স্মৃতি
অবয়ব
স্মৃতি হলো মানুষের সেই ক্ষমতা যার মাধ্যমে অতীতের ঘটনা এবং তথ্য মনে রাখা হয়। মস্তিষ্কে তথ্য ধারণ করে রাখার প্রক্রিয়া কিংবা মস্তিষ্কে ধারণকৃত তথ্যকে স্মৃতি বলে। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে তথ্য আহরণ করে মস্তিষ্কে জমা করা হয় এবং দরকার অনুযায়ী সেই তথ্য আবার ভান্ডার থেকে খুঁজে নিয়ে আসা হয়।
উক্তি
[সম্পাদনা]- আয় স্মৃতি রাখি তোরে হৃদয়ে যতনে।
স্মরিব এ স্মৃতি আমি জীবনে মরণে।৷
এ জীবনে সেই স্মৃতি ভুলিবার নয়।
রহিবে সে চিরদিন ভরিয়া হৃদয়॥- জ্যোতিষ্মতী দেব, বাসনা ত্যাগ, মালা- জ্যোতিষ্মতী দেব, প্রকাশসাল- ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩২২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৯৩-১৯৪
- স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহা কিছু ঘটিতেছে তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি অনুসারে কত কী বাদ দেয় কত কী রাখে। কত বড়ােকে ছোটো করে, ছােটোকে বড়ো করিয়া তােলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবন-স্মৃতি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩
- সেই অতীত কালের স্মৃতি আজও যেন আমার প্রত্যক্ষ বোধ হইতেছে। ভবিষ্যৎ তুমি যদি বর্ত্তমানে পরিণত না হইতে, তবে অতীতের স্মৃতির মর্ম্ম পীড়া আমাকে ভোগ করিতে হইত না। স্মৃতির তীব্র বেদনায় যখন প্রাণে জ্বালা আসে তখন বিস্মৃতির সলিলে তাহা নিবারণ করিতে ইচ্ছা হয় না বিস্মৃতির অতলসলিলে ডোবা, এবং স্মৃতির মর্ম্ম জ্বালা সহ্য করা এই দুয়ের মধ্যবর্ত্তী পথ আর নাই; এই দুয়ের অতীত পথ আছে, তাহা ভগবান।
- ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, আমার খাতা - ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, প্রকাশক-শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬৬
- কতই না আজ ফুল ফুটেছে,
অযুত বরণ, ঊষার মাঝ,
লক্ষ ফুলের সমাধি’পর—
তাদের স্মৃতি তুচ্ছ আজ!
এই ফাগুনের ফুলের বাসে
দেখবে কোথা তলিয়ে যান
জাম্শিয়েদের অতীত্ স্মৃতি,
কৈকোবাদের জীবন গান।- ওমর খৈয়াম, রোবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম, লেখক- ওমর খৈয়াম, অনুবাদক- কান্তিচন্দ্র ঘোষ, প্রকাশক- কমলা বুক ডিপো, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫
- এখানে আমার কষ্ট নাই—এ কথা বললে সত্য বলা হবে না। কিন্তু কষ্ট যা আছে—পত্র না লিখলে তা কি কমবে?—এবং পত্র লিখলে তা কি বাড়বে? পত্র পড়ে যে কষ্ট হয় না—তা নয়। কিন্তু শুধু কি কষ্টই পাই? আর এই সব সুখদুঃখময় স্মৃতি, যার মধ্যে ব্যথার অংশ এখন বেশী হয়ে পড়েছে— তা ছেড়ে আমি বাঁচব কি করে? সন্ন্যাসের মার্গ যখন নিই নাই—তখন বাহিরের স্মৃতি—দুঃখদায়ক হলেও—কি করে ভুলব? শত যন্ত্রণা পেলেও সে সব স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে।
- সুভাষচন্দ্র বসু, শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবীকে লিখিত পত্র, পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)-সুভাষচন্দ্র বসু, প্রকাশক- এম. সি. সরকার এন্ড সন্স লিমিটেড, প্রকাশসাল- ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৬২-২৬৩
- চিন্তাভারাক্রান্ত মনকে শান্তি দান করিতেই যেন, সুদৃশ্য ভাগীরথীর তীরে আগমন করিলেন। সেখানে আসিয়া দেখিলেন— পরপারেই সেই অরণ্য। সেই বনদেবীর বাসস্থান। পূর্ব্বদিনের স্মৃতি জ্বলন্তভাবে তাঁহাকে অভিভূত করিয়া ফেলিল। ভাবিতে ভাবিতে তিনি যে পুনরায় সেই অরণ্যের দিকেই চলিতেছেন—তাহা নিজেই বুঝিতে পারিলেন না। অজ্ঞাত তাড়িতশক্তির প্রভাবেই যেন পদে পদে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। অরণ্যে আসিয়া তাঁহার চমক ভাঙ্গিল,—কিন্তু তখন আর ফিরিয়া যাইতে পা উঠিল না—
- স্বর্ণকুমারী দেবী, ছিন্নমুকুল, চতুর্থ পরিচ্ছেদ, ছিন্নমুকুল-স্বর্ণকুমারী দেবী, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশক- কান্তিক প্রেস, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩২০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২১
- অতীতের সাক্ষী, সত্যের আলো, জীবন্ত স্মৃতি, জীবনের শিক্ষা ও প্রাচীনত্ত্বের বার্তাবাহক হলো ইতিহাস।
- সিসেরো। "On the Ideal Orator", পৃষ্ঠা ১৩৩
- কোথ্বকে আসছে সেই অতীতের স্মৃতি নেই।
কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেই বর্তমানের গতি নেই
কোথায় চলেছে নেই সেই ভবিষ্যতের ঠিকানা।- অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ছন্নছাড়া [১]
- স্মৃতি সতত সুখের। স্মৃতি অনেক সময় প্রতারকও বটে। তবু স্মৃতি মানুষের এক চমৎকার সম্পদ। অবশ্য একটু বয়স না হলে এ সম্পদের যথার্থ মূল্যায়ন করা যায় না এবং বয়স যত বাড়তে থাকে, স্মৃতি যেন তত দূর অতীতের গর্ভে সরে যেতে থাকে।
- কবীর চৌধুরী, আমার ছোটবেলা, পৃষ্ঠা ১
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধরত সৈনিকদের মধ্যে হিস্টিরিক-অন্ধত্ব ও স্মৃতিভ্রংশের অনেক ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এদের প্রতিটি অন্ধত্ব ও স্মৃতিভ্রংশ বহিরাগত কোনও কারণে হয়নি, হয়েছে মস্তিষ্ক-কোষের জন্য। ওদের অবচেতন মন রক্ত দেখতে চাইছে না। হত্যার বীভৎস স্মৃতি ধরে রাখতে চাইছে না। এই না চাওয়ার তীব্র আকুতি থেকেই দৃষ্টি হারিয়েছে, স্মৃতি হারিয়েছে।
- প্রবীর ঘোষ, অলৌকিক নয় লৌকিক (প্রথম খণ্ড) - প্রবীর ঘোষ, প্রকাশক- দে’জ পাবলিশিং, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- প্রকাশসাল ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ (১৪১৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৫৪
- বাল্যকালে একটা ছিল বিষম সুখ
তখন কোনো বাল্যকালের স্মৃতি ছিল না।- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতাসমগ্র ২, "স্মৃতি"-কবিতার অংশ [২]
- এ পৃথিবীতে যাঁহাকে আমরা সর্ব্বাপেক্ষা ভালবাসিতাম, তাঁহাকে হারাইয়া যদিও বাহিরে শােক প্রকাশ করিতেছি; কিন্তু ভিতরে শান্তি বিরাজমান। তাঁহাকে এ পৃথিবীতে আর পাইব না সত্য; কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, তাঁহাকে আমরা পবিত্র স্মৃতি এবং স্বর্গীয় প্রেমে পাইয়াছি। প্রভু আমাদিগকে অত্যন্ত আঘাত দিয়াছেন, কিন্তু এই আঘাতের মধ্যে তাঁহার পিতৃহস্ত নিকটতর বােধ হইতেছে। তিনি আঘাত দিয়া আবার পূর্ণ শান্তিও দিয়াছেন। এই বৎসর আমাদের নিকট অতি প্রিয় এবং পবিত্র হউক; কেন না এই বৎসরে আমার প্রিয়তম পিতা পার্থিব দুঃখ, শােক এবং ক্লান্তির হস্ত এড়াইয়া অমর লোকের চিরশান্তি-আশ্রমে গমন করিয়াছেন।
- মেরী কার্পেন্টার - কুমুদিনী বসু, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৩ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৫-১৬
- এমত নহে যে একেবারে বায়ু বহিতেছিল না; মধু মাসের দেহস্নিগ্ধকর বায়ু; অতিমন্দ; একান্ত নিঃশব্দ বায়ু মাত্র; তাহাতে কেবল মাত্র বৃক্ষের সর্ব্বাগ্রভাগারূঢ় পত্রগুলিন হেলিতেছিল, কেবলমাত্র আভূমিপ্রণত শ্যামালতা দুলিতেছিল; কেবল মাত্র নীলাম্বরসঞ্চারী ক্ষুদ্র শ্বেতাম্বুদখণ্ড গুলিন ধীরে ধীরে চলিতেছিল। কেবল মাত্র, তদ্রূপ বায়ু সংসর্গে সম্ভুক্ত পূর্ব্ব সুখের অস্পষ্ট স্মৃতি হৃদয়ে অল্প জাগরিত হইতেছিল।
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কপালকুণ্ডলা, চতুর্থ খণ্ড — তৃতীয় পরিচ্ছেদ, কপালকুণ্ডলা- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রকাশসাল- ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ (১২৭৭ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১২১
- কি মধুর সুখময় সে পবিত্র স্মৃতি!
সেই বাল্যসুখস্মৃতি অজানা প্রণয়!
যে অনলে দগ্ধ এবে হই দিবারাতি,
সে স্মৃতি স্মরণে কিছু প্রশমিত হয়।- জ্যোতিষ্মতী দেব, অনুরাগ, মালা- জ্যোতিষ্মতী দেব, প্রকাশসাল- ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩২২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪৪
- আমাদের স্মৃতি নিপুণ সাহিত্যরচয়িতার মতো তাঁহার অধিকাংশই বাদ দিয়া ফেলে। তাঁহার ছোটোবড়ো সমস্ত অংশই যদি ঠিক সমান অপক্ষপাতের সহিত আমাদের স্মৃতি অধিকার করিয়া থাকে তবে এই স্তূপের মধ্যে আসল চেহারাটি মারা পড়ে ও সবটা রক্ষা করিতে গেলে আমাদের পরমাত্মীয়কে আমরা যথার্থভাবে দেখিতে পাই না। পরিচয়ের অর্থই এই যে, যাহা বর্জন করিবার তাহা বর্জন করিয়া যাহা গ্রহণ করিবার তাহা গ্রহণ করা।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যের বিচারক, সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৪
- অনিত্য জীবনে কেন গভীর প্রণয়?
কেন এত স্নেহ মায়া নশ্বর জীবনে?
মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে যদি এতই প্রলয়
প্রণয়ের স্মৃতি কেন গভীর স্মরণে?
স্মৃতি—কেন রহে চিত্তে এত দীর্ঘকাল?
ঘটনার সঙ্গে ধ্বংশ কেন নাহি হয়।
সুখের ভাবনা হৃদে জাগে ক্ষণকাল
,দুখের ভাবনা বিন্তু ভুলিবার নয়,
যে অনলে দগ্ধ হয় পাষাণ হৃদয়
সে অনলে স্মৃতি কেন ভস্ম নাহি হয়!- কালীপ্রসন্ন ঘোষ, স্বপ্ন প্রতিমা, চিত্ত-মুকুর - কালীপ্রসন্ন ঘোষ, প্রকাশসাল- ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ (১২৮৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৩১
- মনোবিজ্ঞান মনে করে কোনও একজন প্রবীণ ব্যক্তিকে সম্মোহন করে তার হারিয়ে যাওয়া শৈশবের কিছু স্মৃতিকে আবার উদ্ধার করা সম্ভব। কারণ সম্মোহিত ব্যক্তির বেশ কিছু শৈশব স্মৃতি মস্তিষ্ক কোষে সঞ্চিত থাকে। যে-ভাবে স্মৃতি সঞ্চিত থাকে কম্পিউটারে। কম্পিউটারকে ঠিকমতো চালিয়ে যেমন সঞ্চিত স্মৃতি উদ্ধার করা সম্ভব, ঠিক তেমনি করেই সম্মোহনের সাহায্যে মানুষের অতীতের কিছু সঞ্চিত অথচ চাপা পড়ে থাকা স্মৃতিকে উদ্ধার করা সম্ভব।
- প্রবীর ঘোষ, অলৌকিক নয় লৌকিক (প্রথম খণ্ড) - প্রবীর ঘোষ, প্রকাশক- দে’জ পাবলিশিং, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- প্রকাশসাল ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ (১৪১৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩০৯
- গৃহে আসিয়া দিগ্গজ-পণ্ডিত মনে মনে ভাবিলেন, “ব্যাকরণাদিতে ত কৃতবিদ্য হইলাম। এক্ষণে কিঞ্চিৎ স্মৃতি পাঠ করা আবশ্যক। শুনিয়াছি, অভিরামস্বামী বড় পণ্ডিত, তিনি ব্যতীত আমাকে শিক্ষা দেয় এমন লােক আর নাই, অতএব তাঁহার নিকটে গিয়া কিছু স্মৃতি শিক্ষা করা উচিত।” এই স্থির করিয়া দিগ্গজ দুর্গমধ্যে অধিষ্ঠান করিলেন। অভিরামস্বামী অনেককে শিক্ষা দিতেন; কাহারও প্রতি বিরক্তি ছিল না। দিগ্গজ কিছু শিখুক বা না শিখুক, অভিরামস্বামী তাহাকে পাঠ দিতেন।
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দুর্গেশনন্দিনী, আশ্মানির দৌত্য, দুর্গেশনন্দিনী- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সংস্করণ ২১, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, প্রকাশসাল- ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩১ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫১
- আঠারো বছরের দীর্ঘ ব্যাবধান পার করিয়া দৃষ্টিটাকে পিছনে ঠেলিয়া লইয়া যাইতে হইতেছে, অর্থাৎ অতীতকে উদ্ধার কারতে গিয়া স্মৃতির সাহায্য লইতেছি। স্মৃতি যে সব ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য নহে, তাহা জানা কথা। আবার স্মৃতি যে ইতিহাস নহে, একথাও পণ্ডিতেরা বলিয়া থাকেন। আরও একটা কথা, সময়ে স্মৃতি ঝাপ্সা হইয়া আসে, অর্থাৎ স্মৃতির চোখে ছানি পড়িয়া আসিতে থাকে। স্মৃতির এই ঝাপ্সা ও প্রায়-অন্ধ চোখে অতীতকে দেখিতে গিয়া যাহা দেখা যায়, তাহা ঠিক অতীতকে দেখা নহে। একেবারে নূতন কিছু দেখার সামিল তাহা।
- অমলেন্দু দাশগুপ্ত, বক্সা ক্যাম্প- অমলেন্দু দাশগুপ্ত, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১
- তবে একটী অনুরোধ তোমাকে লতিফ! তোমার হৃদয় হইতে আমায় একাবারে মুছিয়া ফেলিও না। স্মৃতি সুখেরও হয়, দুঃখেরও হয়। কিন্তু এই স্মৃতি জিনিষটা ত এক। তুমি তোমার স্মৃতিকে চিরদিনের জন্য সুখময় করিয়া লইও। ভ্রাতৃভাবে—আমার কল্যাণ কামনা করিও।
- হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, দেওয়ানা, দশম পরিচ্ছেদ, দেওয়ানা - হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৬ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৯১
- বঙ্কিমের স্মৃতি প্রসঙ্গে “বন্দে মাতরম্” গান ও মন্ত্রের স্মৃতি ভেসে না উঠে যায় না। সে গান বঙ্কিম-ভক্তিতে ডোবা আমার প্রাণে প্রথম ফোটেনি। তার ফোটানতে ছিল রবীন্দ্রের হাত। জীবনের প্রথম দিকে কাব্য বা সঙ্গীতের রসগ্রাহিতায় রবীন্দ্রের আত্মপর বিচার ছিল না। যে কবির যেটি ভাল লাগত সেটিতে নিজের সুর বসিয়ে, গেয়ে ও গাইয়ে তার প্রচার করতেন।
- সরলা দেবী চৌধুরানী, জীবনের ঝরাপাতা- সরলা দেবী চৌধুরানী, পরিচ্ছেদ সাত, প্রকাশক- শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪৭
- মানুষ যদি আপনার ভবিষ্যৎ জানিতে পারিত; তাহা। হইলে গর্ব্ব অহঙ্কার সকল পাপই পৃথিবী হইতে চলিয়া যাইত! কি ছিলাম, কি হইয়াছি! তখন যদি বুঝিতাম যে সর্ব্বশক্তিমান পরমেশ্বর দিতেও পারেন এবং নিতেও পারেন; তাহা হইলে কি মান অভিমানের খেলা লইয়া বৃথা দিন কাটাইতাম! এখন দিন গেছে, কথাই আছে, আর আছে স্মৃতির জ্বালা!
- বিনোদিনী দাসী, আমার কথা (প্রথম খণ্ড) - বিনোদিনী দাসী, প্রকাশক- গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩২০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮৮-৮৯
- বহির্জগতের কাল্পনিক প্রতিলিপিই চিত্র, মনোজগতে ধরা নানা বস্তুর যে স্মৃতি তার আলেখ্যই চিত্র,—এ দুটোই মত, মন্ত্র নয়। বাইরে যা দেখছি খুঁটে খুঁটে তার কাপি নেওয়া কিম্বা চোখ উল্টে ভিতরের দিকে বাইরেরই যে সব স্মৃতি রয়েছে জমা তার হুবহু ছাপ তোলায় তফাৎ একটুও নেই, দুটোই একজাতির চিত্র-–এও ছাপ সেও ছাপ, কাপি ছবি নয়। ফটো যন্ত্র বাইরের গাছপালার ছাপ নেয়, আর আচার্য জগদীশচন্দ্রের কল গাছের ভিতরকার ব্যাপারের রেকর্ড তোলে, দুটোই কিন্তু কল, artist নয়; ধর, কোন উপায়ে যদি কল দুটোই বেঁচে উঠে কাজে লেগে যায় তা হ’লেও তারা কি artist, একথা বলাতে পারবে আপনাদের? চোখের সামনে সূর্যোদয় আর অতীত সমস্ত সূর্যোদয়ের স্মৃতিচিত্র (memory picture) দুয়ের মধ্যেও না হয় রং চংএর তফাৎ হ’ল, কিন্তু তাই বলে একটা আর্ট আর অন্যটা আর্ট নয়, স্মৃতির যথাযথ প্রতিলিপিই আর্ট, সামনের যথাযথটা আর্ট নয়, কিম্বা সামনেরটাই আর্ট আর মনেরটা ঠিক তার উল্টো জিনিষ, এ তর্ক উঠতেই পারে না, কেননা যথাযথ প্রতিলিপি, তা সে এ-পিঠেরই হোক বা ও-পিঠেরই হোক, সে কাপি, এবং যারা তা করছে তারা নকলই করছে, কেউ আসল গড়ছে না।
- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মত ও মন্ত্র, বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১২৯
- আমার এই বঙ্গদেশের সুখের স্মৃতি আছে —নিদর্শন কই? দেবপালদেব, লক্ষ্মণসেন, জয়দেব, শ্রীহর্ষ,—প্রয়াগ পর্যন্ত রাজ্য, ভারতের অধীশ্বর নাম, গৌড়ী রীতি, এ সকলের স্মৃতি আছে, কিন্তু নিদর্শন কই? সুখ মনে পড়িল, কিন্তু চাহিব কোন্ দিকে? সে গৌড় কই? সে যে কেবল যবনলাঞ্ছিত ভগ্নাবশেষ! আর্য্য রাজধানীর চিহ্ন কই? আর্য্যের ইতিহাস কই? জীবনচরিত কই? কীর্তি কই? কীর্ত্তিস্তম্ভ কই? সমরক্ষেত্র কই? সুখ গিয়াছে— সুখ-চিহ্নও গিয়াছে, বঁধু গিয়াছে, বৃন্দাবনও গিয়াছে—চাহিব কোন্ দিকে?
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কমলাকান্তের দপ্তর, কমলাকান্ত - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সপ্তম সংখ্যা, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ (১২৯২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৫৭-১৫৮
- আমি বলিতেছিলাম, ‘বাঁশির শব্দে, পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায়, কবিরা বলেন, হৃদয়ের মধ্যে স্মৃতি জাগিয়া উঠে। কিন্তু কিসের স্মৃতি তাহার কোনো ঠিকানা নাই। যাহার কোনো নিদিষ্ট আকার নাই তাহাকে এত দেশ থাকিতে স্মৃতিই বা কেন বলিব, বিস্মৃতিই বা না বলিব কেন, তাহার কোনো কারণ পাওয়া যায় না। কিন্তু ‘বিস্মৃতি জাগিয়া ওঠে’ এমন একটা কথা ব্যবহার করিলে শুনিতে বড়ো অসংগত বোধ হয়। অথচ কথাটা নিতান্ত অমূলক নহে। অতীত জীবনের যে সকল শতসহস্র স্মৃতি স্বাতন্ত্র্য পরিহার করিয়া একাকার হইয়াছে, যাহাদের প্রত্যেককে পৃথক করিয়া চিনিবার জো নাই, আমাদের হৃদয়ের চেতন মহাদেশের চতুর্দিক বেষ্টন করিয়া যাহারা বিস্মৃতিমহাসাগর-রূপে নিস্তব্ধ হইয়া শয়ান আছে, তাহারা কোনো কোনো সময়ে চন্দ্রোদয়ে অথবা দক্ষিণের বায়ু-বেগে একসঙ্গে চঞ্চল ও তরঙ্গিত হইয়া উঠে; তখন আমাদের চেতন হৃদয় সেই বিস্মৃতিতরঙ্গের আঘাত-অভিঘাত অনুভব করিতে থাকে, তাহাদের রহস্যপূর্ণ অগাধ অস্তিত্ব উপলব্ধ হয়, সেই মহাবিস্মৃত অতিবিস্তৃত বিপুলতার একতান ক্রন্দনধ্বনি শুনিতে পাওয়া যায়।’
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গদ্য ও পদ্য, পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮১
- সেই জ্যোৎস্নাস্নাত সুপ্ত গৃহের বাতায়নে নিবদ্ধদৃষ্টি প্রভাতচন্দ্র কল্পনায় কত সুখস্বপ্নের রচনা করিতে লাগিল। শোভার কত কথা, কত ব্যবহার তাহার মনে পড়িতে লাগিল।সে সব স্মৃতি সুখের। প্রেম সুখস্মৃতি সযত্নে রক্ষা করে। প্রেমদীপ্ত স্মৃতি সুখের।
- হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, নাগপাশ - হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, প্রকাশক- বসুমতী পুস্তকবিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ (১৩১৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১০
- এ অনিত্য সংসারে কেবল বিয়োগবিলাপে অধীর হইয়া পড়ি। তাই বিদ্যাসাগরের স্মৃতিতে এখনও বিয়োগ-ঝড়বানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠে। যে যায়, সে ত আর আসে না। যায়, কিন্তু স্মৃতি যে জাগে! স্মৃতি ত নয়, সে যে জালাময়ী জাল। সে জ্বালা জুড়াইব কিসে?
- বিহারীলাল সরকার, বিদ্যাসাগর- বিহারীলাল সরকার, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৯ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১-২
- নজরুল ভাই, রোজই বাজে
মনের মাঝে স্মৃতির সুর,
সেই অতীতের তোমার স্মৃতি!
—আজকে থেকে অনেক দূর।
যৌবনেরি শ্যামল স্মৃতি
এই জীবনে অমূল্য।
বন্ধু, তাহার বিনিময়ে
চাইনা আমি কোহিনূর।- হেমেন্দ্রকুমার রায়, যাঁদের দেখেছি - হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক— নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলিকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩০৪-৩০৫
- এই স্মৃতির মধ্যে এমন কিছু নাই যাহা চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিবার যােগ্য। কিন্তু বিষয়ের মর্যাদার উপরেই যে সাহিত্যের নির্ভর তাহা নহে; যাহা ভালো করিয়া অনুভব করিয়াছি তাহাকে অনুভবগম্য করিয়া তুলিতে পারিলেই মানুষের কাছে তাহার আদর আছে। নিজের স্মৃতির মধ্যে যাহা চিত্ররূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহাকে কথার মধ্যে ফুটাইতে পারিলেই তাহা সাহিত্যে স্থান পাইবার যােগ্য।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবন-স্মৃতি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫
- মাতঙ্গিনী নিজের ভাবনায় এমনই ডুবিয়াছিল যে, বহিঃপ্রকৃতির এই রূপ দেখিবার অবকাশ তাহার ছিল না; সে শুধু ইহাই অনুভব করিয়া লইয়াছিল যে তাহার চারিদিকের প্রকৃতি যেন দুঃখভারাক্রান্ত। নিষিদ্ধ অথচ আকাঙ্খিত মিলনের স্মৃতিটুকু তাহার মনকে ভরিয়া রাখিয়াছিল—বাড়িতে গেলে তাহারা কি ভাবে তাহাকে অভ্যর্থনা করিবে, তাহার স্বামী এই ঘটনার কথা জানিতে পারিলেই বা তাহার কতখানি বিপদ ঘটিতে পারে—এই সকল দুশ্চিন্তা সেই মিলন-দৃশ্যের স্পষ্টতাকে বিন্দুমাত্র ছায়াচ্ছন্ন করিতে পারে নাই; সেই স্মৃতিই তাহার মানস-চক্ষে কখনও উজ্জ্বল রঙে কখনও গভীর কালিমায় ফুটিয়া উঠিতেছিল। সে মাধবকে কথা দিয়াছে, সে ভুলিয়া যাইবে; কিন্তু মাধবের সান্নিধ্য ত্যাগ করিয়াই সর্ব্বপ্রথমে সে এই স্মৃতিরই পূজা করিতে লাগিল—মাধব যতগুলি কথা উচ্চারণ করিয়াছিল তাহার প্রত্যেকটি সে মনে করিয়া করিয়া তাহা লইয়াই স্বপ্নরচনা করিতে লাগিল, মাধবের প্রত্যেক অশ্রুবিন্দুর স্মৃতি তাহাকে পাগল করিতে লাগিল। এবং ক্ষণে ক্ষণে তাহার এই মনের উন্মাদনা কাটিয়া গিয়া নিজের অন্তরের পাপের স্মৃতি, সে যে দেবতাদের ও মানুষের ঘৃণ্য হইয়া উঠিয়াছে, এই কথা ভাবিয়া অভিভূত হইয়া পড়িল।
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজমোহনের স্ত্রী- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দশম পরিচ্ছেদ, অনুবাদক- সজনীকান্ত দাস, প্রকাশক- ঈষ্টার্ণ পাবলিশার্স সিণ্ডিকেট লিঃ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫১ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬০-৬১
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]
উইকিপিডিয়ায় স্মৃতি সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।

উইকিঅভিধানে স্মৃতি শব্দটি খুঁজুন।