বাউল

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে
বাংলাদেশের বাউল-সঙ্গীত শিল্পী

বাউল শিল্পী বা বাউল সাধক বা বাউল একটি বিশেষ ধরনের গোষ্ঠী ও লোকাচার সঙ্গীত পরিবেশক, যারা গানের সাথে সাথে সুফিবাদ, দেহতত্ত্ব প্রভৃতি মতাদর্শ প্রচার করে থাকে। বাউল সাধক বাউল সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকে। মূলত বাউল সংগীত একধরনের বাংলা সুফিবাদ সংগীত ছিল। বাউল গান পঞ্চবিংশ শতাব্দীতে লক্ষ্য করা গেলেও মূলত কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের গানের মধ্য দিয়ে বাউল মত পরিচিতি লাভ করে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের নিকট। বাউলদের সাদামাটা জীবন ধারণ ও একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউলদের বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।[১]

উক্তি[সম্পাদনা]

  • লালন
  এমন মানব-জনম আর কি হবে।
  মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৩৩।
  • লালন
  অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই,
  শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৩৩।
  • লালন
  আমারে চিনি নে আমি।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৩৪।
  • লালন
  আপন ঘরের খবর হয় না,
  বাঞ্ছা করি পরকে চেনা।
  

অর্থ: পরমাত্মাকে চিনতে গেলে আগে নিজেকে চিনতে হবে।

    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৩৫।
  • লালন
  এই মানুষে সেই মানুষ আছে।
  কত মুনি-ঋষি চারযুগ ধরে বেড়াচ্ছে খুঁজে।।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৩৫।
  • লালন
  জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়
  ধরতে গেলে হাতে কে পায়।
  

অর্থ: পরমাত্মাকে অনুভব করা যায়, ধরা যায় না।

    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৩৬।
  • লালন
  আপনারে আপনি না চিনিলে
  ঘুরবি কত ভুবনে।
  

অর্থ: পরমাত্মাকে বাইরে খোঁজার প্রয়োজন নেই, তাকে পাওয়া যাবে নিজের ভিতরে।

    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৩৭।
  • লালন
  আমার ঘরের চাবি পরের হাতে।
  কেমনে খুলিয়া সে ধন দেখব চক্ষেতে।।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৩৭।
  • লালন
  আপন ঘরে বোঝাই সোনা,
  পরে করে লেনা-দেনা,
  আমি হ'লেম জন্ম-কানা-
              না পাই দেখিতে।।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৩৮।
  • লালন
  আমার আপন খবর আপনার হয় না।
  একবার আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা।।
  

অর্থ: নিজেকে চিনলেই পরমাত্মাকে চেনা যায়।

    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৩৮।
  • লালন
  সাঁই আমার কখন খেলে কোন্ খেলা।
  জীবের কি সাধ্য আছে তা-ই বলা।।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৩৯।
  • লালন
  ভক্তির দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই।
  হিন্দু কি যবন ব'লে
          তার কাছে জাতের বিচার নাই।।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৪০।
  • লালন
  প্রেম না জেনে প্রেমের হাটের বুলবুলা।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৪২।
  • লালন
  সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
  লালন কয়, জেতের কিরূপ, দেখলাম না এ নজরে।।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৪৩।
  • ফটিক
  আমার এই কাদা মাখা সার হ'লো।
      ধর্ম-মাছ ধরব ব'লে নামলাম জলে।
      ভক্তি-জাল ছিঁড়ে গেল।
  কেবল হিংসে নিন্দে গুলি ঘোঙা পেয়েছি কতকগুলো।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৪৫।
  • যাদুবিন্দু
  এমন সহজ পথে হুঁচট লাগে ওরে দিনকানা।
  আপনি সহজ না হলে তো সহজের পথ পাবি না।।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৪৭।
  • পেদো
  দিন-দুপুরে চাঁদের উদয় রাত পোহান ভার।
  হ'লো অমাবস্যায় পূর্ণিমার চাঁদ তের প্রহর অন্ধকার।।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৪৯।
  • অজ্ঞাত
  চোখে দেখে গায়ে ঠেকে ধূলা আর মাটি,
  প্রাণ-রসনায় দেখ রে চাইখ্যা রসের সাঁই খাঁটি।।
    • মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা। মুহম্মদ আবদুল হাই, ডঃ আহমদ শরীফ(সম্পাদিত)। মাওলা ব্রাদার্স, পঞ্চদশ মুদ্রণ। পৃষ্ঠা ২৫৩।

বাউল সম্পর্কে উক্তি[সম্পাদনা]

  • বাংলার বাউল বা বাউল সংগীত গবেষকেরা অদ্যাবধি কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারেন নি। সাধারণত মানা হয় যে "বাউল" শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ "বাউর" থেকে, যার অর্থ স্বেচ্ছাচারী, বিশৃঙ্খল বা উন্মাদ।
  • কেউ কেউ বলেছেন, সংস্কৃত “বাতুল” শব্দ থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, এই গবেষকদের মতে- যে সব লোক প্রকৃতই পাগল, তাই তারা কোনো সামাজিক বা ধর্মের কোনো বিধিনিষেধ মানে না, তারাই বাউল।
    • মনসুর মুসা (সম্পাদিত), মুহম্মদ এনামুল হক রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, “বঙ্গে সূফি প্রভাব”, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯১, পৃ. ১৬০।
  • বাউলদের মধ্যে দুটি শ্রেণি আছে গৃহত্যাগী বাউল ও গৃহী বা সংসারী বাউল।
  • বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক। তারা মানবতার বাণী প্রচার করে।
  • বাউল মতে বৈষ্ণবধর্ম এবং সূফীবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাউলরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় আত্মাকে। তাদের মতে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়। আত্মা দেহে বাস করে তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করে। সাধারণত প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও বাউলরা জীবনদর্শন সম্পর্কে অনেক গভীর কথা বলেছেন।
  • বাউল সাধকদের শিরোমণি ফকির লালন সাঁই। লালন তার বিপুল সংখ্যক গানের মাধ্যমে বাউল মতের দর্শন এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রচার করেছিলেন।
  • বাউল-ফকিরদের সাময়িক আবাসস্থলের নাম আখড়া। এসব আখড়া পল্লিগ্রামের লোকালয় থেকে একটু দূরে অবস্থিত। সাধারণত সংসারত্যাগী এবং ভেকধারী বাউল-ফকিররাই এখানে অবস্থান করে। গুরুগৃহ এবং তার সমাধিকে কেন্দ্র করেও আখড়া গড়ে ওঠে।
  • বাউল গান সাধারণত দুপ্রকার দৈন্য ও প্রবর্ত। এ থেকে সৃষ্টি হয়েছে রাগ দৈন্য ও রাগ প্রবর্ত। এই ‘রাগ’ অবশ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ নয়, ভজন-সাধনের রাগ। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের মতো বাউল গানে ‘রাগ’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে ‘রাগ’ অর্থে অভিমান এবং প্রেমের নিবিড়তা বোঝায়। কাঙ্ক্ষিতজনের প্রতি নিবেদিত প্রেমের প্রগাঢ় অবস্থার নামই রাগ। রাগ দৈন্যে এমন ভাবই লক্ষণীয়। বাউলরা তাদের সাধনপন্থাকে রাগের কারণ বলে অভিহিত করে (আমার হয় না রে সে মনের মত মন/ আগে জানব কি সে রাগের কারণ)।
  • অতীতে বাউল বা লালনের গানে নির্দিষ্ট কোনো সুর ছিল না। পরবর্তীকালে লালনশিষ্য মনিরুদ্দিন ফকির এবং তাঁর শিষ্য খোদা বক্স এই গানের একটি ‘ছক‘ বাঁধার প্রচেষ্টা নেন। খোদা বক্সের শিষ্য অমূল্য শাহ্ ছিলেন একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি বাউল তথা লালনগীতির একটি সঙ্গীতকাঠামো নির্মাণ করেন।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

কাহ্নপা

কাজী মোতাহার হোসেন

কাজী আবদুল ওদুদ

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

  1. "UNESCO - Baul songs"। ich.unesco.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৪-২৩।