মায়ার খেলা (গীতিনাট্য)
মায়ার খেলা হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক বাংলা ভাষায় রচিত একটি গীতিনাট্য। এটি ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত হয়। নারী উন্নয়নের কথা চিন্তা করে তিনি এই নাটকটি রচনা করেন। তৎকালীন সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা এ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। এ সম্পর্কে ইন্দিরা দেবী বলেন, "মায়ার খেলার অভিনয় তখনকার দিনে নিশ্চয় বেশ একটি স্মরণীয় ঘটনা, সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা বোধ হয় এই প্রথম সংঘবদ্ধভাবে অভিনয়ে নামেন।
উক্তি
[সম্পাদনা]- “অমর। যেমন দখিনে বায়ু ছুটেছে,
কে জানে কোথায় ফুল ফুটেছে। তেমনি আমিও সখী যাব, না জানি কোথায় দেখা পাব। কার সুধাস্বর মাঝে, জগতের গীত বাজে, প্রভাত জাগিছে কার নয়নে। কাহার প্রাণের প্রেম অনন্ত। তাহারে খুঁজিব দিক্-দিগন্ত।
মায়াকুমারীগণ। মনের মতো কারে খুঁজে মর, সে কি আছে ভুবনে, সে তো রয়েছে মনে। ওগো, মনের মতো সেই তো হবে, তুমি শুভক্ষণে যাহার পানে চাও।” — মায়ার খেলা, দ্বিতীয় দৃশ্য।
- “প্রথমা। তোমার আপনার যে জন, দেখিলে না তারে।
দ্বিতীয়া। তুমি যাবে কার দ্বারে।
তৃতীয়া। যারে চাবে তারে পাবে না, যে মন তোমার আছে, যাবে তাও।” — মায়ার খেলা, দ্বিতীয় দৃশ্য।
- “প্রমদা। ওলো রেখে দে, সখী, রেখে দে,
মিছে কথা ভালোবাসা। সুখের বেদনা, সোহাগ যাতনা, বুঝিতে পারি না ভাষা। ফুলের বাঁধন, সাধের কাঁদন, পরান সঁপিতে প্রাণের সাধন, লহো লহো বলে পরে আরাধন পরের চরণে আশা। তিলেক দরশ পরশ মাগিয়া, বরষ বরষ কাতরে জাগিয়া, পরের মুখের হাসির লাগিয়া অশ্রু-সাগরে ভাসা। জীবনের সুখ খুঁজিবারে গিয়া জীবনের সুখ নাশা।” — মায়ার খেলা, তৃতীয় দৃশ্য।
- “কুমার। যেয়ো না, যেয়ো না ফিরে,
দাঁড়াও, বারেক দাঁড়াও হৃদয়-আসনে। চঞ্চল সমীর সম ফিরিছ কেন, কুসুমে কুসুমে, কাননে কাননে। তোমায় ধরিতে চাহি, ধরিতে পারি নে, তুমি গঠিত যেন স্বপনে, এস হে, তোমারে বারেক দেখি ভরিয়ে আঁখি, ধরিয়া রাখি যতনে। প্রাণের মাঝে তোমারে ঢাকিব, ফুলের পাশে বাঁধিয়ে রাখিব, তুমি দিবস-নিশি রহিবে মিশি কোমল প্রেম-শয়নে।
প্রমদা। কে ডাকে! আমি কভু ফিরে নাহি চাই। কত ফুল ফুটে উঠে, কত ফুল যায় টুটে, আমি শুধু বহে চলে যাই। পরশ পুলক-রস ভরা রেখে যাই, নাহি দিই ধরা। উড়ে আসে ফুলবাস, লতাপাতা ফেলে শ্বাস, বনে বনে উঠে হা-হুতাশ, চকিতে শুনিতে শুধু পাই, চলে যাই। আমি কভু ফিরে নাহি চাই।” — মায়ার খেলা, তৃতীয় দৃশ্য।
- “অশোক। এসেছি গো এসেছি, মন দিতে এসেছি,
যারে ভালো বেসেছি! ফুলদলে ঢাকি মন যাব রাখি চরণে, পাছে কঠিন ধরণী পায়ে বাজে, রেখো রেখো চরণ হৃদি-মাঝে, না হয় দলে যাবে, প্রাণ ব্যথা পাবে, আমি তো ভেসেছি, অকূলে ভেসেছি।
প্রমদা। ওকে বলো, সখী বলো, কেন মিছে করে ছল, মিছে হাসি কেন, সখী, মিছে আঁখিজল! জানি নে প্রেমের ধারা, ভয়ে তাই হই সারা, কে জানে কোথায় সুধা কোথা হলাহল।
সখীগণ। কাঁদিতে জানে না এরা, কাঁদাইতে জানে কল, মুখের বচন শুনে মিছে কী হইবে ফল। প্রেম নিয়ে শুধু খেলা প্রাণ নিয়ে হেলাফেলা, ফিরে যাই এই বেলা, চল, সখী, চল।” — মায়ার খেলা, তৃতীয় দৃশ্য।
- “অমর। মিছে ঘুরি এ জগতে কিসের পাকে,
মনের বাসনা যত মনেই থাকে। বুঝিয়াছি এ নিখিলে, চাহিলে কিছু না মিলে, এরা, চাহিলে আপন মন গোপনে রাখে। এত লোক আছে কেহ কাছে না ডাকে।” — মায়ার খেলা, চতুর্থ দৃশ্য।
- “অমর। ভালোবেসে যদি সুখ নাহি
তবে কেন, তবে কেন মিছে ভালোবাসা। অশোক। মন দিয়ে মন পেতে চাহি। অমর ও কুমার। ওগো কেন, ওগো কেন মিছে এ দুরাশা।
অশোক। হৃদয়ে জ্বালায়ে বাসনার শিখা, নয়নে সাজায়ে মায়া-মরীচিকা, শুধু ঘুরে মরি মরুভূমে। অমর ও কুমার। ওগো কেন, ওগো কেন মিছে এ পিপাসা।
অমর। আপনি যে আছে আপনার কাছে, নিখিল জগতে কী অভাব আছে। আছে মন্দ সমীরণ, পুষ্পবিভূষণ, কোকিল-কূজিত কুঞ্জ।
অশোক। বিশ্বচরাচর লুপ্ত হয়ে যায়, এ কী ঘোর প্রেম অন্ধ রাহুপ্রায় জীবন যৌবন গ্রাসে। অমর ও কুমার। তবে কেন, তবে কেন মিছে এ কুয়াশা।” — মায়ার খেলা, চতুর্থ দৃশ্য।
- “প্রথমা। তারে কেমনে কাঁদাবে, যদি আপনি কাঁদিলে।
দ্বিতীয়া। যদি মন পেতে চাও, মন রাখো গোপনে।
তৃতীয়া। কে তারে বাঁধিবে, তুমি আপনায় বাঁধিলে।
সকলে। কাছে আসিলে তো কেহ কাছে রহে না। কথা কহিলে তো কেহ কথা কহে না।
প্রথমা। হাতে পেলে ভূমিতলে ফেলে চলে যায়।
দ্বিতীয়া। হাসিয়ে ফিরায় মুখ কাঁদিয়ে সাধিলে।” — মায়ার খেলা, পঞ্চম দৃশ্য।
- “অমর। ছিলাম একেলা সেই আপন ভুবনে,
এসেছি এ কোথায়। হেথাকার পথ জানি নে, ফিরে যাই। যদি সেই বিরাম-ভবন ফিরে পাই।” — মায়ার খেলা, পঞ্চম দৃশ্য।
- “অমর। সেই শান্তিভবন ভুবন কোথা গেল।
সেই রবি শশী তারা, সেই শোকশান্ত সন্ধ্যা-সমীরণ, সেই শোভা, সেই ছায়া, সেই স্বপন। সেই আপন হৃদয়ে আপন বিরাম কোথা গেল, গৃহহারা হৃদয় লবে কাহার শরণ। এসেছি ফিরিয়ে, জেনেছি তোমারে, এনেছি হৃদয় তব পায়-- শীতল স্নেহসুধা করো দান, দাও প্রেম, দাও শান্তি, দাও নূতন জীবন।
মায়াকুমারীগণ। কাছে ছিলে দূরে গেলে, দূর হতে এস কাছে। ভুবন ভ্রমিলে তুমি, সে এখনো বসে আছে। ছিল না প্রেমের আলো, চিনিতে পার নি ভালো, এখন বিরহানলে প্রেমানল জ্বলিয়াছে!” — মায়ার খেলা, ষষ্ঠ দৃশ্য।
- “শান্তা। দেখো সখা ভুল করে ভালোবেসো না।
আমি ভালোবাসি বলে কাছে এসো না। তুমি যাহে সুখী হও তাই করো সখা, আমি সুখী হব বলে যেন হেসো না। আপন বিরহ লয়ে আছি আমি ভালো, কী হবে চির আঁধারে নিমেষের আলো। আশা ছেড়ে ভেসে যাই, যা হবার হবে তাই, আমার অদৃষ্ট-স্রোতে তুমি ভেসো না।
অমর। ভুল করেছিনু ভুল ভেঙেছে। এবার জেগেছি, জেনেছি, এবার আর ভুল নয় ভুল নয়। ফিরেছি মায়ার পিছে পিছে, জেনেছি স্বপন সব মিছে। বিঁধেছে বাসনা-কাঁটা প্রাণে, এ তো ফুল নয় ফুল নয়! পাই যদি ভালোবাসা হেলা করিব না, খেলা করিব না লয়ে মন। ওই প্রেমময় প্রাণে, লইব আশ্রয় সখী, অতল সাগর এ সংসার, এ তো কূল নয় কূল নয়!” — মায়ার খেলা, ষষ্ঠ দৃশ্য।
- “অমর। ঐ কে আমায় ফিরে ডাকে।
ফিরে যে এসেছে তারে কে মনে রাখে।
অমর। আমি চলে এনু বলে কার বাজে ব্যথা। কাহার মনের কথা মনেই থাকে। আমি শুধু বুঝি সখী, সরল ভাষা, সরল হৃদয় আর সরল ভালোবাসা। তোমাদের কত আছে, কত মন প্রাণ, আমার হৃদয় নিয়ে ফেলো না বিপাকে।” — মায়ার খেলা, ষষ্ঠ দৃশ্য।
- “অমর। আমি কারেও বুঝি নে শুধু বুঝেছি তোমারে।
তোমাতে পেয়েছি আলো সংশয়-আঁধারে। ফিরিয়াছি এ ভুবন, পাই নি তো কারো মন, গিয়েছি তোমারি শুধু মনের মাঝারে। এ সংসারে কে ফিরাবে, কে লইবে ডাকি, আজিও বুঝিতে নারি ভয়ে ভয়ে থাকি। কেবল তোমারে জানি, বুঝেছি তোমার বাণী, তোমাতে পেয়েছি কূল অকূল পাথারে।” — মায়ার খেলা, ষষ্ঠ দৃশ্য।
- “প্রমদা। চল্ সখী চল্ তবে ঘরেতে ফিরে
যাক ভেসে ম্লান আঁখি নয়ন-নীরে। যাক ফেটে শূন্য প্রাণ, হোক্ আশা অবসান, হৃদয় যাহারে ডাকে থাক্ সে দূরে।” — মায়ার খেলা, ষষ্ঠ দৃশ্য।
- “প্রমদা। আর কেন, আর কেন,
দলিত কুসুমে বহে বসন্ত-সমীরণ। ফুরায়ে গিয়াছে বেলা, এখন এ মিছে খেলা, নিশান্তে মলিন দীপ কেন জ্বলে অকারণ।
সখীগণ। অশ্রু যবে ফুরায়েছে তখন মুছাতে এলে, অশ্রুভরা হাসিভরা নবীন নয়ন ফেলে।
প্রমদা। এই লও, এই ধরো, এ মালা তোমরা পরো, এ খেলা তোমরা খেলো, সুখে থাকো অনুক্ষণ।” — মায়ার খেলা, সপ্তম দৃশ্য।
- “অমর। এ ভাঙা সুখের মাঝে নয়ন-জলে,
এ মলিন মালা কে লইবে। ম্লান আলো ম্লান আশা হৃদয়-তলে, এ চির বিষাদ কে বহিবে। সুখনিশি অবসান, গেছে হাসি গেছে গান, এখন এ ভাঙা প্রাণ লইয়া গলে নীরব নিরাশা কে সহিবে।
শান্তা। যদি কেহ নাহি চায়, আমি লইব, তোমার সকল দুখ আমি সহিব। আমার হৃদয় মন, সব দিব বিসর্জন, তোমার হৃদয়-ভার আমি বহিব। ভুল-ভাঙা দিবালোকে, চাহিব তোমার চোখে, প্রশান্ত সুখের কথা আমি কহিব।” — মায়ার খেলা, সপ্তম দৃশ্য।
- “প্রমদা। কেন এলি রে, ভালোবাসিলি, ভালোবাসা পেলি নে।
কেন সংসারেতে উঁকি মেরে চলে গেলি নে।
সখীগণ। সংসার কঠিন বড়ো কারেও সে ডাকে না, কারেও সে ধরে রাখে না। যে থাকে সে থাকে, আর যে যায় সে যায়, কারো তরে ফিরেও না চায়।” — মায়ার খেলা, সপ্তম দৃশ্য।
উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত
[সম্পাদনা]আমার পরান যাহা চায়,
তুমি তাই, তুমি তাই গো।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর, কেহ নাই কিছু নাই গো।
তুমি সুখ যদি নাহি পাও,
যাও, সুখের সন্ধানে যাও,
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে,
আর কিছু নাহি চাই গো।
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী,
দীর্ঘ বরষ মাস।
যদি আর কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে, তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও,
আমি যত দুখ পাই গো।
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,
শুধু সুখ চলে যায়।
এমনি মায়ার ছলনা।
এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।
তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ,
তাই মান অভিমান,
তাই এত হায় হায়।
প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়।
সখী চলো, গেল নিশি, স্বপন ফুরাল,
মিছে আর কেন বল।
শশী ঘুমের কুহক নিয়ে গেল অস্তাচল।
সখী চলো।
প্রেমের কাহিনী গান, হয়ে গেল অবসান।
এখন কেহ হাসে, কেহ বসে ফেলে অশ্রুজল।
চরিত্র
[সম্পাদনা]- অমর
- শান্তা
- অশোক
- প্রমদা
- কুমার
- মায়াকুমারীগণ ( ৩ জন)
- প্রমদার সখীগণ (৩ জন)
- পুরুষগণ
- স্ত্রীগণ[১]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ রবীন্দ্র নাটক সমগ্র (অখণ্ড), সেপ্টেম্বর ২০১৫, ষষ্ঠ প্রকাশ, কামিনী প্রকাশালয়।