আবুল হোসেন
অবয়ব
আবুল হোসেন (১৫ আগস্ট, ১৯২২ - ২৯ জুন, ২০১৪) ছিলেন একজন বাংলাদেশী কবি। ত্রিশের দশকে অবিভক্ত ভারতে তার লেখালিখির সূত্রপাত। ৪০ দশকের বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি ছিলেন। ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার যে-ধারা উত্তরকালের কবিদের হাতে বিকশিত হয়েছিল, আবুল হোসেন ছিলেন সে-ধারার সফল উত্তরাধিকারী। জীবনদৃষ্টি ও কাব্যভাষা দিয়ে তিনি আমাদের যুক্ত করেছিলেন আধুনিকতার সঙ্গে।
উক্তি
[সম্পাদনা]-
- হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান এলাকাগুলোর সমন্বয়ে কৃষ্ণনগরে এক ধরনের সাধারণ উদারনৈতিক সংস্কৃতির পরিবেশ গড়ে উঠেছিল, যার শক্তি ছিল সব সম্প্রদায়ের লোক। হয়তো এজন্যই স্যর আজিজুল হক ও হেমন্তকুমার সরকারের মতো রাজনৈতিক নেতা, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবি, আকবর উদ্দীনের মতো সাহিত্যিক, অমিয়নাথ সান্যালের মতো সঙ্গীতজ্ঞ এবং মানা গুই-এর মতো খেলোয়াড় একই সঙ্গে পেয়েছিল এই শহর। কিন্তু কৃষ্ণনগরের আসল গৌরব তার মুখের ভাষা, যার হাত ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়ের শুরু। আমার সৌভাগ্য এই ভাষাই আমি শিখেছিলাম ছেলেবেলায়, এই ভাষায়, এদের উচ্চারণে কথা বলতাম এবং যখন দু'চার কথা লিখতে শিখলাম, এই ভাষাতেই লিখে গেলাম।
- আবুল হোসেন (২০০৩), ‘আমার এই ছোট ভুবন’, অবসর, ঢাকা, পৃ. ৩৪-৩৫
- আমি শুধু প্রেরণার তাড়নায় কবিতা লিখি না, লিখিনি, একেবারে ছেলেবেলায় ছাড়া। অনেক ভেবে অনেক খেটে আমি লিখি। স্থপতি যেমন হাতুড়ি বাটালি নিয়ে একটু একটু করে পাথর কুঁদে কুঁদে মূর্তি তৈরি করে ঠিক তেমনিভাবে শব্দকে, বাক্যকে ভেঙেচুরে ছেনে বাছাই করে আমি কবিতার রূপ দিতে ভালোবাসি। কত ঘাম ঝরলো, কত বিনিদ্র দিন রাত্রি কাটলো এক একটা কবিতার শরীর গড়ে তুলতে সে খবর পাঠকদের অবশ্য জানার দরকার নেই। আমি কাব্য এবং গদ্যের পৃথক ভাষায় বিশ্বাস করি না। শুধু তাই নয়, আমরা যে ভাষায় ঘরে, বাইরে, বৈঠকখানায়, অফিস-আদালতে কথা বলি, সেই ভাষাতেই কবিতা লিখতে চেয়েছি। আধুনিক নাগরিক শিক্ষিত মানুষ যা করে, যা ভাবে, যেমন ভাবে, কবিতায় আমি তার প্রতিফলন দেখতে চাই।
- আবুল হোসেনের সঙ্গে কথোপকথন (২০১০), সম্পাদক: তারেক মাহমুদ, সূচীপত্র, ঢাকা, পৃ. ১১-১২
- কবিতার কাজ কি? কবিতার মানে থাকতে হবে? শব্দগুলোর যদি কোন মানে না থাকে তাহলে শুধু একটা সুর উঠবে যে গানে কথা থাকে না, তার মতো। যেমন- যন্ত্রসংগীতে। সেটাই তো মৌল এবং বিশুদ্ধতম শিল্প। গানেও কথা থাকে, কথা এবং সুরের মিলনেই গানের সার্থকতা। কবিতা তো কথা, শব্দ দিয়েই তৈরী। তার একটা মানে থাকতে হবে না? কবিতায় মানেটার কাজ কি? গৃহস্তের বাড়ি গিয়ে চোর যেমন এক টুকরো গোস্ত পাহারাদার কুকুরের কাছে ছুঁড়ে দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দেয়, তারপর নির্বিঘ্নে ঘরের ভেতর ঢুকে সে তার নিজের কাজ সারে, কবিতার অর্থ ঐ মাংসের টুকরোর মতো। বাইরে ঐ লোভনীয় টুকরোটি ছুঁড়ে দিয়ে কবিতা তার কাজ করে যায় ভেতরে ভেতরে।
- আবুল হোসেন (২০০৩), ‘আমার এই ছোট ভুবন’, অবসর, ঢাকা
- আমি কাব্য এবং গদ্যের পৃথক ভাষায় বিশ্বাস করি না। শুধু তাই নয়, আমরা যে ভাষায় ঘরে, বাইরে, বৈঠকখানায়, অফিস-আদালতে কথা বলি, গল্পসল্প করি, সেই ভাষাতেই কবিতা লিখতে চেয়েছি। আধুনিক নাগরিক শিক্ষিত মানুষ যা করে, যা ভাবে, যেমন ভাবে, কবিতায় আমি তার প্রতিফলন দেখতে চাই।
- আবুল হোসেনের সঙ্গে কথোপকথন (২০১০), সম্পাদক: তারেক মাহমুদ, সূচীপত্র, ঢাকা, পৃ. ১২
- মনের কোণে ছিলো হাজার গান,
বুকের মধ্যে মত্ত রাঙা হাওয়া,
আমার গান হয়ে আর আনমনা হাওয়া হয়ে
ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে একটি মেয়ে এলো।
সেই আমার চিরকালের মনের মেয়ে।
- 'চিরকালের সেই মেয়ে’/নব-বসন্ত
- সঙ্কোচহীন, নির্মেঘ সেই দেশে
তোমাকে পাব অশঙ্কিত, অনাবৃত বেশে,
তোমাকে পাব গ্রহণ ছাড়া মুক্ত দেহে মনে।- ‘যতই কাছে যাই’/নব-বসন্ত
- তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারো ভাবিনি তা একবারও।
এই কি সে মেয়ে
চেয়েছি জীবন দিতে যাকে চেয়ে?
- 'সেই মেয়ে’/কালের খাতায়
- মুখের ভাষার মতো ভাষা আছ চোখেরও-
নাইবা বললে, জ্বলে তারায় তারায়!
মুখের চোখের মতো ভাষা আছে মনেরও
বোঝা যায় অনুভবে, হৃদয় হারায়!
- ‘হৃদয়ের ভাষা’/বিরস সংলাপ
- আমরাও স্বপ্ন দেখি দিনে আর রাতে
পথক্লান্ত পাখিদের পাখাতে পাখাতে
সে স্বপ্ন এলোমেলো ভেসে ভেসে আসে
শতাব্দীর মৃত্যুনীল আকাশে আকাশে।
- 'স্বপ্ন'/নব-বসন্ত
- বাজারে পণ্য হাজার হাজার
মেলে না অন্ন তবু ক্ষুধার,
ঘর আছে তবু মেলে নাক' ঘর।
এই আমাদের আজীবন স্বপ্নের সে শহর।
কত দূরে সেই ছায়াঘন নীল দিন,
সোনালী ধানের সুরভিত আশ্বিন।
- 'মন্বন্তরে’/নব-বসন্ত
- পথটা সোজা না বাঁয়ে না ডাইনে
জানিনে জানিনে জানতে চাইনে।
শুধু জানি এই সেটা নিজেকেই
নিতে হবে চিনে যথা সময়েই
- 'দিক-নির্ণয়’/নব-বসন্ত
- জীবনের আলো থিতিয়ে ঝিমিয়ে পড়ে সংসারের
আলুথালু বাগানে, তোমার মোটেই সময় নেই,
- ‘গোধূলি শেষের আলোছায়া’/হাওয়া,তোমার কী দুঃসাহস
আবুল হোসেন সম্পর্কে উক্তি
[সম্পাদনা]- আমার অগ্রজ কবিদের মধ্যে আবুল হোসেনের প্রতিই আমার পক্ষপাত বেশি। তিনি আধুনিক মনের অধিকারী, প্রগতিপন্থী, তার চোখ কান খোলা, তিনি মুক্ত চিন্তাশ্রয়ী, যদিও কোনও কোনও ব্যাপারে তার কোনও কোনও উক্তি শুনে ঈযৎ খটকা লাগে। আমি তাঁর কবিতার অনুরক্ত ভক্ত পাঠক।...আবুল হোসেন, আমরা জানি, বিরলপ্রজ কবি। খুব কম লিখেছেন তিনি, কিন্তু কখনও এমন কবিতা নিঃসৃত হয় নি তার কলম থেকে যা পাঠকপাঠিকার পাতে দেওয়া যায় না। সব সময় ভাল লিখেছেন, কখনও কখনও খুব ভাল।
- শামসুর রাহমান (২০১১), ‘একজন প্রকৃত আধুনিক কবির প্রোফাইল’, 'আবুল হোসেন: কবির পোর্ট্রেট', (সম্পাদক-জুনান নাশিত), মিজান পাবলিশার্স, ঢাকা, পৃ. ১৩
- স্বভাবকবি নন আবুল হোসেন, কিন্তু স্বাভাবিক কবি। কোনো উন্মুল শেকড় ছেঁড়া ঐতিহ্যহীন আধুনিকতার পথিক নন আবুল হোসেন।...মননশীল কবি তিনি, বুদ্ধিবাদী কবি তিনি, কিন্তু বিষ্ণু দে কথিত সেই বুদ্ধিজীবী নন ‘কৈলাসেরে লক্ষ্য করে যে দাম্ভিক ছোঁড়ে শুধু ঢিল'। তার মনন জনতান্তর থেকে বিচ্ছিন্ন নয় কখনো, কিন্তু কবিতাস্তর থেকেও নয় আলাদা। সমাজচেতন হয়েও আবুল হোসেন তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে সতত সচেতন।
- আবদুল মান্নান সৈয়দ (২০১১), 'আবুল হোসেন: কবির পোর্ট্রেট', (সম্পাদক-জুনান নাশিত), মিজান পাবলিশার্স, ঢাকা, পৃ. ১২৫
- ব্যক্তিমনন, সমাজ-অভিজ্ঞতা ও শিল্প-অন্বেষার সমন্বিত পরিচর্যায় আবুল হোসেনের কবিতা এক স্বতন্ত্র মহিমায় উজ্জ্বল ও বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে- যেখানে ব্যষ্টি ও সমষ্টি, স্বদেশ ও বিশ্বপটভূমি নিগূঢ় ঐক্যসূত্রে আন্দোলিত ও কলরবমুখর। তিরিশের সেই নৈরাশ্যবিহারী, ভবিষ্যৎচিন্তায় সংশয়ী কাব্যপরিক্রমার পথ পেরিয়ে তিনি একদিকে যেমন বিষয়ের নতুনত্ব সন্ধানে তৎপর হলেন, অন্যদিকে তেমনি প্রকরণের ক্ষেত্রেও সংযোজন করলেন নবতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কেননা, তাঁর ধারণায়, কাব্যের উত্তরণ কেবল বিষয়ের মধ্যেই নিহিত নয়, প্রকরণও এক্ষেত্রে এক তাৎপর্যপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। এজন্যে, বিশ শতকের নবজাগ্রত মুসলিম সমাজের অবরুদ্ধ চেতনার মুক্তিকামনায় কবিতার বিষয় ও আঙ্গিকের প্রতি যুগপৎ মনোযোগী হলেন আবুল হোসেন।
- রফিকউল্লাহ খান (২০০২), ‘বাংলাদেশের কবিতা : সমবায়ী স্বতন্ত্রস্বর', একুশে পাবলিকেশন্স লিমিটেড, ঢাকা, পৃ. ৯৩-৯৪
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]উইকিপিডিয়ায় আবুল হোসেন (কবি) সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।