বিষয়বস্তুতে চলুন

হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে

হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ (২৪ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ - ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২) একজন বাঙালি সাহিত্যিক, সম্পাদক এবং সাংবাদিক। ১৩০০ বঙ্গাব্দ থেকে 'সাহিত্য' পত্রিকার সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এছাড়া 'দাসী', 'সুহৃদ', 'উৎসাহ', 'মুকুল', 'ভারতী', 'বঙ্গদর্শন' প্রভৃতি পত্রিকাতে তার রচিত বহু গদ্য ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি 'ক্যালকাটা রিভিউ', 'হিন্দুস্তান রিভিউ' প্রভৃতি পত্রিকার লেখক ছিলেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে অরবিন্দ ঘোষ, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী ও বিপিনচন্দ্র পালের সঙ্গে 'বন্দেমাতরম' পত্রিকা পরিচালনা করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হলে তিনি অধ্যাপক হয়েছিলেন।

উক্তি

[সম্পাদনা]

বাঙ্গালা নাটক

[সম্পাদনা]
শ্রীহেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, "বাঙ্গালা নাটক", কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫২।
  • ইংরেজ যে স্থানেই বাস করে, সেই স্থানেই আনন্দসম্ভোগকরে রঙ্গালয়-প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। ১৭৫৩ খৃষ্টাব্দে অঙ্কিত উইন্সের কলিকাতার মানচিত্রে দেখা যায়-ওল্ডকোর্ট হাউসের নিকটে ইংরেজদিগের রঙ্গালয় ছিল। অর্ধশতাব্দী পূর্বেও কলিকাতায় ঠিকাগাড়ীর চালকরা থিয়েটার রোডকে "পুরানা নাচ-ঘরকি রাস্তা" বলিত। তখন বেন্টিঙ্ক প্লাট-কশাইটোলার রাস্তা, বৃটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রীট-রাণী মুদিনীর গলি-ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল।
    • উপক্রমণিকা, পৃষ্ঠা ৬।
  • বাংলা নাটক রচিত হইবার পূর্বে যে যাত্রা প্রচলিত ছিল, তাহাতে রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজন হইত না-ভূমিতেই "আসর” রচনা করা হইত এবং দৃশ্য-পটের ব্যবহার ছিল না। সাধারণতঃ পৌরাণিক ঘটনাবলম্বনেই অভিনয়ের "পালা” রচিত হইত। কিন্তু সকল শ্রেণীর লোকের মনোরঞ্জনের জন্য যাত্রা গাহনা হইত বলিয়া সময় সময় অকারণ হাস্যোদ্দীপন-জন্য সং আনিতে হইত। সং আসরে আসিয়া যে অভিনয় করিত, তাহা সকল সময় সুরুচি-সঙ্গত হইত না এবং সে সময় সময় অবান্তর উক্তি করিত। সং আসিয়া হয়ত জিজ্ঞাসা করিত, তাহার জাতি নির্ণয় কে করিতে পারেন? এক জন হয়ত তাহার পরিচয় চাহিত এবং সে তাহার উত্তরে বলিত: "আমার ঠাকুরদাদা জাত গোয়ালা, ঠাকরুণদিদি উড়ে, আমার বাপ ছিল সাপুড়ে।” তাহাতে দর্শকদিগের মধ্যে এক দল হাস্য করিত।
  • উপক্রমণিকা, পৃষ্ঠা ৮-৯।
  • সংস্কৃত নাটক গ্রীক বা অন্য কোন নাটকের প্রভাবে প্রভাবিত নহে। তাহা সর্বতোভাবে ভারতীয়- ভারতীয়ের মনোরঞ্জন-জন্য ভারতীয় কবি কর্তৃক রচিত-ভারতীয় সংস্কৃতির সহিত সামঞ্জস্যসম্পন্ন। ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য এই যে, একদিকে অভ্রভেদী-শিখরসম্পন্ন হিমাচল-আর অন্য কয় দিকে উত্তুঙ্গতরঙ্গসঙ্কুল সাগর এই দেশকে প্রতিবেশী দেশসমূহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া ইহার অধিবাসীদিগকে স্বতন্ত্র সংস্কৃতির উদ্ভব করিতে প্ররোচিত করিয়াছিল। সেইজন্য ভারতীয় প্রকৃতি, ভারতীয় দর্শন, ভারতীয় সাহিত্য ও ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থা স্বতন্ত্র ও স্বয়ং-সম্পূর্ণ। বাঙ্গালা ভাষা সংস্কৃত ভাষা হইতে উদ্ভুত-বাঙ্গালা নাটকও সম্পূর্ণরূপে সংস্কৃত রচনার প্রভাব-মুক্ত হইতে পারে নাই। কিন্তু বাঙ্গালা নাটকের আদর্শ সংস্কৃত নাটক নহে। বাঙ্গালায় রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হইলে সংস্কৃত নাটকের অনুবাদে ও অনুকরণে রচিত অনেক নাটক অভিনীত হইয়াছিল কিন্তু লোকের প্রীতি অর্জন করিতে পারে নাই।
  • উপক্রমণিকা, পৃষ্ঠা ১০-১১।
  • নাটক হিসাবে ভদ্রার্জুন-এর মূল্য যত সামান্যই কেন হউক না, নূতন পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য ইহার গৌরব পথিপ্রদর্শকের।
    • উপক্রমণিকা, পৃষ্ঠা ১৩।
  • কিন্তু যে দুইজন ঐন্দ্রজালিকের দণ্ডস্পর্শে বাংলা ভাষা অচির-কালমধ্যে সবভাবপ্রকাশক্ষম ও মনোরমসৌন্দর্যসম্পন্ন হইয়াছিল, তখন তাঁহাদিগের আবির্ভাবের বিলম্ব ছিল না। তাঁহারা মধুসূদনবঙ্কিমচন্দ্র
    • উপক্রমণিকা, পৃষ্ঠা ১৮।
  • ইংরেজী সাহিত্যে জনশন লর্ড চেষ্টারফিল্ডকে সদর্পে বলিয়াছিলেন, সাহিত্যিকরা আর ধনীর মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিবেন না। অর্থাৎ অতঃপর তাঁহারা সাহিত্য-সেবা ব্যবসা হিসাবে গ্রহণ করিয়া থাকিতে পারিবেন। যতদিন বাঙ্গালা নাটককার, অভিনেতা প্রভৃতি বলিতে পারেন নাই, দর্শকদিগের আদর তাঁহাদিগের সংসারিক অভাব মোচন করিবে, ততদিন নাটক-রচনায় অনেকে আবশ্যক মনোযোগ প্রদান করেন নাই।
    • উপক্রমণিকা, পৃষ্ঠা ২২।
  • স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে যদি বা শিক্ষার বিস্তার হইতেছিল, তথাপি সামাজিক প্রথা এত প্রবল ছিল যে, তাঁহাদিগকে রুদ্ধদ্বার পাল্কীতে গঙ্গায় চুবাইয়া গঙ্গাস্নানের পুণ্যার্জন করান হইত। ধনীর গৃহিণীরা যে পাল্কীতে যাইতেন, তাহার আবার আবরণ-ঘেরাটোপ থাকিত। আমরা যেমন ইহা দেখিয়াছি, তেমনই দেখিয়াছি, কলিকাতার উপকণ্ঠে সুখচর গ্রামে কলিকাতার ইংরেজের চাকরীতে ধনশালী কোন পরিবারের গঙ্গাতীরস্থ গৃহে যে সোপানশ্রেণী গঙ্গাগর্ভে নামিয়া গিয়াছে, তাহার মধ্যভাগে-যে স্থানে জোয়ারের সময় জল উঠে তথায়-একটি কক্ষ আছে; জল তাহাতে প্রবেশ করিলে পরিবারের মহিলারা তথায় যাইয়া স্নান করিতেন-তাঁহারা অসূর্যস্পশ্যা না হইলেও লোকদৃষ্টির বিষয় হইতে পারেন না। খৃষ্টীয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমেও দেখা গিয়াছে, কোন কোন পরিবারের মহিলারা হয় পাল্কীতে যাইয়া ট্রেনে উঠিতেন, নহেত মশারির মধ্যে তাঁহাদিগকে প্ল্যাটফর্ম অতিক্রম করিতে হইত। বলা বাহুল্য, তাহাতেই তাঁহা-দিগের প্রতি লোকের দৃষ্টি অধিক আকৃষ্ট হইত। সুতরাং পূর্বে যদি পেশাদারী রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হইত, তাহা হইলেও ভদ্রমহিলাদিগের অভিনয়-দর্শনার্থ তথায় গমনের সম্ভাবনা থাকিত না। অথচ তাঁহারাই বাংলানাটকাভিনয়ের আদর করিবেন-এমন সম্ভাবনা ছিল। সেইজন্য রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা করিলেও তাহাতে দর্শকের অভাব ও দর্শকের অভাবে অর্থাগম-বিঘ্নের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু এই মহিলারাই মাতৃভাষার আদর করিতেন এবং তাঁহা-দিগের আদর বাঙ্গালা সাহিত্যের সকল বিভাগ পুষ্ট ও শ্রীসম্পন্ন করিতে অসাধারণ সাহায্য করিয়াছিল।
    • উপক্রমণিকা, পৃষ্ঠা ২৫-২৬।
  • মধুসূদন বাংলা নাটক— প্রকৃত বাংলা নাটক প্রথম রচিত করেন, সেজন্য ভাষাকে প্রয়োজনের উপযোগী করেন এবং বাংলায় প্রকৃত নাটকের আদর্শ-প্রতিষ্ঠা করেন-যেন তিনি উপকরণ সংগ্রহ করিয়া নিপুণ শিল্পীর মত প্রতিমা-গঠন করিয়াছিলেন এবং তাহার পরে সেই প্রতিমা শ্রদ্ধার গঙ্গোদকে বিধৌত রত্নবেদীতে প্রতিষ্ঠিত করিয়া-ভক্তির পঞ্চপ্রদীপে তাহার আরতি করিয়াছিলেন এবং আপনার নিষ্ঠায় তাহাতে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করিতেও সমর্থ হইয়াছিলেন।
    • মধুসূদন ও দীনবন্ধু, পৃষ্ঠা ৪০।
  • দীনবন্ধুর 'নীলদর্পণ' যে কার্য করিয়াছে, নবযুগের ইতিহাসে কেবল মিসেস ষ্টো-র 'টমকাকার কুটীর' সেইরূপ কার্য করিয়াছে। ডিকেন্সের উপন্যাসগুলিও দুর্নীতি ও কদাচার নিবারণে সেরূপ সাফল্যলাভ করে নাই। ষ্টো-লিখিত উপন্যাস আমেরিকায় ক্রীতদাস-প্রথার বিরুদ্ধে লোকমত উদ্রিক্ত করিয়া যেরূপ কার্য করিয়াছিল, দীনবন্ধুর নাটক এই প্রদেশে নীলকরদিগের অত্যাচার-দূরীকরণে সেইরূপ কার্য করিয়াছিল।
    • মধুসূদন ও দীনবন্ধু, পৃষ্ঠা ৪১।
  • বাঙ্গালার রঙ্গালয় ধর্মক্ষেত্রে, সমাজক্ষেত্রে, রাজনীতিক্ষেত্রে যে কার্য করিয়াছে, তাহা স্মরণীয়। সেই রঙ্গালয় যে দীনবন্ধুর নাটক লইয়াই লোককে আকৃষ্ট করিতে আরম্ভ করে-আপনার গৌরক-প্রতিষ্ঠা করে, তাহা সঙ্গত। দীনবন্ধুর নাটকগুলি রচিত না হইলে বাঙ্গালীকে আরও কত দিন অভিনয়-চাতুর্যের জন্য ধনীর অনুগ্রহের চোরাবালুতে আশার সৌধ রচনা করিয়া হতাশ হইতে হইত, কত দিনে আবার নাট্যকারের আবির্ভাব হইত, তাহা কে বলিতে পারে?
    • মধুসূদন ও দীনবন্ধু, পৃষ্ঠা ৫৬।
  • এ দেশের সংস্কৃতির প্রভাবে ধৰ্মজ্ঞান ও স্ত্রীলোকদিগের প্রতি শ্রদ্ধা আপামরসাধারণের ধাতুগত হইয়াছে। ইহা হিন্দু-সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য এবং ইহার জন্য হিন্দু অবশ্যই গৌরবানুভব করিতে পারে। হিন্দু ব্যতীত ভারতে অন্য সকল সম্প্রদায়-সম্বন্ধেও যদি এই কথা বলা সম্ভব হইত, তাহা হইলে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা এই বাঙ্গালাতেই সংঘটিত হইত না।
    • দীনবন্ধুর পরবর্ত্তী নাট্যকারগণ, পৃষ্ঠা ৬৮।
  • সিরাজদ্দৌলা বা মীর কাসিম ইংরেজকে পরাভূত করিলে সমগ্র দেশের কি লাভ হইত, তাহা অনুমান করা দুষ্কর। বঙ্কিমচন্দ্র বলিয়াছেন,-“সিপাহী বিদ্রোহ যদি সফল হইত, তবে আজ দিল্লীতে মুসলমান বাদশাহ এবং লক্ষ্ণৌয়ে মুসলমান বাদশাহ রাজ্য করিত।” হিন্দুর কি লাভ হইত? অথচ হিন্দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ। হিন্দুর লাঞ্ছনার চিহ্ন তো কাশীতে, মথুরায়, বৃন্দাবনে— নানাস্থানে প্রকট।
    • গিরিশচন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্রলাল, পৃষ্ঠা ১০৪।
  • যে সময়ে দেশে স্বাধীনতা-লাভের জন্য আন্দোলন চলিতেছিল এবং বাংলার তরুণরা সে জন্য অনায়াসে হাসিমুখে প্রাণ দিতেছিল, সে সময়ে গিরিশচন্দ্রের দেশাত্মবোধাত্মক নাটকগুলি আদৃত হইবারই কথা। কারণ, তখন ইংরেজবিদ্বেষ দেশে প্রবল-একদিকে স্বাধীনতা-লাভের প্রয়াস, আর একদিকে সেই প্রয়াস নষ্ট করিবার জন্য স্বৈরশাসনের সকল অস্ত্র-প্রয়োগ। কারণ, বিদেশী শাসকদিগের মত। সেইরূপ প্রয়াস— crime of nationalism. আমাদিগের মনে হয়, সিরাজদ্দৌলা ও মীর কাসিম এত অল্পদিন পূর্বের লোক যে, তাঁহাদিগকে লইয়া রচিত নাটকে প্রচুর কল্পনা-প্রয়োগের অবসর অল্প।
    • গিরিশচন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্রলাল, পৃষ্ঠা ১০৪।
  • বাংলা নাটকে পৌরাণিক আখ্যানবস্তু যে অধিক অবলম্বিত হইয়াছে, তাহার কারণ-ইতিহাস পুরাণ অপেক্ষা জনগণের নিকট অল্পপরিচিত-তাহা প্রধানতঃ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে নিবন্ধ; কেবল কিংবদন্তী ইতিহাসের অনেক ঘটনা রক্ষা করিয়াছে। কিন্তু যাহা মুখে মুখে প্রচারিত হয়, তাহা অতিরঞ্জনে বা রঞ্জনের অভাবে বিকৃত হইয়া যায়। এ দেশের অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিকে সে ভোগ ভোগ করিতে হইয়াছে, অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা বিকৃতভাবে প্রচারিত হইয়া আসিতেছে। অবশ্য কিংবদন্তীর ফেনপুঞ্জতলে অনেক সময়ে সতোর শীর্ণ ধারা প্রবাহিত দেখিতে পাওয়া যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ সিরাজদ্দৌলার অত্যাচারের বিষয় উল্লেখ করা যায়। তিনি যে বর্ষায় নদীর প্রবল স্রোতে যাত্রি-নৌকা ডুবাইয়া দিয়া আনন্দ উপভোগ করিতেন, তাহাও যেমন-তাঁহার স্নানাধিনী হিন্দুরমণী-হরণও তেমনই-কাশিমবাজারে তৎকালীন ফরাসী কর্মচারীদিগের লিখিত বিবরণে পাওয়া গিয়াছে।
    • উপসংহার, ১৬১।
  • বাঙ্গালা ভাষা তাহার পুষ্টির ও শক্তির জন্য যেমন, বাঙ্গালা সাহিত্য তাহার সমৃদ্ধির জন্য তেমনই বাঙ্গালা নাটকের নিকট ঋণী।
    • উপসংহার, পৃষ্ঠা ১৭৬।

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]