রণেশ দাশগুপ্ত
রণেশ দাশগুপ্ত (১৫ই জানুয়ারি ১৯১২ - ৪ঠা নভেম্বর ১৯৯৭)-এর জন্ম ভারতের আসামে। পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ। ভারতের বাঁকুড়া জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও কলকাতার সিটি কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। ব্রজমােহন কলেজে অধ্যয়নকালে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যুক্ত হন। দৈনিক সংবাহ দেশের প্রগতিশীল পত্রপত্রিকায় কাজ করেছেন। ১৯৭৫-এ কলকাতায় গিয়ে আর ফেরেননি। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করেছেন। উল্লেখযােগ্য বই উপন্যাসের শিল্পরূপ, শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ, আলাে দিয়ে আলাে জ্বালা, রহমানের মা ও অন্যান্য। অনুবাদ : ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতা। ১৯৯৮ সালে তাকে মরণােত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়।
সাহিত্য সমালোচনা বা শিল্পতত্ত্বের ব্যাখ্যায় রণেশ দাশগুপ্তের রচনাবলি ধ্রুপদ স্থানীয়। বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখকরা তাঁর উপকরণের উৎস- তাতে উনিশ শতকের কবি-লেখকদের সঙ্গে তাঁর অনুজপ্রতিমরাও স্থান পেয়েছেন। ভারতবর্ষের নানা ভাষার সাহিত্যিকরা তাঁর বিশ্লেষণে পরিচিত হয়েছেন বাঙালি সাহিত্যমহলে।
বাংলায় বিশ্বসাহিত্যের আলোচনায় আলোচনার তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। আঠার-উনিশ শতক থেকে শুরু করে সমকালীন বিশ্বের শিল্পী ও শিল্পকে এক অনুপম ভাষায় উপস্থাপন করেছেন পাঠকের সামনে। তাতে বাদ পড়েননি চারুশিল্প বা চলচ্চিত্রকারও। তাঁর প্রিয় শিল্পী-সাহিত্যিকরা ছড়িয়ে আছেন ভিয়েতনাম-চীন থেকে শুরু করে সমগ্র পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর ও লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও আরবভূমিতে।
উক্তি
[সম্পাদনা]- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকাল সমাজতন্ত্রের তথা সাম্যবাদের অভ্যুদয়ের উদয়াচল। অপরদিকে এই শতাব্দী ধনিকতন্ত্রের অস্তমিত হওয়ার কাল। এই কালসন্ধিতে সর্বদেশের শিল্পী-সাহিত্যিকদের জীবন ও সাধনা পরস্পরবিরোধী আকর্ষণ-বিকর্ষণের লীলাভূমি হতে বাধ্য। শিল্পীচিত্তের স্বাতন্ত্র্যবোধ ও সর্বজনীনতা এবং স্বতঃস্ফূর্ততা ও দায়িত্বশীলতা এই শতাব্দীর শুরু থেকেই নতুন কালের রসায়নের ভাণ্ডে কখনো অপূর্ব বর্ণবিভাময় নব উপাদান গড়ে তুলেছে, কখনো ধূম্রবহ্নি-সমন্বিত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতিভার জন্য ডেকে এনেছে বিপর্যয়, কিংবা সৃষ্টিকে করেছে অনাসৃষ্টি।
- শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্ন, পৃষ্ঠা ১১
- ইতিহাসের জয়পতাকা আজ সমাজতন্ত্রের হাতে। ইতিহাসের রায় সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিকদের পক্ষে।
- শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্ন, পৃষ্ঠা ১২
- যে উনিশ শতককে পেছনে ফেলে এসেছি আমার জন্মদিবসে, উনিশশো বার সালের পনেরো-ই জানুয়ারি-তার ধারাটা ফেলে আসা শতাব্দীকে অতিক্রম করে বেশ কয়েকটা বড় দাগে। যেমন, উনিশ শতক ছিল আমাদের উপমহাদেশকে বৃটিশ শাসন ও শোষণের মধ্যে টেনে নেয়ার সর্বব্যাপী প্রয়াস, আর বিশ শতকটা হল বৃটিশ শাসন ও শোষণের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসার ঘটনা পরম্পরা। অর্থাৎ, আমরা একদিকে যেমন উনিশ শতকের শেষে শুরু করি বৃটিশ শাসনের মধ্যে চলে যাওয়ার চূড়ান্ত পর্ব তেমনি শুরু করি বৃটিশ শাসন থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম পর্ব।
- কখনো চম্পা কখনো অতসী, পৃষ্ঠা ১১
- বায়ান্নর অমর একুশে ফেব্রুয়ারির বিপ্লবী কালো পতাকাতে কষ্টিপাথরে লেখার মতো আঁকা রয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারের বুকের খুনে আঁকা পলাশমালা।
- যদিও হওয়া উল্টোপাল্টা, শুধু ভোরের কাকলি হিসেবে নয়, পৃষ্ঠা ২১
রণেশ দাশগুপ্ত সম্পর্কে উক্তি
[সম্পাদনা]- বিশ শতকের মানবতাবাদী-সাম্যবাদী মানচিত্রে রণেশ দাশগুপ্ত একটি দ্বীপের নাম। দ্বীপ তিনি হতে চাননি; চেয়েছিলেন স্বদেশের বুকে সমাজতন্ত্রের দীপ জ্বালাতে। কিন্তু একদিকে আত্মত্যাগের সীমাহীন স্পৃহা, শৈল্পিক রুচির নিরলস সাধনা, সততা এবং সরলতার মূর্তিমান রূপ এবং তার বিপরীতে জীবনের মোহের কাছে পরাজয়, শঠতা ও সুবিধাবাদী জীবনধারা তাঁকে এবং তাঁর মতন আরও একদল মানুষকে দ্বীপে রূপান্তরিত করেছিল। তবু সাম্যবাদের মূলভূমির সংলগ্নই ছিলেন তাঁরা, ছিলেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি।
- সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব রণেশ দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৯৭)। রণেশ দাশগুপ্ত আজীবন সংগ্রাম করেছেন সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, সামন্তবাদ, সাম্প্রদায়িকতা আর সামাজিক অনাচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সংগ্রাম করেছেন রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মঞ্চে আর কলম হাতে সাহিত্যের ক্ষেত্রে। বাঙালি মনন মানসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে রণেশ দাশগুপ্ত এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।
- বদিউর রহমান, লেখক