প্রার্থনা
অবয়ব
প্রার্থনা হলো ঈশ্বর বা অন্য কোন প্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃত সত্ত্বার নিকট কোন কিছু চাওয়া বা আকুতি করা বা তার সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রচেষ্টা। প্রত্যক্ষভাবে এর সফলতার সত্যতা ও প্রমাণ দেখা না গেলেও পালনকারীরা একে কার্যকর বলে মনে করে থাকেন। প্রার্থনা নীরবে, সরবে, গান গেয়ে, নানাবিধ অঙ্গভঙ্গিমায় সম্মান ও বদান্যতা প্রকাশ করা সহ বিভিন্নভাবে করা হয়।
উক্তি
[সম্পাদনা]- শুধু দেবদাসের জন্য বড় কষ্ট হয়। তোমরা যে-কেহ এ কাহিনী পড়িবে, হয়ত আমাদেরই মতো দুঃখ পাইবে। তবু যদি কখনো দেবদাসের মতো এমন হতভাগ্য, অসংযমী পাপিষ্ঠের সহিত পরিচয় ঘটে, তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও। প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হোক, যেন তাহার মতো এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে। মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহ-করস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে—যেন একটিও করুণার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও এক ফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ষোড়শ পরিচ্ছেদ, প্রথম সংস্করণ, প্রথম প্রকাশ- মাঘ-১৩৫৪, প্রকাশক- সরকার এ্যাণ্ড কোং, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১০
- বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা—
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে-ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মত্রাণ, সঞ্চয়িতা, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫০২
- ধর্ম্ম যেমন আমারদিগকে ব্রহ্মধামে লইয়া যান,সেই রূপ এই পৃথিবী-লোকেও ধর্ম্ম আমারদের মন্ত্রী ও সহায়। কি বিষয়ী ব্যক্তি কি ঈশ্বরানুরাগী; ধর্ম্ম সকলেরই সুহৃৎ ও রক্ষক। যাহারা কেবল বিষয়সুখকেই প্রার্থনা করে, ধর্ম্মপথে থাকিলেই তাহাদের মঙ্গল—এবং যাঁহারা ঈশ্বরকে প্রার্থনা করেন, তাঁহারাও ধর্ম্মকেই অবলম্বন করিয়া তাঁহাকে লাভ করিতে পারেন। এক দিকে শ্রেয়ঃ এক দিকে প্রেয়; এক দিকে সংসার, এক দিকে ঈশ্বর—এ দুয়েতেই সমান অনুরাগ হয় না।
- দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস- দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তৃতীয় সংস্করণ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ (১২৭৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩১
- রাজকুমার কহিলেন, “তবে আমি আর এখানে দাঁঁড়াইর না; আমার সহিত ইহাদিগের সাক্ষাতে অনিষ্ট ঘটিতে পারে। অতএব আমি চলিলাম। শৈলেশ্বরের নিকটে প্রার্থনা করি, তোমরা নির্বিঘ্নে বাটী উপনীত হও; মোদিগের নিকট এই প্রার্থনা করি যে, আমার সহিত সাক্ষাৎ হইয়া ছিল এ কথা, সপ্তাহমধ্যে প্রকাশ করিও না; বিস্মৃতও হইও না, বরং স্মরণার্থ এই সামান্য বস্তু নিকটে রাখ। আর আমি তোমার প্রভুকন্যার যে পরিচয় পাইলাম না, এই কথাই আমার হৃদয়ে স্মরণার্থ চিহ্নস্বরূপ রহিল।” এই বলিয়া উষ্ণীষ হইতে মুক্তাহার লইয়া বিমলার মস্তকে স্থাপন করিলেন।
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দুর্গেশনন্দিনী - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩১ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১-১২
- সভাভঙ্গান্তে রাজা অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। হরিদাস আপন বাসস্থানে উপস্থিত হইয়া এক অপরিচিত ব্রাহ্মণকুমারকে উপবিষ্ট দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল তুমি কে কি নিমিত্ত আসিয়াছ। সে কহিল আমি তোমার নিকটে কিছু প্রার্থনা করিতে আসিয়াছি। হরিদাস কহিল কি প্রার্থনা বল আমার সামর্থ্য হয় সম্পন্ন করিব। সে কহিল তোমার এক পরম সুন্দরী গুণবতী কন্যা আছে তাহার সহিত আমার বিবাহ দাও। হরিদাস কহিল আমি কন্যার প্রার্থনানুসারে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি যে ব্যক্তি সমস্ত বিদ্যায় পারদর্শী ও অসাধারণগুণসম্পন্ন হইবেক তাহাকে কন্যা দান করিব। সে কহিল আমি বাল্যকালবিধি পরম যত্নে নানা বিদ্যা অভ্যাস করিয়াছি। আর আমার অসাধারণ গুণ এই যে অদ্ভুত এক রথ নির্মাণ করিয়াছি তাহাতে আরোহণ করিলে ক্ষণমধ্যে বর্ষগম্য দেশেও উপস্থিত হওয়া যায়।
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পঞ্চম উপাখ্যান, বেতালপঞ্চবিংশতি - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নবম সংস্করণ, প্রকাশক- সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ (১২৭৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮৮-৮৯
- আরও মনে পড়ে শ্রাবণের গভীর রাত্রি, ঘুমের ফাঁকের মধ্য দিয়া ঘনবৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মনের ভিতরে সুপ্তির চেয়েও নিবিড়তর একটা পুলক জমাইয়া তুলিতেছে, একটু যেই ঘুম ভাঙিতেছে মনে মনে প্রার্থনা করিতেছি সকালেও যেন এই বৃষ্টির বিরাম না হয় এবং বাহিরে গিয়া যেন দেখিতে পাই, আমাদের গলিতে জল দাঁড়াইয়াছে এবং পুকুরের ঘাটের একটি ধাপও আর জাগিয়া নাই।
- আমি জানি না কী বলব, কারণ আমি জানি না ওখানে কী ঘটছে। আমি শুধু একটি কথাই বলতে পারি—আমার আলবেনীয় জনগণ সবসময়ই আমার হৃদয়ে। আমি প্রভুর কাছে খুব প্রার্থনা করি, যেন তিনি আমাদের হৃদয়ে, আমাদের পরিবারে এবং সারা বিশ্বে শান্তি আনেন। আমি আলবেনিয়ার জন্য প্রার্থনা করি, যেন প্রভু দেশের নেতাদের স্পষ্টভাবে দেখার ক্ষমতা দেন, কারণ যদি তারা শান্তিতে থাকতে চায়, তাহলে একে অপরকে ভালোবাসা উচিত।
- মাদার টেরিজা, উদ্ধৃত: লুইস জানগা, মাদার তেরেসার আলবেনিয়া সফর, রেডিও ফ্রি ইউরোপ রিসার্চ, ২৩ আগস্ট ১৯৮৯
- বিষয়-সুখ যদি ধর্ম্মের লক্ষ্য হয়,তবে সে বিপরীত লক্ষ্য; সে লক্ষ্য সিদ্ধিতেও বিস্তর ব্যাঘাত। বিষয়-সুখ বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত হইয়াই ধর্ম্ম-পথে গমন করিতে হয়; আনুষঙ্গিক যদি বিষয়-মুখ রক্ষা পায়, তবে ভালই। ধর্ম্ম কিছু বিষয়-সুখের অনুচর নহে—কিন্তু ধর্মের অনুচর যদি বিষয়সুখ হয়, তবে তাহা অবশ্য সেব্য। আমরা আত্মসুখের জন্য ধর্ম্মকে প্রার্থনা করিলে সে কেবল স্বার্থপরতা মাত্র। স্বর্গের লোভে বা নরকের ভয়ে নিরাহারে দিন যাপন করাতে ধর্ম্ম হয় না। ধর্ম্মের ভাব নিঃস্বার্থ ভাব। বিষয়সুখ যে ধর্ম্মের অব্যর্থ পুরস্কার তাহা নহে; কিন্তু সুবিমল আত্ম-প্রসাদই ধর্ম্মের পুরস্কার,ঈশ্বর ধর্ম্মের শেষ পুরস্কার। ধর্ম্মের স্বর্গীয় জ্যোতির নিকটে স্বর্ণ রৌপ্য হীরকের পার্থিব জ্যোতি কোথায় থাকে? কেবল এক লক্ষ্যের দোষে ধর্ম্মকেও দূষিত মনে হয়। বিষয়-সুখই যাহার লক্ষ্য থাকে, সে পৃথিবীতে ধর্ম্মের হীনাবস্থা ও পাপের স্ফীতভাব দেথিয়া ঈশ্বরের অখণ্ড মঙ্গল স্বরূপেতেও দোষারোপ করিতে প্রবৃত্ত হয়।
- দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস- দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তৃতীয় সংস্করণ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ (১২৭৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৬
- ধৃতরাষ্ট্র: দারুণ প্রার্থনা হে গান্ধারী রাজমাতা!
গান্ধারী: এ প্রার্থনা শুধু কি আমারি
হে কৌরব? কুরুকুল-পিতৃ-পিতামহ
স্বর্গ হ'তে এ প্রার্থনা করে অহরহ
নরনাথ! ত্যাগ কর ত্যাগ কর তা'রে—
কৌরব-কল্যাণলক্ষী যার অত্যাচারে
অশ্রুমুখী প্রতীক্ষিছে বিদায়ের ক্ষণ
রাত্রি দিন।- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গান্ধারীর আবেদন, কাব্যগ্রন্থ (পঞ্চম খণ্ড) - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান প্রেস লিমিটেড, প্রকাশস্থান- প্রয়াগরাজ, প্রকাশসাল- ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩২২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৭১
- অমিয়া বিছানার উপর বসিয়া প্রার্থনার ভাবে মনে মনে কহিল—“আমার কর্ত্তব্য, আমার প্রার্থনা, আমি যেন ভুলিয়া না যাই। হে ভগবান! স্বর্ণমৃগের প্রলোভনে ভুলিয়া আমার মন যেন দিগ্ভ্রান্ত হইয়া না পড়ে। প্রভু, আমায় বল দাও।”
প্রার্থনা শেষে সে যেন অনেকখানি শান্তি অনুভব করিল। তবু অনিচ্ছায় ও অজ্ঞাতে তাহার চোখের জল ঝরিয়া পড়িল। মনে হইল—কর্ত্তব্যের কাছে সে যেন তাহার অনেক কিছুই বলি দিল।- ইন্দিরা দেবী, স্রোতের গতি - ইন্দিরা দেবী, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১৫
- আমার বাবা সাহেব বায়ু সেবনার্থে একবার পশ্চিম দেশে যাইতেছিলেন, তাহাতে তিনি আমাকে দেখিতে আইলেন, এবং এই ক্ষুদ্র ঘরে অনেক ক্ষণ বসিয়া আমার সহিত ধর্ম্মের বিষয়ে কথোপকথন করিলেন, ও বিদায় হইবার সময়ে তিনি প্রার্থনা করিয়া গেলেন। এই সকল কথা শেষ হইলে প্যারী আরোও আমাকে বলিল, মেম সাহেব, আপনি যদি আজি যাইবার পূর্ব্বে একটি ক্ষুদ্র প্রার্থনা করেন, তবে আমি বড় আহ্লাদিতা হই। আমি এই কথাতে একেবারে সম্মতা হইলাম, তাহাতে আমরা দুই জনে ঈশ্বরের সম্মুখে হাঁটু পাতিয়া প্রার্থনা করিলাম। প্রার্থনার মধ্যে আমি এই নিবেদন করিলাম, হে প্রভো! ইহার পরে আমাদের দুই জনের পরস্পর যে আলাপ হইবে, তাহাতে তুমি আশীর্ব্বাদ দেও, যেন তদ্দ্বারা আমাদের উভয়ের ধর্ম্মবৃদ্ধি হয়।
প্রার্থনা হইলে পর প্যারী উক্ত কথা মনে করিয়া বলিল, হে মেম সাহেব, এ দরিদ্রা বুড়ির গৃহে কখন২ আসিয়া ইহার সহিত ধর্ম্মের বিষয়ে কথা কহিবেন, ও ইহাকে শাস্ত্র বুঝাইয়া দিবেন, আপনি যদি এমত মানস করিয়াছেন, তবে আমার কত বড় সৌভাগ্য! এমন হইলে আমি দায়ূদ রাজার ন্যায় বলিতে পারিব, “আমার আশীর্ব্বাদরূপ পানপাত্র উথলিয়া পড়িতেছে।”- হানা ক্যাথেরিন মুলেন্স, ফুলমণি ও করুণার বিবরণ- হানা ক্যাথেরিন মুলেন্স, চতুর্থ অধ্যায়, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ (১২৫৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১৩-১১৪
- আজকার উৎসবের দিনে আমাদের এই প্রার্থনা যে, সকল অন্ধকার ও অসত্য থেকে আমাদের জ্যোতিতে নিয়ে যাও—সোনা-হীরা-মাণিক্যের জ্যোতি নয়, কিন্তু অধ্যাত্মলোকের জ্যোতিতে নিয়ে যাও। ভারতবর্ষ আজ এই প্রার্থনা জানাচ্ছে যে, তাকে মৃত্যু থেকে অমৃতলোকে নিয়ে যাও। আমরা অকিঞ্চন হলেও তবু আমাদের কণ্ঠ থেকে সকল মানুষের জন্য এই প্রার্থনা ধ্বনিত হোক। আনন্দস্বরূপ, তোমার প্রকাশ পূর্ণ হোক।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩৯৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮৫
- তীরে নেমে মাটিতে নতজানু হয়ে কলম্বাস ভগবানকে ধন্যবাদ জানালেন, তাঁর দু’চোখ দিয়ে তখন আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ছে; তাঁর দেখাদেখি তাঁর সঙ্গের লোকেরাও নতজানু হয়ে প্রার্থনা জানালে। প্রার্থনা থেকে উঠে কলম্বাস নিজের হাতে সেই নব-আবিষ্কৃত দেশের মাটিতে স্পেনের পতাকা পুঁতে দিলেন এবং সেই অজানা দেশের নামকরণ করলেন ‘সান্ সাল্ভাডোর' (San Salvador)।
- নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, সমুদ্রজয়ী কলম্বাস - নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক- দেব সাহিত্য কুটীর, প্রকাশসাল- ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫১ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫০
- আমারে তুমি করিবে ত্রাণ, এ নহে মোর প্রার্থনা—
তরিতে পারি শকতি যেন রয়।
আমার ভার লাঘব করি নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
বহিতে পারি এমনি যেন হয়।- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মত্রাণ, সঞ্চয়িতা, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫০২
- নচিকেতা প্রার্থনা করলেন, “মৃত ব্যক্তির বিষয়ে মানুষের সন্দেহ থাকে। কেউ মনে করেন আত্মা আছে। কেউ মনে করেন নেই। আপনি আত্মার বিষয়ে আমাকে জ্ঞান দান করুন।” যম বললেন, “এ বিষয়ে দেবগণও সন্দিগ্ধ। একে জানা সম্ভব নয়। অতএব এ বিষয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ না করে অন্য বর প্রার্থনা করো।”
নচিকেতা যখন বার বারই যমের অনুরোধ ঠেলে রেখে জানালেন, “এই বর ছাড়া অন্যকিছু প্রার্থনা নেই।” তখন যম নচিকেতাকে উপদেশদানে স্বীকৃত হলেন।- প্রবীর ঘোষ, অলৌকিক নয়, লৌকিক (চতুর্থ খণ্ড) - প্রবীর ঘোষ, প্রকাশক- দে’জ পাবলিশিং, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ (১৪২৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৯
- আমার মনে হয় যেন একটা নতুন সত্যের রাজ্যে যাইতেছি, কিন্তু সাহসে তাহাতে নির্ভর করিতে পারি না। আমার অন্তরের অবস্থা তুমি তো সুস্পষ্টই বুঝিতেছ; তাহা দেখিয়া তুমি আমায় চালাইয়া নেও, এই তোমার চরণে আমার প্রার্থনা। প্রভো! আজ আবার তোমার চরণে আমার এই পতিত মাতৃভূমির জন্য প্রার্থনা করিতেছি। ইহার দুঃখ যাতনা তুমি দূর কর। যে অলৌকিক অধ্যাত্ম সম্পদ তুমি ইহাকে দিয়াছিলে, তাহা নষ্ট হইয়া যাইতেছে দয়াল, জগতে কি তাহা পাবে না? ইহার ধর্ম্ম কর্ম্ম রক্ষা কর। ইহার সন্তানগণের জীবনে শক্তি, প্রাণে সাহস, হৃদয়ে ভক্তি দাও, যেন ইহারা প্রাণপণে মাতৃসেবায় সমুদায় উৎসর্গ করিয়া তোমার লীলা প্রচার করিতে পারে। প্রভো! কৃপা কর, কৃপা কর।
- বিপিনচন্দ্র পাল, জেলের খাতা - বিপিনচন্দ্র পাল, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রকাশক- যুগযাত্রী প্রকাশক লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল= ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪১ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮৯-৯০
- সেই রাত্রেই— কাগজ কলম লইয়া স্বামীকে পত্র লিখিতে বসিল—
“তুমি ঠিক বলিতে— স্ত্রীলোককে বিশ্বাস নাই! আমিও আজ তাহাই বলিতেছি, কেন না মাধবী আমাকে শিখাইয়াছে। আমি তাহাকে বাল্যকাল হইতে জানি, তাই তাহাকে দোষ দিতে ইচ্ছা হয় না, সাহস হয় না; সমস্ত স্ত্রীজাতিকে দোষ দিই— বিধাতাকে দোষ দিই— তিনি কিজন্য এত কোমল, এই জলের মত তরল পদার্থ দিয়া নারীর হৃদয় গড়িয়াছিলেন? এত ভালবাসা ঢালিয়া দিয়া এ হৃদয় কে গড়িতে সাধিয়াছিল? তাঁহার চরণে প্রার্থনা, যেন এ হৃদয়গুলা একটু শক্ত করিয়া নির্ম্মাণ করা হয়;— আর তোমার চরণে প্রার্থনা, যেন ঐ পায়ে মাথা রাখিয়া ঐ মুখপানে চাহিয়া মরিতে পারি! মাধবীকে দেখিয়া বড় ভয় হয়,— সে আমার আজন্মের ধারণা ওলট্পালট্ করিয়া দিয়াছে। আমাকেও বেশী বিশ্বাস করিও না— শীঘ্র আসিয়া লইয়া যাইও—”- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বড়দিদি - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ, অষ্টম সংস্করণ, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪১-৪২
- বলিতে কি, মহারাজ! এখনও আমার এই সমস্ত ঘটনা স্বপ্নদর্শনবৎ বোধ হইতেছে। যাহা হউক, এক্ষণে, আমার প্রথম প্রার্থনা এই, অনুগ্রহ প্রদর্শন পূর্ব্বক আমায় পতি, পুত্র ও পুত্রবধূ লইয়া দেবালয়ে এই উৎসবরজনী অতিবাহনের অনুমতি প্রদান করেন; দ্বিতীয় প্রার্থনা এই, যে সকল ব্যক্তি আজ এই অদ্ভুত ঘটনার সংস্রবে ছিলেন, তাঁহারা সকলে, দেবালয়ে উপস্থিত থাকিয়া, কিয়ৎ কাল আমোদ আহ্লাদ করেন; তৃতীয় প্রার্থনা এই, মহারাজ নিজে উৎসবসময়ে দেবালয়ে অধিষ্ঠান করেন; চতুর্থ প্রার্থনা এই, আমার তৃতীয় প্রার্থনা যেন ব্যর্থ না হয়।
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ভ্রান্তিবিলাস - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পঞ্চম পরিচ্ছেদ, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ (১২৯৩ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১৫
- আমি তখন কবিতা লিখতুম ও গম্ভীর বিষয় সব নিয়ে সাহিত্যিকদের মত আলোচনা করতুম। উপাসনার নিয়ম ছিল এক এক দিন এক একজন ছেলে আচার্য্যের গদীতে বসে প্রার্থনা করবে। গণেশ বাবু আমাকে প্রার্থনা করবার জন্যে অনুরোধ উপরোধ আরম্ভ করলেন এবং আমার অনিচ্ছা দেখে একদিন উপাসনান্তে হঠাৎ সবার সামনে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করে দিলেন—“এইবার বারীন্দ্র কুমার প্রার্থনা করবেন”। আমি কবিত্বময় রাবীন্দ্রিক ভাষায় গদগদ কণ্ঠে এক বক্তৃতা পরম পিতার নিরাকার কর্ণের উদ্দ্যেশ্য ছেড়ে দিয়ে ছেলেদের মধ্যে এক পরম বিস্ময়ের বস্তু হয়ে উঠলুম। প্রার্থনা কিন্তু সে দিনের পর আর আমি করলুম না, এ রকম প্রার্থনা করার সমীচীনতা নিয়ে গণেশ বাবুর সঙ্গে আমার খুব এক চোট তর্ক হয়ে গেল। ভগবান যদি সর্ব্বজ্ঞই হন তা হলে তিনি পিঁপড়াটিরও মনের কথা টের পান। বক্তৃতা দিয়ে জগতের পরম শিল্পীকে কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দেবার বা অনুরোধ জানাবার কোন আবশ্যকতা থাকে না। আর ভগবৎ সাক্ষাৎকার যে করে নি তার পক্ষে ভগবানের সম্বন্ধে পঞ্চমুখ হয়ে বলা কতখানি হাস্যকর ব্যাপার। এই সব নিয়ে নিরীহ গণেশ বাবুকে আমি কিছুক্ষণ অতিষ্ঠ করে তোলায় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাঁচলেন যে আর আমায় প্রার্থনা করতে অনুরোধ করা হবে না। সুতরাং সেই থেকে নিরাকার পরব্রহ্মও রক্ষা পেলেন, আমিও বাঁচলুম।
- বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, আমার আত্মকথা - বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- আর্য্য পাবলিশিং হাউস, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১২৪-১২৫
- মনুষ্যত্বের পরম অধিকার লাভ করবার প্রার্থনা অনেকদিন জানিয়েছি— দুর্যোগের মুখে, বিঘ্নের মুখে, মোহান্ধতার মুখে এই আমার প্রার্থনা— এ প্রার্থনা ব্যর্থ হতেই পারে না— বিপুল ইন্ধনের তলায় যখন আগুন ধরে তখন সে কি চোখে পড়ে? সে নিতান্তই ছোটো, কিন্তু তার শক্তি কি কম? আজ সকালে তাঁর দরবারে আর—একবার দাঁড়িয়েছি। সমস্ত মানুষের হয়ে মানুষের বড়ো ভাই এই প্রার্থনা করে গিয়েছেন: Thy Kingdom come! আমাদের ঋষিরাও এই কথাই আর-এক ভাষায় বলেছেন: আবিরাবীর্ম এধি! সমস্ত মানুষের সেই অন্তরতম প্রার্থনাকে নিজের জীবনের মধ্যে সত্য করে তোলবার চেষ্টায় যদি বিরত হই তা হলে আমাদের প্রতিদিনের অন্ন চুরি করে খাওয়া হবে— তা হলে আমাদের মানবজন্মটা একটা অপরিশোধিত ঋণের স্বরূপ হয়ে আমাদের চিরদায়িক করে রেখে দেবে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খৃষ্ট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬২-৬৩
- নীরব গিরিলোক। পতঙ্গের কণ্ঠধ্বনি বায়ুতে। ধীর পদে হর দেহলিতে। সেখানে উপবিষ্টা পার্বতী। হরযোগীর করতলের করোটীখানি উত্থিতপার্বতী সমুখে। হর কণ্ঠে প্রার্থনা:
অন্নদা অন্নং দেহি।- রামকুমার মুখোপাধ্যায়, হর-পার্বতী কথা- রামকুমার মুখোপাধ্যায়, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, ২০২০ খৃস্টাব্দ, পৃষ্ঠা ৩২১
- তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘আর আমি অবশ্যই ক্ষমাকারী তার জন্য, যে তাওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং হেদায়েত প্রাপ্ত হয়।
- (সূরা ত্বাহা, আয়াত : ৮২)
- পরস্পর বিদায় লইবার সময় উপস্থিত হইলে, আমেরিকার অসভ্য, ইয়ুরোপীয় সভ্যের সম্মুখবর্ত্তী হইয়া, কিয়ৎ ক্ষণ, অবিচলিত নয়নে, তাঁহার মুখ নিরীক্ষণ করিল, অনন্তর, ঈষৎ হাস্য সহকারে ইয়ুরোপীয়কে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি পূর্ব্বে আর কখনও, আমায় দেখেন নাই? তিনি, তাহার দিকে সাভিনিবেশ দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া তৎক্ষণাৎ চিনিতে পারিলেন, দেখিলেন, কিছু দিন পূর্ব্বে, যে ব্যক্তি ক্ষুধার্ত্ত ও তৃষ্ণার্ত্ত হইয়া, তাঁহার আলয়ে গিয়া, জলদান দ্বারা প্রাণদান প্রার্থনা করিয়াছিল, এবং তিনি সেই প্রার্থনা পরিপূরণ না করিয়া, যৎপরোনাস্তি অবমাননা পূর্ব্বক, যাহাকে তাড়াইয়া দিয়াছিলেন, সেই অসময়ে আশ্রয় দিয়া তাহার প্রাণ রক্ষা করিয়াছে। তখন তিনি হতবুদ্ধি হইয়া অধোবদনে দণ্ডায়মান রহিলেন, এবং কি বলিয়া, পূর্ব্বকৃত নৃশংস আচরণের নিমিত্ত, ক্ষমা প্রার্থনা করিবেন, তাহা স্থির করিতে পারিলেন না।
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বর্ব্বরজাতির সৌজন্য, আখ্যানমঞ্জরী (প্রথম ভাগ) - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশক-শ্রীকার্ত্তিক চন্দ্র দে, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫৯-৬০
- হে আল্লাহ, আমার জন্য সকল দরজা খুলে দাও। হে আল্লাহ, যিনি প্রার্থনার উত্তর দেন এবং যারা তোমার কাছে প্রার্থনা করে তাদের উত্তর দেন, আমি তোমার সাহায্য প্রার্থনা করছি। আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি তোমার কাছে আমার পথ হালকা করার জন্য অনুরোধ করছি। আমি তোমাকে আমার বোঝা তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। হে আল্লাহ, তুমি সকল দরজা খুলে দাও, আমার জন্য সকল দরজা খুলে দাও, আমার জন্য সকল পথ খুলে দাও। আল্লাহ আমি তোমার উপর ভরসা করি। আল্লাহ আমি তোমার হাতে নিজেকে সমর্পণ করি.... আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, আমি একজন পাপী। আমরা ঈশ্বরের এবং আমরা ঈশ্বরের কাছেই ফিরে যাই।
- আমার দাদী আমাকে সবসময় বলতেন যে তিনি আমার প্রার্থনা ভালোবাসেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে আমার প্রার্থনা আরও শক্তিশালী, কারণ আমি ইংরেজিতে প্রার্থনা করতাম। সবাই জানে যে যীশু, যিনি শ্বেতাঙ্গ, তিনি ইংরেজিতে কথা বলতেন। বাইবেল ইংরেজিতে। হ্যাঁ, বাইবেল ইংরেজিতে লেখা হয়নি, কিন্তু বাইবেল দক্ষিণ আফ্রিকায় ইংরেজিতে এসেছিল তাই আমাদের কাছে এটি ইংরেজি। কোনটি আমার প্রার্থনাকে সেরা প্রার্থনা করে তুলেছে কারণ ইংরেজি প্রার্থনার উত্তর প্রথমে পাওয়া যায়। আমরা কীভাবে এটি জানি? শ্বেতাঙ্গদের দিকে তাকাও।
- ট্রেভর নোয়া, " একজন অপরাধের জন্ম: দক্ষিণ আফ্রিকার শৈশবের গল্প", (থিম: বর্ণবাদ, পৃষ্ঠা ৪০ )[১]
- কিছু প্রশ্ন এসে হাজির হয়—ঈশ্বর যা বলেন, তা সবই কি সত্যি? বাস্তবিকই কি ঈশ্বরের প্রার্থনা পূরণের ক্ষমতা আছে? আদৌ কি সকলের প্রার্থনা পূরণের ক্ষমতা ঈশ্বরের পক্ষে থাকা সম্ভব? দুই শত্রপক্ষ আন্তরিকতার সঙ্গে যুদ্ধ জয়ের প্রার্থনা জানালে দুজনেরই জয় এনে দেওয়া কি ঈশ্বরের পক্ষে সম্ভব? আদৌ নয়।
- প্রবীর ঘোষ, আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা - প্রবীর ঘোষ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ (১৪০৩ বঙ্গাব্দ),পৃষ্ঠা ৩৬
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]
উইকিপিডিয়ায় প্রার্থনা সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।

উইকিঅভিধানে প্রার্থনা শব্দটি খুঁজুন।