জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত
অবয়ব
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (জন্ম: ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯) হলেন একজন বাংলাদেশী সাহিত্যিক, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। ষাটের দশকে গল্প দিয়ে তার সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়েছিল। তার গল্পে উঠে এসেছে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, জীবনদর্শন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি আধুনিক জীবনযাত্রা। তিনি সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যে নতুন ধারা 'ছোট উপন্যাস' অর্থাৎ 'উপন্যাসিকা'। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান লেখক।গল্পকার হিসেবে ১৯৭১ সালে লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ২০১৬ সালে ভূষিত হয়েছেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে।
উক্তি
[সম্পাদনা]- আমি সবসময়ই চেয়েছি, লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ছায়া যেন আমার স্ত্রী পূরবী বসুর উপর না পড়ে। আমি কখনোই ভাবিনি সে আমার মতো করে কিছু লিখবে। শুরু থেকেই আমি বলেছি, তোমার মতো করে তুমি লিখবে। নিজস্ব ধারায় লিখবে। যার ফলে কিছু বানানের সংশোধন ছাড়া কোনরকম সম্পাদনা আমি করি না। এই বিশ্বাস থেকে সে লেখক তার নিজের গুণে। ফলে তাকেই পাঠক জানুক। চিরকাল সেটাই চেয়েছি। তাছাড়া আমার সবসময়ই মনে হয়েছে, কেবল সময়ের ব্যবধান। যতই সময় এগিয়েছে, আমার মনে হয়েছে বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম একজন লেখক হিসেবে পূরবী প্রতিষ্ঠিত হবে। সে হয়েছে।
- আমার গল্পগুলি স্বতন্ত্র হওয়ার কারণ - প্রথমত গল্পের ভাষা। আমি আমার গল্পের ভাষা এমনভাবে তৈরি করেছি যা সকলের ভাষার চেয়ে আলাদা। আমি তৎসম এবং তদ্ভব শব্দ প্রচুর ব্যবহার করি। তৎসব শব্দের বাড়াবাড়ি আছে। দেশি-বিদেশি শব্দ সবই ব্যবহার করি। আমার যে শব্দটি প্রয়োজন, আমি সেই শব্দটিই ব্যবহার করি। ভাবি না, এটা কোন রকমের শব্দ। আমি পাঠকের সুখপাঠ্যতার দিকে নজর দেই। আমি এমনভাবে বাক্য গঠন করি, যেটি পড়তে ভালো লাগে। বাক্যটি যেন নতুন হয়। সমৃদ্ধ হয়।
- উজ্জ্বল সাহিত্যিক দম্পতি: পূরবী বসু ও জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ১২ই নভেম্বর ২০১৭, শামীম আল আমিন, বিডিনিউজ২৪
- একুশে বইমেলায় আসি অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। সবার সঙ্গে বাসায় গিয়ে দেখা করা তো আর সম্ভব নয়। আর সবাইকে বাসায় ডেকে আনাও যায় না। তাই মেলা একধরনের ক্ষেত্র বা সুযোগ তৈরি করে দেয় সবার সঙ্গে সাক্ষাতের। পাশাপাশি অনেক বই নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগও হয়। অনেক নবীন লেখকের সঙ্গে দেখা হয়। নতুনদের চিন্তার বিষয়েও ধারণা পাওয়া যায়।
- মেলার সময় দেশে আসেন পূরবী বসু ও জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এহসান মাহমুদ, ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০১৫, এনটিভি
- বাংলাদেশি প্রবাসী লেখকরা আন্তর্জাতিক সর্বশ্রেষ্ঠ বিক্রেতা বা বিখ্যাত হতে পারে না কারণ আমরা ইংরেজিতে লিখি না, আর ইংরেজিতে না লিখলে কোনোদিনই বাঙালি কবি লেখক আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলার কিংবা বিখ্যাত হতে পারবে না। তবে অনেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করে এই শূন্যস্থান পূরণ করতে। যদিও এটা পর্যাপ্ত নয়। তাই আমরা বহির্বিশ্বে পৌঁছাতে পারছি না, অন্যসব ভাষার লেখকদের মতো। সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, আপনি যে সাহিত্য অনুবাদ করবেন, তার অর্থনৈতিক শক্তি থাকতে হবে, আমাদের সেই শক্তি/ক্ষমতা নেই। যদিও আমরা কিছু কিছু ইংরেজিতে লিখেছি, তা লিখেছি বাংলাদেশে কিন্তু এগুলো আমরা বহির্বিশ্বে ছড়ানোর চেষ্টাও করিনি, সুযোগও হয়নি। এটা আমাদের ব্যর্থতা।
- কিন্তু কথা হলো আমরা নিজেরা যা লিখছি, আমাদের বাঙালি জনসংখ্যা তো কম নয়, আমাদের তো প্রচুর লোক। আমরা পৃথিবীতে চতুর্থ। আমাদের নিজেদের পাঠকই কী যথেষ্ট নয়? অথচ আমরা এটাকে যথেষ্ট মনে করি না। আমাদের এই যে ইংরেজি মনষ্কতা, যেটা আমাদের ব্রিটিশরা দিয়ে গেছে, আমরা এটাকে এখনো ধরে রেখেছি। নিজেদের দিকে আমরা তাকাতে পারি না। আমাদের সাহিত্য কি খুব খারাপ? না তো।
- আমি অন্যদের মতো করে লিখব না, গল্পও আলাদা হবে এবং ভাষাও আলাদা হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তখন এত ভাবিনি, এখন ভাবি। একটি ভাষার কিছুটা স্বতন্ত্র চেহারা দেয়া এত সহজ না। তার জন্য ভাষাজ্ঞানটি পরিপূর্ণ থাকতে হবে। আমি অনুমান করি আমার সেটা ছিল, আমি বাংলা ভাষার ছাত্র। আমি বাংলা বই পড়বার জন্য বাংলা পড়িনি, বাংলাভাষা শেখা এবং জানবার জন্য বাংলা সাহিত্য পড়েছি; কিন্তু ভাষাজ্ঞান এর পাশাপাশি থাকতে হবে ব্যাকরণ। আমি শরৎচন্দ্র, বিদ্যাসাগরের ব্যাকরণ আমি অতিশয় মনোনিবেশ করে পাঠ করেছি, ব্যাকরণ জ্ঞান আমার ছিল। ফলে ব্যাকরণ এবং ভাষাবোধ দুটিকে একত্র করে আমি অন্যরকম একটি ভাষা সৃষ্টির চেষ্টা করেছি, যা পরে অনেকের কাছে নতুন ভাষা বলে গৃহিত হয়েছে। এটা একটি সচেতন চেষ্টার ফল।
- অন্তরে খুব কমসংখ্যক মানুষ সত্যিকারের প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক: জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু ৩০শে জানুয়ারি ২০২৪, Views Bangladesh
- "মাটির বিছানায় শুয়ে দেখে সে শরতের নীল আকাশ। কখনো আকাশে যদি মেঘ করে, আকাশ যদি ঢেকে যায় দূরাগত মেঘে, তখন সে নিখোঁজ হয়ে যায়। চলে যায় দূরে কোথাও, যেখানে আছে স্বচ্ছ আকাশ, মেঘের আবর্জনাহীন, মুক্ত নীলাকাশ।" - এই যে একজন মানুষ, কেউ জানে না তার পরিচয়, কোত্থেকে এসেছে, কোথায় সে যাবে, সবই অস্পষ্ট। স্পষ্ট যা তা হলো সে ভালোবাসে আকাশ। আকাশই ভালোবাসে সে। আর কিছু নয়। না সংসার, না সন্তান, না অন্য কোনো পার্থিব বন্ধন। এ-ই এই গ্রন্থের প্রতিপাদ্য।
- জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ছোট উপন্যাস কাজী জহিরুল ইসলাম, ডিসেম্বর ২০১৮, কালি ও কলম
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সম্পর্কে উক্তি
[সম্পাদনা]- যখনই তাদের সাথে কথা বলেছি, রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছি। বিশেষ করে এই দম্পতির একের প্রতি অপরের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ দেখে। তারা পরস্পর নিজেদের প্রতি, তাদের কাজের প্রতি ও স্বকীয় ধারার প্রতি প্রচণ্ড যত্নবান।
- ওর কাছে লেখালেখির বিষয়ে আমি সবসময়ই সহযোগিতা পাই। কিন্তু একটা জিনিস সে কখনো করে না, করলে আমি হয়তো আরও ভালো লিখতাম। সে আমার সমালোচনা কখনও করে না। অভিভূত পাঠকও নন। সে মনে করে, আমি একজন লেখক। আমি আমার নিজের মতো করে লিখবো। পাঠক সেটা বিচার করবে। শুধু কিছু বানানের সংশোধন ছাড়া সে আমার লেখা সংস্কারের কোনও কথা বলে না। - স্বামী সমন্ধে পূরবী বসু
- উজ্জ্বল সাহিত্যিক দম্পতি: পূরবী বসু ও জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ১২ই নভেম্বর ২০১৭, শামীম আল আমিন, বিডিনিউজ২৪
- তাঁর বর্ণনায় যেমন আছে নিজস্বতা, তেমনি তাঁর বাক্যের ধরনও আলাদা। অহেতুক কথা খরচ করেন না, ডায়ালগ দেওয়ায় থাকেন হিসাবী। উপমাই যেন গল্প, – পাঠকের কাছে গল্প এভাবে থ্রো করেন তিনি, যেখানে বাণী নয়, পাঠক তাঁর মেজাজে কোনো-না-কোনো মেসেজ সৃজন করতে বাধ্য হন। তিনি তাঁর বাসনার জায়গাটা পরিষ্কার করে বলতে চান। তবে তিনি তা একেবারে ষোলো আনা খোলাসা করেন না।
- কেষ্টবাবু ছেলে নিয়ে ঘুরছেন, দেখছেন, নিজের জগৎ নিয়ে হাহাকারে আছেন, কিন্তু কথা তার থামে না। বর্ণনায়ও কথা আছে। না-কথাতেও কথা আছে – যেন তা এক কথাসরিৎসাগর! এখানেই ছোটগল্পের দাপট প্রকাশ পায়। তিনি ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা দ্বারা তাঁর গল্প ভরাট করেননি। তিনি তাঁর উপমায়, উৎপ্রেক্ষায়, সাংকেতিকতায় তা আমাদের বারবার জানাচ্ছেন। আমরা এ-গল্পে জ্যোতিপ্রকাশের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে বাধ্য হবো।
- গল্পের কবি জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, ডিসেম্বর ২০১৩, কালি ও কলম
- "রমণী তখন প্রকৃতই বিবসনা ও বাক্যহীন। তবে শরীরে ক্রমে উষ্ণতা সঞ্চারিত হতেই পারে। সে জন্যই অঙ্গ শিথিল। একটু দূরে রাখা খালুইয়ের দিকে তাকায় সে আর ঠিক সেই মুহূর্তে পুরুষ নিজ স্থান গ্রহণ করে তাকে বিদ্ধ করে। বারবার।" - এই গ্রন্থের চরিত্রদের কোনো নাম নেই। অনামিকা চরিত্রেরা তারপরও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। নারী-পুরুষের দেহ ও মনের যে স্বাভাবিক চাহিদা তা-ও উপেক্ষিত হয়নি। আমি বলব, এটি জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের একটি সার্থক সৃষ্টি। চরিত্রদের নাম ব্যবহার না করে সাবলীলভাবে গল্পকে টেনে নিয়ে যাওয়া কেবল একজন সমর্থ লেখকের পক্ষেই সম্ভব।
- পশ্চিমের গদ্য-লেখকরা অবশ্য আধুনিক কবিতার গঠন "বাক্যের মধ্যে পারম্পর্য তৈরি করা" পদ্ধতিকেই অনুসরণ করেন। বাক্যের মধ্যে, প্যারাগ্রাফের মধ্যে বা অধ্যায়ের মধ্যে পারম্পর্য ভেঙে দিয়ে তাঁরা পাঠককে কিছুটা সময়ের জন্য বিভ্রান্ত করেন। এতে পাঠকের ভাবনার নদীতে ঢেউ ওঠে, পাঠক ভাবতে থাকেন, ইত্যবসরে ভেঙে যাওয়া পারম্পর্যগুলো একটি সুবৃহৎ ক্যানভাসে নিয়ে জুড়ে দেন লেখক, দাঁড় করান একটি পূর্ণাঙ্গ অবয়ব। লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত তাঁর ছোট উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে এই কাব্যিক ভাষা এবং কাঠামোটি অনুসরণ করেছেন।
- তাঁর রচনার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে হল তিনি সুকৌশলে চরিত্রদের নাম আড়ালে রেখেছেন, ব্যবহার করেছেন সর্বনাম। এই বৈশিষ্ট্য রচনাগুলোকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
- জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ছোট উপন্যাস কাজী জহিরুল ইসলাম, ডিসেম্বর ২০১৮, কালি ও কলম
- ব্যক্তিগত ঘনিষ্টতা না থাকলেও, তার লেখার মধ্য দিয়ে তাকে আবিষ্কার করা সম্ভব।
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]উইকিপিডিয়ায় জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।