শওকত আলী

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে

শওকত আলী (জন্ম: ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬) ছিলেন একজন বাঙালি কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক। তিনি বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে গল্প ও উপন্যাস লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। ভিন্নধর্মী লেখার জন্য তাঁর পাঠক সমাজও ভিন্নরকম ছিল। ১৯৯০ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

উক্তি[সম্পাদনা]

  • ‘ভালোবাসা কারে কয়’ ব্যতিক্রমধর্মী প্রেমের উপন্যাস। আমার এই একমাত্র প্রেমের উপন্যাসটি একেবারে নির্ভেজাল প্রেম নিয়ে উপন্যাস হয়নি। চিরন্তনপ্রথা অনুযায়ী এটি তরুণদের নয় বরং বৃদ্ধালোকের প্রেম নিয়ে এই উপন্যাস।
  • বিশ্ব যুদ্ধের সময় আমি ছোট ছিলাম। দিনের বেলায়ও ভয় লাগতো। রাতের বেলায় তো বাতিও জ্বলতো না। ভয়ে রাতের বেলায় লাইট বন্ধ থাকতো। ওরা লাইট দেখে বুঝতে পারতো লোকজন আছে কিনা, এখানে শহর আছে কিনা? দিনের বেলায়তো ট্রেন আসতো না। যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে সেখানে তো অবস্থা খুব খারাপ। আর সন্ধ্যার পরেই আমাদের ঘরের সব দরজা, জানালা বন্ধ করে রাখা হতো।
    • শওকত আলীর সাক্ষাৎকার, শেমলচন্দ্র নাথ, ১৮ই ডিসেম্বর, ২০১৫ | bdnews24
  • জেলজীবনে আমার অনেক প্রাপ্তিযোগের মধ্যে একটি হলো বিখ্যাত কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশের সঙ্গে জেল খাটা। বন্দী সাঁওতালদের সঙ্গে তাদের জীবনাচার, কৃষ্টি, গঞ্জনা বঞ্চনার কথাও শুনেছি অনেক। শিখেছি কী বিচিত্র সেই জীবন-যাপন।
    • শওকত আলী: অন্তর্জগতের অনালোচিত মানবিক সাহিত্যিক, আহমাদ ইশতিয়াক, রোববার ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩ | The Daily Star বাংলা
  • আমি কোনো রাজনৈতিক দলের চিন্তা করি না। রাজনীতিক কর্মসূচিও দেখি না। সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা যেখানে বলা আছে, সাধারণ মানুষের জীবনের পরিবর্তন যাতে আসে এবং সাধারণ মানুষের যাতে ভালো হয়—সেটাই সমর্থন করি।
  • সাহিত্যকে, শিল্পকে বুঝতে হলে এর জন্য প্রেম প্রয়োজন। প্রেম তো প্রয়োজন আছে জীবনের জন্যও। প্রেম না হলে জীবন হয় না। জীবনের কথা যে লিখতে চায়, জীবনকে যে সামনে আনতে চায়, তার লেখায় তো প্রেম আসবেই। আর প্রেমেও যৌনতা থাকবে। তবে প্রেমপূর্ণ যৌনতা প্রেমে পূর্ণতা আনে আর অকারণ যৌনতা প্রেমকে পরিপূর্ণতা দেয় না বরং বিকৃত করে।
  • কোনো ভাষার সাহিত্যই কোনো সুনির্দিষ্ট পথে যাত্রা করে না। সে বিভিন্নভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়, ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়। সে কিছু হারায় আবার কিছু সঞ্চয় করে। জীবন যেভাবে বিকশিত হয়, সেভাবে সাহিত্যও হয়।
  • জীবনে উপলব্ধি হচ্ছে, যত দিন বাঁচি, বাঁচতে হবে। আনন্দকে গ্রহণ করতে হবে। চারপাশের মানুষ তাদের জীবনধারার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে ব্যস্ত। ঘাত-প্রতিঘাত আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে জীবন যাপন করলাম, তাতে আমার কোনো আফসোস নেই। সৃষ্টি করার এই যে প্রক্রিয়া, তা আগেও ছিল এখনও আছে। পূর্ণতা অর্জনের একটা আকাঙ্ক্ষা এখনও আছে, আর এটাই জীবন।
    • মৃত্তিকালগ্ন মানুষ আজীবন আমাকে টেনেছে - নূর কামরুন নাহার, ১ই এপ্রিল, ২০১৩ | সাকিন
  • কৃষকের জীবনটা দেখলাম। ধান-পাট চাষের সময় চারা গজানোর পরে কিছু ঘাসও গজায়। সেগুলোকে খুপরি দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। যখন ওদের সঙ্গে ছিলাম, এ রকম কিছু কাজও করতাম। তখনই কৃষিবিজ্ঞানের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় হলো। মনে হয়েছে, যারা কৃষক তারাই কিন্তু আসল কৃষিবিজ্ঞানের খবরটা জানে। সার এলে কৃষি বিভাগ থেকে কোন ফসলে কোন সার লাগবে বলা হতো, কিন্তু কৃষকরা বলত, আমরা এটা দেব না। তারা পরীক্ষা করে দেখে যেটাতে কাজ হতো সেটা দিত। তখনই মনে হয়েছিল, সাধারণ মানুষকে আমরা যতই অজ্ঞ মনে করি, তারা কিন্তু অজ্ঞ নয়।
  • একজন ভালোভাবে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে অনার্সে ভর্তি হয়ে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে গেল। আরেকজন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। সে সিএসপি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। সে ইংরেজি ভাষা শিখতে শুরু করল, সমাজের উঁচু শ্রেণিতে মেলামেশা শুরু করল, পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখল। এভাবে একটি শ্রেণি গড়ে উঠল। আরেকটা শ্রেণি আবার মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে শুরু করল। মানুষের সঙ্গে মিশতে শুরু করল। এখন হিসাব করে দেখলে মনে হয়, এদের সংখ্যাটা ছিল বেশি। আর তা যদি না হতো তাহলে বাংলাদেশ হতো না।
  • আমরা যারা এখানে আধুনিক সাহিত্য রচনা করছিলাম বা আমাদের আগে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ, সিকানদার আবু জাফর, আহসান হাবীব-তাঁরা কলকাতার আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছেন। তবে তাঁরা চিন্তা করেছিলেন এখানে সাহিত্যের ভিত্তিটা কোথায় হবে? নগরজীবন হবে না কি গ্রামজীবন হবে? নগরজীবন হলে কোন জীবনটা? সে জীবন বাস্তব হবে কি না? তাঁদের লেখার মধ্যে এই বাস্তবতা আসতে শুরু করেছিল এবং এই বাস্তবতাই পরবর্তী সময়ে প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে হোক বা জীবনযাপনের মধ্যে হোক, স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে হোক-এগুলোর মধ্য দিয়েই বড় হয়েছে এবং এসবের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ব্যাপারটা আরও স্পষ্টতর হয়েছে।
    • কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর সাক্ষাৎকার, ৮ই ফেব্রুয়ারি | রুপসী বাংলা

শওকত আলী সম্পর্কে উক্তি[সম্পাদনা]

  • কিছু কিছু লেখক আছেন যারা জীবন সম্পর্কে, চারপাশের জগৎ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেন; আমাদের তারা যা দেন তা হচ্ছে দেখার চোখ, সমাজকে বোঝার যুক্তি এবং অনুভব করার মতো হৃদয়। কথাসাহিত্যিক শওকত আলী তাদের অন্যতম।
    • শওকত আলীকে শ্রদ্ধার্ঘ্য - আলী রীয়াজ, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ | যুগান্তর
  • শওকত আলী যেমন আপোসহীন ছিলেন তৃণমূল মানুষের মুক্তি ও প্রাপ্তির জায়গায়, তেমনি শিল্পসৃষ্টি লেখনী ও প্রকাশের জায়গায়। তাই তাঁর উপন্যাস-গল্পে যেমন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে সাধারণ মানুষের শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনা এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তেমনি প্রকাশের ঋজুতা, বর্ণনা, ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতায় তা হয়ে উঠেছে শিল্পোত্তীর্ণ জীবনের ঘনিষ্ঠ পাঠ।
    • মৃত্তিকালগ্ন মানুষ আজীবন আমাকে টেনেছে - নূর কামরুন নাহার, ১ই এপ্রিল, ২০১৩ | সাকিন
  • শওকত আলী তার সাহিত্যে পরম মমতায় তুলে এনেছেন নিম্নবর্গের মানুষের উপাখ্যান। ইতিহাসের খেরোখাতা থেকে তুলে এনে চরিত্র বিনির্মাণের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন সেন রাজাদের রাজত্বকালে সামন্ত মহাসামন্তদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ প্রাকৃতজনদের জীবন সংগ্রাম। কেবল কি তাই, মধ্যবিত্ত পরিবারের উত্থান-পতন, গ্রামীণ বাস্তবতা থেকে শহুরে জনপদ, দেশভাগ, কী আসেনি তার সাহিত্যে!
    • শওকত আলী: অন্তর্জগতের অনালোচিত মানবিক সাহিত্যিক, আহমাদ ইশতিয়াক, রোববার ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩ | The Daily Star বাংলা
  • শওকত আলীর লেখার ধার ও ধারণা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার আছে বলে মনে হয় না। কারণ, বাঙালির স্বরূপ অন্বেষণ তাঁর রচনাকে নতুন মাত্রা প্রদান করেছে। শেকড় যেমন মাটির গভীর থেকে নির্যাস সংগ্রহ করে, তেমনি তিনিও জীবনের ভেতর থেকে মানুষের ভেতরের মানুষকে তুলে আনেন খনিজ রত্নের মতো। নগরায়ণ তাঁকে তেমন নাড়া দেয় না; তিনি গ্রামীণ প্রেক্ষাপট তথা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথাই বার বার উপস্থাপন করেছেন, তাদের অস্তিত্বের ভেতরেই আবিষ্কার করতে চেয়েছেন জীবনের রহস্যকে।
  • শওকত আলীর সাহিত্যের ভাষা পড়লেই চেনা যায় এটি কার সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে এমন উদাহরণ খুবই নগণ্য, যাদের সৃষ্টির দ্বারা অতি সহজেই নির্ণয় করা যায় কে হতে পারেন স্রষ্টা। শওকত আলী ছিলেন সেই নগণ্য সংখ্যক সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন। যিনি সমস্ত ধ্বংসলীলার মাঝেও বের করে এনেছেন জীবন সংগ্রামের পথ, মুক্তির নিশানা। সমস্ত নগ্নতার মাঝেও আকাঙ্ক্ষা করেছেন মুক্তির।
    • শওকত আলী: অন্তর্জগতের অনালোচিত মানবিক সাহিত্যিক, আহমাদ ইশতিয়াক, রোববার ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩ | The Daily Star বাংলা
  • শওকত আলীর একটি উপন্যাস থেকে আরেকটি উপন্যাসের দূরত্ব যথেষ্ট। ভিন্ন প্রেক্ষাপট, ভিন্ন আঙ্গিক ভিন্ন চরিত্রে সমৃদ্ধ। কিন্তু দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালরাতে এবং পূর্বদিন পূর্বরাত্রি এই উপন্যাস তিনটি প্রকৃতপক্ষে অবিভাজ্য। রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে এ তিনটি ভিন্নমাত্রা বহন করে।
  • শওকত আলীর সবচেয়ে বড় শক্তির স্থানটি ছিল তার সাহিত্যের ভাষায় দ্বিধাহীন চরিত্রের নির্মাণ। সমাজের সমস্ত গোত্র বর্ণের মানুষকেই তিনি তুলে এনেছেন সাহিত্যে। যেখানে সমাজের ধনবান ব্যক্তি যেমন স্থান পেয়েছে ঠিক তেমনি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যক্তি বা দুর্বলতম ব্যক্তিও স্থান পেয়েছে। একই সঙ্গে শওকত আলী তার সৃষ্টিতেই প্রশ্ন এঁকে দিয়েছেন। তুলে এনেছেন ভাবনার অসীম দুয়ার।
    • শওকত আলী: অন্তর্জগতের অনালোচিত মানবিক সাহিত্যিক, আহমাদ ইশতিয়াক, রোববার ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩ | The Daily Star বাংলা