বিষয়বস্তুতে চলুন

নৃত্য

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে

নৃত্য বা নাচ বলতে সাধারণত শারীরিক নড়াচড়ার প্রকাশভঙ্গীকে বোঝায়। এ প্রকাশভঙ্গী সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রে দেখা যায়। গীতবাদ্যের ছন্দে অঙ্গভঙ্গির দ্বারা মঞ্চে চিত্রকল্প উপস্থাপনের ললিত কলাই নৃত্য বা নাচ। নৃত্যকলার সংজ্ঞা নির্ভর করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নন্দনতত্ত্বিক, শৈল্পিক এবং নৈতিক বিষয়ের উপর। এই আন্দোলনের নান্দনিক এবং প্রতীকী মূল্য আছে।

উক্তি

[সম্পাদনা]
  • পাল্কী চলে,
    পাল্কী চলে—
    দুল্‌কি চালে
    নৃত্য তালে!
    ছয় বেহারা,—
    জোয়ান তারা,—
    গ্রাম ছড়িয়ে
    আগ্‌ বাড়িয়ে
    • সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, পাল্কীর গান, কুহু ও কেকা - সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৯-৩০
  • নৃত্য হচ্ছে একটি স্বাধীন আর্ট, তা দৃশ্যপট, আলোকপাত বা ঐকতানের মুখাপেক্ষা করে না। রুসীয় ব্যালের দেখাদেখি আজকাল য়ুরোপীয় নৃত্যেও দৃশ্যপট এবং ঐকতান প্রভৃতির বাড়াবাড়ি হয়েছে বটে, কিন্তু রুসীয় নৃত্যনাট্যসম্প্রদায় যাঁরা গঠন করেছিলেন, তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল একাধারে তিনটি আর্টের (নৃত্য, সঙ্গীত ও চিত্র) সম্মিলন দেখানো।
    • হেমেন্দ্রকুমার রায়, উদয়শঙ্করের আত্মপ্রকাশ, যাঁদের দেখেছি - হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক— নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলিকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৮৫
  • বুদ্ধির দরকার গতিতে, কিন্তু হৃদয়ের দরকার নৃত্যে। গতির লক্ষ্য—একাগ্র হইয়া লাভ করা, নৃত্যের লক্ষ্য—বিচিত্র হইয়া প্রকাশ করা। ভিড়ের মধ্যে ভিড়িয়া ও চলা যায় কিন্তু ভিড়ের মধ্যে নৃত্য করা যায় না। নৃত্যের চারিদিকে অবকাশ চাই। এই জন্য হৃদয় অবকাশ দাবী করে। বুদ্ধিমান তাহার সেই দাবীটাকে অবাস্তব এবং তুচ্ছ বলিয়া উড়াইয়া দেয়।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আষাঢ়, বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১৩
  • নারদের মুখে নিমন্ত্রণ পেয়ে তিন ঋষি প্রীত হলেন। বললেন, আমরা ময়ূরনৃত্য খঞ্জননৃত্য দেখেছি, বানর-ভল্লুকাদির নৃত্যও দেখেছি, কিন্তু নারীনৃত্য কখনও দেখি নি। দেখবার জন্য খুব কৌতূহল আছে। কিন্তু উর্বশী তো শুনেছি অপ্সরা, সে নারী বটে তো?
    নারদ বললেন, এমন নারী যার জন্যে ‘অকস্মাৎ পুরুষের বক্ষোমাঝে চিত্ত আত্মহারা, নাচে রক্তধারা।’ তার নৃত্য দেখলে তোমরা মুগ্ধ হবে। এখন ইন্দ্রসভায় যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে নাও।
    • রাজশেখর বসু, নির্মোক নৃত্য, আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প - পরশুরাম, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এন্ড সন্স লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৬
  • আবার সেই স্বর্ণভূষণা নর্ত্তকী—সেই নর্ত্তকীবৃন্দের রাণী, নর্ত্তকীদের উজ্জ্বল তারা,—বাদকদল পরিবেষ্টিত হইয়া আবার সহসা আবির্ভূত হইল, তথন উহাদের স্মৃতি, আমার মন হইতে একেবারেই অন্তহিত হইল। শেষ নৃত্যের জন্য উহাকেই রাখা হইয়াছিল। এই নর্ত্তকী অনেকক্ষণ ধরিয়া নৃত্য করিল; যদিও এই নৃত্যে আমার ক্লান্তিবোধ হইতেছিল, তবুও সেই সঙ্গে ভয়ও হইতেছিল, কোন্ মুহূর্ত্তে না জানি তাহার নৃত্যের অবসান হইবে, আমি তাহাকে আর দেখিতে পাইব না।
    • পিয়ের-লোটি, জালিকাটা বেলে-পাথরের নগর, ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ, পিয়ের-লোটির ফরাসী থেকে অনুবাদ, অনুবাদক- জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৭৫
  • ওই গো সন্ধ্যা আসিছে আবার, স্পন্দিত-সচেতন
    বৃন্তে বৃন্তে ধূপাধার সম ফুলগুলি ফেলে শ্বাস;
    ধ্বনিতে গন্ধে ঘূর্ণি লেগেছে, বায়ু করে হাহুতাশ,
    সান্দ্র ফেনিল মূর্চ্ছা-শিথিল নৃত্য-আবর্ত্তন!
    বৃন্তে বৃন্তে ধূপাধার সম ফুলগুলি ফেলে শ্বাস,
    শিহরি’ গুমরি’ বাজিছে বেহালা যেন সে ব্যথিত মন;
    সান্দ্র-ফেনিল মূর্চ্ছা-শিথিল নৃত্য-আবর্ত্তন!
    সুন্দর-ম্লান, বেদী, সুমহান্ সীমাহীন নীলাকাশ।
    • শার্ল বোদলেয়ার, সন্ধ্যার সুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত, তীর্থরেণু, অনুবাদক- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬০-৬১
  • মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
    তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
    তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
    তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
    হাসি কান্না হীরাপান্না দোলে ভালে,
    কাঁপে ছন্দে ভালো মন্দ তালে তালে।
    নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু পাছে পাছে
    তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
    কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ,
    দিবারাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ—
    সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে।
    তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গীতবিতান- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ (১৪০০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫৪৫-৫৪৬
  • রাজা আদিত্যপ্রতাপ এবং তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর স্বর্গীয় বিজয়প্রতাপের তত্ত্বাবধানে যে সব ছউ নৃত্য পরিকল্পিত হয়েছে, সংখ্যায় সেগুলি অসামান্য। ভারতনাট্যম্ ও কথাকলির নৃত্যসংখ্যা আমি জানি না, কিন্তু যে বিশ্ববিখ্যাত রুসীয় নৃত্য-সম্প্রদায় পৃথিবীভ্রমণ করেছিল, তার চেয়ে ছউ নাচের সংখ্যা অনেক বেশী। ১৯৩৮ খৃষ্টাব্দে সেরাইকেলা নৃত্য-সম্প্রদায় মোট একচল্লিশটি নাচ নিয়ে গিয়েছিল ইতালী, ফ্রান্স ও ইংলণ্ডে। কিন্তু সেরাইকেলার নৃত্যতালিকা এর চেয়ে ঢের বেশী দীর্ঘ— বোধ করি শতাধিক হবে।
    • হেমেন্দ্রকুমার রায়, সেরাইকেলার রাজাসাহেৰ, যাঁদের দেখেছি - হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক— নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলিকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬৯
  • বৃদ্ধেরা ইঙ্গিত করিলে যুবাদের দলে মাদল বাজিল, অমনি যুবতীদের দেহ যেন শিহরিয়া উঠিল; যদি দেহের কোলাহল থাকে, তবে যুবতীদের দেহে সেই কোলাহল পড়িয়া গেল, পরেই তাহারা নৃত্য আরম্ভ করিল। তাহাদের নৃত্য আমাদের চক্ষে নূতন; তাহারা তালে তালে পা ফেলিতেছে, অথচ কেহ চলে না; দোলে না, টলে না। যে যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, সে সেইখানেই দাঁড়াইয়া তালে তালে পা ফেলিতে লাগিল, তাহাদের মাথার ফুলগুলি নাচিতে লাগিল, বুকের ধুক্‌ধুকি দুলিতে লাগিল।
    • সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পালামৌ, তৃতীয় সংস্করণ, সম্পাদনা- ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস, প্রকাশক- বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫
  • নৃত্য চলতে লাগল। পর্বত ঋষি দুই হাতে চোখ ঢাকলেন, কিন্তু কৌতূহল দমন করতে না পেরে আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগলেন। ক্লমে ক্রমে উর্বশী তাঁর দেহের ঊর্ধ্বাংশ অনাবৃত করলেন। তখন কর্দম ঋষি চোখ ঢেকে বললেন, উর্বশী, তোমার এই জুগুপ্সিত নৃত্য দেখলে আমাদের তপস্যা নষ্ট হবে। ক্ষান্ত হও।
    • রাজশেখর বসু, নির্মোক নৃত্য, আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প - পরশুরাম, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এন্ড সন্স লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৮
  • দশকুমারে লেখে যে স্ত্রীলোকেরা বিদেশীয় ভাষা, চিত্রকরা, নৃত্য বিদ্যা, সঙ্গীত, নাট্যশালায় অভিনয়করণ, আয় ব্যয় বিষয়ক, তর্কবিদ্যা, গণনা বাক্য-বিন্যাস, পুষ্পবিদ্যা, সৌগন্ধ ও মিষ্টান্ন প্রস্তুত করণ, জীবিকা নির্ব্বাহক—অর্থকরী বিদ্যা ইত্যাদি শিখিতেন। কাব্য গ্রন্থতে চিত্রশালা, নৃত্যশালা ও সঙ্গীতশালার উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্জ্জুন বিরাটের কন্যাদিগকে নৃত্য ও সঙ্গীত শিখাইয়া ছিলেন। নৃত্য, গান ও সমাজে গমন জন্য স্ত্রীলোকেরা মিষ্টরূপে আলাপ করিতে পারিতেন। বিষ্ণু পুরাণে লেখে যে, অঙ্গনাগনের কথা সুমধুর ও সংগীত স্বরূপ।
    • প্যারীচাঁদ মিত্র, এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্ব্বাবস্থা - প্যারীচাঁদ মিত্র, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ (১২৮৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৭
  • আমাদের একটি বক্স ষ্টারে বাঁধা ছিল। সেইখানে মায়ের কোল ঘেসে বসে আমার প্রথম নাটকাভিনয় দর্শন। তখন ভাল বুঝতুম না, সেই নৃত্যগীতমুখর আলোকমালা শোভিত রহস্য-পুরীর পটপরিবর্ত্তন মুগ্ধ স্পন্দিত হৃদয়ে বসে বসে দেখতুম আর ভাবতুম, “ওরা না পারে কি?” পরের সুখ দুঃখের টান যে এমন চিত্তবিমোহন হতে পারে তা’ প্রথম অনুভব করে সেই দশ বৎসর বয়সে আমার চোখে ধারা বইতো। হাসি অশ্রুর সুখস্রোতে নিশি ভোর হয়ে যেত। তখনও কলা রাজ্যের দু’টি বড় জিনিস—ছবি ও গানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় নি, কিন্তু ষ্টারের রঙ্গমঞ্চের মায়াপুরীতে নৃত্য ও গীতের আমি যে প্রথম আস্বাদন পেলুম আমার এই কৈশোরের দিনে, তা খুব উচ্চাঙ্গের নৃত্য-গীত না হলেও আমার বালক-চিত্তকে তা’ আলোড়িত মথিত করে তুলেছিল।
    • বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, আমার আত্মকথা - বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- আর্য্য পাবলিশিং হাউস, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬১-৬২
  • নৃত্যের ভঙ্গীর দ্বারা কোনও প্রাকৃতিক বস্তুর যথাযথ দৃষ্ট-স্বরূপের অনুকরণ সম্ভব নয়। একটি নর্ত্তকী লতার ন্যায় ভঙ্গী করিলে তাহার মধ্যে একটি পদ্মলতার পাতা দেখা যাইবে না, ফুলও দেখা যাইবে না, ডাঁটাও দেখা যায় না; তবে নৃত্যকে কি হিসাবে অনুকৃতি বলা যায়? একটি লতায়িত নৃত্যকে যদি লতার অনুকরণ বলিতে হয় তবে তাহাকে লতার জীবনের মধ্যে যে লাবণ্যময় স্বচ্ছন্দবাহী প্রাণশক্তির তরঙ্গায়িত রূপপ্রবাহ চলিয়াছে তাহারই অনুকরণ বলিতে হয়। নচেৎ কোনও নর্ত্তকীকে লতা বলিয়া ভ্রম হইবার কথা নহে এবং সেরূপ অনুকরণ কোনও নৃত্যেই সম্ভব নহে। অতএব কোন নৃত্যকে যদি ত্রৈলোক্যের অনুকৃতি বলা হয়, তবে ত্রৈলোক্যস্থ নানা বস্তুজাতের বিশিষ্ট বিশিষ্ট প্রাণপ্রদ ধর্ম্মের অনুকরণ বলা যাইতে পারে। চিত্র ও নৃত্যকে যদি একজাতীয় অনুকরণ বলা যায় এবং নৃত্যকে যদি শ্রেষ্ঠ অনুকৃতি বলা হয়, তবে তাহা হইতে ইহাও প্রমাণিত হয় যে চিত্রের মধ্যে যে অনুকৃতি শিল্পীর লক্ষ্য ছিল তাহা বাহ্যস্বরূপের অনুকৃতি নয়, তাহা তাহার অন্তরের প্রাণপ্রদ ধর্ম্মের অনুকৃতি।
    • সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, ভারতীয় প্রাচীন চিত্রকলা- সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, প্রকাশক-দাশগুপ্ত এণ্ড কোং, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২০-২১
  • ওখানে মেঘে মেঘে রূপের এবং রঙের অহেতুক বিকাশ। এ যেন গানের আলাপের মতো, রূপ-রঙের রাগরাগিণীর আলাপ চলছে—তাল নেই, আকার আয়তনের বাঁধাবাঁধি নেই, কোনো অর্থবিশিষ্ট বাণী নেই, কেবলমাত্র মুক্ত সুরের লীলা। সেইসঙ্গে সমুদ্রের অপ্সর-নৃত্য ও মুক্ত ছন্দের নাচ। তার মৃদঙ্গে যে বোল বাজছে তার ছন্দ এমন বিপুল যে, তার লয় খুঁজে পাওয়া যায় না। তাতে নৃত্যের উল্লাস আছে, অথচ নৃত্যের নিয়ম নেই।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাপানে-পারস্যে, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ, জাপানে-পারস্যে-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৯-৩০
  • আপনাদের আগমনে আমরা সকলেই কৃতার্থ হয়েছি। এখন অনুমতি দিন, উর্বশী নৃত্য আরম্ভ করুক।
    আগন্তুক তিন ঋষির মুখপাত্র মহামনি কুতুক বললেন, হাঁ হাঁ, বিলম্বে প্রয়োজন কি, আমরা নৃত্য দেখবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছি।
    লাস্যনৃত্যের উপযুক্ত বেশভূষার উপর একটি আলখাল্লা বা ঘেরাটোপ পরে উর্বশী ইন্দ্রসভায় প্রবেশ করলেন। সকলকে প্রণাম করে যুক্তকরে বললেন, হে মহাভাগ দেবগণ এবং অগ্নিকল্প ঋষিগণ, আমি যে নির্মোক নৃত্য দেখাব তাতে আমার দেহ ক্রমে ক্রমে অপাবৃত হবে। আপনাদের তাতে আপত্তি নেই তো?
    • রাজশেখর বসু, নির্মোক নৃত্য, আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প - পরশুরাম, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এন্ড সন্স লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৮
  • মধ্যযুগের বাংলাদেশে পুরুষদের মধ্যে উচ্চাঙ্গের নৃত্য প্রবর্তন ক’রেছিলেন স্বয়ং চৈতন্যদেব। তাঁর জীবনী পাঠ করলেই বুঝতে বিলম্ব হয় না যে তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ নর্তক। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন পুরুষদের উচ্চশ্রেণীর নৃত্য বোধ করি এদেশে কোনকালেই প্রচলিত ছিল না। গত শতাব্দীতে রামকৃষ্ণদেবও নৃত্য করতেন বটে, কিন্তু তারও মধ্যে ছিল ধর্মভাবের উন্মাদনা।
    • হেমেন্দ্রকুমার রায়, উদয়শঙ্করের আত্মপ্রকাশ, যাঁদের দেখেছি - হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক— নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলিকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৮২-২৮৩
  • আমাদের বাড়ী দুর্গা ও জগদ্ধাত্রী—এই দুই পূজা হত। দুর্গোৎসব মহাসমারোহে সম্পন্ন হত। আমাদের উঠানের উপর সামিয়ানা খাটানো আর তিন দিন ধরে নৃত্য গীত আমোদ প্রমোদ, আমাদের আনন্দের আর সীমা থাকতো না।
    • সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমার বাল্যকথা- সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক— বৈতানিক প্রকাশনী, কলিকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬১
  • নৃত্য এবং চিত্র উভয়েতেই ত্রৈলোক্যের অনুকৃতি দেখা যায়। যে সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গী অন্তরের নানাবিধ ভাব অঙ্গ ও উপাঙ্গের নানা সংস্থানবৈচিত্র্য ও হস্তাদির নানা বিক্ষেপক্রিয়ার কথা নৃত্যপ্রকরণে কথিত হইয়াছে চিত্রেও সেইগুলিই দেখাইবার চেষ্টা করা হয়। নৃত্যই শ্রেষ্ঠ চিত্র। নৃত্যকে শ্রেষ্ঠ চিত্র বলিবার তাৎপর্য্য বোধ হয় এই যে, সমগ্র জগৎময় শক্তির যে ক্রিয়ালীলা চলিয়াছে, বৃক্ষলতা তরুগুল্ম হইতে আরম্ভ করিয়া ইতরপ্রাণী, মনুষ্য ও দেবযোনির মধ্যে অন্তরের নানাবিধ ভাবের প্রস্ফুটনে ও তৎ-সহচরিত নানা দৃষ্টিভঙ্গীতে, নানা প্রকার শরীরাবয়বের আকার ইঙ্গিতে, তাহার অভিব্যক্তির যে অজস্র ক্রীড়ালীলা চলিয়াছে, নৃত্যের গতিভঙ্গীর দ্বারা তাহাকে যেরূপ প্রকাশ করা যায়, স্থিতিশীল চিত্রের মধ্যে তাহাকে সেরূপ প্রস্ফুটিত করা যায় না।
    • সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, ভারতীয় প্রাচীন চিত্রকলা- সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, প্রকাশক-দাশগুপ্ত এণ্ড কোং, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৯-২০
  • নবাগত তিন ঋষিকে পাদ্য অর্ঘ্য আসন ইত্যাদি দিয়ে যথাবিধি সৎকার করে ইন্দ্র বললেন, হে মহাতেজা তপঃসিদ্ধ জিতেন্দ্রিয় মহর্ষিত্রয়, আমার মুখ্যা অপ্সরা উর্বশী আপনাদের মনোরঞ্জনের নিমিত্ত একটি অভিনব নৃত্য দেখাবে—নির্মোক নৃত্য, মর্ত্যলোকের প্রতীচ্যখণ্ডের ম্লেচ্ছগণ যাকে বলে স্ট্রিপ-টীজ।
    • রাজশেখর বসু, নির্মোক নৃত্য, আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প - পরশুরাম, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এন্ড সন্স লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৭
  • মালবিকাগ্নিমিত্র-নাটকে (অঙ্ক ৩) নারীদের নৃত্যের কথা দেখি। মহাদেবের নৃত্যানুকারে ভবানী যে দণ্ডপাদনৃত্য করিয়াছেন, তাহার খবর পাই মম্মটের কাব্যপ্রকাশে। পুরুষের নৃত্য হইল তাণ্ডব। নারীর নৃত্যের নাম লাস্য। জয়দেব ছিলেন নৃত্যকুশলা পদ্মাবতীর ‘চরণচারণচক্রবর্তী’। তবে পদ্মাবতীর কথা বলিতে সাহস হয় না, কারণ নৃত্যই তাঁহার জীবনের সবখানি। কিন্তু সতী বেহুলার নৃত্যের কথা তো তেমন করিয়া উড়াইয়া দিতে পারি না। নৃত্য করিয়াই বেহুলা মৃত পতিকে জিয়াইলেন। বিক্রমোর্বশী- নাটকের চতুর্থ অঙ্কে চিত্রলেখা নৃত্য করিয়াছেন এবং কঠিন কঠিন রাগ-রাগিণীতে গানও করিয়াছেন। সমাজব্যবস্থাপকেরা নারীদের জন্য নৃত্যগীতাদি শাস্ত্রের ব্যবস্থা করিয়াছেন।
    • ক্ষিতিমোহন সেন, আদর্শ ও অধিকার, প্রাচীন ভারতে নারী - ক্ষিতিমোহন সেন, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৩
  • এখন সুসভ্য সুসংযত সমাজে আকস্মিক ঘটনা ক্রমশই কমে আসছে এবং প্রবল আবেগ সহস্র বাঁধে আটকা পড়ে পোষ-মানা ভাল্লুকের মতো নিজের নখদন্ত গোপন করে সমাজের মনোরঞ্জন করবার জন্যে কেবল নৃত্য করে—যেন সে সমাজের নট, যেন তার একটা প্রচণ্ড ক্ষুধা এবং রুদ্ধ আক্রোশ ঐ বহুরোমশ আচ্ছাদনের নীচে নিশিদিন জ্বলছে না।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানবপ্রকাশ, সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২২৪
  • তারার মস্তকে, হৃদয়ে সহস্র নরকজ্বালা, চক্ষের সম্মুখে নরক নৃত্য করিতেছিল। নরক হইতে কে আসিয়া তাহার কাণে কাণে কহিল, এ অপমানের একমাত্র প্রতিবিধান আছে। শম্ভূজীকে দেখিয়া তারার শিরার মধ্যে রক্তস্রোত বেগে প্রবাহিত হইয়া তাহার মুখ অন্ধকার করিয়া তুলিল। চক্ষে একবার মাত্র লোহিত বিদ্যুৎ জ্বলিয়া উঠিল।
    • নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, পর্ব্বতবাসিনী - নগেন্দ্র নাথ গুপ্ত, প্রকাশক- শ্রী রাখাল চন্দ্র ঘোষ, কলকাতা, প্রকাশসাল-১৯০১ খ্রিস্টাব্দ (১৩০৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৬৩-১৬৪
  • নমো নমো নমো—
    তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম।
    নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ, নৃত্যে তোমার মায়া,
    বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া।
    তোমার বিশ্ব-নাচের দোলায় দোলায় বাঁধন পরায় বাঁধন খোলায়
    যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে,
    অন্ত কে তার সন্ধান পায় ভাবিতে লাগায় ধন্দ হে॥
    নমো নমো নমো—
    তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম॥
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গীতবিতান- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ (১৪০০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫৪৪
  • ঐতিহাসিক ঘটনার ধারাবাহিক বাস্তবতাকে আশ্রয় করে ভারতের দেড়শ’ দু’শ’ বছরের জাতীয় জীবনের মর্মকথাকে মঞ্চের উপর নৃত্য-নাট্যের স্বল্প পরিসরের মধ্যে সার্থক রূপ দেওয়া কি সম্ভব? ভারতীয় গণ-নাট্যসঙ্ঘের কেন্দ্রীয়বাহিনীর অভিনীত ‘ভারতের মর্মবাণী’ প্রত্যক্ষ করবার আগে এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ ছিল। কারণ, নৃত্য-নাট্য সম্বন্ধে আমাদের অভিজ্ঞতা এই যে, ভাব ও কল্পনাই এর প্রাণ, ঘটনা তার প্রতীক মাত্র; ভাব ও কল্পনার রূপকধর্মী সাঙ্কেতিক ব্যঞ্জনার উপরেই নৃত্য-নাট্যের সার্থকতা নির্ভর করে। নৃত্য-নাট্যের সরলতা, স্পষ্টতা ও বলিষ্ঠতা আমাদের কাছে স্থুলতার সামিল। আমাদের ধারণা এই যে, নৃত্যগীত সমন্বিত প্রতীক-নাট্যে এই তিনটি গুণের সমাবেশ ঘটলে ভাবের গভীরতা ব্যাহত হয় এবং অবদানের সমগ্রতা রক্ষা করা যায় না।
    • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতের মর্মবাণী, লেখকের কথা - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৯৮
  • অপূর্ব্ব যাইবার মিনিট কয়েক পরেই সাহেব বাড়ি আসেন। আজ খ্রীষ্টানদের পর্ব্বদিন। এবং খুব সম্ভব উৎসব ঘোরালো করিবার উদ্দেশেই তিনি বাহির হইতেই একেবারে ঘোর হইয়া আসেন। প্রথমে গীত ও পরে নৃত্য শুরু হয়। এবং অচিয়েই উভয় সংযোগে শাস্ত্রোক্ত ‘সংগীত’ এরূপ দুর্দ্দান্ত হইয়া উঠে যে তেওয়ারীর আশঙ্কা হয় কাঠের ছাদ হয়ত বা সাহেবের এত বড় আনন্দ বহন করিতে পারিবে না, সবশুদ্ধ তাহার মাথায় ভাঙ্গিয়া পড়িবে।
    • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এণ্ড সন্স লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১২
  • পরদিন প্রভাতে ভীষ্ম সসৈন্যে মহাবেগে অর্জুনের অভিমুখে ধাবিত হলেন। অশ্বত্থামা ভূরিশ্রবা শল্য শল্যপুত্র ও চিত্রসেনের সঙ্গে অভিমন্যুর যুদ্ধ হ’তে লাগল। ধৃষ্টদ্যুম্ন গদাঘাতে শল্যপুত্রের মস্তক চূর্ণ করলেন। শল্য অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নকে আক্রমণ করলেন, দুর্যোধন দুঃশাসন বিকর্ণ প্রভৃতি শল্যের রথ রক্ষা করতে লাগলেন। ভীমসেন আসছেন দেখে তাঁকে বাধা দেবার জন্য দুর্যোধন দশ হাজার গজসৈন্য পাঠালেন। ভীম সেই হস্তীর দল গদাঘাতে বিনষ্ট ক’রে রণস্থলে শংকরের ন্যায় নৃত্য করতে লাগলেন।
    • কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস, ভীষ্মপর্ব, অনুবাদক- রাজশেখর বসু, মহাভারত - রাজশেখর বসু, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এন্ড সন্স লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৯১
  • বেসুরেই বাজবে তাদের রনোন্মাদের যন্ত্র গুলি,
    গগন ছেয়ে উঠবে তাদের, নৃত্য পায়ের মুক্ত ধুলি।
  • নূতন পদ্ধতিতে আধুনিক ভারতীয় নৃত্য পরিকল্পনার সময়ে উদয়শঙ্করের সামনে ছিল কার আদর্শ? তিনি বেশ কিছুকাল ধ’রে আনা পাবলোভার নৃত্য-সম্প্রদায়ে কাজ ক’রেছিলেন। পাবলোভা যখন ভারতবর্ষে আসেন, তখন এখানকার প্রাচীন মন্দিরশিল্পের দিকে অত্যন্ত আকৃষ্ট হন। এবং তারই ফলে তাঁর “অজন্তার ফ্রেস্কো” প্রভৃতি ভারতীয় নৃত্যের জন্ম। আমার অনুমান সত্য কি না জানি না, তবে হয়তো পাবলোভারই প্রভাব পড়েছিল উদয়শঙ্করের পরিকল্পনার উপরে।
    • হেমেন্দ্রকুমার রায়, উদয়শঙ্করের আত্মপ্রকাশ, যাঁদের দেখেছি - হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক— নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলিকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৮৬-২৮৭
  • আমার এক-এক সময় ইচ্ছা করিত, বৃদ্ধ যে মিথ্যা দুর্গ অবলম্বন করিয়া বাস করিতেছে এবং মনে করিতেছে ইহা চিরস্থায়ী, সেই দুর্গটি দুই তোপে সর্বসমক্ষে উড়াইয়া দিই। একটা পাখিকে সুবিধামত ডালের উপর বসিয়া থাকিতে দেখিলেই শিকারির ইচ্ছা করে তাহাকে গুলি বসাইয়া দিতে, পাহাড়ের গায়ে একটা প্রস্তর পতনোন্মুখ থাকিতে দেখিলেই বালকের ইচ্ছা করে এক লাথি মারিয়া তাহাকে গড়াইয়া ফেলিতে—যে জিনিসটা প্রতি মুহূর্তে পড়ি-পড়ি করিতেছে, অথচ কোনো একটা-কিছুতে সংলগ্ন হইয়া আছে, তাহাকে ফেলিয়া দিলেই তবে যেন তাহার সম্পূর্ণতা-সাধন এবং দর্শকের মনে তৃপ্তিলাভ হয়। কৈলাসবাবুর মিথ্যাগুলি এতই সরল, তাহার ভিত্তি এতই দুর্বল, তাহা ঠিক সত্য-বন্দুকের লক্ষ্যের সামনে এমনি বুক ফুলাইয়া নৃত্য করিত যে, তাহাকে মুহূর্তের মধ্যে বিনাশ করিবার জন্য একটি আবেগ উপস্থিত হইত—কেবল নিতান্ত আলস্যবশত এবং সর্বজনসম্মত প্রথার অনুসরণ করিয়া সে কার্যে হস্তক্ষেপ করিতাম না।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঠাকুরদা, গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড)- প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৩০২
  • ক্রমশ বাজনা থেমে আসে। যন্ত্রীর দল তাদের বাজনা দিয়ে যে উন্মত্ত আকাঙ্খাকে জাগিয়ে তুলেছিল, উত্তুঙ্গ করে তুলেছিল, তাতে তাদেরও ন্যায্য অংশ গ্রহণ করবার জন্যে বাজনাকে ফেলে দিয়ে এগিয়ে আসে। যদিও অন্য সব দলের মতন তেমন নিপুণভাবে তারা নাচড়ে পারে না, তবুও সেই নৃত্যের উত্তাল তরঙ্গে তারা নিজেদের ভাসিয়ে দেয়, কারণ আজিকার দিনের এই নৃত্য, প্রণয়-নৃত্য, তাদের উৎসব-জীবনের সর্বোত্তম অনুষ্ঠান, আদিম কাল থেকে এই নৃত্য দিয়ে এসেছে তাদের জীবনে নিবিড় আনন্দের প্রেরণা···অস্তিত্বের স্বাদ···
    • রেনে মারাঁ, অনুবাদক- নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, এরাও মানুষ - নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক- র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, প্রকাশসাল- ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮৭-৮৮
  • বনচাঁড়াল গাছ দিয়া উদ্ভিদের স্পন্দনশীলতা অনায়াসে দেখা যাইতে পারে। ইহার ক্ষুদ্র পাতাগুলি আপনা-আপনি নৃত্য করে। লোকের বিশ্বাস যে, হাতের তুড়ি দিলেই নৃত্য আরম্ভ হয়। গাছের সঙ্গীতবোধ আছে কি না বলিতে পারি না, কিন্তু বনচাঁড়ালের নৃত্যের সহিত তুড়ির কোনো সম্বন্ধ নাই। তরুস্পন্দনের সাড়ালিপি পাঠ করিয়া জন্তু ও উদ্ভিদের স্পন্দন যে একই নিয়মে নিয়মিত তাহা নিশ্চয়রূপে বলিতে পারিতেছি।
    • জগদীশচন্দ্র বসু, বনচাঁড়ালের নৃত্য, অব্যক্ত - জগদীশচন্দ্র বসু, তৃতীয় সংস্করণ, প্রকাশক- বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১৬-১১৭
  • নাচতে দেখেছি সারসকে। সেই নাচকে কেবল আঙ্গিক বলা যায় না, অর্থাৎ টেক্‌নিকেই তার পরিশেষ নয়। আঙ্গিকে মন নেই, আছে নৈপুণ্য। সারসের নাচের মধ্যে দেখেছি ভাব এবং তার চেয়েও আরো কিছু বেশি। সারস যখনি মুগ্ধ করতে চেয়েছে আপন দোসরকে, তখনি তার মন সৃষ্টি করতে চেয়েছে নৃত্যভঙ্গির সংস্কৃতি, বিচিত্র ছন্দের পদ্ধতি। সারসের মন আপন দেহে এই নৃত্যশিল্প রচনা করতে পেরেছে, তার কারণ তার দেহভারটা অনেক মুক্ত।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১৪
  • এদেশী নৃত্যধুরন্ধররা যখন প্রাচীন বা প্রাদেশিক নানা শ্রেণীর নাচ নিয়ে খুব খানিকটা ধোঁয়াভরা বড় বড় কথার ফানুস ওড়াতে ও তর্কাতর্কি করতে নিযুক্ত ছিলেন, উদয়শঙ্কর তখন মানুষের সত্যকার হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করবার জন্যে লোক-নৃত্যের সাহায্যে রচনা করতে লাগলেন দৃশ্যকাব্যের পর দৃশ্যকাব্য। নাচের ওস্তাদরা সব লোকনৃত্যের আভিজাত্য স্বীকার করতে নারাজ, উদয়শঙ্করের নৃত্য-প্রতিভায় সেইগুলিই হয়ে উঠেছে বিদগ্ধজনের উপযোগী, বেগবান, বলিষ্ঠ ও বিচিত্র জীবনের উৎস এবং রূপে, রসে, বর্ণে ও দৃশ্যসঙ্গীতে অনুপম। কে বলতে পারে এই লোকনৃত্যের গতি ও ছন্দের ভিতর থেকেই আত্মপ্রকাশ করবে না ভবিষ্যতের ভারতীয় প্রধান নৃত্য?
    • হেমেন্দ্রকুমার রায়, উদয়শঙ্করের দৃশ্যসঙ্গীত, যাঁদের দেখেছি - হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক— নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলিকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৯১-২৯২
  • হায়, শম্ভু, তোমার নৃত্যে, তোমার দক্ষিণ ও বাম পদক্ষেপে সংসারে মহাপুণ্য মহাপাপ উৎক্ষিপ্ত হইয়া উঠে! সংসারের উপরে প্রতিদিনের জড় হস্তক্ষেপে যে একটা সামান্যতার একটানা আবরণ পড়িয়া যায়, ভালোমন্দ দুয়েরই প্রবল আঘাতে তুমি তাহাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিতে থাকো ও প্রাণের প্রবাহকে অপ্রত্যাশিতের উত্তেজনায় ক্রমাগত তরঙ্গিত করিয়া শক্তির নব নব লীলা ও সৃষ্টির নব নব মূর্ত্তি প্রকাশ করিয়া তোলো। পাগল, তোমার এই ক্ষুদ্র আনন্দে যোগ দিতে আমার ভীত হৃদয় যেন পরাত্মখ না হয়! সংহারের রক্তআকাশের মাঝখানে তোমার রবিকরোদ্দীপ্ত তৃতীয়নেত্র যেন ধ্রুবজ্যোতিতে আমার অন্তরের অন্তরকে উদ্ভাসিত করিয়া তোলে! নৃত্য করো, হে উন্মাদ, নৃত্য করো! সেই নৃত্যের ঘূর্ণবেগে আকাশের লক্ষকোটিযোজনব্যাপী উজ্জ্বলিত নীহারিকা যখন গ্রাম্যমাণ হইতে থাকিবে—তখন আমার বক্ষের মধ্যে ভয়ের আক্ষেপে যেন এই রুদ্রসঙ্গীতের তাল কাটিয়া না যায়! হে মৃত্যুঞ্জয়, আমাদের সমস্ত ভালো এবং সমস্ত মন্দের মধ্যে তোমারই জয় হউক্‌!
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পাগল, বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১০২-১০৩
  • এরপর যে কলরব আরম্ভ হবে, তার কাছে এখনকার এই আওয়াজ কিছুই নয়। কারণ, এই সব অনুষ্ঠান শেষ হবে গিয়ে, উৎসবের প্রধানতম ব্যাপারে, প্রণয় নৃত্যে। এই প্রণয়-নৃত্যের রাতের জন্যে সারা বছর তারা অপেক্ষা করে থাকে। বছরে একদিন মাত্র আসে এই প্রণয়-নৃত্যের রাত। এই রাতে তারা অবাধে ছেড়ে দেয় তাদের মনের সমস্ত কামনা, বাসনা আর প্রবৃত্তিকে। এই রাতে অসংযম আর অনিয়ম পায় সামাজিক অনুমোদন। অপরাধহীন অনাচারের মধু রাত
    • রেনে মারাঁ, অনুবাদক- নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, এরাও মানুষ - নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক- র‍্যাডিক্যাল বুক ক্লাব, প্রকাশসাল- ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮৪-৮৫
  • বৈঠকখানাঘরে আসিয়া দেখিলাম অনেকগুলি প্রাচীনা নারীর সমাগম হইয়াছে। তাঁহাদের মধ্যে একজন সুন্দরী যুবতী ছিলেন তিনি আমেরিকান এবং তিনি গৃহস্বামিনীর যুবক ভ্রাতুষ্পত্রের সহিত বিবাহের পূর্বে পূর্বরাগের পালা উদ্‌যাপন করিতেছেন। ঘরের গৃহিণী বলিলেন, এবার তবে নৃত্য শুরু করা যাক। আমার নৃত্যের কোনো প্রয়োজন ছিল না, এবং শরীরমনের অবস্থাও নৃত্যের অনুকূল ছিল না। কিন্তু অত্যন্ত ভালোমানুষ যাহারা জগতে তাহারা অসাধ্যসাধন করে। সেই কারণে যদিচ এই নৃত্যসভাটি সেই যুবকযূবতীর জন্যই আহূত তথাপি দশঘণ্টা উপবাসের পর দুইখণ্ড বিস্কুট খাইয়া তিনকালউত্তীর্ণ প্রাচীন রমণীদের সঙ্গে নৃত্য করিলাম।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিলাত, জীবন-স্মৃতি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৮২
  • ঘেরাটোপ ফেলে দিয়ে উর্বশী তাঁর মণিমত্তাস্বর্ণময় দৃষ্টিবিভ্রমকর উজ্জ্বল বেশ প্রকাশ করলেন। তার পর কিছুক্ষণ নৃত্য করে তাঁর উত্তরীয় বা ওড়না খুলে ফেলে দিলেন।
    পর্বত ঋষি হাত তুলে বললেন, উর্বশী, নিবৃত্ত হও, তোমার নৃত্যে শালীনতার অত্যন্ত অভাব দেখছি। এই চিত্তপীড়াকর নৃত্য আমরা দেখতে চাই না।
    মহামনি কুতুক ধমক দিয়ে বললেন, তোমার চিত্তপীড়া হয়েছে তো আমাদের কি? তুমি চক্ষু মুদ্রিত করে থাক, নৃত্য চলুক।
    • রাজশেখর বসু, নির্মোক নৃত্য, আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প - পরশুরাম, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এন্ড সন্স লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৮
  • ভোজন আরম্ভ হ’ল। বারম্বার ‘স্বাস্থ্যপান’ এবং পানপাত্র এক চুমুকে নিঃশেষ করতে হবে। এখানে ভোজসভা এক বিরাট ব্যাপার, সন্ধ্যায় আরম্ভ হয়ে শেষরাত্রি পর্যন্ত পান ভোজন নৃত্য গীত বিরামহীন ভাবে চলে। গল্প শুনলাম, কোন গ্রামে এক ‘তামাদা’ তিন দিন তিন রাত সমানে ভোজসভায় নৃত্য গীত চালিয়েছিলেন। আমাদের ‘তামাদা’ এতটা নিষ্ঠুর না হলেও সহজে রেহাই দিলেন না; রাত্রি এগারটায় নিয়ে গেলেন পর্বতচূড়ার ওপরে এক সুরম্য প্রমোদ নিকেতনে।
    • সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, আমার দেখা রাশিয়া - সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, প্রকাশক- নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড, প্রকাশসাল- ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা-১১৪
  • সৃষ্টি ও ধ্বংসের মধ্যে সেই অপরূপেরই রূপময় লীলায় নটরাজের জটাভার উন্মুক্ত হইয়া নাচিয়া নাচিয়া এই চিরন্তন বিশ্বদোলার ইঙ্গিত করিতেছে। পলকে প্রলয় পলকে সৃষ্টির সূচনা করিতেছে। তাহার বাম পদে নটরাজ মৃত্যুর উপর নৃত্য করিতেছেন, একটি দক্ষিণ হস্তে লেলিহানজিহ্বা অগ্নিশিখা লইয়া ক্রীড়া করিতেছেন, আর একটা দক্ষিণ হস্তে বিশ্বকে অভয় দিতেছেন। তাঁহার মুখে হাসি, জন্ম-মৃত্যুর খেলায় আপন লীলারসকে উন্মুক্ত করিতেছেন। মৃত্যু ও অমৃত্যুর ঝরণা তাঁহার নৃত্যের মধ্য দিয়া যেন ঝরঝর ভাবে প্রবাহিত হইতেছে। নৃত্যের মধ্যে তাঁহার লীলায়িত দেহের ও লীলায়িত বাহু-চতুষ্টয়ের ও পদযুগলের সামঞ্জস্য কোথায়ও ব্যাহত হয় নাই। প্রতি অঙ্গের লাবণ্য সমগ্র নৃত্যের ধারার সহিত আপন আপন ক্ষুদ্রধারা মিলাইয়া সমগ্র নৃত্যের সামঞ্জস্যসুষমাকে উদ্ভাসিত করিতেছে।
    • সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, ভারতীয় প্রাচীন চিত্রকলা- সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, প্রকাশক-দাশগুপ্ত এণ্ড কোং, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৯০
  • পরিকল্পনার মাধুর্ষে ও বিস্ময়প্রাচুর্যে নয়, ছন্দসৌকুমার্যে, ভঙ্গি-বৈচিত্র্যে ও কাব্যলালিত্যেও সেরাইকেলার এই ছউ নৃত্য আমার চিত্তকে ক’রে তুললে সমৃদ্ধ ও উৎসবময়। ভারতের অধিকাংশ প্রাদেশিক নৃত্যের মত- এ নাচ একদেশদর্শী নয়, মানুষের বিচিত্র জীবনকে এ দেখতে ও দেখাতে চেয়েছে সকল দিক দিয়েই। পৌরাণিক, আধুনিক, লৌকিক, আধ্যাত্মিক, ঐতিহাসিক, সাংসারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, কাল্পনিক ও বস্তুতান্ত্রিক তাবৎ চিত্রই ফুটে ওঠে এই নাচের ছন্দোবদ্ধ আঙ্গিক অভিনয়ের ভিতর দিয়ে।
    • হেমেন্দ্রকুমার রায়, সেরাইকেলার রাজাসাহেৰ, যাঁদের দেখেছি - হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক— নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলিকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬৭
  • কাল কৃষ্ণএকাদশীর নিভৃত রাত্রের নিবিড় অন্ধকারকে পূর্ণ করে সেই বীনকার তাঁর রম্য বীণা বাজাচ্ছিলেন; জগতের প্রান্তে আমি একলা দাঁড়িয়ে শুনছিলুম; সেই ঝংকারে অনন্ত আকাশের সমস্ত নক্ষত্রলোক ঝংকৃত হয়ে অপূর্ব নিঃশব্দ সংগীতে গাঁথা পড়ছিল। তার পরে যখন শুতে গেলুম তখন এই কথাটি মনে নিয়ে নিদ্রিত হলুম যে, আমি যখন সুপ্তিতে অচেতন থাকব তখনও সেই জাগ্রত বীনকারের নিশীথরাত্রের বীণা বন্ধ হবে না— তখনও তাঁর যে ঝংকারের তালে নক্ষত্রমণ্ডলীর নৃত্য চলছে সেই তালে তালেই আমার নিদ্রানিভৃত দেহনাট্যশালায় প্রাণের নৃত্য চলতে থাকবে, আমার হৃৎপিণ্ডের নৃত্য থামবে না, সর্বাঙ্গে রক্ত নাচবে এবং লক্ষ লক্ষ জীবকোষ আমার সমস্ত শরীরে সেই জ্যোতিষ্কসভার সংগীতচ্ছন্দেই স্পন্দিত হতে থাকবে।
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শোনা, শান্তিনিকেতন (১৯৩৪ প্রথম খণ্ড)-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫৫-৫৬
  • প্রেম বললে “সাগরবুকের উপরে নেই তার নীচে আছে। কুমার, আমার ঘর সাগরবুকের যেখানে প্রায় অতল সেইখানে। যেখানে সাগরবুকের ঊর্ম্মিবালারা তাদের নৃত্যে নৃত্যে আকাশের আলোক আর বাতাস মিশিয়ে আমার ঘর তৈরি করে দিয়েছে, সেইখানে আমি থাকি।”
    রাজপুত্র বিস্ময়ে সংশয়ে কতক্ষণ চুপ করেই রইলেন। তারপর বললেন, “প্রেম, কাল আসবে ত?”
    প্রেম উত্তর দিলে——“আসব বই কি রাজকুমার——নিশ্চয়ই আসব।
    • সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, একটী আষাঢ়ে গল্প।, ইরাণী উপকথা - সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, প্রকাশক- আর্য্য পাবলিশিং হাউস, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮০

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]