বিষয়বস্তুতে চলুন

মহাদেব গোবিন্দ রানাডে

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে
মহাদেব গোবিন্দ রানাডের মূর্তি

মহাদেব গোবিন্দ রানাডে (১৮ জানুয়ারি, ১৮৪২ – ১৬ জানুয়ারি, ১৯০১) ছিলেন একজন খ্যাতিমান ভারতীয় বিচারপতি, পণ্ডিত, সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারক এবং লেখক। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন ছিলেন। বিচার বিভাগের কর্মজীবনে তিনি ১৮৭১ সালে প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট পদ থেকে শুরু করে ১৮৯৩ সালে বম্বে উচ্চ আদালতের বিচারপতি পদে উন্নীত হন এবং নিজ দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি সরকারের একাধিক কমিটির সদস্য ছিলেন এবং বোম্বে আইন পরিষদেরও সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতীয় সমাজে সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে তিনি জনসেবামূলক বহু কাজ করেছিলেন।

উক্তি

[সম্পাদনা]

Verinder Grover (১৯৯০)। Mahadev Govind Ranade। Deep & Deep Publications। পৃষ্ঠা 487–। আইএসবিএন 978-81-7100-245-0 

  • আমাদের কষ্ট সহ্য করতে হবে… শুধুমাত্র এই কারণে নয় যে যন্ত্রণা ভোগ করা মধুর, বরং এই কারণে - যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এতে জড়িত, তার তুলনায় এই ব্যথা ও যন্ত্রণা কিছুই নয়।
    • দুইটি কর্তব্য, দুইটি আদর্শ জীবনধারা এবং কর্তব্যের দুইটি রূপ নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে, উদ্ধৃত: পৃষ্ঠা ৪৮৮
  • ...জনসমাগমের অপমানজনক কলহ থেকে দূরে।
    • সাধারণ মানুষের জীবন থেকে অনেক দূরে, তিনি নিজস্ব এক উচ্চতর পথে চলতেন, উদ্ধৃত: পৃষ্ঠা ৪৮৯
  • ধর্মীয় কারণ ছাড়া আর কী বাধা আছে? ধর্ম ছাড়া এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই করার আছে।
    • উদ্ধৃত: পৃষ্ঠা ১০২
  • এই দেশ ধর্মের দেশ। যা কিছুই ভালো হোক কিংবা মন্দ, আমরা ধর্ম ছাড়া চলতে পারি না। ধর্মীয় ভাবনা আমাদের রক্তের মধ্যে মিশে আছে। যদি আমরা ধর্ম থেকে পালাতে চাই, তবুও তা আমাদের অনুসরণ করবে।
    • উদ্ধৃত: পৃষ্ঠা ১০২
  • আমরা সুর, তাল, বা ছন্দে দক্ষ নই—আমরা সাধারণ মানুষ। কিন্তু সেটা কোনো ব্যাপার নয়। যার উদ্দেশ্যে আমরা ভজন গাই, তিনি সব কিছুই বুঝতে পারেন। আমাদের সুরের ভুল বা গানের অমিল তার কিছুই আসে যায় না।
    • প্রতিদিন প্রার্থনার সময় যখন স্বর ও তাল মেলাতে না পেরে ভজন গাইতেন, তখন স্ত্রীকে তিনি এই কথা বলেছিলেন। উদ্ধৃত: পৃষ্ঠা ১০৪
  • যৌবনে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় যে জীবনের গভীর রহস্য, চিন্তা এবং ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের আশাকে উপেক্ষা করে বিজ্ঞানের চূড়ান্ত বক্তব্য হলো—অজ্ঞেয়বাদ। সেই আত্মিক আকাঙ্ক্ষাকে উপহাস করা হয়। তার জায়গায় গোঁড়াভাবে বিশ্বাস করতে শেখানো হয় বিবর্তন তত্ত্ব এবং সম্মিলিত উন্নতি ও অগ্রগতির নিয়মে। বিশেষ করে হিন্দু শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন ঈশ্বরে বিশ্বাস থেকে উৎসারিত আত্মিক শক্তি। কেবল সেই বিশ্বাসই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে মানুষকে প্রকৃত শক্তি দিতে পারে। একটি জাতির মানসিকতা অজ্ঞেয়বাদের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এই যুগ বা অন্য কোনো যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নৈতিক শিক্ষকদের দ্বারা, ইতিহাসে একবার বড় পরিসরে এই চেষ্টা হয়েছিল। বৌদ্ধধর্মের ব্যর্থতা এই বিষয়ে একটি সংকেত। এ ধরনের শিক্ষা জাতীয় চিন্তাকে টিকিয়ে রাখতে পারে না।
    • ধর্ম তার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা বোঝা যায় যখন তিনি ডেকান কলেজের অধ্যাপক সেলবি-কে সতর্ক করেছিলেন, যিনি “বাটলার'স এনালজি এন্ড সার্মনস”-এর ওপর বক্তৃতার নোট প্রকাশ করেছিলেন। উদ্ধৃত: পৃষ্ঠা ১০৫–১০৬
  • যে ভালোবাসা খ্রিস্টান সমাজে যিশুখ্রিস্টের জীবন ও মৃত্যু নিয়ে আবর্তিত হয়, সেই ভালোবাসাই ভারতে অবাধে উৎসারিত হয়েছে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের উপস্থিতির গভীর উপলব্ধির ওপর। এমন এক উপলব্ধি, যা চোখ, কান বা স্পর্শের চেয়েও বেশি বাস্তব এবং দৃঢ়। এই উপলব্ধিই হল সাধুদের গৌরবের উৎস। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত, নারী-পুরুষ সবাই এটিকে জীবনের এক অমূল্য আশ্বাস হিসেবে লালন করে।
    • তাঁর ধর্মীয় ভাবধারা অনেকাংশে প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টানদের বিশ্বাস ও অনুভূতির মতো ছিল। উদ্ধৃত: পৃষ্ঠা ১০৬–১০৭
  • সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সহ্য করতে এবং সংযম বজায় রাখতে শিখতে হবে। আমাদের শেখা দরকার কিভাবে উপহাস, অপমান এমনকি ব্যক্তিগত আঘাতও সহ্য করতে হয়। এবং কিভাবে প্রতিশোধ না নিয়ে নিজেকে সংযত রাখতে হয়। নাজারেথের নবীর ভাষায়, আমাদের ক্রুশের মত হতে হবে। সেটা এই কারণে নয় যে অত্যাচার সহ্য করা আনন্দের, বরং এই কারণে যে, যন্ত্রণা ও ক্ষতি কিছুই নয়, যদি তাকে কোনো মহৎ আদর্শের জন্য সহ্য করা হয়।
    • ফার্গুসন কলেজে কংগ্রেসের একটি সমাজ সম্মেলনে তিনি এই বক্তৃতা দেন, যা ছিল চরমপন্থী তিলক গোষ্ঠীর বিকল্প সম্মেলনের জবাবস্বরূপ। উদ্ধৃত: পৃষ্ঠা ১১৩

রানাডে, গান্ধী ও জিন্নাহ্‌ সম্পর্কে ১৯৪৩ সালে দেওয়া ১০০তম বার্ষিক বক্তৃতায় ড. আম্বেদকর

[সম্পাদনা]

"Ranade Gandhi & Jinnah"। Columbia Education। সংগ্রহের তারিখ ৫ ডিসেম্বর ২০১৩ 

  • আমি আমার ধর্মবিশ্বাসের দুইটি মূলনীতিতে পূর্ণ আস্থা রাখি। এক—এই দেশ আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রকৃত ভূমি। দুই—এই জাতি আমাদের নির্বাচিত জাতি।
  • প্রবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে স্ত্রী বা কন্যা সন্তানদের প্রলুব্ধ করে নিয়ে যাওয়ার জন্য নারীদের ব্যাপকভাবে নিযুক্ত করা হতো। স্বামী ও পিতারা প্রায়ই পরিবার ও সন্তানদের পরিত্যাগ করতেন। সমাজে কোনো নৈতিক বিবেক ছিল না। আর যখন বিবেকই নেই, তখন সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক ক্ষোভ আশা করাটাই বৃথা। আসলে ব্রাহ্মণরা এসব অন্যায়কে প্রশ্রই দিয়েছিলেন—কারণ, এদের মাধ্যমেই তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। তারা অচ্ছুৎ প্রথার পক্ষেই সায় দিতেন, এইভাবেই লক্ষ লক্ষ মানুষকে দাসত্বে পরিণত করা হত। তারা জাতি প্রথাকে সমর্থন করতেন, সমর্থন করতেন বাল্যবিবাহ এবং বিধবাদের বাধ্যতামূলক নিঃসঙ্গ জীবন—এই দুইটি ছিল জাতিভিত্তিক ব্যবস্থার প্রধান স্তম্ভ। তারা সতীদাহ প্রথাকে রক্ষা করত এবং এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা সমর্থন করত যেখানে অসমতা ছিল স্তরভেদে বিভক্ত। এর মধ্যেই ছিল ‘হাইপারগ্যামি’ বা উচ্চবর্ণে বিয়ের নিয়ম। এই নিয়ম রাজপুতদের বাধ্য করত নিজেদের কন্যাদের অগনিত সংখ্যায় হত্যা করতে। কি লজ্জা! কত ভয়াবহ অন্যায়! এমন সমাজ কি সভ্য জাতির সামনে মুখ দেখাতে পারে? এমন সমাজ কি টিকে থাকার আশা করতে পারে?
    • এই নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে ১৮১৯ সালের প্রবিধানের (১৮১৯ সালের সপ্তম প্রবিধান) পক্ষে রানাডে এই প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন। তিনি উপসংহারে বলেন, কেবল একটি শর্তেই এই সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব—তা হলো কঠোর সামাজিক সংস্কার। উদ্ধৃত: রানাডে, গান্ধী এবং জিন্নাহ
  • আপনি অর্ধেক উদার হতে পারেন না। রাজনীতিতে উদার হয়ে ধর্মে রক্ষণশীল হওয়া যায় না। হৃদয় এবং মস্তিষ্ক—এই দুইয়ের একসাথে চলা দরকার। আপনি আপনার জ্ঞানকে পরিপুষ্ট করতে পারেন, মনকে সমৃদ্ধ করতে পারেন, রাজনৈতিক অধিকার ও সুযোগকে বিস্তৃত করতে পারেন। কিন্তু একই সাথে যদি আপনার হৃদয় সংকীর্ণ হয়, তাহলে তার কোনো মূল্য নেই। এটা একটা অলীক কল্পনা—এমনটা আশা করা যে মানুষ নিজেদের কুসংস্কার ও সামাজিক অন্যায়ের শৃঙ্খলে বন্দী থাকবে, অথচ শাসকের কাছ থেকে অধিকার আদায়ে লড়াই করবে। খুব বেশি দেরি হয়নি, এই অলীক কল্পনাবাদীরা বুঝতে পারবে—তাদের স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেছে।
    • তিনি তাঁর বিরোধীদের স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করেছিলেন, যেন তারা রাজনৈতিকভাবে উদার হলেও সামাজিকভাবে রক্ষণশীল না থাকেন। উদ্ধৃত: রানাডে, গান্ধী এবং জিন্নাহ

রানাডে সম্পর্কে

[সম্পাদনা]
  • মহামান্য, আমার মনে হয়, আজকের দিনে কোনো ভারতীয় যদি তার প্রিয়, কৃতজ্ঞ এবং শোকাভিভূত দেশবাসীর কাছে একটি স্মৃতিস্তম্ভের যোগ্য হন, তাহলে নিঃসন্দেহে সেই ব্যক্তি ছিলেন প্রয়াত শ্রীমান রানাডে।
    • রানাডের স্মৃতিতে একটি মূর্তি স্থাপনের প্রসঙ্গে জি.কে. গোখলের মন্তব্য, উদ্ধৃত: মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, পৃষ্ঠা ৪৮৭
  • রাত প্রায় ৪টা... হঠাৎ গাড়ির ভিতর কিছু গান শুনে আমার ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে দেখি, রানাডে মশাই উঠে বসে আছেন এবং তুকারামের দুটি অভঙ্গ বারবার গাইছেন। হাততালি দিয়ে ছন্দ মেলাচ্ছেন। তার গলার সুর বিশেষ সঙ্গীতময় ছিল না, কিন্তু গানের মধ্যে যে তীব্র ভক্তি ছিল, তা এতটাই গভীর ছিল যে আমি ভিতর থেকে একেবারে আপ্লুত হয়ে যাই। আমিও আর বসে থাকতে পারিনি, উঠে বসে গান শুনতে লাগলাম।
    • গোখলের স্মৃতিচারণা, যখন তিনি রানাডের সঙ্গে ট্রেনে সফর করছিলেন, উদ্ধৃত: মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, পৃষ্ঠা ১০৪
  • এটা মোটেও অতিরঞ্জন নয় যে, যেসব তরুণ ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সংস্পর্শে আসতেন, তাঁরা যেন এক পবিত্র উপস্থিতির অনুভূতিতে পূর্ণ হতেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কেউ শুধু হীন কথা বলাই নয়, হীন চিন্তাও ভাবতে সাহস করতেন না।
    • গোখলের মন্তব্য, উদ্ধৃত: মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, পৃষ্ঠা ১০৫
  • তিনি মনে করতেন, ভাষণটাই আসল—তা কোথায় দেওয়া হচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁর চিন্তাভাবনাগুলো দেশবাসীর কাছে পৌঁছাক, সেটাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। মানুষ যেখানে জড়ো হতেন, তিনি সেখানেই যেতে রাজি থাকতেন—শুধু তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলেই।
    • সংযতপন্থী রানাডের উপদেশ প্রচার সম্পর্কে গোখলের পর্যবেক্ষণ, উদ্ধৃত: মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, পৃষ্ঠা ১১৬
  • এই বিদ্যার রত্ন শুধু ব্রাহ্মণ সমাজের নয়, কেবল পুণে শহরেরও নয়। এবং প্রশ্ন উঠেছিল—"রানাডে যদি না হন, তবে প্রকৃত জননেতা কাকে বলা হবে?"
    • ড. পেন্‌সকট খ্রিস্টধর্ম নিয়ে একাধিক ভাষণ দেওয়ার পর, রানাডে যখন হিন্দুধর্ম নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন, তখন জনতার প্রশংসাভরা প্রতিক্রিয়ায় এই কথা বলা হয়। উদ্ধৃত: মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, পৃষ্ঠা ১০৭
  • তিনি ছিলেন এক গভীর সহানুভূতিসম্পন্ন বিচারক, যিনি সুদূরদর্শী বোধসম্পন্ন এবং ন্যায়ের পথে চলার প্রবল ইচ্ছায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। তার মতামত সহকর্মীদের কাছে ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। তার বিচারিক সিদ্ধান্তগুলো ভবিষ্যতে জ্ঞানের স্মারক হিসেবে স্মরণীয় থাকবে।
    • রানাডের উচ্চ আদালতের সাত বছরের বিচারক জীবনের মূল্যায়নে প্রধান বিচারপতি স্যার লরেন্স জেনকিন্সের মন্তব্য, উদ্ধৃত: মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, পৃষ্ঠা ১০৮
  • তার রায়গুলো যেন হিন্দু সমাজ নিয়ে লেখা পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধের মতো। এসব রায় শাস্ত্র (শ্রুতি-স্মৃতি), পুরাণ, ইতিহাস এবং গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি রায়ের বিবেচনার ওপর ভিত্তি করে গঠিত।
    • উদ্ধৃত: মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, পৃষ্ঠা ১০৯

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]
  • "Mahadev Govind Ranade"। Encyclopaedia Britannica। সংগ্রহের তারিখ ৫ ডিসেম্বর ২০১৩ 
  • "Justice Mahadev Govind Ranade"। Manase Organization। সংগ্রহের তারিখ ৫ ডিসেম্বর ২০১৩