সুমুলং -এর বক্তৃতার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তিনি এই মন্তব্য করেন।
- মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে বিশ্বের ভবিষ্যৎ এবং যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আপনার তেমন কোনও উদ্বেগ নেই। কিন্তু যুদ্ধ আপনাকে কী দেবে? আপনি আমাদের যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছেন, অথচ আপনি ভালো করেই জানেন যে, আপনি যদি যুদ্ধ শুরু করেন তাহলে যে পরিণতি আমাদের হবে সেই একই পরিণতি আপনাদেরও \ হবে। এই কথা আমাদের সকল বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, যাদের উপর কর্তৃত্ব, আস্থা ও গুরুদায়িত্বভার অর্পিত তাদের পরিষ্কারভাবে বোঝা উচিত। আমাদের ক্ষণস্থায়ী লোভ-লালসা বা আবেগপ্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ যাই হোক না কেন, এসব তুচ্ছ বিষয়। কিন্তু যদি সত্যিই যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে সেটিকে থামানো আমাদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না—কারণ যুদ্ধের নিজেরই একটা নির্মম যুক্তি আছে। আমি নিজে দুটি যুদ্ধ দেখেছি এবং জানি—যুদ্ধ কখনও শেষ হয় না, যতক্ষণ না তা শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, সর্বত্র মৃত্যু ও ধ্বংসের বীজ ছড়িয়ে দেয়। … যদি মানুষ প্রজ্ঞা না দেখায় তাহলে শেষ পর্যন্ত তারা অন্ধ তিলের মতো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে—এবং তার ফলাফল হবে পারস্পরিক ধ্বংস।
- জন এফ. কেনেডির কাছে খ্রুশ্চেভের টেলিগ্রাম (২৬ অক্টোবর, ১৯৬২ সাল)
- এখন আমাদের উচিত, আমরা যারা এই যুদ্ধের দড়িতে গিঁট বেঁধেছি, সেই দড়ির দুই প্রান্ত ধরে আর না টানা। কারণ যত বেশি টানবো, এই গিঁট ততই শক্ত হয়ে যাবে। এমন একটি মুহূর্ত আসতে পারে যখন এই গিঁট এতটাই শক্ত হয়ে যাবে যে যিনি একে বেঁধেছেন, তিনিও আর তা খুলতে পারবেন না। তখন একে কেটে ফেলাই একমাত্র উপায় থাকবে। আর এই গিঁট কাটার মানে কী, তা আমাকে আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না—আপনি নিজেই জানেন, আমাদের দেশগুলো কী ভয়াবহ ধ্বংসক্ষমতা ধারণ করে। অতএব, যদি সত্যিই কোনও পক্ষের লক্ষ্য না হয় এই গিঁট আরও শক্ত করে বিশ্বকে উত্তপ্ত পরমাণু যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া, তাহলে আসুন আমরা পারস্পরিক এই ক্ষমতার প্রতিযোগীতা বন্ধ করি এবং গিঁটটি খোলার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিই। আমরা তার জন্য প্রস্তুত।
- জন এফ. কেনেডির কাছে খ্রুশ্চেভের টেলিগ্রাম (২৬ অক্টোবর, ১৯৬২ সাল)
- তুমি কি ছবি আঁকতে পারো না? আমার নাতিও এর চেয়ে ভালো আঁকে! এটা কী? তোমরা কি আসলে পুরুষ, নাকি নেহাত পথচারী? এমন ছবি কীভাবে আঁকো? তোমার বিবেক কোথায়?
- ১৯৬২ সালের ১ ডিসেম্বর তারিখে এক শিল্প প্রদর্শনী পরিদর্শনের সময় শিল্পী এলি বিলুটিন ও আর্নস্ট নেইজভেস্তনির উদ্দেশ্যে খ্রুশ্চেভের মন্তব্য।
- রাজনীতিবিদরা সব দেশেই একরকম—তারা এমন জায়গাতেও সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়, যেখানে কোনও নদীই নেই।
- বেলগ্রেডে একটি সেতু নির্মাণ নিয়ে খ্রুশ্চেভের মন্তব্য (২২ আগস্ট, ১৯৬৩ সাল); শিকাগো ট্রিবিউন পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত।
- বার্লিন হলো পশ্চিমা বিশ্বের অণ্ডকোষের মতো। যখনই আমি পশ্চিম বিশ্বের আর্তনাদ শুনতে চাই, তখন আমি বার্লিনের উপর চাপ প্রয়োগ করি।
- ২৪ আগস্ট, ১৯৬৩ সালে, যুগোস্লাভিয়ায় এক ভাষণে উদ্ধৃত[উৎস প্রয়োজন]।
- যদি তুমি আমার দিকে সজারু ছুঁড়ে মারো, তাহলে আমি প্রতিক্রিয়াশ্বরূপ তোমার দিকে দুটো সজারু ছুঁড়ে দেব।
- দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস -এ উদ্ধৃত, (৭ নভেম্বর ১৯৬৩ সাল)।
- আমার মনে আছে, প্রেসিডেন্ট কেনেডি একবার বলেছিলেন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এত পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র আছে যে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে দুবার নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে, অথচ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে এত অস্ত্র নেই, তারা মাত্র একবারই আমেরিকাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে। সাংবাদিকেরা তখন আমার মন্তব্য জানতে চাইল। আমি তখন মজা করে বলেছিলাম, “হ্যাঁ, আমি জানি কেনেডি কী বলেছেন, আর তিনি একদম ঠিক বলেছেন। কিন্তু আমি এতে অভিযোগ করছি না। আমরা যদি একবারেই আমেরিকাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি সেটাই যথেষ্ট। একটি দেশকে দুবার নিশ্চিহ্ন করার দরকার কী? আমরা রক্তপিপাসু নই।”
- খ্রুশ্চেভ রিমেম্বার্স: দ্য লাস্ট টেস্টামেন্ট (১৯৭৪) -এ উদ্ধৃত_
- আমার হাত কনুই পর্যন্ত রক্তে ভেজা। আমার আত্মার উপরে এটাই সবচেয়ে ভয়ানক বোঝা।
- সোভিয়েত নাট্যকার নিকোলাই শতরভকে উদ্দেশ্য করে বলা খ্রুশ্চেভের মন্তব্য; উইলিয়াম টাউবম্যান, খ্রুশ্চেভে: দ্য ম্যান অ্যান্ড হিজ এরা (নিউ ইয়র্ক: ডব্লিউডব্লিউ নর্টন, ২০০২) -এ উদ্ধৃত করা হয়েছে।
সিপিএসইউ-এর ২০তম পার্টি কংগ্রেসে গোপন প্রতিবেদন থেকে
[সম্পাদনা]নিম্নলিখিত বক্তব্য দ্যা কাল্ট অফ ইন্ডিভিজুয়াল অ্যান্ড ইটস্ কন্সিকোয়েন্স (২৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৬) থেকে উদ্ধৃত।
- কমরেডগণ!আমাদের অবশ্যই ব্যক্তি-অর্চনার প্রথাকে চিরতরে নির্মূল করতে হবে।
- স্ট্যালিনের গুণাবলির ওপর তাঁর জীবদ্দশাতেই বিপুল সংখ্যক বই, পুস্তিকা ও গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নে, গৃহযুদ্ধের সময় এবং আমাদের দেশে সমাজতন্ত্র নির্মাণের সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা সর্বজনবিদিত।
- স্ট্যালিনিস্ট লিগ্যাসি (১৯৮৪)
- যখন আমরা দল ও দেশের দিকনির্দেশনা নির্ধারণে স্ট্যালিনের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করি, তখন আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে লেনিনের আশঙ্কা অমূলক ছিল না। স্ট্যালিনের যেসব নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য লেনিনের সময়ে কেবল প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল, সেগুলো পরবর্তী বছরগুলোতে গুরুতর ক্ষমতার অপব্যবহারে পরিণত হয়, যার ফলে দল ও রাষ্ট্রে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
- স্ট্যালিন জনগণের সাথে বোঝাপড়া, ব্যাখ্যা ও ধৈর্যের মাধ্যমে কাজ করেননি; বরং তিনি তাঁর ধারণা জোরপূর্বক চাপিয়ে দিতেন এবং নিজের মতের প্রতি অন্ধ আনুগত্য দাবি করতেন। কেউ তাঁর মতের বিরোধিতা করলে কিংবা যুক্তি দিয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলে, তাকেই নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হতো এবং নৈতিক ও শারীরিকভাবে ধ্বংস করে ফেলার জন্য তাকে চিহ্নিত করা হতো।
- আমাদের নিশ্চিতভাবে বুঝতে হবে যে, ট্রটস্কিবাদী, ডানপন্থী ও বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াই ছিল কঠোর এবং এটি লেনিনবাদের সকল শত্রুকে আদর্শিকভাবে নিরস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। এই আদর্শিক সংগ্রাম সফলভাবে পরিচালিত হয়েছিল, যার ফলে দল আরও সুসংহত ও শক্তিশালী হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে স্ট্যালিন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
- "স্ট্যালিন জনগণের শত্রু" -এই ধারণার জন্ম স্ট্যালিন নিজেই দেন। এই শব্দটি এমনভাবে ব্যবহৃত হতো যাতে কোনো মতভেদ বা আদর্শিক ত্রুটি প্রমাণের আর প্রয়োজন থাকতনা। বিপ্লবী ন্যায়বিচারের সমস্ত নিয়ম লঙ্ঘন করে, এই একটি শব্দ। স্ট্যালিন তাঁর যেকোন বিরোধীদের বিরুদ্ধে হোক না সে কেবল সন্দেহভাজন, দুর্নামপ্রাপ্ত বা ভিন্নমতাবলম্বী, তাদে উপর নৃশংস দমন-পীড়ন চালাতে পারতেন। "জনগণের শত্রু" ধারণাটি মূলত যেকোনো আদর্শিক বিতর্ক কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কার্যত অবসান ঘটিয়ে দিয়েছিল। এমনকি বর্তমান আইনতত্ত্বের নিয়ম অনুসারে অপরাধ প্রমাণের যে পদ্ধতি থাকা উচিত, সেটিও নস্যাৎ হয়ে যায়—কারণ একমাত্র প্রমাণ হয়ে দাঁড়াত অভিযুক্ত ব্যক্তির নিজের স্বীকারোক্তি।
- যখন ফ্যাসিস্ট বাহিনী সোভিয়েত ভূখণ্ডে আক্রমণ করেছিল এবং সামরিক অভিযান শুরু হয়েছিল তখন মস্কো থেকে জার্মানদের আক্রমণের জবাব না দেওয়ার নির্দেশ জারি হয়। কেন? কারণ, যথাযথ গোয়েন্দা তথ্য থাকা সত্ত্বেও, স্ট্যালিন বিশ্বাস করতেন যুদ্ধ শুরু হয়নি। এটা কেবলমাত্র জার্মান সেনাবাহিনীর কিছু অংশের একটি উসকানিমূলক পদক্ষেপ ছিল। তিনি মনে করতেন পাল্টা জবাব দিলে সেটিই প্রকৃত যুদ্ধ শুরুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ভুলভাবে আরোপিত
[সম্পাদনা]- জীবিতরা মৃতদের ঈর্ষা করবে।
- পারমাণবিক যুদ্ধের প্রসঙ্গে এই বিখ্যাত উক্তিটি প্রায়ই নিকিতা খ্রুশ্চেভের নামে প্রচারিত হলেও, তাঁর কোনও লিখিত রচনা বা নথিভুক্ত বক্তব্যে এর কোনও প্রত্যক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায় না—যেমনটি রেস্পেক্টফুলি কোটেড: আ ডিকশিওনারী অফ কোটেশন (১৯৮৯) গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে।হারমান কান তাঁর ১৯৬০ সালের প্রভাবশালী গ্রন্থ অন থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ার-এ প্রথম এই বাক্যাংশ ব্যবহার করেন। রাশিয়ায় এই বাক্যটির সাধারণ উৎস হিসেবে ধরা হয় নিকোলাই চুকভস্কি অনূদিত ট্রেজার আইল্যান্ড গ্রন্থের একটি বাক্যকে, যার আক্ষরিক অর্থ হল; "তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, তারা মৃতদের হিংসা করবে"। এর মূল ভাবটি আরও সহজভাবে বোঝানো যায় এই বাক্যের মাধ্যমে- "যারা মৃত্যুবরণ করবে, তারাই ভাগ্যবান।"[২] এই ধারণাটি ধর্মীয় পাঠেও প্রতিফলিত হয়েছে যার একটি নিদর্শন বাইবেলের একটি উক্তিতে দেখা যায়; যেটি হল; "যারা অবশিষ্ট থাকবে, তারা জীবন অপেক্ষা মৃত্যুকেই বেছে নেবে।"
- আমরা আমেরিকানদের নিকট এই আশা করতে পারিনা যে তারা পুঁজিবাদ ত্যাগ করে সরাসরি কমিউনিজম গ্রহণ করবে। কিন্তু আমরা তাদের নির্বাচিত নেতাদের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের সামান্য আস্বাদ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি—যতক্ষণ না তারা ঘটনাবশত নিজে থেকেই সচেতন হয়ে বুঝতে পারছে যে তাদের মধ্যে ইতিমধ্যেই কমিউনিজমের চেতনা বর্তমান রয়েছে।
- এই উদ্ধৃতিটিও প্রায়শই খ্রুশ্চেভের নামে প্রচার করা হয়, বিশেষ করে ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের কয়েক মাস আগে তিনি এই বক্তব্য রাখেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু লাইব্রেরি অব কংগ্রেস এবং ইউ.এস. ইনফরমেশন এজেন্সি-র তৎকালীন তদন্তে এর কোনও নির্ভরযোগ্য উৎস পাওয়া যায়নি। তবে, জানা যায় যে ক্রুশ্চেভ এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অল্পমাত্রিক সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম প্রয়োগের কথা বলেছিলেন, যেখান থেকে এই ভুল উদ্ধৃতির উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। এ বিষয়ে মরিস কে. উদালের "খ্রুশ্চেভ কুড হ্যাভ সেড ইট" শিরোনামের বিশ্লেষণটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
খ্রুশ্চেভ সম্পর্কে উক্তি
[সম্পাদনা]- ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে এক পলিটব্যুরো সদস্য খ্রুশ্চেভকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন। এ ই পদক্ষেপের পেছনে কারণ ছিল সুয়েজ, বার্লিন এবং কিউবা সংকটের প্রতি তাঁর কঠোর মনোভাব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহাবস্থানের জন্য তাঁর অস্থির প্রচেষ্টার বিরোধিতা। নয় বছরের শাসনকালে খ্রুশ্চেভ এক অসম্ভব কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন। স্ট্যালিনবাদের দমনমূলক উপাদান ভাঙতে গিয়ে তিনি কখনও কখনও স্ট্যালিনবাদী কৌশলই অবলম্বন করেছিলেন, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপে গণ-আন্দোলন দমনে। তিনি বৈশ্বিক কমিউনিস্ট ঐক্য গঠনের চেষ্টা করেচগিলেন কিন্তু চীনে মাওয়ের নেতৃত্বাধীন এক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীতার মুখোমুখি হন। একই সময়ে, তৃতীয় বিশ্বের দেশে মার্কসবাদ-লেনিনবাদী বিপ্লবী আন্দোলন পুনর্জীবিত করার প্রয়াসে তিনি শুধুই ওয়াশিংটনের উদ্বেগ বাড়াননি, বরং এমন কিছু জাতীয়তাবাদী নেতাকেও সমর্থন করেন, যারা নিজের দেশের বামপন্থীদের বন্দি করেছিল। খ্রুশ্চেভ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ন্যাটো সংগঠন ভেঙে ফেলার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন, তখন তাঁর আগ্রাসী ভাষা ও পারমাণবিক হুমকি পশ্চিমা বিশ্বকে আরও ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। যদিও বয়স ও স্বভাবের দিক থেকে দুজনের বেশ পার্থক্য ছিল, তবুও কেনেডি ও খ্রুশ্চেভ—দুজনই কট্টর শীতল যুদ্ধের সৈনিক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এরা বিশ্ব রাজনীতির রূপান্তরকে কেবল আংশিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। এই পরিবর্তন পরাশক্তিদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ক্রমশ কমিয়ে দিতে শুরু করেছিল। তাঁদের উত্তরসূরীরা, যারা কূটনীতিতে অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ এবং অভ্যন্তরীণ সংস্কারে বেশি মনোযোগী ছিলেন, তারা বার্লিন ও কিউবা-পরবর্তী যুগের পরাশক্তিদের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাসে উদ্যোগী হয়ে একটি শূন্যতার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন।
- ক্যারোল সি. ফিঙ্ক, কোল্ড ওয়ার: অ্যান ইন্টারন্যাশনাল হিস্ট্রী(২০১৭), পৃ. ১১৫
- চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্ব এই সময় রাজনৈতিক ভূদৃশ্যকে নাটকীয়ভাবে রূপান্তরিত করে। ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে, চীনের পারমাণবিক কর্মসূচিতে মস্কোর সহযোগিতা না পেয়ে অসন্তুষ্ট মাও সেতুং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতিকে ত্যাগ করেন এবং বিপ্লবী যুদ্ধের পথেই ফেরার আহ্বান জানান। তাঁর ব্যর্থ গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড কর্মসূচি ও প্রতিবেশীদের প্রতি আগ্রাসী মনোভাবের সমালোচক খ্রুশ্চেভ আচমকাই ১৯৬০ সালে চীন থেকে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাহার করেন এবং আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা কমিয়ে দেন। ১৯৬১ সালের অক্টোবরে বাইশতম পার্টি কংগ্রেসে চীন-সোভিয়েত বিভাজন প্রকাশ্যে আসে। পরবর্তীতে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটে খ্রুশ্চেভের নতিস্বীকারকে মাও তীব্রভাবে উপহাস করেন। একই সময়ে, ১৯৬২ সালের চীন-ভারত সীমান্ত সংঘাতে মস্কোর দিল্লিমুখী অবস্থান নিয়ে চীন তীব্র আপত্তি তোলে। ১৯৬৩ সালের পারমাণবিক পরীক্ষা নিষেধাজ্ঞা চুক্তিকেও চীন তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বন্ধ করার একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখায়। ১৯৬৩ সালের শেষ নাগাদ এই দুই কমিউনিস্ট দৈত্য (চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন) এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার বিপ্লবী আন্দোলনগুলির নেতৃত্বের প্রশ্নে প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়ে।
- ক্যারোল সি. ফিঙ্ক, কোল্ড ওয়ার: অ্যান ইন্টারন্যাশনাল হিস্ট্রী(২০১৭), পৃ. ১২৫
- আমাদের অপরাধ একটাই—আমরা বুখারেস্টে একমত হইনি যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মতো একটি ভ্রাতৃপ্রতিম দলকে অন্যায়ভাবে নিন্দা করা উচিত। আমাদের অপরাধ এটুকুই যে, আমরা সাহস করে প্রকাশ্যে কমরেড খ্রুশ্চেভের অন্যায্য অবস্থানের বিরোধিতা করেছি এবং তা জনবহুল কোন বাজারে নয় বরং একটি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সভায়। আমাদের অপরাধ এটাও যে, আমরা একটি ছোট ও দরিদ্র দেশের ছোট একটি পার্টি—যাদের কেবল উর্দ্ধতনদের প্রশংসা করাই শোভন বলে অনেকে মনে করেন, কিন্তু নিজস্ব মত প্রকাশের অধিকার তাদের নেই। কিন্তু এই অবস্থান মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পরিপন্থী। এই মতবাদ আমাদের স্পষ্টভাবে মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে এবং আমরা এই অধিকার ত্যাগ করব না—না রাজনৈতিক চাপের মুখে, না অর্থনৈতিক হুমকির কারণে, না অবমাননাকর অপবাদে। এই প্রসঙ্গে আমরা কমরেড খ্রুশ্চেভকে জিজ্ঞেস করতে চাই—তিনি কেন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আমাদের উদ্দেশ্যে বিবৃতি দিয়েছেন? তিনি কি মনে করেন, আলবেনিয়ার শ্রমিক পার্টির নিজের কোনো অবস্থান নেই এবং চীনের সঙ্গে কেবল অন্ধ সমর্থনে যুক্ত? না, কমরেড খ্রুশ্চেভ, আপনি আমাদের ভুল বুঝছেন। আলবেনিয়ার লেবার পার্টির একটি স্বাধীন মতামত আছে, এবং তারা শুধু নিজেদের জনগণের কাছেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ও শ্রমিক আন্দোলনের কাছেও দায়বদ্ধ। আমরা যুগোস্লাভদের মতো নই—আপনারাই বরং আমাদের বিরুদ্ধে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বাইরে গিয়ে আচরণ করেছেন। আপনারা আলবেনিয়াকে কেবলমাত্র একটি বস্তু হিসেবে দেখেন যা কেবল অর্জন করা যায় বা হারানো যায়। একসময় অনেকে ভেবেছিলেন, আলবেনিয়ার অস্তিত্ব টিকে থাকবে কি না, তা তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু সেই যুগ শেষ—আজ আমাদের দেশে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নীতি প্রতিষ্ঠিত। যখন আপনি মনে করেন আলবেনিয়াকে হারিয়ে দিয়েছেন তখন আপনি আমাদের সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবেই স্বীকার করেন না। আপনার ৮ নভেম্বরের চিঠিতেও এ কথার প্রতিফলন দেখা গেছে—সেখানে আলবেনিয়াকে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবেই উল্লেখ করা হয়নি।
- এনভার হোজা, "সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিশতম কংগ্রেসের সংশোধনবাদী থিসিস এবং খ্রুশ্চেভের গ্রুপের মার্কসবাদ-বিরোধী অবস্থান প্রত্যাখ্যান করুন! মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে সমুন্নত রাখুন" আলবেনিয়ার শ্রমিক পার্টির প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে, মস্কোতে ৮১টি কমিউনিস্ট ও শ্রমিক পার্টির বৈঠকের প্রাক্কালে প্রদত্ত ভাষণ, ১৬ নভেম্বর ১৯৬০ সাল।
- নিকিতা খ্রুশ্চেভ ছিলেন একজন কঠিন মানুষ, যার সঙ্গে আচরণ করা সহজ ছিল না—তিনি প্রায়শই কঠোর ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তবে তাঁর ভেতরের কৃষকসুলভ দিকটি তাঁকে কথোপকথনে সপ্রতিভ ও ধূর্ত করে তুলত, এবং একইসঙ্গে তাকে এক ধরনের আকর্ষণীয়তাও দিত।
- মুহাম্মদ রেজা পাহলভি, দ্যা শাহ'স স্টোরি, পৃষ্ঠা ১৪২ (১৯৮০)
- কমরেড খ্রুশ্চেভ প্রায়ই বলেন, "আমেরিকান গম দিয়ে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা যায় না।" আমার মতে, কেউ যদি জানে কীভাবে সমাজতন্ত্র গড়ে তুলতে হয়, তবে সে তা অন্যের গম দিয়েও করতে পারে। আর কেউ যদি না জানে, তবে নিজের গম দিয়েও তা সম্ভব নয়। তিনি বলেন আমরা সাম্রাজ্যবাদীদের দানের উপর নির্ভর করে টিকে আছি... তবে যিনি নিজেই আমেরিকার সঙ্গে একটি অর্থনৈতিক চুক্তি করতে চেয়েছিলেন, তাঁর কী নৈতিক অধিকার আছে আমাদের, যারা মার্কিন সহায়তা গ্রহণ করেছে তাদের তিরস্কার করার?
- জোসিপ ব্রোজ টিটো, উদ্ধৃত: জ্যাসপার রিডলি, টিটো: আ বায়োগ্রাফি, পৃষ্ঠা ৩৪৮–৩৪৯ (১৯৯৪)
- বক্তা হিসাবে তিনি ছিলেন একজন মনোমুগ্ধকর মানুষ
- জন চার্লস ডেলি, হোয়াটস মাই লাইন?, ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯।[৩]
- আমাদের সকল গণতান্ত্রিক জাতির মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য আকুল। আমরা কেউ কেউ গত বিশ বছর যুদ্ধ বা তার ছায়ায় কাটিয়েছি। এখন তারা কিছুটা স্বস্তি চায়। কিছু যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রচলিত সামরিক শক্তিকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে, ফলে সামরিক খাতে ব্যয় একধরনের অপচয়। আবার কেউ বলে হাইড্রোজেন বোমার বিপর্যয় এমনই যে যুদ্ধ কার্যত অসম্ভব—কারণ উভয় পক্ষই ধ্বংস হবে। এইসব যুক্তির ফলে অনেকেই মিথ্যা নিরাপত্তার অনুভূতিতে আশ্বস্ত হয়ে পড়তে পারে, যা তাদের প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা থেকে বিরত রাখবে। আমাদের তাই সতর্ক থাকতে হবে, যেন আমরা ক্রেমলিনের হাস্যময়তার অতিরিক্ত কিছু মানে না বের করে ফেলি। স্বয়ং মি. খ্রুশ্চেভও আমাদের সর্তক করেছিলেন। সম্প্রতি এক ভোজসভায় তিনি বলেছিলেন: "পশ্চিমারা বলে সোভিয়েত নেতারা কৌতুকমুখী, কিন্তু তাদের কাজের মধ্যে তা দেখা যায় না। আমি বলছি আমাদের হাসি আন্তরিক। কিন্তু কেউ যদি মনে করে আমাদের হাসি মানে আমরা মার্কস ও লেনিনের আদর্শ ছেড়ে দিচ্ছি—তবে তারা ভুল করছে।" এই প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় স্পষ্ট: যদি আমরা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি উত্তেজনা প্রশমিত করতে চাই, তবে আমাদের একতা রক্ষা করতে হবে এবং সম্মিলিত শক্তি তৈরি করতে হবে।”
- হেস্টিংস ইসমে, ডেনিশ সোসাইটি ফর অ্যাটলান্টিক প্যাক্ট অ্যান্ড ডেমোক্রেসি-তে বক্তৃতা, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ সাল।
- সবশেষে, চেয়ারম্যান খ্রুশ্চেভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এমন একজন ক্লান্ত দৌড়বিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন যে তার অতীতের গৌরবের উপর নির্ভর করে টিকে আছে। আর বলেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন এক উন্নত দেশ হিসাবে ১৯৭০ সালের মধ্যে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে আমি চেয়ারম্যানের মতো অতিরঞ্জিত কথা ব;তে চাই না, তবে মনে করিয়ে দিতে চাই—তিনি আমাকে সেই বাঘ শিকারির কথা মনে করিয়ে দেন, যে বাঘ ধরার আগেই দেয়ালে সেই চামড়াটি ঝুলিয়ে রাখার জায়গা নির্ধারণ করে রেখেছিল। কিন্তু সেই বাঘের পরিকল্পনা ছিল সম্পুর্ন ভিন্ন।
- রাষ্ট্রপতি জন এফ. কেনেডি, ১৩ তম সংবাদ সম্মেলন, ২৮ জুন ১৯৬১ সাল। সূত্র: এফ. কেনেডি প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি ও জাদুঘর
- থম্পসনের মনে তখন একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল: ক্রুশ্চেভ নিজেকে এক জটিল অবস্থায় ফেলেছেন। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন, "হে ঈশ্বর, আমি যেন কোনোভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি এবং রুশ জনগণকে বলতে পারি যে, কেনেডি কাস্ত্রোকে ধ্বংস করতে যাচ্ছিলেন এবং আমি তা প্রতিরোধ করেছি।" থম্পসনের ধারণা ছিল, খ্রুশ্চেভ তাঁর (থম্পসনের) ব্যাখ্যায় সম্মত হবেন—এবং ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল।
- রবার্ট ম্যাকনামারা, দ্য ফগ অফ ওয়ার (২০০৩)
- খ্রুশ্চেভ তাঁর পূর্বসূরি স্বৈরশাসকের শাসনব্যবস্থার মূল কাঠামো ও আইন অপরিবর্তিত রেখে কিছুটা শিথিলতা এনেছিলেন। তার শাসনকালে একদলীয় শাসনব্যাবস্থা বহাল ছিল। গোপন পুলিশ ও বিবাচনও আগের মতোই সক্রিয় ছিল। তবুও, সাধারণ সোভিয়েত নাগরিকদের জীবন উল্লেখযোগ্যভাবে সহজতর হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বন্দি শ্রমশিবির থেকে মুক্তি পায়। নিপীড়নের শিকার বহু মানুষ পুনর্বাসিত হয়—যদিও তা মূলত তাঁদের পরিবারদের জন্য স্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগের অনুমতি সীমিতভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বিদেশি দর্শনার্থীদের আরও ভিসা দেওয়া হয় এবং সোভিয়েত নাগরিকদের মধ্যে ইউএসএসআরের বাইরে ভ্রমণের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। বিদেশি বেতার-তরঙ্গ সম্প্রচার তখনও বাধাগ্রস্ত করা হতো, তবে তা অসম্পূর্ণভাবে, যার ফলে নাগরিকরা দেশ-বিদেশের বাস্তব জীবনের একটি তুলনামূলক চিত্র পেতে শুরু করে। এর প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ—মানুষের চোখ খুলে যেতে শুরু করে।
- রিচার্ড পাইপস, কমিউনিজম: আ হিস্ট্রি (২০০৩)
- নিকিতা খ্রুশ্চেভ মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এবং এমনকি আফ্রিকা ইত্যাদি বিবিধ দেশজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী প্রতিপত্তিকে প্রতিস্পর্ধা জানানোর চেষ্টা করেন।শীতল যুদ্ধের বিস্তারে তাঁর আগ্রাসী কৌশল শুধু সোভিয়েত প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ধরে রাখার তাগিদ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে পারমাণবিক প্রতিযোগিতায় জড়াতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন দেশে অস্ত্রভান্ডার বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট যেকোন সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে পারমাণবিক হামলার করতে পারে। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, একটি শক্তিশালী আক্রমণ—একটি আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি সোভিয়েত ইউনিয়নের দুর্বলতাকে আড়াল করতে পারবে এবং বার্লিনের মতো বিবিধ পশ্চিম দেশের উপর এইভাবে চাপ সৃষ্টি করা যাবে। তাঁর এই মনোভাব ১৯৫০-এর দশকে সোভিয়েত-আমেরিকান পুনর্মিলনের পথ কার্যত রুদ্ধ করে তোলে।
- রোনাল্ড পাওয়াস্কি, দ্য কোল্ড ওয়ার: দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্ড দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯১৭–১৯৯১, পৃ. ১৩৩–১৩৪ (১৯৯৮)
- কেনেডি রাষ্ট্রপতি হিসাবে অভিষিক্ত হওয়ার পর খ্রুশ্চেভের প্রকাশ্য বক্তব্য সোভিয়েত-আমেরিকান সম্পর্ককে আরও জটিল করে তোলে। ১৯৬১ সালের ৬ জানুয়ারি সোভিয়েত নেতা ঘোষণা করেন যে তাঁর দেশ অনুন্নত বিশ্বের জাতীয় মুক্তির যুদ্ধ সমর্থন করবে। কেনেডির ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ও ইতিহাসবিদ আর্থার শ্লেসিঞ্জার জুনিয়র লিখেছেন: এই ঘোষণাটি কেনেডিকে আরও সতর্ক করেছিল। যদিও কেনেডি শীতল যুদ্ধের অবসান চেয়েছিলেন এবং আলোচনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তবুও খ্রুশ্চেভ তৃতীয় বিশ্বের প্রতি সমর্থনের মাধ্যমে তাঁর সাথে যেভাবে কূটনৈতিক প্রতিস্পর্ধা শুরু করেন, তাকেই কেনেডি প্রধান্য দিতে শুরু করে।
- রোনাল্ড পাওয়াস্কি, দ্য কোল্ড ওয়ার: দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্ড দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯১৭–১৯৯১, পৃ. ১৩৫ (১৯৯৮)
- ইতিহাসবিদ ব্রুস মিরফের মতে, খ্রুশ্চেভের কটাক্ষের প্রতিক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট কেনেডির আচরণে এক ধরনের হীনমন্যতা প্রকাশ পায়। তিনি তাঁর নেতৃত্বের সামর্থ্য প্রমাণের জন্য এক বিকৃত প্রয়োজনবোধে তাড়িত হন। এর ফলে, তিনি আইজেনহাওয়ারের সাবধানতামূলক পরামর্শ বা হুমকিগুলোকে অবহেলা বা খণ্ডন না করে বরং ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেন এবং বিষয়টিকে নিজের ইচ্ছাশক্তির পরীক্ষা হিসেবে রূপ দেন। এই মনোভাবের ফলে এমন সংকট তৈরি হয় যা বাস্তবে এড়ানো সম্ভব ছিল। মিরফ লক্ষ্য করেন যে, আইজেনহাওয়ারের আমলে ১৯৬১ সালে সংঘটিত বার্লিন সংকট কিংবা ১৯৬২ সালে সংঘটিত কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সঙ্গে তুলনীয় কিছুই ছিল না, অথচ এই দুই সংকটই পরাশক্তিদের পারমাণবিক সংঘাতের চরম সন্নিকটে নিয়ে গিয়েছিল। আদর্শিক রাজনৈতিক অথবা মনস্তাত্ত্বিক যেকোনো কারণেই হোক, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া নির্ধারণে কেনেডি বন্ধুত্বের পরিবর্তে খ্রুশ্চেভের আগ্রাসী কৌশলের প্রতিই বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র যখন কেনেডি সোভিয়েত নেতার কাছে প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে তিনি কমিউনিজমের প্রশ্নে দুর্বল নন তখন তাঁর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হতে শুরু করে।"
- রোনাল্ড পাওয়াস্কি, দ্য কোল্ড ওয়ার: দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্ড দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯১৭–১৯৯১, পৃ. ১৩৬ (১৯৯৮)
- যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক শ্রেষ্ঠত্বকে সামান্যতম হলেও প্রতিস্পর্ধা জানাতে এবং তার চেয়েও বড় এক উদ্দেশ্যে কিউবায় আরেকটি মার্কিন-সমর্থিত আক্রমণ প্রতিরোধ করতে খ্রুশ্চেভ তার পরিকল্পনামতো ১৯৬২ সালের গোড়ার দিকে কিউবায় ছত্রিশটি মাঝারি-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেন। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কে জুপিটার আইআরবিএম প্রকল্প মোতায়েন করার পর সোভিয়েত নেতৃবৃন্দদের দ্বারা কিউবায় একই ধরনের প্রকল্প মোতায়েন করাকে একধরনের ন্যায্য প্রতিক্রিয়া বলে ধরা হয়েছিল।খ্রুশ্চেভ নিজের স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন: "এখন সময় এসেছে যখন আমেরিকা বুঝবে নিজ ভূমি এবং নিজ জনগণ যখন হুমকির মুখে পড়ে, তখন কেমন অনুভব হয়।
- রোনাল্ড পাওয়াস্কি, দ্য কোল্ড ওয়ার: দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্ড দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯১৭–১৯৯১, পৃ. ১৪২
- সম্ভবত খ্রুশ্চেভ বার্লিন সংকট সমাধানে এক নাটকীয় কূটনৈতিক অগ্রগতি অর্জনের আশায় কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল কিউবায় তাদের সফল ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন মার্কিন পারমাণবিক শ্রেষ্ঠত্বকে কিছুটা নিরপেক্ষ করবে এবং এর ফলে বার্লিনে সোভিয়েত অবস্থান আরও জোরদার করা সম্ভব হবে। কিছু বিশ্লেষকের মতে, এই পদক্ষেপের পেছনে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণও ছিল সোভিয়েত কৃষি খাতের দুর্বলতা থেকে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সোভিয়েত নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা—যা ততকালীন চীনের ক্রমবর্ধমান প্রতিস্পর্ধার মুখে পড়েছিল।
- রোনাল্ড পাওয়াস্কি, দ্য কোল্ড ওয়ার: দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্ড দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯১৭–১৯৯১, পৃ. ১৪২
- "ব্যঙ্গাত্মকভাবে হলেও কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর রাষ্ট্রপতি কেনেডি স্বল্পমেয়াদে যে আন্তর্জাতিক মর্যাদা অর্জন করেছিলেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার নিরিখে এক প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করে। এই সংকটে খ্রুশ্চেভ যে অপমান সহ্য করেন তা তাঁর ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরপর লিওনিড ব্রেজনেভের নেতৃত্বাধীন নতুন সোভিয়েত নেতৃত্ব সংকল্পবদ্ধ হয় যে, ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। ফলে, ১৯৬৫ সালের গোড়া থেকেই সোভিয়েত পারমাণবিক অস্ত্রাগারের ব্যাপক সম্প্রসারণ শুরু হয়, যা ১৯৭০-এর দশকের শেষদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পারমাণবিক ক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্রের সমতায় পৌঁছে দেয়।"
- রোনাল্ড পাওয়াস্কি, দ্য কোল্ড ওয়ার: দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্ড দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯১৭–১৯৯১, পৃ. ১৪৪
- চলুন আমরা বাস্তব পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে বুঝে নিই। শান্তি ও যুদ্ধের মধ্যে বেছে নেওয়ার প্রশ্নে বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু শান্তি অর্জনের একমাত্র নিশ্চিত পথ—যা আপনি এর ঠিক পরমুহুর্তেই আত্মসমর্পণ মাধ্যমে অর্জন করতে পারেন। স্বীকার করতেই হবে, এর বাইরে যেকোনো পথেই কিছুটা ঝুঁকি আছে। তবে ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়: তুষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি লুকিয়ে থাকে। আমাদের উদারপন্থী বন্ধুদের জন্য এটি কঠিন হলেও সত্য—তাঁদের আপোষকামীতা বাস্তবে তুষ্টি নীতিই প্রতিনিধিত্ব করে এবং এই নীতি শান্তি ও যুদ্ধের মধ্যে নয় বরং যুদ্ধ ও আত্মসমর্পণের মধ্যেই আমাদের ঠেলে দেয়। যদি আমরা ক্রমাগত আপোষ করে যাই, পিছু হটি, তবে একসময় আমরা এমন এক চূড়ান্ত দাবির মুখোমুখি হব, যেখানে কোনও বিকল্প থাকবে না—শুধু আত্মসমর্পণ। নিকিতা খ্রুশ্চেভ একবার তাঁর জনগণকে বলেছিলেন, তিনি জানেন আমরা কী করব, কারণ আমরা ইতিমধ্যেই আমরা পিছু হটার নজির স্থাপন করেছি। তিনি বলেন, আমরা আত্মসমর্পণ করব স্বেচ্ছায়—কারণ তখন আমরা আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ব যে আর প্রতিরোধের শক্তি থাকবে না। তিনি তা বিশ্বাস করেছিলেন, কারণ আমাদের পক্ষ থেকে তিনি শুনেছেন—'যে কোনও মূল্যে শান্তি', 'মৃত্যুর চেয়ে লাল রং(কমিউনিজম) ভালো', কিংবা—একজন ভাষ্যকারের ভাষায়—'দাড়িয়ে থেকে মরার চেয়ে হাঁটু গেড়ে বেঁচে থাকাই শ্রেয়।' এই মনোভাবই যুদ্ধের পথ উন্মুক্ত করে। এই প্রবচন আমাদের বাকি জনগণের পক্ষে কথা বলে না।
- রোনাল্ড রিগ্যান, আ টাইম ফর চুসিং বক্তৃতা, (১৯৬৪)
- খ্রুশ্চেভ এবং তাঁর উত্তরসূরি ব্রেজনেভ দুজনেই জোর দিয়ে দাবি করেছিলেন যে বৈশ্বিক ক্ষেত্রে কমিউনিজম স্বাধীনতা ও সামাজিক কল্যাণের প্রশ্নে পশ্চিমা উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে তাঁরা এটাও উপেক্ষা করেছিলেন যে, একটি ব্যবস্থা যেখানে কেবল একটি দলের প্রার্থীই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে সেখানে গণতন্ত্র কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাঁরা গুলাগে রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী ও ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বীদের বন্দিত্বের বাস্তবতাকেও চুপচাপ পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও, সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক দিক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে প্রশংসনীয় বলে মনে হতো। দেশটিতে বেকারত্ব ছিল না বললেই চলে। আবাসন, উত্তাপ, জ্বালানি, শিক্ষা, গণপরিবহন ও স্বাস্থ্যসেবা — নাগরিকজীবনে এসকল কিছু অত্যন্ত কম খরচে বা বিনামূল্যে পাওয়া যেত। সোভিয়েত ইউনিয়নে আগত বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা জানিয়েছেন সেদেশে চুরি-ছিনতাই ছিল বিরল ঘটনা। দেওয়াললিখন কার্যত দৃষ্টিগোচর হতনা। যেখানে পশ্চিমা শহরগুলোতে নিওন আলোয় জ্বলজ্বল করা বিজ্ঞাপন প্রায় সর্বত্র দেখ যেত, সেখানে সোভিয়েতের রাস্তাঘাটের দৃশ্য ছিল তার একেবারেই বিপরীত। এছাড়া সোভিয়েত প্রতিনিধিরা বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন। ইউএসএসআর নিজেই একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র ছিল এবং এর নেতারা বারবার দাবি করতেন যে তাদের ব্যবস্থায় এসব অন্যায় দূর করা হয়েছে। যদিও ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলো তাদের উপনিবেশ থেকে সরে দাঁড়ায়। সেসব নবস্বাধীন রাষ্ট্র বহু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নির্ভরতা ও অনুন্নয়নের ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকে। এই প্রসঙ্গে, সোভিয়েত প্রভাবাধীন আজারবাইজানকে প্রায়শই তুলনা করা হতো ব্রিটিশ-অধিকৃত নাইজেরিয়া, ফরাসি আলজেরিয়া বা ডাচ মালয়েশিয়ার সঙ্গে।
- রবার্ট সার্ভিস, কমরেডস: আ হিস্ট্রি অফ ওয়ার্ল্ড কমিউনিজম (২০০৯)
- ১৯৬১ সালের জানুয়ারিতে, ক্যারল রুথ সিলভার সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা খ্রুশ্চেভকে তাঁর বিখ্যাত ভাষণের সময় টেবিলে জুতা আঘাত করতে দেখেছিলেন। সেই বক্তৃতায় খ্রুশ্চেভ কিউবা এবং ভিয়েতনামের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের অকুণ্ঠ সমর্থন ঘোষণা করেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মার্কিন আধিপত্যবাদকে প্রকাশ্যে দ্বন্দের জন্য আহ্বান জানাতে দেখেই সিলভারের দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তৃত হয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর তাঁর চিন্তাভাবনার গভীরতা নতুন মাত্রা পায়।"
- ডেব্রা এল. শুল্টজ, গোয়িং সাউথ: জিউস উইমেন ইন সিভিল রাইটস মুভমেন্ট (২০০২)
- নিকিতা খ্রুশ্চেভ ধীরে ধীরে নতুন নেতৃত্বের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর, সোভিয়েত ইউনিয়নে গুলাগ থেকে বন্দিদের মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। যদিও শ্রম শিবিরগুলো সোভিয়েত শাসনের শেষকাল অবধি রয়ে গিয়েছিল। খ্রুশ্চেভ এগুলিকে দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরিয়ে দেন। এখানে একসময় স্ট্যালিনের অধীনে বন্দিশ্রম কার্যকর করা হত। লক্ষ লক্ষ বন্দী—যাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধী, ছোটখাটো অপরাধী, ভুল জাতীয়তার সৈন্য, এমনকি অনেকেই ছিলেন যাঁরা জানতেনই না তাঁদের অপরাধ কী—তাঁরা ধীরে ধীরে মুক্তি পেতে শুরু করেন। তারা ঘরে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন কিংবা সমাজে নতুন করে স্থান খুঁজে নেন। এই পুনরাগমনের প্রক্রিয়া চিত্রিত হয়েছে রুশ নোবেলজয়ী আলেকজান্ডার সোলঝেনিতসিনের ওয়ান ডে ইন দ্যা লাইফ অফ ইভান ডেনিসোভিচ এবং ইলিয়া এহরেনবার্গের দ্যা থ নামক রচনায়। তবে পরবর্তীতে খ্রুশ্চেভ স্বীকার করেন যে, "আমরা ভীত ছিলাম—ভয়ানকভাবে। আমরা আশঙ্কা করছিলাম, সত্য প্রকাশের ফলে এমন এক ঢেউ উঠতে পারে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে ডুবিয়ে দেবে।"
- অড আর্ন ওয়েস্টাড, দ্যা কোল্ড ওয়ার: আ গ্লোবাল হিস্ট্রী (২০১৭)
- স্ট্যালিন-পরবর্তী সোভিয়েত নেতৃত্ব উপলব্ধি করেছিল, তাঁর কিছু নীতির বিরুদ্ধে শুধু পূর্ব জার্মানিতেই নয়, অন্যান্য প্রভাবাধীন রাষ্ট্রেও প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। তারা ভয় পেয়েছিল যে পূর্ব জার্মানির বিদ্রোহ অন্যান্য দেশেও প্রতিধ্বনিত হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে তারা নতুন পথ অনুসরণ করতে শুরু করে। তারা দাবি করেছিল যে কমিউনিস্টদের একচেটিয়া ক্ষমতা দুর্বল না করেই সংস্কার সম্ভব। এই নতুন নীতির মূল উপাদান ছিল: রাজনৈতিক গ্রেফতার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নদের সংখ্যা হ্রাস করা, সাধারণ ক্ষমা প্রদান, ভারী শিল্প ও প্রতিরক্ষা খাতে উৎপাদন কমানো এবং খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি।
- অড আর্ন ওয়েস্টাড, দ্যা কোল্ড ওয়ার: আ গ্লোবাল হিস্ট্রী (২০১৭)
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]
উইকিমিডিয়া কমন্সে নিকিতা খ্রুশ্চেভ সম্পর্কিত মিডিয়া
- মৃত্যুসংবাদ, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস (১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)
- "দ্য কেস অফ ক্রুশ্চেভস জুতা" নিনা খ্রুশ্চেভ (নিকিতার নাতনী) দ্বারা নিউ স্টেটসম্যানে প্রকাশিত(২ অক্টোবর ২০০০)
- "নিকিতা এস. ক্রুশ্চেভ: দ্য সিক্রেট স্পিচ — অন দ্য কাল্ট অফ পারসোনালিটি" (১৯৫৬) আধুনিক ইতিহাসের উৎসপুস্তকে
- সিপিইউএসএ থেকে খ্রুশ্চেভের "গোপন বক্তৃতা" - এর এক "স্ট্যালিনবাদী" খণ্ডন (১৯৫৬)
- "উচ্ছ্বসিত, দীর্ঘ করতালি, করতালিতে শেষ। সবাই উঠে দাঁড়ায়।" ক্রুশ্চেভের "সিক্রেট রিপোর্ট" এবং পোল্যান্ড (মার্চ ২০০৬)]