ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (২৬ আগস্ট ১৯২০ - ৪ মার্চ ১৯৮৩) পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেতা। বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে হাস্যকৌতুকময় অভিনয়ের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দিকপাল।
উক্তি
[সম্পাদনা]- “তবে কমেডিয়ানের সব থেকে বড় ট্র্যাজেডি কী জানেন, যেদিন আমার মা মারা গেলেন, কেওড়াতলা শ্মশানে তাঁর শবদেহ নিয়ে চলেছি। আশপাশের জনসাধারণ আমায় দেখে হাসছে আর বলছে, ওই দ্যাখ ভানু কাঁদছে।” — ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, [১]
- “শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গুরুজনদের দেখাশোনার ভার আমার হাতে নিশ্চিন্তে সঁপে দিয়ে স্টুডিও চত্বরে পরিচালক, প্রযোজকদের কাছে ধর্না দিয়ে ঘুরতে লাগলেন। শুনেছি প্রথমদিকে দু-একজন প্রযোজক কি পরিচালক তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে এখনও জিভের আড় ভাঙেনি। কিন্তু পরে তাঁরাই আবার যখন এসেছেন ডেকে কাজ দেওয়ার জন্য তখন শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের পারিশ্রমিকের অঙ্ক শুনে বলেছেন, "বাবা এত টাকা নেবে?" এর উত্তরে তিনি তাঁদের বলেছেন যে, "হ্যাঁ, ঐ জিভের আড় ভাঙার মূল্য দেবেন না? ওর অর্ধেক হল আমার রেট, বাকিটা জিভের আড় ভাঙানোর জন্য।” — ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, [২]
- “ব্যাপার হইল কী জানেন, দ্যাশে তো কিসু জমিজমা আমার আছিল, জমি থাকা মানেই ল্যান্ডলর্ড। দ্যাশ বিভাগের পর ল্যান্ড তো গ্যাল, পইড়া রইল লর্ড। লর্ডেরে রাখি কই! নামের গোড়ায় লাগাইয়া দিসি।” — ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, লর্ড ভানু [৩]
- “হরধনু ভাইঙ্গা সীতারে বিয়া করসিল, এই রে ফলো কইরা আমার মেজ পোলা পাশের বাড়ির সীতারে বিয়া করনের লিগ্যা ধনুক ভাঙ্গা পণ করসে। পাবলিকের প্যাঁদানির ভয়ে যে নিজ়ের বৌরে আগুনে ডুকতে কয় সে আবার আদর্শ রাজ়া।” — ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, নব্য রামায়ণ [৪]
- “এই নাটকের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পেরেছিলাম বলেই গ্রামগঞ্জে, সর্বত্র এই নাটক আমাদের করতে হয়েছে। আমরা প্রথম থেকেই এই নাটককে গণনাট্যের আদর্শে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। যা আমি এখনো আছি। কলকাতা শহরের কয়েকটা হল কেন্দ্রিক নাট্য আন্দোলনে আমার বিশ্বাস কম, ওই কটা জায়গায় কয়জন "গণ" যায়? আজকের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন অনেকটা সেইরকম নাটকবিলাসীদের হাতে পড়েছে।” — ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, আত্মজীবনী, ভানু সমগ্র, পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ১১৫
- “সত্যিকারের প্রফেশনাল না-হওয়া পর্যন্ত গ্রুপ থিয়েটারের ভেতরে এই অবস্থা থাকবে বলে আমার ধারণা। কিন্তু প্রফেশনাল হতে গেলে আন্তরিকতা ছাড়াও পরিশ্রম করে যাবার মানসিকতা দরকার। অন্যান্য সমস্ত বৃত্তির জন্য যে ধরনের পঠন পাঠানোর ব্যবস্থা আছে অভিনয়ের ব্যাপারে আমার মনে হয় সে ধরনের ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।” — ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, আত্মজীবনী, ভানু সমগ্র, পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ১১৫
- “আমি যে ছবিদার একনিষ্ঠ ভক্ত, তা শুধু তাঁর সিরিয়াস অভিনয়ের জন্য নয়, ছবিদার যে কী সাংঘাতিক কমেডি সেন্স ছিল, যারা তাঁর সঙ্গে মেশেনি তারা জানে না। ছবিদা যদি কমেডি অভিনয় করতেন তবে আমি হরফ করে বলতে পারি ভানু বন্দোপাধ্যায় তুলসী চক্রবর্তী জহর রায়ের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যেত।” — ছবি বিশ্বাসের উদ্দেশ্যে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, আত্মজীবনী, ভানু সমগ্র, পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ৩৮
- “আজকাল সব স্টার অভিনেতাদের আবেগপূর্ণ অভিনয়ের শুটিংয়ে যে দেখি, পরিচালক 'কাট' বলার পর দশ মিনিট পরেও কান্নার আবেগ থামাতে পারেন না। তাই দেখে আবার স্টুডিওর কিছু বোদ্ধারা বলেন, 'কি দারুন অভিনেত্রী, কি ন্যাচারাল দেখেছেন!' আমি বলি অভিনয় খুব বেশি ন্যাচারাল হলে মুশকিল আছে। কারণ কাউকে খুনের সিনে খুব বেশি ন্যাচারাল অভিনয় করতে গিয়ে যদি সজোরে পেটে ছুরি মেরে দেয় তাহলে সেটা বেশ মুশকিলের ব্যাপার হবে।” — ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, আত্মজীবনী, ভানু সমগ্র, পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত,পৃষ্ঠা ৩৫
- “আমার ছেলেবেলার নাটকে অভিনীত চরিত্রগুলো আমার খুব পছন্দের থাকত না। কিন্তু রোগা-পটকা চেহারা ও মিহি কণ্ঠস্বরে জন্য নাটকের পরিচালকরা যে চরিত্রের জন্য আমাকে নির্বাচিত করতেন, সেগুলোই আমাকে করতে হতো। 'শাজাহান'-এ জাহানারা 'পথের শেষে' নাটকে সুখদা, 'মেবার পতন'-এ মানসী, সরলা নাটকে সরলা এছাড়াও কুন্তী সীতা প্রভৃতি চরিত্রগুলোয় অভিনয় করতে হতো।” — ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, আত্মজীবনী, ভানু সমগ্র, পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ১৫
- “ভজ, দু-হাত তুলিয়া ভজ, কাঞ্চন গোসাই
তারই জোরে সবে তোমায় বাপ ডাকবে ভাই। থাকলে তিনি ট্যাঁকের মাঝে বুকে বারে বল
(দেখবে) স্ত্রী পুত্র ভাই বন্ধু তোমার পদতল।
(আহা!) টাকাই ধর্ম, টাকাই ধর্ম কলিযুগের সার
সত্যনিষ্ঠা, আইন কানুনের মাথায় ঝাঁটা মার” — ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ভানুশ্বরানন্দ, ভানু সমগ্র, পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ১৭৩
- “দুর ভাই! জগতের নিয়ম বিস্তর পাল্টাইছে। সবকিছু বেশি কইরা পাইতে হইলে অখন একমাত্তর এই গেরুয়া লাইনটাই খোলা। ভারতবর্ষের যেখানেই যাও গেরুয়ার মাইর নাই - আয়কর নাই, পৌরসংস্থার ঝামেলা নাই, লোডশেডিংয়ের বালাই নাই। মাথার উপর কেবল উন্মুক্ত আকাশ।” — ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ভানুশ্বরানন্দ, ভানু সমগ্র, পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ১৭৩
- “ভানু। আপনারা কে ?
নাদীর। আমি নাদীর শাহ।
ভানু। নাদির শাহ? সেই পারস্যের?
নাদীর। হ্যাঁ, আমার ডাইনে তৈমুর লং, বামেরসুলতান মামুদ। আর ওই যে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছেন উনি ওয়ারেন হেস্টিংস।
ভানু। তা আপনারা এইখানে?
নাদীর। যমরাজা আমাদের পাঠিয়েছেন দেখতে - ভারতবর্ষের যে ক্ষতি আমরা করেছি এখন সেই ভারতবর্ষের অবস্থা কী?
ভানু। কি দেখলেন ?
নাদীর। নিজেরা নিজেদের দেশের লোককে যেভাবে ঠকাচ্ছে আর দেশের লোকের মাথায় যেভাবে লাঙল চালাচ্ছে তার তুলনায় আমাদের অপরাধ শিশুসুলভ সফলতা মাত্র।
ভানু। তাহলে এখন আপনাগো মুক্তি...” — ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ভানুশ্বরানন্দ, ভানু সমগ্র, পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ১৭৪
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে উক্তি
[সম্পাদনা]- “চিত্রনাট্যে হাসি নেই অথচ হাসানোর দাবিতেই পয়সা দিয়ে এঁদের নিযুক্ত করা হয়। সে রকম অজস্র ছবিতে অভিনয় করার একটা খেসারত আছে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও তা দিতে হয়েছে।” — সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, [৫]
- “ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বললে শুধুই একটা হাসাবার যন্ত্র মনে পড়ে না— একটা জীবন ধারণা, জীবন সম্পর্কে একটা মন্তব্য যেন মনকে ছুঁয়ে যায়।” — সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, [৬]
- “বাবা ‘ওরা থাকে ওধারে’-র মতো কিছু ছবিতে ১০০০ টাকা রোজ দরেও অভিনয় করেছেন। অনেকটা সময় তাঁর বাঁধা দর ছিল, ২৫০ টাকা। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর পর থেকেই একেবারে ছোট, চার-পাঁচ দিন কাজের পার্ট বাবা নিতেন না। ছোট চরিত্রে কেউ খুব ঝুলোঝুলি করলে, ৮০০ বা ১০০০ টাকা দর হাঁকাতেন।’” — গৌতম ব্যানার্জি, [৭]