বিষয়বস্তুতে চলুন

ভারতে বর্ণপ্রথা

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে
কেউ জন্মের দ্বারা অন্ত্যজ হয় না, কেউ জন্মের দ্বারা ব্রাহ্মণও হয় না। কর্মের দ্বারা একজন মানুষ অন্ত্যজ হয়, কর্মের দ্বারাই সে ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠে। ~ সুত্তনিপাত

ভারতে বর্ণপ্রথা হলো জাতিভিত্তিক সামাজিক ব্যবস্থার একটি আদর্শ নৃতাত্ত্বিক উদাহরণ।

উক্তি

[সম্পাদনা]
  • ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক বিবর্তন এক ভিন্ন পথে ঘটেছিল এবং এর একটি স্বতন্ত্র কঠোর বংশানুক্রমিক বর্ণপ্রথার উদ্ভব ঘটে। এই বর্ণপ্রথা বাজার ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও বিভিন্ন পেশায় শ্রমবণ্টনের ওপর অনেক বেশি কড়াকড়ি আরোপ করেছিল, যা মধ্যযুগীয় ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি সীমাবদ্ধতাপূর্ণ ছিল। এই ব্যবস্থা মুঘল শাসকদের অধীনে আরেক ধরনের শক্তিশালী একনায়কতন্ত্রের ভিত্তিও তৈরি করেছিল। মধ্যযুগে বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশেও একই ধরনের ব্যবস্থা ছিল। আজকের যুগে প্রচলিত ইংরেজি ‘অ্যাংলো-স্যাক্সন’ পদবিগুলোর মধ্যে যেমন বেকার (Baker), কুপার (Cooper) ও স্মিথ (Smith), সেগুলো এক সময় পেশাভিত্তিক বংশানুক্রমিক পরিচয়ের প্রতিফলন ছিল। বেকাররা রুটি বানাতো, কুপাররা পিপে তৈরি করত, আর স্মিথরা ধাতু গলাতো। কিন্তু এই পেশাগুলি কখনোই ভারতীয় বর্ণভেদ প্রথার মতো কঠোর ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পদবিগুলি এক ব্যক্তির পেশা বোঝাতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। যদিও ভারতীয় বণিকরা ভারত মহাসাগরজুড়ে ব্যবসা করতেন এবং একটি বড় বস্ত্রশিল্পেরও বিকাশ ঘটেছিল, তবুও বর্ণপ্রথা এবং মুঘল আমলের একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভারতে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উনিশ শতকে, যখন ভারত ইংরেজদের একটি শোষণমুখী উপনিবেশে পরিণত হয়, তখন শিল্পায়নের পরিবেশ আরও প্রতিকূল হয়ে ওঠে।
    • ড্যারন আসেমোগলু ও জেমস এ. রবিনসন, হুয়াই নেশনস ফেইল: দ্য অরিজিনস অফ পাওয়ার, প্রসপারিটি অ্যান্ড পাওভার্টি (২০১২)
  • মহাত্মার দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণ ও জাতির মধ্যে কী পার্থক্য আছে? আমি কোনো পার্থক্য দেখতে পাই না। মহাত্মার সংজ্ঞায় বর্ণ আসলে জাতিরই আরেকটি নাম মাত্র, কারণ তার মূলভাব একই—নিজের বংশগত পেশাকে অনুসরণ করা। মহাত্মা অগ্রগতির পথে না গিয়ে বরং পশ্চাৎপদ হয়েছেন। তিনি বেদের বর্ণব্যবস্থার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা এই উচ্চতর ভাবনাটিকে হাস্যকর করে তুলেছে। যদিও আমি আমার ব্যাখ্যা করা কারণে বেদের বর্ণব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করি, তবুও আমাকে স্বীকার করতেই হবে—স্বামী দয়ানন্দ এবং আরও কিছু মনীষীর ব্যাখ্যায় বেদের বর্ণতত্ত্ব একটি যুক্তিপূর্ণ ও অনাক্রমণীয় ধারণা ছিল। এই তত্ত্বে ব্যক্তির সমাজে অবস্থান নির্ধারণে জন্ম কোনো মানদণ্ড ছিল না। কেবল গুণের স্বীকৃতি ছিল তার ভিত্তি। কিন্তু মহাত্মার বর্ণ-দৃষ্টিভঙ্গি বেদীয় বর্ণতত্ত্বকে শুধু অর্থহীনই করে তোলে না, একে ঘৃণার যোগ্য করে তোলে। বর্ণ ও জাতি একেবারেই ভিন্ন দুটি ধারণা। বর্ণের ভিত্তি হলো—"যার যেমন যোগ্যতা, তার তেমন কাজ"। আর জাতির ভিত্তি হলো—"যার যেমন জন্ম, তার তেমন কাজ"। এই দুইয়ের পার্থক্য চক আর পনিরের মতো। প্রকৃতপক্ষে, এদের মধ্যে বিরোধিতা আছে। যদি মহাত্মা সত্যিই বিশ্বাস করেন যে প্রত্যেকে তার বংশগত পেশা অনুসরণ করবে, তবে নিঃসন্দেহে তিনি জাতিপ্রথাকেই সমর্থন করছেন। আর তিনি যদি একে ‘বর্ণপ্রথা’ বলে চালিয়ে দেন, তবে তিনি কেবল শব্দপ্রয়োগে ভুল করছেন না, বরং বিভ্রান্তি আরও গভীর করে তুলছেন। আমি নিশ্চিত যে এই সব বিভ্রান্তির মূল কারণ হলো—মহাত্মার কাছে বর্ণ কী, জাতি কী, এবং হিন্দুধর্ম টিকিয়ে রাখার জন্য এদের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কিনা, সে সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ধারণাই নেই।
  • একটি বিষয় আমি আপনাদের বলে দিতে চাই—মনু বর্ণপ্রথার আইন তৈরি করেননি, এবং করতে পারতেনও না। বর্ণব্যবস্থা মনুর অনেক আগে থেকেই ছিল। তিনি এর সমর্থক ছিলেন, তাই এ নিয়ে দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কিন্তু তিনি হিন্দু সমাজের বর্তমান বর্ণবিন্যাস নির্ধারণ করেননি। বর্ণপ্রথার বিস্তার ও বিকাশ এত বিশাল একটি কাজ, যা কোনো ব্যক্তির বা একটি শ্রেণির ক্ষমতা বা চাতুর্যের দ্বারা ঘটানো সম্ভব নয় ...ব্রাহ্মণরা অনেক অন্যায় করে থাকতে পারেন, এবং আমি বলতে পারি, করেছেন; কিন্তু ব্রাহ্মণদের পক্ষে অ-ব্রাহ্মণদের ওপর বর্ণব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া একেবারেই সম্ভব ছিল না।
    • ভীমরাও রামজি আম্বেদকর, ১৯১৬, 'কাস্ট ইন ইন্ডিয়া. দেয়ার মেকানিজম, জেনেসিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট', ইন: রাইটিংশ অ্যান্ড স্পিচেস, বম্বে: মহারাষ্ট্র সরকার, ১৯৮৯. কোনরাড এলস্ট, "মনু অ্যাজ এ উইপন এগেনস্ট এগলিটারিয়ানিজম নিৎশে এন্ড হিন্দু পলিটিক্যাল ফিলোজফি" : সিমেন্স এবং ভাস্টি রুড্ট, সংস্করণ: নিৎশে , পাওয়ার অ্যান্ড পলিটিক্স (ওয়াল্টার ডি গ্রুইটার, বার্লিন ২০০৮) থেকে উদ্ধৃত।
  • ভারতে বর্ণপ্রথা নিয়ে জাতিগত তত্ত্ব শুধু নৃতাত্ত্বিক মাপজোকের ফলাফলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, বরং ভারতের জাতিতত্ত্ব সম্পর্কে যেটুকু তথ্য আমাদের জানা আছে, তাও এই তত্ত্বকে খুব সামান্যই সমর্থন করে। এটা খুব ভালোভাবে জানা যায় যে, একসময় ভারতের মানুষ গোত্রভিত্তিক সমাজে সংগঠিত ছিল। যদিও সেই গোত্রগুলো পরবর্তীকালে জাতিতে পরিণত হয়েছে, তথাপি গোত্রভিত্তিক সংগঠন এখনো অনেকাংশে অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
    • বি. আর. আম্বেদকর, দ্য আনটাচেবলস, ১৯৪৮, রাইটিংস অ্যান্ড স্পিচেস, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ৩০৩; এবং কোনরাড এলস্ট (২০১০), দ্য স্যাফ্রন স্বস্তিকা: দ্য নোশন অফ "হিন্দু ফ্যাসিজম", অধ্যায় ৩, আই.২৫২ থেকে উদ্ধৃত।
  • মুসলমানদের সমাজেও দুটি প্রধান শ্রেণিবিভাগ আছে—
    (১) আশরাফ বা শরাফ এবং
    (২) আজলাফ।
    "আশরাফ" মানে ‘উচ্চবংশীয়’; এই শ্রেণিতে পড়ে সেই সব লোক যারা নিঃসন্দেহে বিদেশি বংশোদ্ভূত অথবা উচ্চবর্ণ হিন্দুদের বংশধর ছিলেন এবং পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। অন্যান্য সব মুসলমান—যাদের মধ্যে পেশাভিত্তিক গোষ্ঠী ও নিচু শ্রেণির ধর্মান্তরিতরাও পড়ে—তাদের বলা হয় অবজ্ঞাসূচক বা ‘আজলাফ’, অর্থাৎ ‘নীচু’ বা ‘তুচ্ছ লোক’। এদের আরও বলা হয় ‘কামিনা’ বা ‘ইতার’, অর্থাৎ ‘নিকৃষ্ট’ অথবা ‘রাসিল’—যা ‘রিজাল’ শব্দের বিকৃত রূপ, যার মানে ‘অযোগ্য’। কিছু এলাকায় আরও একটি তৃতীয় শ্রেণি আছে, যাদের বলা হয় ‘আরজাল’ বা ‘সবচেয়ে নিচু’। এই শ্রেণির লোকদের সঙ্গে অন্য কোনো মুসলমান মেলামেশা করে না, এমনকি তাদের মসজিদে প্রবেশ ও সাধারণ কবরস্থানে দাফনের অধিকারও নেই।
  • “ইউরোপীয় বর্ণপ্রথা-গবেষকরা... নিজেরাই বর্ণবিদ্বেষে আক্রান্ত ছিলেন, তাই তারা খুব সহজে ধরে নিলেন যে বর্ণপ্রথার মূল সমস্যা বর্ণভেদ। কিন্তু সত্য থেকে এটা অনেক দূরে। ড. কেতকার একদম ঠিক বলেছেন যখন তিনি জোর দিয়ে বলেন—‘সব রাজপুত্র, তারা তথাকথিত আর্য জাতিভুক্তই হোক বা তথাকথিত দ্রাবিড়, সবাই ছিল আর্য। কোনো গোষ্ঠী বা পরিবার আর্য না দ্রাবিড়—যতক্ষণ না বিদেশি পণ্ডিতরা এসে সীমারেখা টানতে শুরু করে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই প্রশ্নে ভারতের মানুষদের কখনও কোনো মাথাব্যথা ছিল না।’’
    • ড. বি. আর. আম্বেদকর, কাস্ট ইন ইন্ডিয়া, রাইটিংস অ্যান্ড স্পিচেস, মহারাষ্ট্র সরকার, ১৯৮৬, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২১; এস. ভি. কেতকার, হিস্ট্রি অফ কাস্ট ইন ইন্ডিয়া, দিল্লি: লো প্রাইস পাবলিকেশন, ১৯৯০ (প্রথম প্রকাশ ১৯০৯), পৃষ্ঠা ৮২; এবং কোনরাড এলস্ট (১৯৯৯)।

আপডেট অন দ্য আর্যন ইনভেশন ডিবেট আদিত্য প্রকাশন, নতুন দিল্লি থেকে উদ্ধৃত।

  • পাঞ্জাবের ব্রাহ্মণ ও চামার, জাতিগতভাবে একই গোত্রভুক্ত". ... "বর্ণপ্রথা কোনো জাতিগত বিভাজন নির্ধারণ করে না। এটি একই জাতির মধ্যে সমাজিক বিভাজন মাত্র।
    • অ্যানাইহিলেশন অফ কাস্ট: রাইটিংস অ্যান্ড স্পিচেস, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪৯, শিক্ষা দপ্তর, মহারাষ্ট্র সরকার ১৯৭৯, কোনরাড এলস্ট (১৯৯১), অযোধ্যা অ্যান্ড আফটার: ইস্যুজ বিফোর হিন্দু সোসাইটি থেকে উদ্ধৃত।
  • বঙ্গের যে সারণি পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, চণ্ডালরা—যাদের সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী ষষ্ঠ স্থানে রাখা হয়েছে এবং যাদের ছোঁয়াও অশুচি মনে করা হয়—তারা ব্রাহ্মণদের থেকে শারীরিকভাবে বিশেষ ভিন্ন নয়। ...বোম্বেতে দেশস্থ ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাদের নিজেদেরই আরেক গোষ্ঠী চিতপাবন ব্রাহ্মণের তুলনায় সোন-কলি নামে মৎস্যজীবী জাতির অনেক বেশি মিল আছে। মারাঠা অঞ্চলের অস্পৃশ্য মহার জাতি, কুনবি (চাষি) জাতির সঙ্গে অনেকটাই মিল রাখে। এরপর আসে শেনভি ব্রাহ্মণ, নাগর ব্রাহ্মণ এবং উচ্চবর্ণ মারাঠারা। এই ফলাফলগুলো প্রমাণ করে যে, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের সঙ্গে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কোনো মিল নেই।.
    • ড. বি. আর. আম্বেদকর, কাস্ট ইন ইন্ডিয়া: রাইটিংস অ্যান্ড স্পিচেস, মহারাষ্ট্র সরকার, ১৯৮৬, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ৩০১ আপডেট অন দ্য আর্যন ইনভেশন ডিবেট আদিত্য প্রকাশন, নতুন দিল্লি থেকে উদ্ধৃত।
  • বর্ণব্যবস্থা মূলত সমাজে বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টনের একটি ব্যবস্থা ছিল, যেমনটি ইউরোপে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের মাধ্যমে হয়েছে। তবে ভারতে এই বণ্টনের ভিত্তিটি ছিল একান্তই দেশীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ... একজন ব্রাহ্মণ কেবল জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হতেন না, তিনি জাতির আত্মিক ও বৌদ্ধিক উৎকর্ষ রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন বলেই ব্রাহ্মণ হতেন। তার এই দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অর্জনের জন্য তাকে আত্মিক প্রবৃত্তি চর্চা করতে হতো এবং আত্মিক শিক্ষাও অর্জন করতে হতো। একজন ক্ষত্রিয় কেবল যোদ্ধা বা রাজপুত্রের সন্তান বলেই ক্ষত্রিয় হতেন না, তিনি দেশরক্ষা ও জাতির সাহসিকতা ও বীরত্ব বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করতেন, আর সেই জন্যই তাকে রাজসিক গুণাবলি অর্জন করতে হতো এবং বলিষ্ঠ ও উচ্চচেতা সামুরাই ধাঁচের প্রশিক্ষণ নিতে হতো। একইভাবে বৈশ্য জাতির দায়িত্ব ছিল জাতির জন্য সম্পদ আহরণ, আর শূদ্র জাতি পালন করতেন সেবার এমন সব ছোটোখাটো কাজ, যেগুলি ছাড়া অন্য বর্ণেরা ব্যাক্তি নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন না...
    আদিপুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে মূলত একজন আন্তরিক ব্রাহ্মণ ও একজন আন্তরিক শূদ্রের মধ্যে কোনো অসাম্য ছিল না, যার প্রতিটি অংশই অপরিহার্য। মহারাষ্ট্রের দলিত সাধক সেই ব্রাহ্মণদের গুরু হয়ে উঠেছিলেন যারা নিজেদের জাতিপবিত্রতা নিয়ে গর্ব করতেন; চণ্ডাল একদিন শংকরাচার্যের শিক্ষক হয়েছিলেন—কারণ, ব্রাহ্মণ নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন এক পরিয়া দেহে, আর চণ্ডালের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিলেন সর্বশক্তিমান শিব স্বয়ং...
    সুতরাং, বর্ণব্যবস্থা এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা বহুদিন ধরে "দ্বিতীয় হাতের সস্তা নিন্দা" সহ্য করেছে, অথচ এই ব্যবস্থা হিন্দু সভ্যতার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য গঠনে এবং এর অনন্য আদর্শ নির্মাণে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছিল।
    তবে এর মানে এই নয় যে, আমরা এই ব্যবস্থার বিকৃতি ও দুর্বল দিকগুলোর সমালোচনা করতে পারি না বা এর রূপান্তরের কথা বলতে পারি না। সব মানবিক প্রতিষ্ঠানেই একসময় পতন আসে, প্রাণশক্তি হারায়, ক্ষয়প্রাপ্ত হয়; আর এই ক্ষয়ের প্রথম লক্ষণ হলো—প্রসারযোগ্যতা হারানো ও যে আত্মা দিয়ে এটি গঠিত হয়েছিল তা ভুলে যাওয়া। আত্মা চিরন্তন, দেহ পরিবর্তনশীল; আর যে দেহ পরিবর্তন মানে না, তার মৃত্যু অনিবার্য। আত্মা বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেতে পারে, কিন্তু নিজে অপরিবর্তিত থাকে। তবে দেহকে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হলে রূপান্তর অবশ্যই ঘটাতে হয়। সন্দেহ নেই, বর্ণপ্রথা এক সময়ে পতিত হয়েছে। এটি আর আত্মিক যোগ্যতা অনুযায়ী নির্ধারিত হয় না—যা একসময় অত্যাবশ্যক ছিল—বরং এখন এটি নির্ধারিত হয় শুধুই পেশা ও জন্মের মতো ভৌতিক মানদণ্ড অনুযায়ী। এই পরিবর্তনের ফলে এটি হিন্দু ধর্মের মূল প্রবণতা—আধ্যাত্মিকতাকে প্রধান্য দিয়ে ভৌতিকতাকে গৌণ করার নীতির পরিপন্থী হয়ে পড়েছে এবং এই কারণেই এর মূল তাৎপর্য হারিয়ে গেছে। বর্ণপ্রথায় কর্তব্যবোধের পরিবর্তে স্থান পেয়েছে অহংকার, একঘরে করে রাখা এবং শ্রেষ্ঠত্বের অনুভব। আর এই পরিবর্তন জাতিকে দুর্বল করেছে এবং আমাদের আজকের অবস্থায় এনে ফেলেছে।
    • অরবিন্দ ঘোষ: ঘোষ, এ., নাহার, স., ও ইন্সটিট্যুট দ্য রিসার্শ এভল্যুটিভ (২০০০), ইন্ডিয়াস রিবার্থ: এ সিলেকশন ফ্রম শ্রী অরবিন্দোজ রাইটিংস, টকস অ্যান্ড স্পিচেস, প্যারিস: ইন্সটিট্যুট দ্য রিসার্শ এভল্যুটিভ; এবং কোনরাড এলস্ট (২০০২), হু ইজ এ হিন্দু?: হিন্দু রিভাইভালিস্ট ভিউজ অফ অ্যানিমিজম, বুদ্ধিজম, শিখিজম অ্যান্ড আদার অফশুটস অফ হিন্দুইজম। ISBN 978-8185990743 থেকে উদ্ধৃত।
  • জন্মের দ্বারা কেউ বহিষ্কৃত হয় না, জন্মের দ্বারা কেউ ব্রাহ্মণ হয় না।
    কর্মের জন্য কেউ বহিষ্কৃত হয়, কর্মের দ্বারাই কেউ ব্রাহ্মণ হয়।
  • উদাহরণস্বরূপ, ডব্লিউ. আর. কর্নিশ, যিনি ১৮৭১ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির জনগণনা পরিচালনা করেন, লিখেছিলেন: “হিন্দুরা যে কখনও চারটি বর্ণে বিভক্ত ছিল—এই ধারণাটি ভীষণভাবে সন্দেহজনক।” অনুরূপভাবে, সি. এফ. ম্যাগ্রাথ, যিনি ১৮৭১ সালের বিহার জনগণনার ওপর একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন, মন্তব্য করেছিলেন: “মনুর তথাকথিত চার বর্ণের যে বিভাজন, তা এখন অর্থহীন ও বাতিলযোগ্য।”
    • ক্রবর্তী, সঞ্জয় (২০১৯), ভিউপয়েন্ট: হাউ দ্য ব্রিটিশ রিশেইপড ইন্ডিয়াজ কাস্ট সিস্টেম, ১৯ জুন. সংগৃহীত ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২। https://www.bbc.com/news/world-asia-india-48619734. মালহোত্রা, রজিভ এবং বিশ্বনাথন, বিজয় (২০২২). স্নেইক্স ইন দ্য গঙ্গা: ব্রেকিং ইন্ডিয়া ২.০ থেকে উদ্ধৃত।
  • ঔপনিবেশিক যুগের অনেক পর পর্যন্ত উপমহাদেশের বহু অঞ্চলে এমন মানুষ বাস করতেন, যাদের কাছে বর্ণগত বিভেদ খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না—এমনকি তথাকথিত ‘হিন্দু হৃদয়ভূমি’ বলেও পরিচিত অঞ্চলগুলোতেও। বর্ণব্যবস্থার যে সমস্ত প্রথা ও বিশ্বাসকে আজ আমরা “ঐতিহ্যবাহী” বলে মনে করি, সেগুলি আসলে গড়ে উঠতে শুরু করেছিল কেবলমাত্র ১৮শ শতকের গোড়ার দিকে।
    • সুসান বেলি , উদ্ধৃত Chakravorty, চক্রবর্তী, সঞ্জয় (২০১৯), ভিউপয়েন্ট: হাউ দ্য ব্রিটিশ রিশেইপড ইন্ডিয়াজ কাস্ট সিস্টেম, বিবিসি, ১৯ জুন. সংগৃহীত ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২। https://www.bbc.com/news/world-asia-india-48619734. মালহোত্রা, রজিভ এবং বিশ্বনাথন, বিজয় (২০২২). স্নেইক্স ইন দ্য গঙ্গা: ব্রেকিং ইন্ডিয়া ২.০ থেকে উদ্ধৃত।
  • প্রথমদিকের ইন্দো-আর্যরা আধুনিককালের বর্ণবৈষম্যের ধারণার কথা ভাবতেই পারত না, যেমনটা তারা উড়োজাহাজ আবিষ্কার কল্পনাও করতে পারত না।
  • ব্রিটিশদের কাছে বর্ণব্যবস্থা ছিল এক বিরাট বাধা—একটি নিঃসন্দেহে খারাপ জিনিস, কিন্তু তার কারণ এই নয় যে তারা শ্রেণিহীন সমাজে বিশ্বাস করত বা বৈষম্যহীন সমাজে। বরং বর্ণব্যবস্থা ছিল ভারতীয় সমাজকে ভেঙে ফেলার পথে তাদের প্রধান বাধা।... বর্ণব্যবস্থা সমাজের এককীকরণের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করত এবং তা ব্রিটিশদের পক্ষে শাসন কঠিন করে তুলত। আজকের দিনে ভারতীয় সমাজকে বর্ণভিত্তিতে সংগঠিত থাকার বিরুদ্ধে যে তীব্র সমালোচনা ও মতবাদ প্রচলিত হয়েছে, তার সূচনা মূলত ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই।
    • রামপাল ধরমপাল (২০০৩), রিডিসকভারিং ইন্ডিয়া: কালেকশন অফ এসেজ অ্যান্ড স্পিচেস, ১৯৫৬–১৯৯৮, মুসৌরি: সোসাইটি ফর ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট অফ হিমালয়াজ; উদ্ধৃত: মালহোত্রা, রজিভ এবং বিশ্বনাথন, বিজয় (২০২২)। স্নেইক্স ইন দ্য গঙ্গা: ব্রেকিং ইন্ডিয়া ২.০
  • ঐতিহাসিকভাবে, হিন্দুধর্ম নির্ধারণে জাতব্যবস্থাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জোর—তা নিরীহ কিছু ছিল না। এটি ছিল ব্রিটিশদের 'বিভাজনের মাধ্যমে শাসন' কৌশলের অংশ, যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই মানদণ্ডগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে নিম্নবর্ণ এবং কিছু নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে - হিন্দু রীতিনীতি ও বিশ্বাস মেনে চললেও - হিন্দু পরিচয় থেকে বাদ দেওয়া যায়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু সমাজকে ভেঙে ফেলা। ‘স্বদেশি আন্দোলনের নেতৃত্ব যেহেতু প্রধানত উচ্চবর্ণের হাতে ছিল, তাই এই ‘পরীক্ষা’টি করা হয়েছিল নিম্নবর্ণদের হিন্দু পরিচয় থেকে আলাদা করার জন্য, যাতে উচ্চবর্ণরা যাদের প্রতিনিধি বলে দাবি করত, তাদের সংখ্যা কমে আসে।’ এই পরীক্ষা বাস্তবে ১৯০৯ সালে মুসলিম লীগের নেতা আমীর আলীর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেছিল, যেখানে তিনি নিম্নবর্ণদের হিন্দু পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করার কথা বলেছিলেন। এরপর থেকেই দেখা যায়, হিন্দুবিরোধী শিবিরে জাতব্যবস্থাকে অতিরঞ্জিত করা হয়, আর হিন্দু পুনর্জাগরণপন্থী শিবিরে এর গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়ার বা একেবারে বিলুপ্তির জন্য চেষ্টা চলে আসছে।
    • প্রদীপ কুমার দত্ত, কোনরাড এলস্ট (২০০২)। হু ইজ আ হিন্দু?: হিন্দু রিভাইভালিস্ট ভিউস অফ এনিমিজম, বুদ্ধিজম, শিখিজম অ্যান্ড আদার অফসুটস অফ হিন্দুইজম. ISBN 978-8185990743, with প্রদীপ কুমার দত্ত: ডাইং হিন্দুস, ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি, ১৯ জুন ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৩০৬ থেকে উদ্ধৃত।
  • আজকের দিনে আমরা যে জাতব্যবস্থাকে জানি, তা আসলে প্রাচীন ভারতের কোনো অপরিবর্তিত অবশেষ নয়, কোনো একক কাঠামো নয় যা ভারতীয় সভ্যতার মূল মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে, এমনকি ভারতীয় ঐতিহ্যের মৌলিক প্রকাশও নয়। বরং আমি বলব, আজকের জাতব্যবস্থা একটি আধুনিক বাস্তবতা, যা গড়ে উঠেছে ভারতের সঙ্গে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসনের এক ঐতিহাসিক সংঘাত থেকে। আমি এই কথায় বোঝাতে চাই না যে জাতব্যবস্থা শুধুই চতুর ব্রিটিশদের সৃষ্টি; বরং বলছি, ব্রিটিশ শাসনের সময়ই ‘জাত’ শব্দটি একটি একক ধারণায় পরিণত হয়, যা ভারতের নানা সামাজিক পরিচয়, সম্প্রদায় ও সংগঠনকে প্রকাশ, বিন্যস্ত ও ‘ব্যবস্থাবদ্ধ’ করতে শুরু করে। এটি একটি স্পষ্ট (যদিও বিতর্কিত) মতাদর্শিক কাঠামোর মাধ্যমে তৈরি হয়, যা ঔপনিবেশিক আধুনিকতার বাস্তব রূপ। সংক্ষেপে, জাতব্যবস্থাকে আজ যেভাবে আমরা জানি, তা মূলত ঔপনিবেশিক শাসনেরই ফল।
  • বৈদিক যুগ থেকে এই ব্যবস্থা ধীরে ধীরে আরও কঠোর ও জটিল হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। শুধু প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক জড়তা নয়, বরং রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বহিরাগত জাতি ও ধর্মের বারবার আক্রমণে এই জাতপ্রথা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে—মূলত মুসলিম ও হিন্দুদের রক্তের মিশ্রণ ঠেকানোর এক প্রতিরোধব্যবস্থা হিসেবে। এই জাতব্যবস্থা ছিল ধনবান শ্রেণি বা সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিকল্প, যা সাধারণত অভিজাততন্ত্রের বাইরে আর কোনো স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থা দেয় না। এটি ভারতে শত শত বিপ্লব আর দখলের মাঝেও একটি সামাজিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা তৈরি করেছিল, যার তুলনা কেবল চীনের সঙ্গে করা যায়। যখন রাষ্ট্রের ভিত নড়বড়ে, তখন ব্রাহ্মণরা জাতব্যবস্থার মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল সমাজ গঠন করে সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখে, উন্নত করে এবং উত্তরাধিকার হিসেবে পৌঁছে দেয়। জাতি তাদের সহ্য করেছিল—এমনকি তাদের ওপর গর্বও করেছিল—কারণ সবাই জানত, শেষ পর্যন্ত তারাই ভারতের একমাত্র অপরিহার্য শাসক।
    • উইল ডিউরান্ট, আওয়ার ওরিয়েন্টাল হেরিটেজ
  • এই ভুলটা যে কত বড় প্রভাব ফেলেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। "শ্বেতাঙ্গ আর্যরা এসে কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসীদের পরাজিত করেছিল"—এই গল্পটা এতটা ছড়িয়ে পড়ে যে অনেক লেখক, যাদের আদৌ কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না, সাদামাটা ভাবে একে সত্য বলে ধরে নিয়েছেন। এই ভুলের ওপর দাঁড়িয়েই তৈরি হয়েছে আরও এক গোঁড়া ভুল—যেখানে বলা হয়, সংস্কৃত শব্দ বর্ণ মানে "চর্মের রঙ"। কিন্তু বাস্তবে বর্ণ মানে একটিমাত্র রঙ নয়, বরং একটি ধারাবাহিকতার অংশ—যেমন রঙের ধারায় একেকটা রঙ, সমাজের স্তরে একেকটা শ্রেণি, কিংবা ধ্বনির ধারায় একেকটা শব্দ বা বর্ণ (এই কারণেই তো আমরা বলি “বর্ণমালা”)।... “জাতিগত আর্য” ধারণাটা, যা নাৎসি যুগে বিশ্বজুড়ে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল, আসলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ব্যাখ্যায়ও বেশ জনপ্রিয় ছিল। এমনকি অনেক ভারতীয় লেখকও এই ধারণাকে অনুকরণ করেছেন। অথচ এই পুরো ভাবনাটা দাঁড়িয়ে আছে একটা সাধারণ ভুল অনুবাদের ওপর।... আসলে, জাতি (jāti) শব্দটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই পুরনো "race" শব্দের সব অর্থ—রক্তের সম্পর্ক, গোষ্ঠী, জাতি, প্রজাতি। যেমন, "মানবজাতি" মানে "human race" নয়, বরং "human species" বললে বেশি সঠিক হয়।... আর বর্ণ—যাকে অনেকেই গায়ের রঙ মনে করেন—তার আসল অর্থ সেইটা নয়। এটা বোঝাতো প্রতীকী রঙ, যেমন দিক, উপাদান বা সমাজের স্তর অনুযায়ী রঙ। অনেক সংস্কারবাদী হিন্দু, যাঁরা বর্ণপ্রথাকে জন্মের ভিত্তিতে নয় বরং যোগ্যতার ভিত্তিতে ভাবতে চান, তাঁরা মনে করেন বর্ণ এসেছে সংস্কৃত ধাতু var- থেকে, যার মানে “পছন্দ করা”—যেমন “স্বয়ম্বর” শব্দে দেখা যায়। অর্থাৎ, one's varṇa বা সমাজে কার কোন স্তরে অবস্থান, তা জন্ম নয়, নিজের পছন্দ বা যোগ্যতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। এই ব্যাখ্যার সঙ্গে মিল রয়েছে স্ট্যানলি ইনসলারের অনুবাদেও, যেখানে তিনি জেন্দ অবেস্তার সমার্থক শব্দ 'বর্ণ' (varanā)-এর মানে করেছেন “preference” বা পছন্দ। কেউ কেউ একে বলেন “বিশ্বাস” বা “ধর্মীয় পরিচয়”। আরও গভীরে দেখলে দেখা যায়, ঋগ্বেদে বর্ণ শব্দটা ২২ বার এসেছে—তার মধ্যে ১৭ বারই দেবতাদের জ্যোতি বা দীপ্তি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন ঊষা, অগ্নি, সোম ইত্যাদির ক্ষেত্রে। দু-এক জায়গায় এটা আকাশের আলো বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, আর কয়েক জায়গায় দাসদের "বর্ণ" দমন করার কথা বলা হয়েছে, যার মানে তাদের দীপ্তি বা শক্তি। র‍্যালফ গ্রিফিথ তো এক জায়গায় একে অনুবাদ করেছেন “the fury of the Dasa”। একটা মজার উদাহরণ আছে ঋগ্বেদের একটা কামনাময় স্তোত্রে (৪:১৭৯)। সেখানে বলা হয়েছে, ঋষি অগস্ত্য সন্তানলাভের জন্য স্ত্রী লোপামুদ্রার সঙ্গে মিলনে “উভয় বর্ণ”-কে তৃপ্ত করেন। কেউ কেউ বলেন, এখানে স্বামী-স্ত্রীর দুই পরিবারের আনন্দ বোঝানো হয়েছে, আবার কেউ বলেন, সংসার আর বৈরাগ্যের দুই পথকেই বোঝানো হয়েছে। যেভাবেই হোক, কোথাও এখানে জাতি বা বর্ণবাদ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি।
  • এই সামাজিক ব্যবস্থা কখনোই আপনাআপনি গড়ে ওঠেনি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা বৈদেশিক শাসনের এর ওপর প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। আমরা ধরে নিতে পারি যে, আগে থেকেই যখন সমাজের উঁচু স্তরের মানুষরা বহিরাগত শাসনের চাপে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন তারা নিজেরাও নিচু শ্রেণির ওপর বেশি চাপ সৃষ্টি করে।... একটি সমাজ যদি প্রতিরক্ষার ভূমিকায় চলে যায়, তবে তা আরও কঠিন হয়ে ওঠে, ভেতরে ভেতরে সংঘাতও বাড়ে। হয়তো এই বিশ্লেষণ সহজ মনে হতে পারে, কিন্তু এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত—যে বর্ণব্যবস্থার কিছু অমানবিক রূপ, যেটা আমরা সাম্প্রতিক যুগে দেখেছি, তা অনেকটাই বাইরের হস্তক্ষেপের ফল, বিশেষ করে মুসলিম শাসনের দরিদ্রতাকর, হিংস্র ও মনোবল ধ্বংসকারী প্রভাব। ... বর্ণব্যবস্থার মূল দর্শন ছিল একেবারেই ভিন্ন। এই দর্শন অনুসারে, আলাদা মানসিকতা ও গুণাবলির মানুষদের জন্য আলাদা দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়, বয়সভেদে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরণের কর্তব্য থাকে। সমাজ ও রাষ্ট্রের মাঝামাঝি স্তরে গোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব বিকাশের সুযোগ ছিল এখানে। এর সঙ্গে কোনো একরকমের কাঠামো চাপিয়ে দেওয়ার, বা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার একরূপতার মিল নেই।
    • কোনরাড এলস্ট (১৯৯১). অযোধ্যা অ্যান্ড আফটার: ইসুজ বিফর হিন্দু সোসাইটি থেকে উদ্ধৃত।
  • হিন্দু বর্ণব্যবস্থার পেছনে মূল ব্যাখ্যা হলো উপজাতি সমাজে বিয়ের রীতিনীতির (এনডোগ্যামি) ঐতিহ্য। বৈদিক সমাজ যখন উত্তর-পশ্চিম থেকে ভারতের অভ্যন্তরে বিস্তৃত হচ্ছিল, তখন তারা বহু উপজাতিকে নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করেছিল। তবে সেই উপজাতিগুলোকে নিজেদের বিয়ের নিয়ম-নীতিসহ আলাদা সাংস্কৃতিক পরিচয় বজায় রাখতে দেওয়া হয়েছিল। এভাবেই স্বতন্ত্র উপজাতিগুলো বদ্ধ সমাজ হিসেবে রয়ে গেল, কিন্তু হিন্দু সমাজের ভেতরেই – অর্থাৎ তারা পরিণত হলো আলাদা "জাতি" বা বর্ণে।
  • ভারতে বর্ণ-চেতনার প্রধান উৎসই এই আদি উপজাতীয় আন্তঃবিবাহ বা নিজগোষ্ঠীর ভেতরেই বিয়ে করার ঐতিহ্য। যখন কোনো উপজাতি সম্প্রসারিত বৈদিক সমাজে অন্তর্ভুক্ত হতো, তখন তাদের আলাদা পরিচয় ও বাইরের সীমা নির্ধারণকারী এই আন্তঃবিবাহের রীতিকে সম্মান জানানো হতো... সামাজিক স্তরবিন্যাস কোনো আর্য জাতির চাপিয়ে দেওয়া বর্ণবাদ নয়, বরং এটা এক প্রকারের বৈশ্বিক ঘটনা। এমনকি এটি ভারত-প্রশান্ত অঞ্চলের বহু অনার্য জনগোষ্ঠীতেও দেখা যায়।
    • কোনরাড এলস্ট (২০১০) দ্য স্যাফ্রন স্বস্তিকা: দ্য নোশন অফ "হিন্দু ফ্যাসিজম" অধ্যায় তিন, পৃষ্ঠা ২৫২ থেকে উদ্ধৃত।
  • তবু এটা বলতে হয়, 'শ্বেতাঙ্গ আর্যরা এসে কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসীদের পরাজিত করেছিল'—এই ব্যাখ্যাটি ছিল একটি মারাত্মক ভুল ধারণা, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এই মতবাদ অনেক লেখকই মেনে নিয়েছেন, এমনকি যাদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না, তাঁরাও। এর ফলেই আরেকটা ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়ে—যে সংস্কৃত "বর্ণ" শব্দের অর্থ গায়ের রঙ, অর্থাৎ চর্মবর্ণ। কিন্তু বর্ণ শব্দের আসল মানে হলো 'একটা ধারাবাহিকতার একটা অংশ'—যেমন দৃষ্টির বর্ণালি (রঙ), সমাজের বর্ণালি (শ্রেণি), আর শব্দের বর্ণালি (বর্ণমালা)। 'জাতিগত আর্য'-এর পুরো চিন্তাধারাটা, যেটা নাৎসি যুগে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভাষ্যেও জনপ্রিয় ছিল, আসলে গড়ে উঠেছে এই একটিমাত্র ভুল অনুবাদের ওপর!
    • বর্ণ সম্পর্কে।
    • কোনরাড এলস্ট, দি ইউনিক প্লেস অফ শ্রীকান্ত তালাগেরি'জ কন্ট্রিবিউশন টু দা ইন্দো-ইউরোপিয়ান হোমল্যান্ড ডিবেট। তালাগেরি, এস. জি. (২০১৯). জেনেটিক্স এন্ড দি আর্যন ডিবেট থেকে উদ্ধৃত।
  • [হান্স হক এই বর্ণবাদী ব্যাখ্যার উৎপত্তিকে তুলে ধরেছেন সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে, যখন ইউরোপীয় শক্তিগুলো বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ গড়ে তুলতে উঠেপড়ে লেগেছিল। এই প্রেক্ষিতে তিনি বলেন]—"ব্রিটিশরা যেভাবে ভারতে দখল নিয়েছিল, অনেকেই সেটাকেই প্রাগৈতিহাসিক ভারতে তথাকথিত 'আর্য আক্রমণের' সাথে তুলনা করে দেখতে শুরু করেছিল।”... তিনি আরও বলেন, “গায়ের রঙ দিয়ে 'জাতি' বা 'রেস' নির্ধারণ করার ধারণা আসলে আধুনিক ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদেরই উদ্ভাবন... এই বর্ণভিত্তিক ব্যাখ্যাকে সন্দেহজনক বলেই বিবেচনা করা উচিত।”
    • হান্স হক, কোনরাড এলস্ট (২০০৭). আস্টেরিস্ক ইন ভরোপীয়স্থান: মাইনর রাইটিং ইন আর্যন ইনভেশন ডিবেট থেকে উদ্ধৃত।
  • প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে গায়ের রঙ নিয়ে কোনো মোহ বা অতি গুরুত্ব দেওয়ার নিঃসন্দেহ প্রমাণ নেই। বরং, কৃষ্ণ, দ্রৌপদী, অর্জুন, নকুল, এমনকি দময়ন্তীর মতো মহাকাব্যিক নায়ক-নায়িকাদের অনেকেই গাড় (কৃষ্ণ বর্ণ) রঙের মানুষ হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। আবার অজন্তার গুহাচিত্রগুলোতেও নানা বর্ণের মানুষের চিত্র আঁকা হয়েছে। কিন্তু এইসব চিত্র কিংবা সাহিত্যে আমরা কোথাওই দেখি না যে, গায়ের রঙ গাঢ় বলে কাউকে খারাপ, গুণহীন বা অগভীর চরিত্রের বলা হয়েছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, সংস্কৃত সাহিত্যে যেসব ক্ষেত্রে গায়ের রঙ উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে সেটা ব্যক্তিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে—পুরো কোনো জাতিগোষ্ঠীকে গায়ের রঙের ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে, এমন প্রমাণ নেই।"
    • হান্স হক, থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি:মডান বেসিয়াল ইন্টারপ্রিটেশন ভারসেস টেকচুয়াল এন্ড জেনারেল অন আর্য এন্ড দাস/দাসায়ু ইন বেদিক সোসাইটি। ১৪৫-১৭৪. আর্যন এন্ড নন-আর্যন ইন সাউথ এশিয়া: এভিড্যান্স, ইন্টারপিটিশন, এন্ড আইডিওলজি, প্রসিডিংস অফ দা ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার অন ইন সাউথ এশিয়া, ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান, আ্যন আরবর, ২৫-২৭ অক্টোবর, ১৯৯৬, জন ব্রঙ্কহর্স্ট এবং মাধব এম দেশপান্ডে দ্বারা সম্পাদিত। হার্ভার্ড ওরিয়েন্টাল সিরিজ, অপেরা মিনোরা, ৩. ১৯৯৯।
  • গোপথ ব্রাহ্মণে ব্রাহ্মণদের বর্ণ বলা হয়েছে "শুক্ল"—অর্থাৎ ফর্সা বা সাদা। কিন্তু কথক সংহিতায় একই শব্দ "শুক্ল" ব্যবহৃত হয়েছে বৈশ্যদের জন্য, এবং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে, সেখানে রাজন্যদের (ক্ষত্রিয়দের) বর্ণ বলা হয়েছে "ধূম্র"—অর্থাৎ গাঢ় বা ধোঁয়াটে রঙের। পরবর্তীকালে জাতিভেদ অনুযায়ী চারটি বর্ণকে চারটি নির্দিষ্ট রঙের সঙ্গে যুক্ত করা হয়—ব্রাহ্মণদের জন্য সাদা (শুক্ল), ক্ষত্রিয়দের জন্য লাল (রক্ত), বৈশ্যদের জন্য হলুদ (পীত), এবং শূদ্রদের জন্য কালো (কৃষ্ণ)... তবে এই রঙগুলোর প্রতীকী ব্যাখ্যাও আছে। যেমন—ব্রাহ্মণদের সাদা রঙ পবিত্রতার প্রতীক, ক্ষত্রিয়দের লাল রঙ রক্তের—অর্থাৎ যুদ্ধ ও সাহসিকতার প্রতীক, বৈশ্যদের হলুদ রঙ পাকা শস্যের এবং সম্ভবত সোনার রঙ হিসেবেও ধরা যায়—যা বাণিজ্য ও ঐশ্বর্যের প্রতীক। শূদ্রদের কালো রঙকে ধরা হয়েছে শ্বেত বা সাদা রঙের বিপরীত হিসেবে—যা পবিত্রতা থেকে বিচ্যুত এক শ্রেণিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। এই শ্রেণিটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে অনেক আগেই বাদ হয়ে গিয়েছিল।
    • হান্স হক, থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি:মডান বেসিয়াল ইন্টারপ্রিটেশন ভারসেস টেকচুয়াল এন্ড জেনারেল অন আর্য এন্ড দাস/দাসায়ু ইন বেদিক সোসাইটি। ১৪৫-১৭৪. আর্যন এন্ড নন-আর্যন ইন সাউথ এশিয়া: এভিড্যান্স, ইন্টারপিটিশন, এন্ড আইডিওলজি, প্রসিডিংস অফ দা ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার অন ইন সাউথ এশিয়া, ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান, আ্যন আরবর, ২৫-২৭ অক্টোবর, ১৯৯৬, জন ব্রঙ্কহর্স্ট এবং মাধব এম দেশপান্ডে দ্বারা সম্পাদিত। হার্ভার্ড ওরিয়েন্টাল সিরিজ, অপেরা মিনোরা, ৩. ১৯৯৯।
  • এই সময়কাল নিয়ে লেখালেখি করা প্রায় সব ঐতিহাসিক—যারা না মার্ক্সবাদী, না ইসলামের পক্ষপাতদুষ্ট—মেনে নেন যে হিন্দুদের ব্যর্থতার কারণ ছিল তাদের সমাজব্যবস্থা, বিশেষ করে জাতিভেদ প্রথা। কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই ব্যাখ্যাটা অতটা সহজ নয়। বরং এই মতামতটাই বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে ইতিহাসকে উল্টোভাবে বোঝায়। আসলে হিন্দু সমাজব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং জাতিভেদ কঠিন হয়ে উঠেছিল তখন, যখন হিন্দুরা রাজনৈতিক ক্ষমতা হারায়। প্রচুর প্রমাণ আছে যে, ইসলামী আগ্রাসনের ঠিক আগেই হিন্দু সমাজে সেইসব জটিলতা ছিল না, যেগুলো পরে দেখা যায়। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, শুরুতে হিন্দুদের যে মজবুত আর সুসংগঠিত সমাজব্যবস্থা ছিল, সেটাই তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস থেকে রক্ষা করেছিল। আর সেটাই ধীরে ধীরে তাদের লড়াইয়ের শক্তি জুগিয়েছে এবং ভবিষ্যতে বিজয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। যেসব দেশ—যেমন ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মিশর আর উত্তর আফ্রিকা—ইসলামী শাসনের অধীনে ছিল, তারা মূলত হারিয়ে গিয়েছিল কারণ তাদের সমাজে এমন কোনো কাঠামো ছিল না যা এত বড় ধাক্কা সামলাতে পারত।
  • মুসলমানদের রাজনৈতিক মতাদর্শ হিন্দু সমাজজীবনে দ্বিমুখী প্রভাব ফেলেছিল—একদিকে জাতিভেদ প্রথাকে আরও কঠোর করে তোলে, অন্যদিকে এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বীজ বপন করে।
    • আর্নেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল:দ্য হিস্ট্রি অফ আরৃযন রুল ইন ইন্ডিয়াড়, ফ্রম দ্য টাইমস টু দ্যা ডেথ অফ আকবর [৪], মানবেন্দ্রনাথ রায়।
      কোনরাড এলস্ট (২০০১) ,হিস্টোরিকাল রোল অফ ইসলাম এন্ড ডিকলোনাইজিং দ্য হিন্দু মাইন্ড আইডিওলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট অফ হিন্দু রিভাইভালিসম, নয়াদিল্লি: পৃষ্ঠা ৪০৮ থেকে উদ্ধৃত।
  • 'এটি ভ্রান্ত ধারণা হবে যদি মনে করা হয় যে বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম শুরু থেকেই জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে সচেতনভাবে পরিচালিত হয়েছিল। আদতে, বৌদ্ধধর্ম যখন আবির্ভূত হয়, তখন জাতি ব্যবস্থা কেবল গঠিত হতে শুরু করেছিল। আর পরবর্তীকালে, যখন বৌদ্ধধর্ম তার ধর্মপ্রচারের পথে এগোয়, তখন এই জাতি ব্যবস্থাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়—সেসব অঞ্চলে, যেখানে তখনও এই প্রথা প্রবেশ করেনি।'
    • ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার: ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার: ইমপেরিয়াল গেজেটিয়ার, ১৯০৭; উদ্ধৃত করেছেন জে. কুলকার্নি, হিস্টোরিকাল ট্রুথস, পৃষ্ঠা ২৭।
  • মধ্যযুগের ইসলামি সাহিত্যে হিন্দুদের ‘কাফের’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, বহুদেববাদ এবং মূর্তি পূজার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু তখনকার সমাজে ছড়িয়ে থাকা জাতিভেদ, অশুচিতা এবং অচ্ছুৎদের ওপর হওয়া দমন-পীড়নের কোনো সমালোচনা সেখানে পাওয়া যায় না। ... মুসলমানদের মনোভাব জাতিভেদ প্রথা নিয়ে বিরোধিতার নয়, বরং ছিল অনেকাংশেই নির্লিপ্ত বা গ্রহণযোগ্যতার...
    • ইরফান হাবিব, কোনরাড এলস্ট (২০০১)। ডিকলোনাইজিং দ্য হিন্দু মাইন্ড আইডিওলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট অফ হিন্দু রিভাইভালিসম, নয়াদিল্লি: পৃষ্ঠা ৪০৮ থেকে উদ্ধৃত।
  • একজন সাধকের জাত জানতে চাওয়া বৃথা;
    কারণ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য—সবাই তো ঈশ্বরকে খুঁজছে।

    সাধুর জাত জানতে চাওয়াটা নিছকই মূর্খতা;
    নাপিত, ধোপা, কাঠমিস্ত্রী - সবাই তো ঈশ্বরের সন্ধানে —
    রবিদাসও তো ঈশ্বরের অন্বেষণ করেছিলেন।
    • কবীর: সংস অব কবীর (অনুবাদ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
  • তৎকালীন ফারসি ভাষার ইতিহাসচর্চায় কোথাও জাতিভেদের কারণে ধর্মান্তরের কথা উল্লেখ নেই। মধ্যযুগীয় ভারতের মুসলিম ঐতিহাসিকরা অবশ্যই হিন্দু সমাজে জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন—যেমন আলবিরুনি, আবুল ফজল বা সম্রাট জাহাঙ্গীরের কথাই ধরা যায়। তবু কেউই কখনো বলেননি যে নিম্নবর্ণের ওপর অত্যাচার ধর্মান্তরের কারণ ছিল। তাদের লেখালেখি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভারতে ইসলাম প্রচার হয়েছিল একই উপায়ে যেমনটা দেখা গেছে আরব, পারস্য, মধ্য এশিয়া বা উত্তর আফ্রিকায়। ভারতে ইসলামের প্রচার প্রথম ছিল না; এর আগে বহু দেশে তা ছড়িয়েছে, যেখানে জাতিভেদ বলে কিছুই ছিল না—তবু সেখানে ব্যাপক ধর্মান্তর ঘটেছিল।
    • কে. এস. লাল: ইন্ডিয়ান মুসলিমস, ডিকলোনাইজিং দ্য হিন্দু মাইন্ড আইডিওলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট অফ হিন্দু রিভাইভালিসম, নয়াদিল্লি: পৃষ্ঠা ৩৯৬ থেকে উদ্ধৃত।
  • বিশেষ করে দিল্লি সালতানাত তেমন কার্যকর কোনও সাম্রাজ্য ছিল না... দিল্লির দক্ষিণে মেওয়াত অঞ্চলে শূদ্ররা সুলতানদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে—তারা বন-জঙ্গল থেকে গেরিলা যুদ্ধ চালাত। সুলতান নাসিরউদ্দিন ও বলবন প্রথমে জঙ্গল পরিষ্কার করে তবেই এই প্রতিরোধকারীদের খুঁজে বের করে জোর করে ইসলাম ধর্মে রূপান্তর ঘটান। কে. এস. লাল একটি ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দের শিলালিপি উদ্ধৃত করেছেন, যেখানে অন্ধ্রের রেড্ডি রাজবংশ জানায়—যুদ্ধে ক্ষত্রিয়দের নির্মূলের পর, গোরু আর ব্রাহ্মণদের রক্ষার দায়িত্ব পড়ে শূদ্রদের ওপর, যাঁরা “বিষ্ণুর পা থেকে জন্মেছিলেন”। আরেকটি শিলালিপিতে রাজা ভীমের গৌরব বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবে—তিনি ছিলেন “বিজয়ী চতুর্থ বর্ণে”র সন্তান, যিনি সেই অঞ্চল শাসন করতেন যা আগে দ্বিজদের হাতে ছিল, মুসলিম বিজয়ের আগ পর্যন্ত। তার বড় ছেলে অন্না-ভোটা ব্রাহ্মণদের জন্য অগ্রহারা দান করেছিলেন, আর ছোট ছেলে অন্না-ভেমা শত্রুদের বিতাড়িত করে বিদ্বানদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। মনে হয় শূদ্ররা সেই সময়ে নিজেদের জন্য এক ধরনের গর্বের কাজ বলে মনে করতেন—দেশরক্ষা করা এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা।
  • কে. এস. লাল; এপিগ্রাফিকা ইন্ডিকা, জে. রামাইয়া, ই. হুল্টশ, কে. রাম শাস্ত্রী; কোনরাড এলস্ট (২০০১)। ডিকলোনাইজিং দ্য হিন্দু মাইন্ড আইডিওলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট অফ হিন্দু রিভাইভালিসম, নয়াদিল্লি: পৃষ্ঠা ৪০২-৪০৪ থেকে উদ্ধৃত।
  • নিম্নবর্ণের মানুষরা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের উচ্চবর্ণের মানুষদের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের একই জাতিভুক্ত মানুষের চেয়ে জেনেটিক বা বংশগতভাবে বেশি মিল রাখে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে—“উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, বাংলা এবং তামিলনাড়ুর জনগণের ওপর বিশদ মানবদেহ-ভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে, একই জাতির মধ্যে অঞ্চলভেদে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। বরং একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিভিন্ন বর্ণের জাতির মধ্যে যে মিল দেখা যায়, তা অন্য অঞ্চলের একই জাতির মানুষের তুলনায় অনেক বেশি।”
    • কৈলাস সি. মালহোত্রা, সাক্ষাৎকারে এন. ভি. সুব্রহ্মণ্যম; “দ্য ওয়ে উই আর. অ্যান এএসআই প্রোজেক্ট শ্যাটারস সাম এন্ট্রেঞ্চড মিথস ”, সানডে, ১০ এপ্রিল ১৯৯৪,কোনরাড এলস্ট (১৯৯৯)।

আপডেট অন দ্য আর্যন ইনভেশন ডিবেট আদিত্য প্রকাশন, নতুন দিল্লি থেকে উদ্ধৃত।

  • প্রাচীন ঋক বৈদিক যুগের প্রসঙ্গে ভি. এম. আপ্টে বলেছেন—ঋগ্বেদে বর্ণব্যবস্থার উল্লেখ আছে ঠিকই, কিন্তু তা কোনওরকম বৈষম্য বা শ্রেণীবিন্যাসের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। তার মতে, সেই সময় ব্রাহ্মণরা কোনও একচেটিয়া জাতি বা বর্ণ ছিল না। ঈশ্বরদের উদ্দেশে স্তোত্র রচনা করা বা পূজা-আর্চা সম্পাদনের কাজ শুধু পুরোহিত পরিবার থেকেই আসতো, এমন নয়। কবি বা চিকিৎসকের মতো পেশাগুলোও তখন ছিল অনেক বেশি উন্মুক্ত ও নমনীয়। আপ্টে জোর দিয়ে বলেন, ঋগ্বেদে কোথাও এমনকি আভাসও নেই যে ভিন্ন বর্ণের মানুষদের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া বা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। অথচ আজকের সময়ে এই দুটি বিষয়ই জাতিভেদের সবচেয়ে কঠিন রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
  • পরবর্তী স্মৃতি যুগে... কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন এই সময়ই ভারতে কিছু কিছু অঞ্চলে বৈদেশিক শাসকরা প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। আর তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে, বা পরিস্থিতির মোকাবিলায়, বর্ণভিত্তিক আইনি অধিকার নির্ধারণের প্রচলন শুরু হয়। মনে করা হয়, ব্রাহ্মণরা সেই সময় এমন আইন তৈরি করেছিলেন যাতে বিদেশি ক্ষত্রিয় রাজাদের অধিকার সীমাবদ্ধ করা যায়।
  • এমনকি বুদ্ধের উপদেশের কারণে ভারতীয় সমাজে বড় পরিসরে কেউ বর্ণ বা জাতিভিত্তিক পরিচয় বর্জন করেছে—এমন প্রমাণ নেই।
  • বিশিষ্ট সংস্কৃত পণ্ডিত জি. সি. পাণ্ডে মনে করেন, বেদ-পরবর্তী যুগে ধর্মশাস্ত্রগুলোই প্রথম বর্ণ এবং জাতিকে এক করে গুলিয়ে ফেলে। এই সময়েই ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব ধীরে ধীরে উত্তরাধিকারসূত্রে পুরোহিতত্ব পাওয়ার একপ্রকার বৈধ অধিকারে পরিণত হয়।
  • ব্রিটিশ ভারতে জাতিভেদ যেমনভাবে প্রচলিত ছিল... ঠিক তেমনভাবেই ভারতের অভ্যন্তরীণ সমাজেও তা ছিল ব্যাপকভাবে ছড়ানো।
    • ফিলিপ ম্যাসন, অর্নামেন্টালিজম: হাউ দ্য ব্রিটিশ স' দেয়ার এম্পায়ার, ডেভিড কানাডাইন থেকে উদ্ধৃত।
  • জার্মানিক মধ্যযুগ ছিল আর্য বর্ণব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক প্রচেষ্টা... এই সময়ের সামাজিক সংগঠনকে দেখলে মনে হয়, তা যেন সেই প্রাচীন ভারতীয়-আর্য সমাজের ধারণাগুলোকে পুনরুদ্ধার করার এক অস্থির খোঁজ, তবে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যার মূল নিহিত হতাশাজনিত জাতিগত অবক্ষয়ের মাটিতে লিপ্ত।”
    • ফ্রিডরিখ নিৎশে, কোনরাড এলস্ট মনু অ্যাজ এ উইপন এগেন্সত এগেনস্ট এগলিটারিয়ানিজম: নিৎশে এন্ড হিন্দু পলিটিক্যাল ফিলোজফি উদ্ধৃত : সিমেন্স ও ভাস্তি রুড্ট, সংস্করণ: নিৎশে, পাওয়ার এন্ড পলিটিক্স (ওয়াল্টার ডি গ্রুটার, বার্লিন ২০০৮) থেকে উদ্ধৃত।
  • তথাকথিত নিচু জাতির প্রতি যে 'অস্পৃশ্যতা'র সামাজিক রীতি প্রচলিত, তার সূচনা সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের নব্য-প্রস্ত্রর যুগীয় সংস্কৃতিতে হয়েছিল (জর্জ হার্টের মতে: দ্য পোয়েম অফ এনসিয়েন্ট তামিল, ১৯৭৫)। তবে এটি বৈদিক সমাজে ছিল না, কিন্তু মুসলমান যুগের আগেই তা গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।... তবুও, ইসলামের আগমন এই সমস্যাগুলিকে আরও তীব্র করে তোলে। কিশোরী মেয়েকে বাল্যবিবাহ দেওয়াটা তখন অনেকটা নিরাপত্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, কারণ মুসলিম সৈন্য ও শাসকরা যখন তখন মেয়েদের তুলে নিতে পারে—এই ভয় ছিল সর্বত্র। জাত-ব্যবস্থার সংস্কার তখন হিন্দু সমাজের জন্য অগ্রাধিকার ছিল না, কারণ তখন তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল শুধু টিকে থাকা। উপরন্তু, উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও নিজেদের ওপর মুসলিম শাসকদের দমন নেমে আসার পর নিজেদের নিচুদের ওপর আরও বেশি দমনমূলক আচরণ করতে থাকে—এই মনস্তত্ত্বও কাজ করেছিল।
  • হিন্দু পুনর্জাগরণবাদী ইতিহাস চর্চায় এখন একটি নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা আধুনিক পশ্চিমা গবেষণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতব্যবস্থাকে নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্ন করছে। এই ইতিহাস বলছে, জাতব্যবস্থা এমন কোনও 'প্রাচীন, চিরস্থায়ী' কাঠামো ছিল না; ব্রিটিশদের জনগণনা আর প্রশাসনিক শ্রেণিবিন্যাসের কারণেই তা স্থায়ী ও কঠোর হয়ে ওঠে। এমনকি জওহরলাল নেহরুও বলেছিলেন—“হিন্দু সমাজকে খুব রক্ষণশীল বলাটা ঠিক নয়। অতীতে এখানে পরিবর্তন এসেছে আইন দিয়ে নয়, বরং মানুষের অভ্যাসের মাধ্যমে—মানুষ নিজেরাই বদলেছে।”
    • নেহরু, কোনরাড এলস্ট (২০০২).হু ইজ এ হিন্দু?: হিন্দু রিভাইভালিস্ট ভিউজ অফ অ্যানিমিজম, বুদ্ধিজম, শিখিজম অ্যান্ড আদার অফশুটস অফ হিন্দুইজম। ISBN 978-8185990743, নেহেরুর প্রসঙ্গে, টিবোর মেন্ডের সাথে নেহেরুর কথা: মিঃ নেহেরুর সাথে কথোপকথন, পৃষ্ঠা ১০৭ থেকে উদ্ধৃত।
  • আমরা অতীত থেকে যেসব নিয়ম কানুন অন্ধভাবে বহন করে চলেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং ইতিহাসের আবর্জনার ঝুড়িতে ছুড়ে ফেলার মতো হলো এই কঠোর জাতব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাই আমাদের হিন্দু সমাজকে অসংখ্য ক্ষুদ্র উপ-গোষ্ঠীতে ভাগ করেছে, যারা একে অপরের সঙ্গে সবসময় দ্বন্দ্বে লিপ্ত। মন্দির থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি, চাকরি, গ্রাম সভা, আইন ও আইনসভা—সব ক্ষেত্রেই এই জাতিভেদ কেবল হিন্দুদের মধ্যে চিরস্থায়ী দ্বন্দ্বের বিষ ছড়িয়েছে। এই জাতব্যবস্থাই আমাদের ঐক্যকে দুর্বল করেছে, বাইরের হুমকির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি কেড়ে নিয়েছে। হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণার পথে এটি অন্যতম বড় বাধা।
  • নতুন যুগের স্বঘোষিত সামাজিক ন্যায়বাদের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক দলগুলো এমন এক ভারত চায় না যেখানে জাত নেই; বরং তারা চায় এমন এক জাতব্যবস্থা, যেখানে ধর্ম থাকবে না।
    • রাম স্বরূপ: “লজিক বিহাইন্ড পার্ভার্সন ও কাস্ট”, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৩-৯-১৯৯৬ ।
  • সিংগয়া-নায়ক (১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দ) এর একটি শিলালিপিতে লেখা আছে: “তিনটি বর্ণ—যেমন ব্রাহ্মণ, এবং পরবর্তী [ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য]—উদ্ভূত হয়েছেন পরমেশ্বরের মুখ, বাহু এবং উরু থেকে; এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য তার পদ থেকে জন্ম নিয়েছেন চতুর্থ বর্ণ [শূদ্র]। এই চতুর্থ বর্ণ যে পূর্ববর্তী তিন বর্ণের থেকেও পবিত্র, তা স্পষ্টই প্রতীয়মান; কারণ এঁরাও গঙ্গার সঙ্গে একসাথে জন্মেছেন, যিনি পদ থেকে উৎসারিত এবং তিনটি জগতের পবিত্রতা রক্ষাকারী। এই বর্ণের মানুষরা নিজেদের কর্তব্যে মনোযোগী, দুষ্ট নয়, নির্মলচেতা এবং কাম-ক্রোধের মতো দোষ থেকে মুক্ত; তাঁরা রাজবংশীয় বর্ণে জন্ম নেওয়াদের সহায়তা করে দক্ষতার সঙ্গে পৃথিবীর ভার বহন করেন।” অন্য একটি শিলালিপিতে বলা হয়েছে, কপয়া-নায়ক নামক তার এক আত্মীয় “মুসলমানদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে অন্ধ্র দেশকে উদ্ধার করেন।”
    • কে. রামা শাস্ত্রী: “আক্কালাপুন্ডি গ্র্যান্ট অফ সিংগয়া-নায়ক:“সাকা সম্বৎ ১২৯০”, এপিগ্রাফিকা ইন্ডিকা, খণ্ড ১৩ (এএসআই পুনর্মুদ্রণ, ১৯৮২), পৃষ্ঠা ২৫৯ ও পরবর্তী;, খণ্ড.৫-৭. ডিকলোনাইজিং দ্য হিন্দু মাইন্ড আইডিওলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট অফ হিন্দু রিভাইভালিসম, নয়াদিল্লি: পৃষ্ঠা ৪০২-৪০৪ থেকে উদ্ধৃত।
  • ভারতে লাভজনক চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দু উচ্চবর্ণদের ক্রমাগত অতিরিক্ত উপস্থিতি দেখে যে কেউই বলবেন, এই কাঠামোটি অত্যন্ত অযৌক্তিক ও খামখেয়ালি ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে। হিন্দু উচ্চবর্ণের যে বিশ্বাস—এই দেশ শাসন করা, বিচার করা কিংবা শিক্ষা দেওয়ার অধিকার শুধুই তাদের—তা একেবারেই ভিত্তিহীন। এবং অন্য সব বর্ণ ও ধর্মের শিশুদের যেন তাদের দেওয়া শিক্ষা ও বিচার ব্যবস্থার জন্য কৃতজ্ঞ থাকা উচিত—এই ধারণাও নেহাৎ একপাক্ষিক।
  • [ট্রটম্যানও দেখিয়েছেন যে ‘বর্ণ’ শব্দের যেটি প্রচলিত অনুবাদ—‘রং’, তার ভিত্তিতে ‘ত্বকের রং’ অর্থ করা ভুল:] তাঁর মতে, ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট, এখানে বর্ণ মানে কেবলই ‘শ্রেণি’ বা ‘সামাজিক গোষ্ঠী’।”
    • থমাস ট্রটম্যান, কোনরাড এলস্ট (২০০৭). এস্টেরিস্ক ইন ভারোপীয়স্থান: মাইনর রাইটিংস অন দ্য আর্যন ইনভেশন ডিবেট থেকে উদ্ধৃত
  • ব্রাহ্মণ লেখকরা শুধু বিদ্যমান জাতব্যবস্থাকে লিপিবদ্ধ ও ন্যায়সঙ্গত বলে প্রতিষ্ঠা করেননি, বরং সম্ভবত সেই ব্যবস্থাকে আরও কঠোরও করেছেন। পুরাণ ভিত্তিক হিন্দুধর্মের বহু প্রভাবশালী গ্রন্থের চূড়ান্ত সম্পাদনার সময়, তারা জাতগত ভেদাভেদকে শুধু সামাজিক নয়, অপ্রয়োজনীয়ভাবে আত্মিক মুক্তির ক্ষেত্রেও টেনে এনেছেন; ধর্ম ও কর্মের যুক্তির সঙ্গে জাতের কর্তব্যকে জুড়ে দিয়েছেন। ...“এই সকল গ্রন্থে প্রারম্ভিক সংযোজন ও পরবর্তী সংযোজনগুলোর মধ্যে মনোভাবের ক্ষেত্রে এক বিশাল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়”, অর্থাৎ—পরবর্তীকালে জাতি-ভেদের চরম মাত্রায় কঠোরতা যুক্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোর কড়া জাত-ভেদব্যবস্থা হিন্দু সমাজের ইতিহাসে একটি অপেক্ষাকৃত নতুন সংযোজন, চিরকালীন নয়। ...এই পার্থক্য—প্রাচীন যুগে অপেক্ষাকৃত কম জাতভেদ এবং খ্রিস্টীয় যুগে অধিক জাতভেদের যে চিত্র, তা প্রমাণ করে এমনকি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলির জাতি-বিরোধী যুক্তিও। যেমন মরিস উইন্টারনিত্জ মন্তব্য করেন বজ্রসূচী নামক একটি গ্রন্থ সম্পর্কে, যা ব্রাহ্মণজাত ভিক্ষু অশ্বঘোষ রচিত বলে প্রচলিত: “এই রচনাটি ব্রাহ্মণ্য জাতব্যবস্থাকে প্রচণ্ডভাবে খণ্ডন করে। লেখক (...) নিজেই বেদ, মহাভারত ও মনুসংহিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করতে চান যে ব্রাহ্মণ জাতির দাবি কতটা দুর্বল।”
    • মরিস উইন্টারনিত্জ, জে. এল. ব্রকিংটন, কোনরাড এলস্ট (২০০২). হু ইজ আ হিন্দু?: হিন্দু রিভাইভালিস্ট ভিউস অফ এনিমিজম, বুদ্ধিজম, শিখিজম অ্যান্ড আদার অফসুটস অফ হিন্দুইজম. ISBN 978-8185990743,এবং জে. এল. ব্রকিংটন: রাইটস রাম, পৃষ্ঠা ১৫৮. এবং মরিস উইন্টারনিত্জ (এ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান লিটারেটার খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৬৫–২৬৬) থেকে উদ্ধৃত।
  • বৈদিক সভ্যতা তার শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের মধ্যে অনেক “পিছিয়ে-পড়া” সম্প্রদায়ের মানুষকেও স্থান দিয়েছে—যেমন মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসদেব, রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকী, বা তামিল কবি তিরুভল্লুভার। ‘আর্য’ শব্দের অর্থ এখানে কোনো জাতিগত বা ভাষাগত নয়; বরং সাংস্কৃতিক অর্থে ব্যবহৃত—যার মানে হলো ‘বৈদিক’, আর কিছু নয়।
    • কোনরাড এলস্ট রেতুরিটার্ন অফ দ্য স্বস্তিকা:হেট এন্ড হিস্তেরিয়া ভার্সেস হীিন্দু স্যানিটী (২০০৭) থেকে উদ্ধৃত।
  • বিশ্বে কোনো দেশই জাত-বিচারহীন নয়। ভারতে জাতিভিত্তিক সমাজ থেকেই আমরা ধাপে ধাপে এমন অবস্থানে পৌঁছাই, যেখানে জাতির সীমা বিলুপ্তির পথ তৈরি হয়। ভারতীয় জাতব্যবস্থার মূল দর্শনই এমন। ভারতের পরিকল্পনাই হচ্ছে—সবার মধ্যেই ব্রাহ্মণসুলভ গুণ বিকাশ ঘটানো; কারণ ব্রাহ্মণই মানবজাতির আদর্শরূপ। আপনি যদি ভারতের ইতিহাস খুঁজেন, দেখবেন নিম্নবর্গকে উন্নীত করার প্রচেষ্টা বরাবরই হয়েছে। অনেক শ্রেণি উঠে এসেছে, আরও অনেক উঠে আসবে—এভাবেই একদিন সবাই ব্রাহ্মণ হয়ে উঠবে। সেটাই প্রকৃত লক্ষ্য। আমাদের কাজ তাদের উন্নত করা, কাউকে নিচে নামানো নয়...ভারতীয় জাতব্যবস্থা ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় অনেক ভালো। আমি বলছি না এটি পুরোপুরি নিখুঁত। তবে যদি জাত না থাকত, তবে আপনি আজ কোথায় থাকতেন? বিদ্যা, সংস্কৃতি—কোনোকিছুই থাকত না। ইউরোপীয়দের জন্য কিছুই পড়ে থাকত না গবেষণার জন্য। মুসলমানরা সবকিছু ধ্বংস করে ফেলত।” ...“জাতি, রীতি—এসব সবসময়ই পরিবর্তনশীল। যা অপরিবর্তনীয়, তা হলো এর মূলতত্ত্ব। জাতব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত নয়; বরং সময়ে সময়ে তা পুনর্গঠিত হওয়া দরকার। পুরনো কাঠামোর মধ্যেই এত জীবনীশক্তি রয়েছে যে, সেখান থেকে নতুন দুই লক্ষ কাঠামো গড়ে তোলা যায়। জাত উঠিয়ে দেওয়ার ভাবনাটি একেবারে অমূলক। নতুন পন্থা হলো—পুরনোকে বিবর্তনের পথে এগিয়ে নেওয়া।”
    • স্বামী বিবেকানন্দ কমপ্লিট ওয়ার্কর্স অফ বিবেকানন্দ, খণ্ড ৫. Quoted from গোয়েল এস. আর. (২০১৬). হিস্ট্রি অফ হিন্দু-ক্রীশ্চিয়ান এনকাউন্টার্স, ৩০৪ থেকে ১৯৯৬ খ্রীস্টাব্দ. অধ্যায় ১৩ ISBN 9788185990354 [৫]
  • আর আপনি যত দিন ‘আর্য’ না ‘দ্রাবিড়’, ব্রাহ্মণ না অব্রাহ্মণ—এই ধরনের তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে কাটাবেন, তত দিন আপনি সেই শক্তি আর উৎসাহ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন, যা ভবিষ্যতের ভারত গড়ে তুলতে পারত।
    • স্বামী বিবেকানন্দ
    • ডানিনো, মিশেল, & নাহার,শিখা. (১৯৯৬). দ্য ইনভেসন দ্যাট নেভার ওয়াজ (প্রথম প্রকাশন)। মাদার'স ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ ও মীরা আদিতি, মাইসোর, ইন্ডিয়া।
  • স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, মানবসমাজে চারটি শ্রেণি পালা করে নেতৃত্ব দেয়। প্রাচীন হিন্দু যুগে ব্রাহ্মণরা ছিলেন চিন্তার প্রধান চালক। তারপর এল ক্ষত্রিয়দের শাসন—যার ছাপ পড়েছিল রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে সতেরো শতকের ইউরোপীয় আধিপত্যে। এরপর বৈশ্যরা উঠে এলেন সামনে—যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল আমেরিকার উত্থানে। আর তারপর আসবে শ্রমজীবী শূদ্রদের সময়। এই চার চক্র পূর্ণ হলে আবার আত্মিক জগৎ মাথা তুলে দাঁড়াবে। তখন আবার ব্রাহ্মণদের মাধ্যমে মানবসভ্যতা নতুন করে আলোর পথ পাবে। বিবেকানন্দ গভীর বিশ্বাসে বলতেন, ভবিষ্যতের ভারতের গৌরব অতীতের সব গৌরবকে ছাড়িয়ে যাবে।
    • স্বামী নিখিলানন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ : এ বায়োগ্রাফি (১৯৭৫); এখানে "বৈশ্য" বলতে মূলত বাণিজ্য ও অর্থনির্ভর মানুষদের বোঝানো হয়েছে, আর শূদ্র বলতে বোঝানো হয়েছে সাধারণ পরিশ্রমী, কর্মজীবী শ্রেণিকে।
  • একজন হিন্দু যদি আরেকজন হিন্দুকে বিয়ে করে, তাতে তার জাত যেতে পারে, কিন্তু তার হিন্দুত্ব যায় না।
    • বিনায়ক দামোদর সাভারকর, হিন্দুত্ব, পৃষ্ঠা ৯০।
  • সৃষ্টির সূচনালগ্নে ভারত ছিল বিশ্বের অগ্রদূত। এখানেই গড়ে উঠেছিল প্রথম সভ্যতা, প্রথমবারের মতো এখানে জমা হতে শুরু করেছিল বস্তুগত সম্পদ। এদেশ ছিল চিন্তাশীল ও সূক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বাসভূমি। এখানে ছিল বিভিন্ন খনিজের খনি, গভীর বনভূমি, উর্বর জমি। সব দিক থেকেই মনে হতে পারে, ভারতকে আজও শীর্ষে থাকার কথা ছিল—নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার মতো স্বাধীন এক জাতি, বিশ্বের প্রতিটি জাতিকে পথ দেখানোর মতো এক নেতৃত্বের আসনে থাকার কথা ছিল তার। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতের পক্ষে এমন বিশ্ব-নেতৃত্ব কখনোই সম্ভব ছিল না। যদি ভারত একটি দেশ হতো, একটি ভাষায় কথা বলতো—তাহলে হয়তো কিছু হতো। কিন্তু এখানে ছিল আশিটি ভাষা, আশিটি জাতি! যখন একটি দেশের ভেতরেই শত শত শাসনব্যবস্থা আর পরস্পরের সঙ্গে বিবাদমান জাতি থাকে, তখন অগ্রগতির বদলে বিভাজনই নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। এমন ছিন্নমূলতার মধ্যে ঐক্য, দিশা বা নেতৃত্বের চিন্তা বাতুলতা মাত্র। এমনকি বর্ণব্যবস্থাও ভাষাবিভেদের মতোই বিভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে—কারণ তা সমাজকে একের পর এক স্তরে ভাগ করে দেয়, এমনভাবে ভাগ করে দেয় যে, এক স্তরের মানুষের সঙ্গে অন্য স্তরের কোনো মনের মিল বা সংযোগ থাকে না। এই অবস্থায় দেশপ্রেমের কোনো স্বাস্থ্যকর বিকাশ সম্ভব নয়।
  • নিয়মতান্ত্রিকভাবে হিন্দুধর্মের প্রসার সাধারণত এইভাবে ঘটে—স্থানীয় দেবতাদের নতুন করে হিন্দু দেবতা ও দেবীদের নামে চিহ্নিত করা হয়। এরপর কোনো ব্রাহ্মণকে ডেকে আনা হয়, যিনি আচার-অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নেন। একইসঙ্গে তিনি নিজেকে এবং অন্যদের বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেন যে, ওই গোষ্ঠীর শাসকরা প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন কালের, শুধু সাময়িকভাবে বিস্মৃত, ক্ষত্রিয় রক্তধারী বংশোদ্ভূত।
  • সমাজ আর রাজনীতিতে শাসকশ্রেণি ও পুরোহিতশ্রেণির মধ্যে যে ঐক্য গড়ে ওঠে, তার মূল ভিত্তি থাকে স্বীকৃত ধর্মের দ্বারা সেই শক্তিকে বৈধতা দেওয়া। হিন্দু সমাজে অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানে ছিল এমন ধর্মীয় বৈধতা পাওয়া, যা ‘বর্বর’ রাজাদের একদিকে সংস্কৃতিবিশ্বে মর্যাদাসম্পন্ন করে তোলে, অন্যদিকে তাদের বর্ণে রূপান্তরের মাধ্যমে প্রজাদের ওপর এক অদ্বিতীয় কর্তৃত্ব দেয়—এমন কার্যকারিতা অন্য কোনো ধর্মে দেখা যায় না
  • “তাই, বন্ধুরা, বর্ণ নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনো লাভ নেই। এতে আমরা একে-অপর থেকে আরও দূরে সরিয়ে পড়ব, আমাদের আরও দুর্বল করে দেওয়া হবে, আরও নিচু করা হবে।
    • স্বামী বিবেকানন্দ. কমপ্লিট ওয়ার্কস, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৯৪
  • ভারতের মানুষকে উন্নীত করে তোলাই ছিল আর্যদের উদ্দেশ্য, কেবল নিজেদের সমান নয়—তাদের চেয়েও উঁচু স্তরে নিয়ে যাওয়া। ইউরোপীয়দের উদ্দেশ্য ছিল নিজে বাঁচতে হলে অন্য সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রধান হাতিয়ার ছিল তরবারি, আর আর্য সভ্যতার ভিত্তি ছিল বর্ণব্যবস্থা। এই বর্ণভেদ আসলে সভ্যতার পথে একটি ধাপ—জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে মানুষকে ক্রমাগত উন্নত হতে সহায়তা করে। ইউরোপে সর্বত্র বলবান জেতে, দুর্বল মরে। অথচ ভারতের প্রতিটি সামাজিক নিয়ম দুর্বলের সুরক্ষার জন্যই তৈরি।
  • বর্তমানে প্রয়োজন একটি সাবধানী ও বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পাদিত অভিধান বা গেজেটিয়ার, যাতে ব্রিটিশ ভারতের জাতি, উপজাতি ও সামাজিক বিভাজনগুলি সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত থাকবে। এটি বর্ণানুক্রমিকভাবে প্রধান নাম অনুযায়ী সাজানো হবে, সমস্ত সমার্থক ও বিকল্প নাম রোমান হরফে নিখুঁতভাবে লিপ্যন্তরিত করে স্থানীয় ভারতীয় বর্ণমালায়ও উপস্থাপন করা হবে। ভারতে জাতব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করাটা বৃথা—এটা যেন ভারতের বাতাসে মিশে আছে। ইংরেজ তার নিজের জাত নিয়ে এসে এই তালিকায় আরেকটি মাত্রা যোগ করেছে। তবে জাতব্যবস্থার কিছু সুবিধাও আছে। গভীর অথচ নিরীহ বিভাজনের কারণে বিপজ্জনক রাজনৈতিক গোপন সংগঠন গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। জাতির পঞ্চায়েত এক সৎ শাসকের জন্য সহায়ক শক্তি। রোমান প্রবাদই প্রমাণ—“Divide et impera” অর্থাৎ বিভাজনের মাধ্যমে শাসন। ধর্ম বা ভাষার বিভেদ যত বড়ই হোক, জাতির বিভাজন তার চেয়েও কার্যকর। এছাড়া, দরিদ্রদের সাহায্য করার জন্য আলাদা কোনও দারিদ্র্য-আইনের প্রয়োজন পড়ে না, জাত ব্যবস্থা তা নিজের মতো সামলে নেয়। জাতি তার সদস্যদের সম্মান বজায় রাখে, যেভাবে ইউরোপীয়রাও নিজের দেশে লিখিত না হলেও কিছু নিয়ম মেনে চলে। ইংরেজ সরকার প্রকাশ্য প্রশাসনে জাতিকে উপেক্ষা করলেও প্রতিটি শ্রেণির ব্যক্তিগত অধিকারকে সম্মান করেছে। বেসামাল কোনও আচরণে কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগলে, দেওয়ানি আদালত প্রতিকার দিয়েছে। আর কারও জল কূপ বা অন্য সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার আটকানোর, কিংবা কোনও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামাজিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা হলে, তা কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। আমি আনন্দিত যে ব্রিটিশ ভারতে একটি জাতিগত জরিপ (Ethnological Survey) চালুর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
    • রবার্ট নিডহ্যাম কাস্ট, লিঙ্গুইস্টিক অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল এসেস: ১৮৪৭ থেকে ১৮৮৭, কোটেড ইন চক্রবর্তী, ডি. কে., ১৯৯৭। কলোনিয়াল ইন্ডোলজি: সোশিওপলিটিক্স অফ দ্য এইনশিয়েন্ট ইন্ডিয়ান পাস্ট. নিউ দিল্লি: মুন্সিরাম মনোহরলাল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ১২৪ থেকে উদ্ধৃত।
  • ব্রিটিশদের কাছে জাতব্যবস্থা ছিল একটি বিরাট বাধা, এক নির্মম দানব—তবে সেটা এই কারণে নয় যে তারা জাতহীন সমাজে বিশ্বাস করত বা সমতাভিত্তিক কোনও আদর্শে। বরং জাতব্যবস্থা তাদের পক্ষে ভারতীয় সমাজকে টুকরো টুকরো করে দেওয়া কঠিন করে তুলেছিল। জাতি ছিল এক সামাজিক কাঠামো, যা ভারতীয় সমাজের ভাঙন ঠেকাত। ব্রিটিশদের শাসন ও দখলের পথে এই কাঠামোই অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজকের দিনে জাতির বিরুদ্ধে যে প্রবল ক্ষোভ ও তাত্ত্বিক বিতর্ক দেখা যায়—তার সূত্রপাত আসলে ব্রিটিশ শাসন থেকেই।
    • ধর্মপাল, রাজীব মালহোত্রা ও বিজয়া বিষ্ণনাথন - বর্ণ, জাতি, কাস্ট_ আ প্রাইমার অন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল স্ট্রাকচারস-ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন (২০২৩) থেকে উদ্ধৃত
    • (ধর্মপাল ২০০৩, পৃষ্ঠা ১২) ধর্মপাল. ২০০৩. রিডিসকভারিং ইন্ডিয়া: কালেকশন অফ এসেস অ্যান্ড স্পিচেস, ১৯৫৬-১৯৯৮. মুসৌরি: সোসাইটি ফর ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট অফ হিমালয়াস।
  • ১৮৭১ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে আদমশুমারির দায়িত্বে থাকা ডব্লিউ. আর. কর্নিশ মন্তব্য করেন—"হিন্দুরা কোনো এক সময়ে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল, এমনটা আদৌ সত্য কিনা তা গভীর সন্দেহের বিষয়।"
    • চক্রবর্ত্তী, সঞ্জয়. ২০১৯. ভিউপয়েন্ট: হাউ দ্য ব্রিটিশ রিশেইপড ইন্ডিয়াজ ক্যাস্ট সিস্টেম. ১৯ জুন. সংগৃহীত ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২. https://www.bbc.com/news/world-asia-india-48619734।
    • রাজীব মালহোত্র ও বিজয়া বিশ্বনাথন - বর্ণ, জাতি, কাস্ট_ আ প্রাইমার অন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল স্ট্রাকচারস-ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন (২০২৩) থেকে উদ্ধৃত।
  • একইভাবে, ১৮৭১ সালের বিহার আদমশুমারির প্রতিবেদনে সি. এফ. ম্যাগ্রাথ লেখেন—“মনুর কথিত চার জাতির বিভাজন এখন সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং একে বিসর্জন দেওয়া উচিত।”
    • চক্রবর্ত্তী, সঞ্জয়. ২০১৯. ভিউপয়েন্ট: হাউ দ্য ব্রিটিশ রিশেইপড ইন্ডিয়াজ ক্যাস্ট সিস্টেম. ১৯ জুন. অ্যাকসেসড ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২. https://www.bbc.com/news/world-asia-india-48619734।
    • রাজীব মালহোত্র ও বিজয়া বিশ্বনাথন - বর্ণ, জাতি, কাস্ট_ আ প্রাইমার অন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল স্ট্রাকচারস-ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন (২০২৩) থেকে উদ্ধৃত।
  • ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ স্যুজান বেইলি লিখেছেন—“ঔপনিবেশিক যুগের অনেকটা সময় পর্যন্ত উপমহাদেশের অনেক জায়গায়, এমনকি তথাকথিত হিন্দু হৃদয়ভূমিতেও, জাতিগত ভেদাভেদের নির্দিষ্ট কাঠামো খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না... আজ যেসব প্রতিষ্ঠান ও বিশ্বাসকে জাতি প্রথার ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেগুলোর অনেকটাই মূলত আঠারো শতকের গোড়ার দিকে গড়ে উঠেছিল।”
    • চক্রবর্ত্তী, সঞ্জয়. ২০১৯. ভিউপয়েন্ট: হাউ দ্য ব্রিটিশ রিশেইপড ইন্ডিয়াজ ক্যাস্ট সিস্টেম. ১৯ জুন. অ্যাকসেসড ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২. https://www.bbc.com/news/world-asia-india-48619734।
    • রাজীব মালহোত্র ও বিজয়া বিশ্বনাথন - বর্ণ, জাতি, কাস্ট_ আ প্রাইমার অন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল স্ট্রাকচারস-ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন (২০২৩) থেকে উদ্ধৃত
  • নৃতত্ত্ববিদ সাইমন চার্সলি ব্যাখ্যা করেছেন—“একজনের পর একজন আদমশুমারি কমিশনার এই বিভক্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো এক রকম শৃঙ্খলা বা নিয়ম খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছেন।”
    • চার্সলি, সাইমন. ১৯৯৬. “‘আনটাচেবল’: হোয়াট ইজ ইন আ নেম?” দ্য জার্নাল অফ দ্য রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট (রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অফ গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড) ২ (১): ১–২৩।
    • রাজীব মালহোত্র ও বিজয়া বিশ্বনাথন - বর্ণ, জাতি, কাস্ট_ আ প্রাইমার অন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল স্ট্রাকচারস-ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন (২০২৩) থেকে উদ্ধৃত
  • ভারতের এক আদমশুমারি কমিশনার তখন অভিযোগ করেছিলেন—“বাংলার সাধারণ মানুষ জাত বলতে কী বোঝায় সে সম্পর্কে খুব কমই জানে। তারা অনেক সময় নিজেদের জাতের জায়গায় পেশা, উপ-জাতি, বংশ বা এমনকি এমন কোনো উপাধি বলে যা গ্রামে তাদেরকে চেনাতে সাহায্য করে।”
    • চার্সলি, সাইমন. ১৯৯৬. “‘আনটাচেবল’: হোয়াট ইজ ইন আ নেম?” দ্য জার্নাল অফ দ্য রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট (রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অফ গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড) ২ (১): ১–২৩।
    • রাজীব মালহোত্র ও বিজয়া বিশ্বনাথন - বর্ণ, জাতি, কাস্ট_ আ প্রাইমার অন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল স্ট্রাকচারস-ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন (২০২৩) থেকে উদ্ধৃত
  • উদাহরণস্বরূপ, বরোদায় আদমশুমারির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা মন্তব্য করেন যে রিসলির ব্যবহৃত পরিভাষাগুলি "সম্পূর্ণ অপরিচিত", কারণ তার প্রদেশে "এখানে জাতির মধ্যে এতটা স্পষ্ট বিভাজন নেই"। তিনি শ্রেণিবিন্যাস না করে জাতিগুলিকে বর্ণানুক্রমে তালিকাভুক্ত করেন।
  • ঔপনিবেশিকরা প্রায় পুরো উনবিংশ শতক জুড়ে সুবিধাজনক শ্রেণিবিভাগের ভিত্তিতে ভারতীয় সামাজিক পরিচয় নির্মাণ করে। এর উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ ভারতের শাসন ব্যবস্থার জন্য একটি অভিন্ন সমাজ ও অভিন্ন আইনব্যবস্থা তৈরি করা, যা সহজে পরিচালনাযোগ্য হবে। একটি বিশাল, জটিল এবং আঞ্চলিকভাবে বিচিত্র বিশ্বাস ও সামাজিক পরিচয়ভিত্তিক কাঠামোকে এতটাই সরলীকরণ করা হয় যে, এমন উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সম্পূর্ণ নতুন শ্রেণিবিন্যাস সৃষ্টি করা হয়, অপ্রাসঙ্গিক অংশগুলো একত্রে জোড়া লাগানো হয়, নতুন সীমারেখা নির্ধারণ করা হয় এবং নমনীয় সীমারেখাগুলিকে কঠিন করে তোলা হয়।
    এর ফলে সৃষ্ট শ্রেণিবিভাগ পরবর্তী দেড় শতকে কঠিন রূপ ধারণ করে, কারণ এই কৃত্রিম শ্রেণিগুলোর সঙ্গে বাস্তবিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা জড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ ভারতে ধর্মভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং স্বাধীন ভারতে জাতভিত্তিক সংরক্ষণ—এই দুটো ব্যবস্থাই এই বিমূর্ত শ্রেণিগুলিকে বাস্তব করে তোলে। কোনো শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হওয়া না হওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে যায় বাস্তব ও উপাদেয় পরিণতি।
    • চক্রবর্ত্তী, সঞ্জয়. ২০১৯. ভিউপয়েন্ট: হাউ দ্য ব্রিটিশ রিশেইপড ইন্ডিয়াজ ক্যাস্ট সিস্টেম. ১৯ জুন. সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২. https://www.bbc.com/news/world-asia-india-48619734।
    • রাজীব মালহোত্র ও বিজয়া বিশ্বনাথন - বর্ণ, জাতি, কাস্ট_ আ প্রাইমার অন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল স্ট্রাকচারস-ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন (২০২৩) থেকে উদ্ধৃত
  • সাইমন চার্সলির মতে, এই শ্রেণিবিন্যাস "স্থানীয় বৈচিত্র্যকে গোপন করে, এবং অঞ্চলভেদে যে বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অবাস্তব ঐক্য তা প্রতিষ্ঠা করে। এতে ভারতীয় সমাজকে বোঝার কাজ সরলীকৃত হয় ঠিকই, তবে সমাজের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণযোগ্য বৈশিষ্ট্য—বৈচিত্র্য—তার স্বরূপে অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ে।".
    • চার্সলি, সাইমন. ১৯৯৬. “‘আনটাচেবল’: হোয়াট ইজ ইন আ নেম?” দ্য জার্নাল অফ দ্য রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট (রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অফ গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড) ২ (১): ১–২৩।
    • রাজীব মালহোত্র ও বিজয়া বিশ্বনাথন - বর্ণ, জাতি, কাস্ট_ আ প্রাইমার অন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল স্ট্রাকচারস-ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন (২০২৩) থেকে উদ্ধৃত
  • জাত এখন এক আইনি স্বীকৃত শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি হয় নির্দ্বিধায় এর অন্তর্ভুক্ত অথবা নয়। যেসব জাতির জন্য রাষ্ট্র প্রদত্ত সুবিধা ও অধিকার নির্ধারিত, তাদের সেই জাতভুক্তির প্রমাণপত্র অর্জন করতে হয়, যাতে দাবি প্রমাণ করা যায়।
    • চার্সলি, সাইমন. ১৯৯৬. “‘আনটাচেবল’: হোয়াট ইজ ইন আ নেম?” দ্য জার্নাল অফ দ্য রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট (রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অফ গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড) ২ (১): ১–২৩।
    • রাজীব মালহোত্র ও বিজয়া বিশ্বনাথন - বর্ণ, জাতি, কাস্ট_ আ প্রাইমার অন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল স্ট্রাকচারস-ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন (২০২৩) থেকে উদ্ধৃত
  • … শতকের শুরুর দিকে রিসলির "বৃহৎ পরীক্ষা"র ফলাফলে যে বিশৃঙ্খল, অগোছালো, অনিয়ত বিভাজিত সমাজ দেখা গিয়েছিল, তার তুলনায় এখন এক সম্পূর্ণ রূপান্তর ঘটেছে—একটি অনেক বেশি নিয়মিত, একক ও স্পষ্ট শ্রেণিবিন্যাসের সমাজ গঠিত হয়েছে।
    • চার্সলি, সাইমন. ১৯৯৬. “‘আনটাচেবল’: হোয়াট ইজ ইন আ নেম?” দ্য জার্নাল অফ দ্য রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট (রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অফ গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড) ২ (১): ১–২৩।
    • রাজীব মালহোত্র ও বিজয়া বিশ্বনাথন - বর্ণ, জাতি, কাস্ট_ আ প্রাইমার অন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল স্ট্রাকচারস-ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন (২০২৩) থেকে উদ্ধৃত
  • আজকের বিতর্ক—‘অচ্ছুতরা কি জাতিভিত্তিক ব্যবস্থাকে পুনরুত্পাদন করে, না সেটিকে প্রত্যাখ্যান করে’—এটি আসলে একটি ভুলভাবে গঠিত, অবাস্তব সমস্যা, যা এই শ্রেণিকে ভুলভাবে বোঝার ফল।
    • চার্সলি, সাইমন. ১৯৯৬. “‘আনটাচেবল’: হোয়াট ইজ ইন আ নেম?” দ্য জার্নাল অফ দ্য রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট (রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অফ গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড) ২ (১): ১–২৩।
    • রাজীব মালহোত্র ও বিজয়া বিশ্বনাথন - বর্ণ, জাতি, কাস্ট_ আ প্রাইমার অন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল স্ট্রাকচারস-ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন (২০২৩) থেকে উদ্ধৃত
  • … এই ধারণা একটি শ্রেণিকে সমাজের শৃঙ্খলাভিত্তিক কাঠামোর সর্বনিম্ন স্তর হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে, কিন্তু বাস্তবে এতে অনেক ভিন্ন ভিন্ন জাতকে একত্রে ফেলে দেওয়া হয়, যাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান এক নয়।
    • চার্সলি, সাইমন. ১৯৯৬. “‘আনটাচেবল’: হোয়াট ইজ ইন আ নেম?” দ্য জার্নাল অফ দ্য রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট (রয়্যাল অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অফ গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড) ২ (১): ১–২৩।
    • রাজীব মালহোত্র ও বিজয়া বিশ্বনাথন - বর্ণ, জাতি, কাস্ট_ আ প্রাইমার অন ইন্ডিয়ান সোশ্যাল স্ট্রাকচারস-ইনফিনিটি ফাউন্ডেশন (২০২৩) থেকে উদ্ধৃত

প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ

[সম্পাদনা]
  • দেবতারা যখন "পুরুষ" নামের আদিমানবকে ভাগ করলেন, তখন তাকে বিভিন্ন অঙ্গে বিভক্ত করা হয়। বলা হয়—তার মুখ থেকে ব্রাহ্মণদের সৃষ্টি হয়, বাহু থেকে ক্ষত্রিয় বা রাজারা, উরু (থাই) থেকে বৈশ্যরা এবং পা থেকে শূদ্রদের জন্ম হয়।
    • ঋগ্‌বেদ, (আম্বেদকর, হু ওয়ার দ্য শূদ্রাজ? ১৯৭৯, ২২) কোউটেড ফ্রম মালহোত্রা, আর. অ্যান্ড বিষ্ণুনাথন ভি. (২০২২)। স্নেইকস ইন দ্য গঙ্গা : ব্রেকিং ইন্ডিয়া ২.০। থেকে উদ্ধৃত।

মহাভারত এবং ভগবদ্গীতা

[সম্পাদনা]
  • মহাভারতে যুধিষ্ঠির বলেন: "ব্রাহ্মণের মধ্যে শূদ্রের লক্ষণ দেখা যায়; কিন্তু কেউ শূদ্র বললেই তিনি শূদ্র নন, আবার কেউ ব্রাহ্মণ বললেই তিনি ব্রাহ্মণ নন। যার মধ্যে ব্রাহ্মণের লক্ষণ পাওয়া যায়, তাকেই ব্রাহ্মণ বলা হয়; আর যার মধ্যে সেই লক্ষণ নেই, তাকে আমরা শূদ্র বলে থাকি।"
  • ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে একজন রাজার একটি মন্ত্রিসভা রাখা উচিত, যেখানে “চারজন ব্রাহ্মণ...; আটজন ক্ষত্রিয়...; একুশজন ধনী বৈশ্য এবং চারজন নিঃকলঙ্ক চরিত্র ও আত্মসংযমে পারঙ্গম শূদ্র” থাকবেন।
    • রাম স্বরূপ: মেডিটেশনস, যোগাস, গডস, রিলিজিয়ন্স (২০০০) পৃষ্ঠা ২৪৮ থেকে উদ্ধৃত।
  • এই বিষয়ে একমাত্র ব্যাখ্যা পাওয়া যায় মহাভারতে। সেখানে বলা হয়েছে, সত্য যুগের শুরুতে শুধু একটি জাতিই ছিল—ব্রাহ্মণ। পরে কর্মভেদ বা পেশাভেদের কারণে তারা নিজেরাই বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত হয়ে যায়। এটাই একমাত্র যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা যা দেওয়া হয়েছে। এবং আসন্ন সত্য যুগে সব জাতিকেই আবার সেই প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে যেতে হবে।
  • ‘গুণ ও কর্ম অনুযায়ী চারটি বর্ণ আমি সৃষ্টি করেছি।’
    • (গীতা ৪.১৩) মালহোত্রা, আর. অ্যান্ড বিষ্ণুনাথন ভি. (২০২২)। স্নেইকস ইন দ্য গঙ্গা : ব্রেকিং ইন্ডিয়া ২.০ থেকে উদ্ধৃত।
    • ‘যে ব্যক্তি আমাকে সবকিছুর মধ্যে দেখতে পায় এবং সবকিছুকেই আমার মধ্যে দেখে, সে কখনও আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। আমি তার কাছে কখনও হারিয়ে যাই না।’ (গীতা ৬.৩০) এবং পরবর্তী শ্লোক: ‘যে ব্যক্তি অন্যদের মধ্যে সুখ ও দুঃখকে সেই একই মানদণ্ডে বিচার করে, যা সে নিজের জন্য প্রয়োগ করে, সেই সেরা যোগী।’
    • (গীতা ৬.৩২) মালহোত্রা, আর. অ্যান্ড বিষ্ণুনাথন ভি. (২০২২)। স্নেইকস ইন দ্য গঙ্গা : ব্রেকিং ইন্ডিয়া ২.০ থেকে উদ্ধৃত।
  • উচ্চ বংশ চরিত্রহীন মানুষের জন্য কোনো সনদ হতে পারে না। কিন্তু ভালো চরিত্রসম্পন্ন ব্যক্তিরা নিম্ন বংশ পরিচয় থাকা সত্ত্বেও নিজেদের আলাদা করে প্রমাণ করতে পারে।
    • (মহাভারত, উদ্যোগ পর্ব, অধ্যায় ৩৪.৪১) মালহোত্রা, আর. অ্যান্ড বিষ্ণুনাথন ভি. (২০২২)। স্নেইকস ইন দ্য গঙ্গা : ব্রেকিং ইন্ডিয়া ২.০ থেকে উদ্ধৃত।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]