বিসর্জন (নাটক)

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে

বিসর্জন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কাব্যনাট্য। নাটকটি শুধু জীবপ্রেম ও মানবপ্রেমের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনই নয় বরং ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামির ফলে মানবপ্রেমের যে সংকটময় মুহূর্ত রবীন্দ্রনাথ সেটি এখানে কুযুক্তির সঙ্গে যুক্তিবাদিতার চিরন্তন দ্বন্দ্বের মাধ্যমে রূপায়িত করেছেন।

কাহিনী-সংক্ষেপ[সম্পাদনা]

বিসর্জন নাটকের আখ্যান ত্রিপুরার রাজ পরিবারকে কেন্দ্র করে। সন্তানহীন রাজমহিষীর সন্তান আকাঙ্খা, দেবীর নিকট সন্তান প্রার্থনা এবং পুরোহিত রঘুপতির ষড়যন্ত্র উদ্ভাবন এবং তাতে রাজার কনিষ্ঠ ভ্রাতার যোগদান এসবই কাহিনীর দৃশ্যপট। শেষে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস ও কুসংস্কারের রক্তপিপাসার প্রতি জয়সিংহের আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে নাটকের সমাপ্তি।

নাটকটির কাহিনীর উপাদান রাজর্ষি উপন্যাসেরই। ভিখারিণী অপর্ণা নাটকের নতুন আবিষ্কার।

উক্তি[সম্পাদনা]

  • জয়সিংহ। সৃজনের আগে দেবতা যেমন একা! তাই বটে!

তাই বটে! মনে হয় এ জীবন বড়ো বেশি আছে--যত বড়ো তত শূন্য, তত আবশ্যকহীন।

অপর্ণা। জয়সিংহ, তুমি বুঝি একা! তাই দেখিয়াছি, কাঙাল যে জন তাহারো কাঙাল তুমি। যে তোমার সব নিতে পারে, তারে তুমি খুঁজিতেছ যেন। ভ্রমিতেছ দীনদুঃখী সকলের দ্বারে। এতদিন ভিক্ষা মেগে ফিরিতেছি--কত লোক দেখি, কত মুখপানে চাই, লোকে ভাবে শুধু বুঝি ভিক্ষাতরে--দূর হতে দেয় তাই মুষ্টিভিক্ষা ক্ষুদ্র দয়াভরে। এত দয়া পাই নে কোথাও--যাহা পেয়ে আপনার দৈন্য আর মনে নাহি পড়ে।

জয়সিংহ। যথার্থ যে দাতা, আপনি নামিয়া আসে দানরূপে দরিদ্রের পানে, ভূমিতলে। যেমন আকাশ হতে বৃষ্টিরূপে মেঘ নেমে আসে মরুভূমে--দেবী নেমে আসে মানবী হইয়া, যারে ভালোবাসি তার মুখে। দরিদ্র ও দাতা, দেবতা মানব সমান হইয়া যায়।--ওই আসিছেন মোর গুরুদেব।

অপর্ণা। আমি তবে সরে যাই অন্তরালে। ব্রাহ্মণেরে বড়ো ভয় করি। কী কঠিন তীব্র দৃষ্টি! কঠিন ললাট পাষাণসোপান যেন দেবীমন্দিরের।

জয়সিংহ। কঠিন? কঠিন বটে। বিধাতার মতো। কঠিনতা নিখিলের অটল নির্ভর।”  — বিসর্জন, প্রথম অঙ্ক।


  • “গোবিন্দমাণিক্য।
       অপ্রসন্ন প্রেয়সীর মুখ, বিশ্বমাঝে

সব আলো সব সুখ লুপ্ত করে রাখে। উন্মনা-উৎসুক-চিত্তে ফিরে ফিরে আসি। গুণবতী।

            যাও, যাও। এস না এ গৃহে। অভিশাপ

আনিয়ো না হেথা। গোবিন্দমাণিক্য।

                            প্রিয়তমে, প্রেমে করে

অভিশাপ নাশ, দয়া করে অকল্যাণ দূর। সতীর হৃদয় হতে প্রেম গেলে পতিগৃহে লাগে অভিশাপ।--যাই তবে দেবী! গুণবতী।

                    যাও! ফিরে আর দেখায়ো না মুখ।

গোবিন্দমাণিক্য।

       স্মরণ করিবে যবে, আবার আসিব।  

[ প্রস্থানোন্মুখ পায়ে পড়িয়া গুণবতী।

            ক্ষমা করো, ক্ষমা করো নাথ! এতই কি

হয়েছ নিষ্ঠুর, রমণীর অভিমান ঠেলে চলে যাবে? জান না কি প্রিয়তম, ব্যর্থ প্রেম দেখা দেয় রোষের ধরিয়া ছদ্মবেশ? ভালো, আপনার অভিমানে আপনি করিনু অপমান ক্ষমা করো! গোবিন্দমাণিক্য।

       প্রিয়তমে, তোমা-'পরে টুটিলে বিশ্বাস

সেই দণ্ডে টুটিত জীবনবন্ধ। জানি প্রিয়ে, মেঘ ক্ষণিকের, চিরদিবসের সূর্য। গুণবতী।

                   মেঘ ক্ষণিকের এ মেঘ কাটিয়া

যাবে, বিধির উদ্যত বজ্র ফিরে যাবে, চিরদিবসের সূর্য উঠিবে আবার চিরদিবসের প্রথা জাগায়ে জগতে, অভয় পাইবে সর্বলোক--ভুলে যাবে দু দণ্ডের দুঃস্বপন। সেই আজ্ঞা করো। ব্রাহ্মণ ফিরিয়া পাক নিজ অধিকার, দেবী নিজ পূজা, রাজদণ্ড ফিরে যাক নিজ অপ্রমত্ত মর্ত-অধিকার-মাঝে। গোবিন্দমাণিক্য।

       ধর্মহানি ব্রাহ্মণের নহে অধিকার।

অসহায় জীবরক্ত নহে জননীর পূজা। দেবতার আজ্ঞা পালন করিতে রাজা বিপ্র সকলেরই আছে অধিকার। গুণবতী।

             ভিক্ষা, ভিক্ষা চাই! একান্ত মিনতি করি

চরণে তোমার প্রভু! চিরাগত প্রথা চিরপ্রবাহিত মুক্ত সমীরণ-সম, নহে তা রাজার ধন--তাও জোড়করে সমস্ত প্রজার নামে ভিক্ষা মাগিতেছে মহিষী তোমার। প্রেমের দোহাই মানো প্রিয়তম! বিধাতাও করিবেন ক্ষমা প্রেম-আকর্ষণ-বশে কর্তব্যের ত্রুটি। গোবিন্দমাণিক্য।

        এই কি উচিত মহারানী? নীচ স্বার্থ,

নিষ্ঠুর ক্ষমতাদর্প, অন্ধ অজ্ঞানতা, চির রক্তপানে স্ফীত হিংস্র বৃদ্ধ প্রথা-- সহস্র শত্রুর সাথে একা যুদ্ধ করি; শ্রান্তদেহে আসি গৃহে নারীচিত্ত হতে অমৃত করিতে পান; সেথাও কি নাই দয়াসুধা? গৃহমাঝে পুণ্যপ্রেম বহে, তারো সাথে মিশিয়াছে রক্তধারা? এত রক্তস্রোত কোন্‌ দৈত্য দিয়েছে খুলিয়া-- ভক্তিতে প্রেমেতে রক্ত মাখামাখি হয়, ক্রূর হিংসা দয়াময়ী রমণীর প্রাণে দিয়ে যায় শোণিতের ছাপ! এ শোণিতে তবু করিব না রোধ? মুখ ঢাকিয়া গুণবতী।

                                      যাও, যাও তুমি!

গোবিন্দমাণিক্য।

        হায় মহারানী, কর্তব্য কঠিন হয়

তোমরা ফিরালে মুখ।”  — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্দেশ্যে।