বনলতা সেন (কবিতা)

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে
বনলতা সেনের সত্যজিৎ রায় কৃত প্রচ্ছদ

বনলতা সেন বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম রহস্যময়ী নারী চরিত্র। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা বনলতা সেন থেকেই এই চরিত্রের পরিচিতি। তবে জীবনানন্দ দাশের লেখায় বনলতা সেনের উল্লেখ সর্বপ্রথম পাওয়া যায় ১৯৩২ সালে লেখা "কারুবাসনা" উপন্যাসে।

উক্তি[সম্পাদনা]

   

আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের 'পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতোদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

○ জীবনান্দ দাশ। "বনলতা সেন" কবিতা থেকে।
  • সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
    থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
    • জীবনান্দ দাশ। "বনলতা সেন" কবিতা থেকে।
  • বনলতার পরিচয় পেলেই আমরা বুঝতে পারি কবি কেন কবিতার শেষে বলেছেন 'সব পাখি ঘরে ফেরে'। বনলতাদের সাথে দু'দণ্ড সময় কাটালেও শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দদের (বিবাহিত পুরুষদের) লাবণ্যপ্রভাদের (স্ত্রীদের) কাছে ফিরে আসতে হয়। বনলতাকে আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীতে প্রকাশ্যে পাওয়ার সুযোগ নেই। বনলতার কথা কাউকে বলারও উপায় নেই। বনলতাকে নীরবে নিভৃতে স্মরণ করতে হয় অপরাধবোধ নিয়ে। তাই কবি বলেছেন, 'থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।' এ অন্ধকার প্রাকৃতিক নয়, এ অন্ধকার মানসিক। আমার জানামতে নিষিদ্ধ প্রেমের আনন্দ ও বেদনা এত সুন্দরভাবে আর কোন কবি ফুটিয়ে তুলতে পারেননি।
    • "লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি, পরার্থপরতার অর্থনীতি", আকবর আলি খান, পৃষ্ঠা-৮২ [১]
  • জীবনানন্দ দীর্ঘ যাত্রা শেষে প্রাক-উষালগ্নে বনলতা সেনকে দেখেন, দিনটা কাটে সম্ভবত তার সঙ্গেই এবং সন্ধ্যার পর দুজনে আবার মুখোমুখি বসেন; সব পাখি ঘরে ফিরলেও জীবনানন্দ কিন্তু ঘরে ফেরার ভাবনায় কাতর নন, বরং ধীরে সুস্থে বনলতা সেনের মুখোমুখি বসেন; কাজেই প্রবন্ধকার বিবাহিত পুরুষদের ঘরে ফেরার যে কথা বলেছেন তা অপ্রাসঙ্গিক এবং নিষিদ্ধ প্রেমের যে আনন্দ ও বেদনার কথা বলা হয়েছে তাও অপ্রাসঙ্গিক। মোটকথা, বনলতা সেন একজন রূপাজীবা এ ধরনের বিবেচনা শুধু বিতর্কমূলকই নয়- বিভ্রান্তকর বলেই মনে হয়।
    • আকবর আলি খানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জবাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোঃ আবু তাহের মজুমদার তাঁর 'জীবনানন্দ' নামক গ্রন্থে বনলতা সেন নামের এক নিবন্ধে এটি লিখেছেন। পৃষ্ঠা ৭৩-৭৫ [২]
  • এক নিভৃত সন্ধ্যায় জীবনানন্দের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, বনলতা সেন নামটি কবিতায় ব্যবহারের জন্য তাঁর কী করে মনে এল; সেইসঙ্গে এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম, কবিতাটির অন্তঃস্থিত অন্ধকারের প্রসঙ্গ তাঁর কি আগে থেকেই ভাবা ছিল, না কি বনলতা সেন নামটি বেছে নেওয়ার পর কবিতাটি নিজের নিয়তি নির্ধারণ করেছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের কোনও জবাব পাইনি। জীবনানন্দ শুধু জানিয়েছেন, সেই সময় আনন্দবাজার পত্রিকায় মাঝে মাঝে নিবর্তক আইনে বন্দিরা কে কোন কারাগারে আছেন, বা কোন জেল থেকে কোন জেলে স্থানান্তরিত হলেন, সে-সমস্ত খবর বেরোত। হয়তো ১৯৩২ সাল হবে, নয়তো তার পরের বছর, বনলতা সেন নাম্নী এক রাজবন্দি রাজশাহি জেলে আছেন, খবরটা তাঁর চোখে পড়েছিল, রাজশাহি থেকে নাটোর তো একচিলতে পথ। ইতবৃত্তের এখানেই শেষ। প্রাকস্বাধীনতা যুগে রাজবন্দিনী সেই মহিলা পরে গণিতের অধ্যাপিকা হয়েছিলেন, কলকাতার কলেজেও পড়িয়েছেন। বিবাহোত্তর পর্বে অন্য পদবি ব্যবহার করতেন, তাঁর সামান্য আলাপ হয়েছিল। ভব্যতাবশতই জিজ্ঞেস করা হয়নি তিনি কবিতাটির সঙ্গে আদৌ পরিচিত কি না। কিছু কিছু রহস্যকে অন্ধকারে ঢেকে রাখাই সম্ভবত শ্রেয়।
    • অশোক মিত্র। বনলতা সেন/বিক্ষিপ্ত অর্ধশতক, পৃষ্ঠা ৫ [৩]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]