নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৮- ৮ নভেম্বর, ১৯৭০) একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক। জন্ম অবিভক্ত বাংলার (অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত) অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বালিয়াডাঙ্গীতে (বর্তমানে বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও)। তিন খণ্ডে প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস উপনিবেশ (১৯৪২, ১৯৪৫, ১৯৪৬) পাঠকসমাজে সমাদৃত হয়। তার উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প সংকলন বীতংস (১৯৪৫), দুঃশাসন (১৯৪৫), ভোগবতী (১৯৪৭) এবং উল্লেখযোগ্য উপন্যাস বৈজ্ঞানিক (১৯৪৭), শিলালিপি (১৯৪৯), লালমাটি (১৯৫১), সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী (১৯৫৫), পদসঞ্চার (১৯৫৪)। সাহিত্যে ছোটগল্প তার একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। ছোটদের জন্য তার সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্র টেনিদা খুবই জনপ্রিয়। তার লেখা কিছু উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প হল — ইতিহাস, নক্রচরিত, হাড়, বীতংস, রেকর্ড, টোপ, আদাব, প্রভৃতি।
উক্তি
[সম্পাদনা]- “আমার ঠাকুর তেরনাথ কিছু নাহি চায়,
এক পয়সার গাজা দিয়া তিন কল্কি সাজায়
রে সাধু ভাই
দিন গেলে তেরনাথের নাম লইয়ো।” — ভাঙ্গাবন্দর, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ২৯৬
- “এই বন্দর হয়তো আবার তেমন করেই উঠবে বড় হয়ে। সামনে ওই যে তেলের কলটা আজ প্রায় তিন বছর ধরে তালা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, ওই মিলটাও হয়তো চলতে শুরু করবে সেদিন। আবার এই বন্দরে কোটি টাকার লেনদেন চলবে দক্ষিণের তালবনটার পাশ ঘেঁষে চিনে-বাজার বসবে আবার।” — ভাঙ্গাবন্দর, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ২৯৭
- “আধুনিকেরা কৌতুহলী হতে চায় না। স্পর্ধার একটা তীক্ষ্ণতায় ছুরি দিয়ে অতীতের সবকিছুকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায়।” — ভাঙ্গাবন্দর, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩০১
- “বর্তমানে ঝাঁঝালো উগ্রতা ছাড়া আধুনিকদের বিশ্বাস করানো অসম্ভব। অতীতের পটভূমিটাকে অস্বীকার করতে পারলেই যেন তারা সান্তনা পায়।” — ভাঙ্গাবন্দর, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩০২
- “অস্বাভাবিক প্রশান্ত স্বরে আধুনিকেরা অদ্ভুত রকমের নিষ্ঠুর কথা বলতে পারে বহ্নিকুণ্ডটা চোখে দেখা যায় না কিন্তু তার নির্নিরীক্ষ্য সমস্ত শরীর যেন ঝলসে দেয়।” — ভাঙ্গাবন্দর, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩০৩
- “বিপরীত-ধর্মী মানুষের পরস্পরের প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে - অনেকটা বৈদ্যুতিক নিয়মে” — কবর, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩০৫
- “অন্যায় হয়ে গেলে কাউকে তো শাস্তি দিতেই হবে ভাই। হবুচন্দ্র রাজার বিচার এই কথাই বলে। চুরি করতে গিয়ে চোর যদি দেওয়াল চাপা পড়ে মরে তাহলে কুমোরকে ধরে ফাঁসি দাও। আইনের মর্যাদা তো রাখতে হবে।” — কবর, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩০৭
- “ক্ষমা করতে চায়না। যা কাছে আসে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুহাত দিয়ে, পৃথিবীর ওপরে ও যেন প্রতিশোধ নেবে।” — কবর, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩০৫
- “মানুষ নেই, কিন্তু কবর আমার মোটরের পথ আটকে দিয়েছে।” — কবর, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩১১
- “জীবন তো পদ্মপত্রে শিশির বিন্দুর মত, একদিন টপ করে ঝরে যেতে পারে। দেহতত্ত্বের গানে বলেছে ধুলোর দেহ একদিন ধুলো হয়ে যাবে। কালের অনিবার্য করার স্পর্শকে কেউ অতিক্রম করতে পারবে না কোনদিন।” — তীর্থযাত্রা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩১১
- “তুমি তো বামুন। সমাজের ইজ্জৎ বজায় রাখা তোমার কাজ। ঘরের পর ঘর উজাড় করে মেয়েদের বিক্রি করে দিচ্ছ পেশাকরদের কাছে - সমাজের মুখে হাজার বাদে রসনাই জ্বলে উঠছে নিশ্চয়!” — তীর্থযাত্রা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩১৫
- “কাঁদছে - কাঁদছে! নরোত্তমের মেজাজ যেন সপ্তমে চড়ে যায়। কেন কাঁদে, কার কাছে কাঁদে? কে আছে কান্না শুনবার জন্য? অথচ মরার আগে সপ্তমে চেচিয়ে কাঁদছে। মরবার সময় অব্যক্ত যন্ত্রণায় গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে। তবু ভালো, মরবার পরে মানুষের কান্না শোনা যায় না। তাহলে সে কান্নার শব্দে আকাশ ফেটে চৌচির হয়ে যেত।” — তীর্থযাত্রা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩১৫
- “এখানে মেঘনার জল কালীয়নাগের নিঃশ্বাসে কালো হয়ে গেছে। এখানে মড়কে জর্জরিত বাংলার বুক থেকে গৃহচ্যুত গৃহলক্ষীরা পণ্য হতে চলেছে শহরের গণিকা পল্লীতে। অভিশপ্ত শরৎ - দুঃস্বপ্নের শরৎ। ভিখারী মহেশ্বরের গৃহিণী আজ কুলত্যাগিনী।” — তীর্থযাত্রা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩১৭
- “চিরজীবনের রাজ্যে সবৎসার চেয়ে অবৎসার কদর বেশি” — তীর্থযাত্রা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩১৯
- “মাথার ওপরে শরতের নির্মল নীলিমা। দূরে বোধনের বাজনা। অকাল-বোধন নয়, আকাল-বোধন। কিন্তু কে জাগবে এই বোধন মন্ত্রে? চৌরঙ্গীর হোটেলে সে আজ রঙমাখানো মুখে মদের গেলাসে চুমুক দিয়েছে।” — তীর্থযাত্রা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩১৯
- “এমন কত আসে, কত যায়, কেহ কাহারও কথা মনে করিয়া রাখে না। দেওয়ালের গায়ে কাঠ কয়লায় মৃতের নাম স্থায়ী করিয়া রাখার চেষ্টা নিত্যনতুন লেখার অন্তরালে অস্পষ্ট হইয়া আসে, তারপর খুব ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিলেও একটা নামেরও স্পষ্ট পাঠোদ্ধার করা চলে না।” — ছলনাময়ী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩২০
- “চিতার পোড়া কয়লার স্তুপ জমিতে জমিতে আদি গঙ্গার গর্ভ ভরিয়া ওঠে, হিন্দুর পাপ ক্ষালনের বোঝা টানিতে টানিতে জননী ভাগীরথী শীর্ণা হইতে শীর্ণতরা হইয়া আসেন। ভাঁটায় নামিয়া যাওয়া ঘোলাটে জল আর পঙ্কিল তীরের অশ্বাস্থ্যকর দুর্গন্ধ স্বর্গযাত্রার পথে নরকের কথায় স্মরণ করিয়া দেয়।” — ছলনাময়ী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩২১
- “মনের মিলটা যেমন দুর্লভ সুলভ তেমনি সারা জীবনের চেষ্টাতেই অনেক সময় বস্তুটি ঘটিয়া উ,,ঠে না আবার অতি সহজেই কোন একটা অজ্ঞাত আকর্ষনে পরস্পরের কাছে আসিয়া পড়ে সেটা একটা দুর্গে রহস্য।” — ছলনাময়ী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩২১
- “স্বর্ণপদ্মাসীনা সরস্বতী মূর্তিমতী হয়ে বরদান করতে এলে সিদ্ধেশ্বরবাবু শোনার পদ্মটাই চেয়ে বসবেন, বাজারে আটাত্তর টাকা ভরি চলছে আজকাল।” — লুচির উপাখ্যান, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩৩১
- “একটা অপূর্ব জগৎ। পূর্ণ আর ভগ্নাংশের আচ্ছেদ্য বন্ধনে গলাগলি করে আছে। কালিমাখা কলের মানুষ আর ধোপদুরস্ত নাগরিক। সন্ধ্যায় প্রজাপতি সেজে মেয়েরা রিক্সা চেপে সিনেমায় যায়, আবার কেউ কেউ রুপোর গয়না পরা কালো কালো হাতের মেটে দেওয়ালে ঘুটে থাবড়ায় তখনো।” — লুচির উপাখ্যান, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩৩২
- “সকলের মাথার উপরে চুড়ো তুলে জেগে আছে পরেশনাথের মন্দির। রাজবৈভব ঐশ্বর্য-বৈরাগী মহাপ্রাণ জৈন তীর্থঙ্করদের আবার রাজপ্রাসাদে এনে বসিয়েছে কুবেরের বরপুত্রেরা। ত্যাগী সন্ন্যাসীদের জন্য ব্যয়িত বিপুল অর্থের অভ্রভেদী চূড়া নিশ্চয়ই বস্তির নিরন্ন মানুষগুলোকে ত্যাগ আর বৈরাগ্যের মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করছে।” — লুচির উপাখ্যান, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩৩৩
- “সাধারণ, অতি সাধারণের সঙ্গে বেঁচে থাকার পূর্বানূবৃত্তি। সবাই যেমন করে বাঁচে, সবাই যেমন করে মরে। লক্ষকোটি জল-বুদবুদের ভেতর আর একটি। যাচাই করা যায় না, বাছাই করা যায় না, অবশ্যম্ভাবী ক্ষণভঙ্গুরতায় সকলের দৃষ্টির সামনে থেকে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কবে একদিন সূর্যের আলো ইন্দ্রধনুর সাতটি রঙে তাকে রাঙিয়ে দিয়েছিল, সে ইতিহাস সেদিন কে জানে?” — পাণ্ডুলিপি, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩৩৭
- “অদ্ভুত একটা অকারণ বেদনায় তারাকান্তের সমস্ত বুকের ভেতরটা যেন আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। মনে হল : কোথায় কি যেন একটা ভুল রয়ে গিয়েছে। মূর্তি রচনা হয়তো সম্পূর্ণ হয়নি, হয়তো এখনো তারাকান্তের বাধা ফর্মুলার বাইরে কোথায় একটা স্বতন্ত্র সত্তা প্রচ্ছন্ন রয়েছে বিভূতির।” — পাণ্ডুলিপি, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩৪০
- “স্বপ্ন হয়তো সার্থক হয়েছে, হয়তো তার নিজের হাতে গড়া প্রতিকৃতির নৈপুণ্যে কারো এতটুকু সন্দেহ করবার কারণ নেই। কিন্তু সৃষ্টি কখন যে স্রষ্টাকে অতিক্রম করে গিয়েছে তারাকান্ত তা কি জানতেন? আজ তাঁর আর বিভূতির মাঝখানে সমস্ত পৃথিবী এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। তার ভেতর থেকে নিজের গড়া বিভূতিকে আর আলাদা করে, একান্ত করে খুঁজে পাবেন না তিনি। তাঁর রচনা তাঁকে ছাড়িয়ে এত দূরে চলে গেছে যে সেখানে তাঁর আর একটুও দাবি নেই। তাঁর নিজস্ব পান্ডুলিপি আজ যে তাঁরই হাতের লেখা কে নিশ্চিহ্ন ভাবে মুছে দিয়ে ছাপার অক্ষরে সমস্ত পৃথিবীর মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে মুক্ত হয়ে গেছে, এই কি তিনি চেয়েছিলেন?” — পাণ্ডুলিপি, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৩৪১
- “ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস! ইয়াক ইয়াক!” — নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, টেনিদা
- “আমাদের জীবনে এক-একটা ঘটনা যেন অতিথি,প্রত্যেকের জন্য রয়েছে এক-একটি নির্দিষ্ট আসন।অন্নপ্রাশন,পইতে,প্রেম,বিয়ে-এইসব।জীবন এগিয়ে চলে,ধীরে ধীরে ভরে উঠে এক-একটি আসন।কেবল একটি থেকে যায় খালি।তখন,সেই নির্জন প্রহরের পড়ন্তে রোদ্দুরে গা দিয়ে বসে কেবল অপেক্ষা,কখন আসবে সেই অতিথি।” — নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
- “তখন হঠাৎ আমার মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। কেমন স্বর্গীয় স্বর্গীয় মনের ভাব এসে দেখা দিলে। ব্যাপারটা কী রকম জানাে? মনে করো, তুমি অঙ্কের পরীক্ষা দিতে বসেছ। দেখলে, একটা অঙ্কও তোমার দ্বারা হবে না - মানে তোমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না। তখন প্রথমটায় খানিক দরদরিয়ে ঘাম বেরুল, মাথাটা গরম হয়ে গেল, কানের ভেতর ঝিঝি পোকা ডাকতে লাগল আর নাকের ওপরে যেন ফড়িৎ এসে ফড়াৎ ফড়াৎ করে উড়তে লাগল। তারপর আস্তে আস্তে প্রাণে একটা গভীর শান্তির ভাব এসে গেল। বেশ মন দিয়ে তুমি পাতায় একটা নারকোল গাছ আঁকতে শুরু করে দিলে। তার পেছনে পাহাড় -- তার ওপর চাঁদ - অনেকগুলো পাখি উড়ছে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। মানে সব আশা ছেড়ে দিয়ে তুমি তখন আর্টিস্ট হয়ে উঠলে।” — নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, টেনিদা
- “হাবুল বললে, তোমার প্যাটে ভস্মকীট ঢুইক্যা বসছে!” — নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, টেনিদা
- “সে কী গান!
আমাদের চারজনের গলাই সমান চাঁছাছোলা'-টেনিদার তো কথাই নেই l একবার টেনিদা নাকি অ্যায়সা কীর্তন ধরেছিল যে তার প্রথম কলি শুনেই চাটুজ্যেদের পােষা কোকিলটা হার্টফেল করে।” — নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, টেনিদা
- “কাঞ্চন নদীর ধার থেকে যখন বরেন্দ্রভূমির আচক্রবাল মাঠের দিকে পা বাড়ালাম, তখন এমন একটা পৃথিবীকে দেখলাম, যা আমার কল্পনাকে ছাড়িয়ে তরঙ্গিত রাঙ্গামাটির টিলায় টিলায় মহাশূন্যতায় অগ্রসর। আর তার উপর চোখে পড়ল আমার দেশের মানুষকে। তিন মাসের বেশি তার খোরাকির ধান থাকে না। পাঁচ মাস পরে তার দু পয়সার লবণ জোটে না। আমার মহা পৃথিবীতে এসে মিশল মহাবুভুক্ষা; লাল মাটির ওপর বৈশাখী ঘূর্ণি আমার চোখে দীর্ঘশ্বাস হয়ে উঠলো।
বিনতি অর্কেস্টার বহু যন্ত্রের হার্মনির মতো বিচিত্রের অখন্ডতা যেখানে ধ্বনিত হয়েছে সেই রকম ভাবে একটা সমগ্র মানবতাকে স্পর্শ করতে আমি প্রলুব্ধ হয়ে উঠলাম।” — নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় ভাগ, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স