অচ্যুত গোস্বামী
অচ্যুতানন্দ গোস্বামী (১ মার্চ, ১৯১৮ – ১৬ মার্চ, ১৯৮০) (অচ্যুত গোস্বামী নামে সমধিক পরিচিত; ছদ্মনাম বিক্রমাদিত্য হাজরা) ছিলেন একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক। ইংরেজির এই অধ্যাপক মার্ক্সবাদী সমালোচক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। জন্ম অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ফরিদপুরে। ১৯৪০ সালে ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘ স্থাপনে অন্যতম উদ্যোক্তার ভূমিকা নেন। সেই সময় সোমেন চন্দের সহযোগে ক্রান্তি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এছাড়া ১৯৪২ সালে মার্ক্সবাদী ও ফ্যাসিবাদবিরোধী পাক্ষিক পত্রিকা প্রতিরোধ প্রকাশ ও কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের সাথে দুই বছর সম্পাদনা করেন। অধ্যাপনা করেন যাদবপুরের বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজের ইংরেজি বিভাগে। নতুন সাহিত্য, পরিচয়, অগ্রণী, চতুষ্কোণ প্রভৃতি পত্রিকায় তার রচনা প্রকাশিত হয়। তার উল্লেখযোগ্য সমালোচনা গ্রন্থ বাংলা উপন্যাসের ধারা (১৩৫৭ বঙ্গাব্দ) ও ইংরাজী সাহিত্যের ধারা। এছাড়া অভিষেক, কানাগলির কাহিনী (১৯৫৩), মৎস্যগন্ধা (১৯৫৭), রাজ্যচ্যুত ঈশ্বর প্রভৃতি উপন্যাসও রচনা করেন।
উক্তি
[সম্পাদনা]- আমার পদ্ধতি প্রধানতঃ ব্যাখ্যামূলক। লেখকের প্রতিভার বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর সাহিত্য-কর্মের গূঢ় তাৎপর্যকে উপস্থাপিত করাই আমার লক্ষ্য: যদিও আমি জানি এ দুরূহ কাজে যথেষ্ট সার্থকতা অর্জন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সমালোচনা এবং বিচারের অপ্রিয় দায়িত্ব আমি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেছি ; কারণ কাজটা শুধু অপ্রিয়ই নয়, বিচারের কোন নির্ভরযোগ্য সর্বজনীন মানদণ্ড আছে কিনা সে বিষয়েও আমি নিঃসন্দিগ্ধ নই।
- অচ্যুত গোস্বামীর সমালোচনা গ্রন্থ বাংলা উপন্যাসের ধারার মুখবন্ধ অংশ থেকে সংগৃহীত। বাংলা উপন্যাসের ধারা
- উপন্যাসের বিষয়বস্তু এবং রূপ দুটি স্বতন্ত্র বস্তু নয়। বিষয়বস্তুকে প্রকাশ করতে গেলেই তা কোন-না-কোন রূপ গ্রহণ করবে, এবং সেই রূপের বাইরে বিষয়- বস্তুর কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। তথাপি আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা স্বতন্ত্র ভাবে রূপ-রীতি নিয়ে আলোচনা করি; আর তা সম্ভবপর এই জন্য যে বিষয়বস্তুর অসংখ্য বৈচিত্র্য থাকলেও উপন্যাসের মৌল সাংগঠনিক রীতি মাত্র অল্প কয়েকটি।
- অচ্যুত গোস্বামীর সমালোচনা গ্রন্থ বাংলা উপন্যাসের ধারার মুখবন্ধ অংশ থেকে সংগৃহীত। বাংলা উপন্যাসের ধারা
- বাংলা উপন্যাসকে যদি সুনিশ্চিত অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণ পেতে হয় তবে দুটি জিনিসের প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে। লেখককে মনে রাখতে হবে যে সমকালীন জীবন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতাই তাঁর উপন্যাসের প্রধান বিষয়বস্তু বা প্রেরণা হওয়া উচিত। লেখক যদি আন্তরিকভাবে ভনিতা ও অহমিকাকে প্রশ্রয় না দিয়ে নিজের উপলব্ধিকে প্রকাশ করেন, তবেই তাঁর রচনায় সত্যিকারের মৌলিকতা আত্মপ্রকাশ করবে। লেখককে আরও মনে রাখতে হবে যে উপন্যাসকে তিনি যদি সাময়িক চিত্ত-বিনোদনের উপায় থেকে অধিক মর্যাদা দেন, এবং নিছক উদ্দেশ্যমূলক বা রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার বলে গণ্য না করেন, তবে তাঁর পরিকল্পিত উপন্যাসকে অবশ্যই একটি নিটোল শিল্প-কর্ম হয়ে উঠতে হবে। সাহিত্য যদি সাহিত্য-কর্ম হিসাবে মূল্যবান হয়ে ওঠে, তবেই তার অন্যবিধ মূল্যের প্রশ্ন ওঠে।
- অচ্যুত গোস্বামীর সমালোচনা গ্রন্থ বাংলা উপন্যাসের ধারার মুখবন্ধ অংশ থেকে সংগৃহীত। বাংলা উপন্যাসের ধারা
- পৃথিবী অনেক বড়; সাদা চোখে পৃথিবীর আকৃতি সম্পর্কে সামান্য আভাস পাওয়াও সম্ভব নয়। চাঁদে গেলে হয়তো আমরা দূর থেকে পৃথিবীর গোলাকৃতি দেখে ধন্য হতে পারতাম; কিন্তু আপাতত আমরা চাঁদে যেতে পারছি না। কাজেই আমাদের পৃথিবীর মানচিত্র বা গ্লোব দেখার আগ্রহ। তেমনি জীবন অনেক বড় ; আমাদের ক্ষুদ্র আয়ুষ্কালের মধ্যে জীবনের খুব সামান্য ভগ্নাংশই আমরা দেখতে পাই; জীবনের একটি ঘটনার যুক্তিসঙ্গত পরিণতি দেখার জন্য আমাদের বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। তাই সেই আদিম কাল থেকেই মানুষের মনে গল্প শোনার আগ্রহ — ঘটনার শেষ পরিণতি জানার জন্য।
- অচ্যুত গোস্বামীর সমালোচনা গ্রন্থ বাংলা উপন্যাসের ধারার প্রথম পরিচ্ছেদঃউপন্যাস থেকে সংগৃহীত, পৃষ্ঠা ১। বাংলা উপন্যাসের ধারা
- অন্যান্য শিল্পকর্ম থেকে কাহিনী বা গল্পের তফাৎ এই যে তা চলিষ্ণু পরিবর্তনশীল জীবনের পরিচয় দেয়। প্রত্যেক মানুষ তার নিজের নিজের বৃত্তে গতিশীল বলে গতিশীলতার অভিজ্ঞতা তার কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
- অচ্যুত গোস্বামীর সমালোচনা গ্রন্থ বাংলা উপন্যাসের ধারার প্রথম পরিচ্ছেদঃউপন্যাস থেকে সংগৃহীত, পৃষ্ঠা ১। বাংলা উপন্যাসের ধারা
- অনেক সময় বুদ্ধিসম্মত যুক্তি-পারম্পর্য একসঙ্গে সংশ্লেষিতভাবে কল্পনায় বিধৃত হয়। সেই জন্যই গল্প-কাহিনীতে যুক্তিসঙ্গত পারম্পর্য বা যুক্তি প্রয়োগের চেষ্টা দেখা যায়।
- অচ্যুত গোস্বামীর সমালোচনা গ্রন্থ বাংলা উপন্যাসের ধারার প্রথম পরিচ্ছেদঃউপন্যাস থেকে সংগৃহীত, পৃষ্ঠা ২। বাংলা উপন্যাসের ধারা
- ইম্যাজিনেশনের সাহায্যে আমরা যে শুধু জ্ঞান লাভ করি তাই নয়, তা আমাদের সুখ লাভেরও উপায় বটে। ঘটনা বাস্তবে যেমন করে ঘটে শুধু তা জেনেই আমরা সন্তুষ্ট নই; ঘটনা যেমন করে ঘটলে আমরা খুশি হই, তার কদরও আমাদের কাছে কম নয়। আবার কিছু কিছু মানব কল্যাণকামী ব্যক্তি আছেন যারা ঘটনা যেমন করে ঘটলে মানুষের কল্যাণ হয় তার উপর গুরুত্ব দেন। আমাদের জ্ঞান-তৃষ্ণার সঙ্গে সুর্থ-কামনা এবং কল্যাণ-কামনা যুক্ত হয় বলেই ইম্যাজিনেশন-সৃষ্ট শিল্প সাহিত্যের আলোচনা এত জটিল হয়ে উঠেছে।
- অচ্যুত গোস্বামীর সমালোচনা গ্রন্থ বাংলা উপন্যাসের ধারার প্রথম পরিচ্ছেদঃউপন্যাস থেকে সংগৃহীত, পৃষ্ঠা ২। বাংলা উপন্যাসের ধারা