চর্যাপদ

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে

চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম পদ সংকলন তথা সাহিত্য নিদর্শন। নব্য ভারতীয় আর্য ভাষারও প্রাচীনতর রচনা এটি। খ্রিষ্টীয় ৬৫০-১২০০ সালে (ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ'র মতে) বা ৯৫০-১২০০ সালের মধ্যে (আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর মতে) রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় অর্থ সাংকেতিক রূপের আশ্রয়ে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তারা পদগুলো রচনা করেছিলেন। বাংলা সাধন সংগীত শাখাটির সূত্রপাতও হয়েছিলো এই চর্যাপদ থেকেই। সে বিবেচনায় এটি একটি ধর্মগ্রন্থজাতীয় রচনা। একই সঙ্গে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্রাবলি এই পদগুলোতে উজ্জ্বল। এর সাহিত্যগুণ এখনও চিত্তাকর্ষক। চর্যাপদের মোট কবি ২৪ জন।

উক্তি[সম্পাদনা]

চর্যাপদের কবি তন্ত্রীপাসহ কয়েকজনের বৌদ্ধগান পাওয়া যায়নি ও সম্পর্কে বেশ কিছু জানাও যায় নি।

লুইপা[সম্পাদনা]

কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল।। [ধ্রু]।।
দিট করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ।। [ধ্রু]।।
সঅল সহিঅ কাহি করিঅই।
সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিআই।। [ধ্রু]।।
এড়িএউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস।
সুনু পাখ ভিতি লাহু রে পাস।। [ধ্রু] ।।
ভণই লুই আম্‌হে সাণে দিঠা।
ধমণ চমণ বেণি পান্ডি বইণ।। [ধ্রু] ।।

অনুবাদ:
শরীরের গাছে পাঁচখানি ডাল–
চঞ্চল মনে ঢুকে পড়ে কাল।
দৃঢ় ক’রে মন মহাসুখ পাও,
কী-উপায়ে পাবে গুরুকে শুধাও।
যে সবসময় তপস্যা করে
দুঃখে ও সুখে সেও তো মরে।
ফেলে দাও পারিপাট্যের ভার,
পাখা ভর করো শূন্যতার–
লুই বলে, ক’রে অনেক ধ্যান
দেখেছি, লভেছি দিব্যজ্ঞান।

কুক্কুরীপা[সম্পাদনা]

  • দিবসহি বহূড়ি কাউহি ডর ভাই। রাতি ভইলে কামরু জাই।।
    • আধুনিক বাংলা: দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয় / রাত হলে কামরূপ না গেলে নয়।

বিরুপা[সম্পাদনা]

  • এক সে সুণ্ডিনী দুই ঘরে সান্ধই। চীঅণ বাকলত বারুণী বান্ধই।।
    • আধুনিক বাংলা: এক সে শুঁড়িনী দুই ঘরে সান্ধায় / চিকন বাকলেতে মদ বাঁধে।

গুণ্ডরীপা[সম্পাদনা]

  • জোইনি তইঁ বিনু খনহিঁ ন জীবমি। তো মুহ চুম্বী কমল রস পিব্মি ।।
    • আধুনিক বাংলা: রে যোগিনী, তুই বিনা ক্ষণকাল বাঁচি না / তোর মুখ চুমিয়া কমল রস পান করি।

চাটিল্লপা[সম্পাদনা]

  • ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহী। দুআন্তে চিখিল মাঝে ন থাহী॥ ধ্রু॥ দামার্থে চাটিল সাঙ্কম গঢ়ই। পার্গামি লোঅ নিভর তরই॥ ধ্রু॥
    • আধুনিক বাংলা: ভবনদী বয় বেগে গহিন গভীর, / মাঝগাঙে ঠাঁই নাই, পঙ্কিল দু’তীর– / চাটিল ধর্মের জন্য সাঁকো গড়ে তায়, / পারগামী লোক তাতে পার হ’য়ে যায়।

ভুসুকুপা[সম্পাদনা]

  • বাজনাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ
অদব বঙ্গাল দেশ লুড়িউ ।।
আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী,
নিঅ ঘরিণী চণ্ডালেঁ লেলী ।।
  • আধুনিক বাংলা: বজ্ররূপ নৌকায় পাড়ি দিয়া পদ্মার খালে বাহিলাম। / অদ্বয়রূপ বাঙ্গালা দেশ লুঠ করিলাম। / আজি ভুসুকু বাঙ্গালী হইলি / নিজ ঘরনীকে চণ্ডালে লইয়া গেলি।

কাহ্নপা[সম্পাদনা]

  • ভন কইসেঁ সহজ বোলবা জাই / কাআবাকিচঅ জসু ন সমাই ।। / আলেঁ গুরু উএসই সীস ।। / যেতই বলি তেতবি টাল ।
গুরু বোব সে সীসা কাল ।।
  • আধুনিক বাংলা: বল কেমনে সহজ বলা যায়, যাহাতে কায়বাকিচত প্রবেশ করিতে পারে না ? গুরু শিষ্যকে বৃথা উপদেশ দেন। বাকপথাতীতকে কেমনে বলিবে ? যতই বলি সে সবই টালবাহানা। গুরু বোবা, সে শিষ্য কালা।

কম্বলারম্বপা[সম্পাদনা]

  • সোনে ভরিতী করুণা নাবী । / রূপা থোই নাহিক ঠাবী ।। / বাহতু কাম্লি গঅন উবেসেঁ। / গেলী জাম বাহুড়ই কইসেঁ ।।
    • আধুনিক বাংলা: আমার করুণা-নৌকা সোনায় ভর্তি রয়েছে; তাতে রূপা রাখার ঠাঁই নেই। অরে কম্বলি পা, গগনের (নির্বাণের) উদ্দেশ্যে তুমি বেয়ে চলো; যে জন্ম গেছে সে ফিরবে কি করে ?

ডোম্বীপা[সম্পাদনা]

  • গঙ্গা জউনা মাঝেঁরে বহই নাঈ / তহিঁ চড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলে পার করেই ।। / বাহ তু তোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা / সদ্গুরু পাও-পসাএঁ জাইব পুণু জিণউরা ।।
    • আধুনিক বাংলা: গঙ্গা যমুনা মাঝে রে বয় নৌকা, / তাউ চড়িয়া চণ্ডালী ডোবা লোককে অনায়াসে পার করে ।। / বা তুই ডুমনি ! বা লো ডুমনি ! পথে হইল সাঁঝ, / সদ্গুণ পায়ের প্রসাদে যাইব পুনরায় জিনপুর।

শান্তিপা[সম্পাদনা]

  • সঅসম্বেঅণসরুঅবিআরেঁ অলক্খ লক্খণ ন জাই। / জে জে উজূবাটে গেলা অনাবাটা ভইলা সোই॥ ধ্রু॥ / কুলেঁ কুল মা হোই রে মূঢ়া উজূবাট সংসারা। / বাল ভিণ একু বাকু ণ্ ভূলহ রাজ পথ কন্ধারা॥ ধ্রু॥
    • আধুনিক বাংলা: স্বয়ং-সংবেদন-স্বরূপ বিচারে / অলখ হয় না লক্ষণ; / সোজা পথে, আর হয় না রে / তাদের প্রত্যাবর্তন!

মহীধরপা[সম্পাদনা]

  • তিনিএঁ পাটেঁ লাগেলি রে অণহ কসণ গাজই। / তা সুনি মার ভয়ঙ্কর রে বিসঅমণ্ডল ভাজই॥ ধ্রু॥ / মাতেল চীঅগএন্দা ধাবই। / নিরন্তর গঅণন্ত তুসেঁ ঘোলই॥ ধ্রু॥
    • আধুনিক বাংলা: তিনটি পাটে কৃষ্ণ হাতির অশান্ত বৃংহণ, / শুনে, বিষয়-সমেত ভীষণ ‘মার’-এর আন্দোলন; / মত্ত গজেশ ছুটে গিয়ে শেষটায় গগন-প্রান্ত ঘুলিয়ে ফ্যালে তেষ্টায়।

বীণাপা[সম্পাদনা]

  • সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী। / অণহা দাণ্ডী একি কিঅত অবধূতী॥ ধ্রু॥ / বাজই অলো সহি হেরুঅবীণা। / সুনতান্তিধনি বিলসই রুণা॥ ধ্রু॥
    • আধুনিক বাংলা: সূর্য হ’ল লাউ আর তার হ’ল চন্দ্র, / অবধূতি চাকি হ’ল, অনাহত দণ্ড; / হেরুক-বীণাটি বেজে ওঠে, সখী ও লো, / করুণায় শূন্য-তন্ত্রী বিলসিত হ’ল।

সরহপা[সম্পাদনা]

  • হিঅ তাঁবোলা মহাসুহে কাপুর খাই। / সূণ নৈরামণি কণ্ঠে লইআ মহাসুহে রাতি পোহাই ।।
    • আধুনিক বাংলা: হৃদয়-তাম্বুলে মহাসুখে কর্পূর খায়, / শূন্য-নৈরাত্মাকে কণ্ঠে লইয়া মহাসুখে রাত্রি পোহায় ।।

শবরপা[সম্পাদনা]

  • উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী। / মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।। / উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি। / ণিঅ ঘরণী ণামে সহজ সুন্দারী।। / ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী। / একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ কুণ্ডলবজ্রধারী।।
    • আধুনিক বাংলা: উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। / তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। / নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। / শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। / কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। / শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো।

আর্যদেবপা[সম্পাদনা]

ঢেণ্ডণপা[সম্পাদনা]

  • টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী / হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী
    • আধুনিক বাংলায় : লোক শূণ্য স্থানে প্রতিবেশীহীন আমার বাড়ি / হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ প্রেমিক এসে ভিড় করে।

দারিকপা[সম্পাদনা]

ভাদেপার[সম্পাদনা]

  • এতকাল হঁউ আচ্ছিলোঁ স্বমোহেঁ / এবেঁ মই বুঝিল সদ্ গুরু বোহেঁ ।।
    • আধুনিক বাংলায় : এতকাল হয়ে আছিলাম স্বমোহে / এখন আমি সদগুরু বুঝিলাম।

চর্যাপদ নিয়ে উক্তি[সম্পাদনা]

  • very simple little songs
    • স্প্যানিশ ভাষার প্রধান কবি পেদ্রো সালিনাস

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]