রমেশচন্দ্র দত্ত
অবয়ব

―রমেশচন্দ্র দত্ত
রমেশচন্দ্র দত্ত (১৩ আগস্ট ১৮৪৮ - ৩০ নভেম্বর ১৯০৯) ছিলেন ভারতীয় বাঙালি ইতিহাসবিদ ও ঔপন্যাসিক। ১৮৯৪ সালে রমেশচন্দ্র বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম সভাপতি হিসাবে দায়িত্বভার পালন করেন। সূদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন। রমেশচন্দ্রের চারটি ঐতিহাসিক উপন্যাস বঙ্গবিজেতা (১৮৭৪), মাধবীকঙ্কণ (১৮৭৭), মহারাষ্ট্র জীবন-প্রভাত (১৮৭৭) এবং রাজপুত জীবন-সন্ধ্যা (১৮৭৮) যথাক্রমে আকবর, শাজাহান এবং আওরঙ্গজেব এবং জাহাঙ্গীরের সময়ের ঘটনা অবলম্বনে রচিত হয়। অনুবাদকর্মের মধ্যে রয়েছে ইয়ুরোপে তিন বৎসর (১৮৮৩) এবং অন্যান্য রচনাগুলি হলো সংসার (১৮৭৫), হিন্দুশাস্ত্র (প্রথম খণ্ড) (১৮৯৫), হিন্দুশাস্ত্র (দ্বিতীয় খণ্ড) (১৮৯৬) প্রভৃতি।
উক্তি
[সম্পাদনা]- হেমলতার পক্ষে সে রজনী কী ভীষণ! বালিকা ধীরে ধীরে শয্যা হইতে উঠিয়া গবাক্ষের নিকট আসিল, ধীরে ধীরে গবাক্ষ উদঘাটন করিয়া বাহিরে দেখিল; তারা-পরিপূর্ণ অন্ধকার আকাশের নীচে বিশাল গঙ্গা অনন্তস্রোতে ভাসিয়া যাইতেছে। সেই নৈশ-গঙ্গার দিকে দেখিতে দেখিতে কি হৃদয়বিদায়ক ভাব হেমলতার হৃদয়ে জাগরিত হইতে লাগিল। বাল্যকালের ক্রীড়া, কিশোর-বয়সের প্রথম ভালবাসা, কত কথা, কত কৌতুক একে একে জাগরিত হইয়া বালিকাহৃদয় দলিত করিতে লাগিল। এক একটি কথা মনে হয়, আর হৃদয়ে দুঃখ উথলিয়া উঠে, অবিরল অশ্রুধারায় চক্ষু ও বক্ষঃস্থল ভাসিয়া যায়। আবার বালিকা শান্ত হইয়া গঙ্গার দিকে দেখে, আবার একটি কথা স্মরণ হয়, শোকবিহ্বলা হইয়া অজস্র রোদন করে; কাঁদিয়া কাঁদিয়া বালিকা অবসন্ন হইল, হায়! সে ক্রন্দনের শেষ নাই, সে ক্রন্দন অবারিত অশান্তিপ্রদ।
- মাধবীকঙ্কণ, ছয় পরিচ্ছেদ, মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রকাশক- পুস্তকালয়, প্রকাশস্থান- কলকাতা,, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৭
- মিলান হইতে ভিনিস নগরে গেলাম। পূর্ব্বে যে এই নগর অতি ঐশ্বর্য্যশালী ছিল, নগর দেখিলেই তাহা স্পষ্ট বোধ হয়। তাহার গির্জা সমস্ত কি ছোট, কি বড়, দেখিতে অতি শোভাময়; এবং অট্টালিকা সকল রাজভবনের ন্যায়। নগরের বিশেষ শোভা এই যে, অন্য নগরে যে স্থানে রাস্তা পথ থাকে, এ নগরের সে স্থানে সমুদ্রজল জোয়ার ভাটা খেলিতেছে। বস্তুতঃ এই নগর সমুদ্রের উপর নির্ম্মিত, অট্টালিকা সকল সমুদ্র হইতে উথিত ও এক বাটী হইতে অন্য বাটীতে যাইতে হইলে নৌকাদ্বারা যাইতে হয়।
- ইয়ুরোপে তিন বৎসর, সপ্তম অধ্যায়, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ (১২৯০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৯৬
- জয়সিংহ। আপনি ক্ষত্রিয় হইয়া এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন? রাজপুতকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন? রাজপুতের ইতিহাস পাঠ করুন, তাহারা বহুশত বৎসর মুসলমানদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়াছে, কখনও সত্য লঙ্ঘন করে নাই। কখন জয়লাভ করিয়াছে, অনেক সময়ে পরাস্ত হইয়াছে, কিন্তু জয়ে, পরাজয়ে, সম্পদে, বিপদে, সর্ব্বদা সত্যপালন করিয়াছে। এখন আমাদের সে গৌরবের স্বাধীনতা নাই, কিন্তু সত্যপালনের গৌরব আছে। দেশে, বিদেশে, মিত্রমধ্যে, শত্রুমধ্যে, রাজপুতের নাম গৌরবান্বিত। ক্ষত্রিয়রাজ টোডরমল্ল বঙ্গদেশ জয় করিয়াছিলেন, মানসিংহ কাবুল হইতে উড়িষ্যা পর্যন্ত দিল্লীশ্বরের বিজয়পতাকা উড়াইয়াছিলেন, কেহ কথনও ন্যস্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধাচরণ করেন নাই, মুসলমান সম্রাটের নিকট যাহা সত্য করিয়াছিলেন, তাহা পালন করিতে ত্রুটি করেন নাই।
- মহারাষ্ট্রের জীবন-প্রভাত- রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রকাশক- বসুমতী সাহিত্য মন্দির, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ (১২৮৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৯২
- পর্বত অতিক্রম করিয়া যশোবন্তসিংহ অচিরাৎ আপন মাড়ওয়ার দেশে আসিয়া পড়িলেন। মেওয়ার ও মাড়ওয়ার দুই দেশ দেখিলেই বোধ হয় যেন প্রকৃতি লীলাক্রমে দুই দেশের বিভিন্নতা সাধন করিয়াছেন। মেওয়ারের যেরূপ পর্বতরাশি ও বিশাল বৃক্ষাদি ও লতাপত্রের গৌরব, মাড়ওয়ারে তাহার বিপরীত। পর্বত নাই, অশ্বত্থ, বট প্রভৃতি বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষ নাই, উর্বরা-ক্ষেত্র নাই, বেগবতী তরঙ্গিনী নাই, পর্বতবেষ্টিত হ্রদ নাই, কেবল মরুভূমিতে বালুকারাশি ধূ ধূ করিতেছে ও স্থানে স্থানে অতি ক্ষুদ্রকায় কণ্টকময় বাবুল ও অন্যান্য বৃক্ষ দেখা যাইতেছে।
- মাধবীকঙ্কণ, উনিশ পরিচ্ছেদ, মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রকাশক- পুস্তকালয়, প্রকাশস্থান- কলকাতা,, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫৪
- অনন্তর আমরা রেলগাড়িযোগে জগদ্বিখ্যাত জায়ণ্টস্ কজ্ওয়ে দেখিতে গেলাম। শিলাময় ভূখণ্ড সমুদ্রমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। স্কট লণ্ডের ফিন গালের গহ্বর যে প্রকার প্রস্তরে নির্ম্মিত, এখানকার প্রস্তরের গঠন প্রায় তদ্রূপ। ইহার স্তম্ভ সকল তিন হইতে নয় কোণবিশিষ্ট, তার এমন সৌষ্ঠবান্বিত যে, দেখিলে বোধ হয় যেন বাটালি দ্বারা পরিষ্কৃত হইয়াছে। ভীষণনাদী আট্লাণ্টিক মহাসাগর এই সকল স্তম্ভকে তরঙ্গাস্ত্র দ্বারা প্রচণ্ড পরাক্রমে অবিরাম প্রহার করিতেছে, কিন্তু কিছুই করিতে পারে নাই। অদূরে অনেক গুলা গহ্বর আছে, কিন্তু তন্মধ্যে কোনটা ফিন গালের গহ্বর তুল্য সুন্দর নহে।
- ইয়ুরোপে তিন বৎসর, পঞ্চম অধ্যায়, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ (১২৯০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬৭
- প্রবেশ করিয়া শিবজী যাহা দেখিলেন, তাহাতে আরও বিস্মিত হইলেন। চতুর্দ্দিকে বিস্তীর্ণ “কারখানায়” অসংখ্য শিল্পকারগণ রাজব্যবহার্য্য নানাবিধ দ্রব্য প্রস্তুত করিতেছে; অপূর্ব্ব সুবর্ণ ও রৌপ্যখচিত বস্ত্র, মলমল, মসলিন বা ছিট, বহুমূল্য গালিচা, চন্দ্রাতপ, তাম্বু, বা পর্দা; সুন্দর পরিধেয় উষ্ণীষ, শাল বা গাত্রাবরণ; অপরূপ সুবর্ণ ও মণিমাণিক্যের বেগমপরিধেয় অলঙ্কার; সুন্দর চিত্র, সুন্দর কারুকার্য্য, সুন্দর শ্বেত প্রস্তরের গৃহানুকরণ দ্রব্য; রাশি রাশি নীল, পীত, রক্তবর্ণ বা হরিদ্বর্ণ প্রস্তরের নানারূপ খেলনা দ্রব্য; ―কত বর্ণনা করিব! ভারতবর্ষে যত অপূর্ব্ব শিল্পকার ছিল, সম্রাট্ আদেশে তাহারা মাসিক বেতন পাইয়া প্রতিদিন দুর্গে কার্য্য করিতে আসিত। সম্রাট, রাজকার্য্যার্থ বা নিজ প্রয়োজনের জন্য যে কোন বস্তু আবশ্যক বোধ করিতেন, বিলাসপ্রিয়া বেগমগণ যতরূপ অপূর্ব্ব দ্রব্য আদেশ করিতেন, প্রাসাদবাসীদিগের যত প্রকার সামগ্রী প্রয়োজন হইত, তৎসমস্তই এই স্থানে প্রস্তুত হইত।
- মহারাষ্ট্রের জীবন-প্রভাত- রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রকাশক- বসুমতী সাহিত্য মন্দির, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ (১২৮৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৭০-১৭১
- মেওয়ার দেশে পূর্বে চিতোর প্রধান নগরী ছিল, এক্ষণে উদয়পুর মাড়ওয়ারের বালুকারাশি ও মরুভূমি হইতে প্রধান-পর্বত মেওয়ার দেশে পুনরায় আসিতে নরেন্দ্রনাথ বড়ই আনন্দানুভব করিলেন। আবার আরাবলীর উচ্চ শিখর উল্লঙ্ঘন করিলেন, আবার পর্বতীয় নদী ও প্রস্রবণের বেগ ও মহিমা সন্দর্শন করিলেন, আবার শান্ত নিস্তব্ধ পর্বত হ্রদের শোভা দেখিয়া নরেন্দ্রের হৃদয়ে অতুল আনন্দোদয় হইল। কিছুদিন এইরূপে ভ্রমণ করিয়া নরেন্দ্রনাথ ও যোধপুরের দূতগণ উদয়পুরে উপস্থিত হইলেন।
- মাধবীকঙ্কণ, কুড়ি পরিচ্ছেদ, মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রকাশক- পুস্তকালয়, প্রকাশস্থান- কলকাতা,, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫৮
- রাইন নদ অতি বৃহৎ এবং যে যে প্রদেশ দিয়া প্রবাহিত হইতেছে, তাহা দেখিলে যুগপৎ আমোদ ও বিস্ময়ের আবির্ভাব হয়। আমরা তাহার সৌন্দর্য্যের ভূয়সী প্রশংসা করিতে করিতে ধীরে ধীরে উজানে যাইতে লাগিলাম। ক্রমে রাইন নদ শৃঙ্খলবদ্ধ সুন্দর হ্রদ-সমুহের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল, উভয় পার্শ্বে দ্রাক্ষালতামণ্ডিত দুর্গ-শোভিত পর্ব্বতশ্রেণী শোভা পাইতেছে। সন্ধ্যার সময় বাডন-বাডন নগরে আসিলাম। এই স্থানটি অতি পরিপাটী, উদ্ভিদ্-শোভিত, শৈলবেষ্টিত এবং পর্ষটকদিগের পরম রমণীয়। এখানে কি প্রাতঃ, কি মধ্যাহ্ন, কি রাত্রি, সকল সময়েই প্রকাশ্যরূপে জুয়া খেলা হইয়া থাকে।
- ইয়ুরোপে তিন বৎসর, সপ্তম অধ্যায়, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ (১২৯০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৯০
- যখন সম্পূর্ণ চৈতন্য হইল, দেখিলেন এক অপূর্ব ঘরে একটি দীপ জ্বলিতেছে। তিনি একটি শয্যায় শুইয়া রহিয়াছেন। এরূপ সুরম্য ঘর তিনি কখনো দেখেন নাই। সমস্ত ঘর সুন্দর শ্বেতপ্রস্তর দ্বারা নির্মিত। রৌপ্যের শামাদানে দীপ জ্বলিতেছে ও সমস্ত গৃহ সুগন্ধে আমোদিত করিতেছে। তাহার পালঙ্ক দ্বিরদবদখচিত, সুবর্ণ ও রৌপ্য দ্বারা বিভূষিত। সম্মুখে একটি রৌপ্য-আধারের উপর এক রৌপ্য-পাত্রে জল রহিয়াছে, নীচে শয্যা হইতে কিঞ্চিৎ দূরে একটি বিচিত্র গালিচার উপর এক যবনকন্যা ও এক খোজা বসিয়া অতি মৃদুস্বরে কথোপকথন করিতেছে।
- মাধবীকঙ্কণ, এগার পরিচ্ছেদ, মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রকাশক- পুস্তকালয়, প্রকাশস্থান- কলকাতা,, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৯
- নেপোলিয়ন বোনাপার্টি কহিয়াছিলেন যে, ইংরাজ জাতি কেবল দোকানদার। তিনি একথা বলিতেও পারিতেন যে, উহারা কেবল বিজ্ঞাপনদার। এদেশের লোক যে কি বিজ্ঞাপনপ্রিয়, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। যে স্থানে স্থলবিন্দু পায়, সেইখানে বিজ্ঞাপনপত্র সকল প্রদর্শিত হয়। রেলওয়ে ষ্টেশনে আর স্থান থাকে না, তথাপি লোকে সন্তুষ্ট নহে। তাহারা বেতন দিয়া লোক নিযুক্ত করে ও তাহার সম্মুখে ও পশ্চাতে বিজ্ঞাপনপত্র ঝুলাইয়া দিয়া নগর মধ্যে ভ্রমণ করিতে পাঠাইয়া দেয়। আহা! বাহকগণের কি সুখের চাকরী!!
- ইয়ুরোপে তিন বৎসর, দ্বিতীয় অধ্যায়, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ (১২৯০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৯
- সেই নৈশ-গঙ্গার দিকে দেখিতে দেখিতে কি হৃদয়বিদায়ক ভাব হেমলতার হৃদয়ে জাগরিত হইতে লাগিল। বাল্যকালের ক্রীড়া, কিশোর-বয়সের প্রথম ভালবাসা, কত কথা, কত কৌতুক একে একে জাগরিত হইয়া বালিকায় দলিত করিতে লাগিল। এক একটি কথা মনে হয়, আর হৃদয়ে দুঃখ উথলিয়া উঠে, অবিরল অশ্রুধারায় চক্ষু ও বক্ষঃস্থল ভাসিয়া যায়। আবার বালিকা শান্ত হইয়া গঙ্গার দিকে দেখে, আবার একটি কথা স্মরণ হয়, শোকবিহ্বলা হইয়া অজস্র রোদন করে; কাঁদিয়া কাঁদিয়া বালিকা অবসন্ন হইল, হায়! সে ক্রন্দনের শেষ নাই, সে ক্রন্দন অবারিত অশান্তিপ্রদ। রজনী একপ্রহর, দ্বিপ্রহর হইল, তথাপি বালিকা গবাক্ষর নিকট দণ্ডায়মানা অথবা ভূমিতে লুষ্ঠিত হইয়া নীরবে রোদন করিতেছে।
- মাধবীকঙ্কণ, ছয় পরিচ্ছেদ, মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রকাশক- পুস্তকালয়, প্রকাশস্থান- কলকাতা,, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৭
- বহুজনাকীর্ণ লিমারিক নগর দেখিয়া পরে সানন নদের জলপ্রপাত সন্দর্শন করিতে গেলাম। বস্তুতঃ ইহা প্রকৃত জলপ্রপাত নহে; এখানে সানন নদের গভীরতা অতি কম এবং ইহা অতি আয়ত ও প্রস্তরময় গর্ভের উপর দিয়া ভীষণ বেগে ও কল কল শব্দে প্রবাহিত হইতেছে। চতুর্দ্দিকে বসন্তলক্ষী বিরাজিত, পাদপপুঞ্জে নদীর জল ছায়াময়, এবং ঐ জলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ প্রতিফলিত হইয়াছে। নদীর জল যেখানে সুগভীর, সেখানে অতি পরিষ্কার ও স্থির, অন্য স্থানে তাহার বেগগামী বারি ভূরি প্রস্তরখণ্ড প্রতিঘাতে বিচ্ছিন্ন ও বহুল ফেনময় হইয়া প্রবাবিত হইতেছে।
- ইয়ুরোপে তিন বৎসর, পঞ্চম অধ্যায়, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ (১২৯০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬৯
- রাজার আজ্ঞানুসারে নরেন্দ্র কয়েকজন রাজপুত দূতের সহিত যোধপুর দুর্গে গমন করিলেন। যোধপুর দুর্গ যাঁহারা একবার দেখিয়াছেন, তাঁহারা কখনও বিস্মরণ হইতে পারিবেন না। চতুর্দিকে কেবল বালুকারাশি ও মরুভূমি, তাহার মধ্যে একটি উন্নত পর্বত সেই পর্বতের শিখরের উপর যোধপুব দুর্গ যেন যোদ্ধার কিরীটের ন্যায় শোভা পাইতেছে। পর্বততলে নগর বিস্তৃত রহিয়াছে এবং নগরের ভিতর দুইটি সুন্দর হ্রদ; পূর্বদিকে রানী তলাও ও দক্ষিণ দিকে গোলাপ সাগর। নগরবাসিনী শত শত কামিনী হ্রদ হইতে জল লইতে আসিতেছ হ্রদের পার্শ্বস্থ সুন্দর উদ্যানে শত শত দাড়িম্ববৃক্ষ ফল ধারণ করিয়াছে ও নাগরিকগণ স্বচ্ছন্দচিত্তে সেই উদ্যানে বিচরণ করিতেছে।
- মাধবীকঙ্কণ, উনিশ পরিচ্ছেদ, মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রকাশক- পুস্তকালয়, প্রকাশস্থান- কলকাতা,, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫৬
- কালেণ্ডরের নিকটে একটা ভীম-নাদ জলপ্রপাত আছে। তাহা দেখিবার যোগ্য বস্তু বটে। মনে মনে চিন্তা করিয়া দেখুন যে, দুই পর্ব্বতশ্রেণীর মধ্যবর্ত্তী একটা গভীর সঙ্কীর্ণ পথে দণ্ডায়মান আছেন; দুই দিকের শৈল হইতে স্খলিত উপলখণ্ড ঐ বর্ত্মোপরি বিকীর্ণ আছে। পথে কেটী নাম্নী গিরিনদী ‘কুল কুল’ শব্দে ও চঞ্চলবেগে প্রবাহিত হইতেছে ও তাহার জল অতি উচ্চ দেশ হইতে নিম্নস্থ গভীর গহ্বরে নিপতিত হইতেছে। অনন্তর আমরা এক পর্ব্বত-শেখরে উঠিয়া অভ্রভেদী বেননেভিস পর্ব্বতশৃঙ্গ সন্দর্শন করিলাম উহা ২৮৮২ ফিট উচ্চ।
- ইয়ুরোপে তিন বৎসর, তৃতীয় অধ্যায়, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ (১২৯০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৮
- যমুনার অনন্ত সৌন্দর্য ও আগ্রা নগরের অপূর্ব শোভা দেখিয়া কে না বিমোহিত হইয়াছে। শ্বেতপ্রস্তর-বিনির্মিত, অপূর্ব চারুশিল্পখচিত, জগতের অতুল্য তাজমহল সন্ধ্যায় নীল-গগনে একটি প্রতিকৃতির ন্যায় বোধ হয়; তাহার চতুর্দিকে সুন্দর পথ, সুন্দর কুঞ্জবন, সুন্দর ফোয়ারা; পাশে শ্যামা যমুনা। আগ্রার প্রকাণ্ড দুর্গ; তন্মধ্যে মর্মর-প্রস্তর-বিনির্মিত সুন্দর মতি-মসজিদ, দেওয়ান-খাস, দেওয়ান-আম, রংমহল, শীসমহল।
- মাধবীকঙ্কণ, সাতাশ পরিচ্ছেদ, মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রকাশক- পুস্তকালয়, প্রকাশস্থান- কলকাতা,, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮
রমেশচন্দ্র দত্তকে নিয়ে উক্তি
[সম্পাদনা]- শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত সাহিত্য-ক্ষেত্রে যে অসামান্য শ্রম স্বীকার করিয়াছেন, তজ্জন্য তিনি তাঁহার স্বদেশীয়গণের অশেষ কৃতজ্ঞতার ভাজন, সন্দেহ নাই। তাঁহার মহনীয় উপন্যাসগুলি বঙ্গবাসীদিগের পরম সময়ের সামগ্রী। তিনি ঋগবেদের সটীক সংস্করণ প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা ইউরোপের বিদ্বৎসমাজে সমুচিত প্রশংসালাভ করিয়াছে। তাঁহার ঐতিহাসিক গ্রন্থনিচয় তাঁহাকে সুলেখক বলিয়া ঘোষণা করিতেছে। ফলতঃ তিনি একা ধারে ঐতিহাসিক, ঔপন্যাসিক কবি, পণ্ডিত ও সুলেখক।
- বিনয়কৃষ্ণ দেব, কলিকাতার ইতিহাস, নবম অধ্যায়, কলিকাতার ইতিহাস - বিনয়কৃষ্ণ দেব, অনুবাদক- সুবলচন্দ্র মিত্র, বঙ্গবাসী-ইলেক্ট্রো-মেসিন-প্রেসে শ্রীনটবর চক্রবর্ত্তী কর্ত্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৯৭
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]
উইকিপিডিয়ায় রমেশচন্দ্র দত্ত সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।

উইকিসংকলনে রমেশচন্দ্র দত্ত রচিত অথবা সম্পর্কিত রচনা রয়েছে।

উইকিমিডিয়া কমন্সে রমেশচন্দ্র দত্ত সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে।