শ্যামা (নৃত্যনাট্য)
শ্যামা হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি বাংলা নাটক। এটি ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়। এটি একটি নৃৃত্যনাট্য।
উক্তি
[সম্পাদনা]- “বন্ধু। জান না কি
পিছনে তোমার রয়েছে রাজার চর।
বজ্রসেন। জানি জানি, তাই তো আমি চলেছি দেশান্তর। এ মানিক পেলেম আমি অনেক দেবতা পূজে, বাধার সঙ্গে যুঝে-- এ মানিক দেব যারে অমনি তারে পাব খুঁজে, চলেছি দেশ-দেশান্তর॥” — শ্যামা, প্রথম দৃশ্য।
- “কোটাল। থামো থামো,
কোথায় চলেছ পালায়ে সে কোন্ গোপন দায়ে। আমি নগর-কোটালের চর।
বজ্রসেন। আমি বণিক, আমি চলেছি আপন ব্যবসায়ে, চলেছি দেশান্তর।
কোটাল। কী আছে তোমার পেটিকায়।
বজ্রসেন। আছে মোর প্রাণ আছে মোর শ্বাস।
কোটাল। খোলো, খোলো, বৃথা কোরো না পরিহাস।
বজ্রসেন। এই পেটিকা আমার বুকের পাঁজর যে রে-- সাবধান! সাবধান! তুমি ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না এরে। তোমার মরণ, নয় তো আমার মরণ-- যমের দিব্য করো যদি এরে হরণ-- ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না।” — শ্যামা, প্রথম দৃশ্য।
- “কোটাল। ধর্ ধর্ ওই চোর, ওই চোর।
বজ্রসেন। নই আমি নই চোর, নই চোর, নই চোর-- অন্যায় অপবাদে আমারে ফেলো না ফাঁদে।
কোটাল। ওই বটে, ওই চোর, ওই চোর, ওই চোর।
শ্যামা। আহা মরি মরি, মহেন্দ্রনিন্দিতকান্তি উন্নতদর্শন কারে বন্দী করে আনে চোরের মতন কঠিন শৃঙ্খলে। শীঘ্র যা লো সহচরী, যা লো, যা লো-- বল্ গে নগরপালে মোর নাম করি, শ্যামা ডাকিতেছে তারে। বন্দী সাথে লয়ে একবার আসে যেন আমার আলয়ে দয়া করি॥
সখী। সুন্দরের বন্ধন নিষ্ঠুরের হাতে ঘুচাবে কে। নিঃসহায়ের অশ্রুবারি পীড়িতের চক্ষে মুছাবে কে। আর্তের ক্রন্দনে হেরো ব্যথিত বসুন্ধরা, অন্যায়ের আক্রমণে বিষবাণে জর্জরা-- প্রবলের উৎপীড়নে কে বাঁচাব দুর্বলেরে, অপমানিতেরে কার দয়া বক্ষে লবে ডেকে।” — শ্যামা, দ্বিতীয় দৃশ্য।
- “শ্যামা। তোমাদের এ কী ভ্রান্তি--
কে ওই পুরুষ দেবকান্তি, প্রহরী, মরি মরি। এমন করে কি ওকে বাঁধে। দেখে যে আমার প্রাণ কাঁদে। বন্দী করেছ কোন্ দোষে।
কোটাল। চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে, চোর চাই যে করেই হোক। হোক-না সে যেই-কোনো লোক, চোর চাই। নহিলে মোদের যাবে মান!
শ্যামা। নির্দোষী বিদেশীর রাখো প্রাণ, দুই দিন মাগিনু সময়।
কোটাল। রাখিব তোমার অনুনয়; দুই দিন কারাগারে রবে, তার পর যা হয় তা হবে।
বজ্রসেন। এ কী খেলা হে সুন্দরী, কিসের এ কৌতুক। দাও অপমান-দুখ-- মোরে নিয়ে কেন, কেন এ কৌতুক।
শ্যামা। নহে নহে, এ নহে কৌতুক। মোর অঙ্গের স্বর্ণ-অলংকার সঁপি দিয়া শৃঙ্খল তোমার নিতে পারি নিজ দেহে। তব অপমানে মোর অন্তরাত্মা আজি অপমানে মানে।” — শ্যামা, দ্বিতীয় দৃশ্য।
- “শ্যামা। রাজার প্রহরী ওরা অন্যায় অপবাদে নিরীহের প্রাণ বধিবে ব'লে কারাগারে বাঁধে।
ওগো শোনো, ওগো শোনো, ওগো শোনো, আছ কি বীর কোনো, দেবে কি ওরে জড়িয়ে মরিতে অবিচারের ফাঁদে অন্যায় অপবাদে।
উত্তীয়। ন্যায় অন্যায় জানি নে, জানি নে, জানি নে, শুধু তোমারে জানি ওগো সুন্দরী। চাও কি প্রেমের চরম মূল্য-- দেব আনি, দেব আনি ওগো সুন্দরী। প্রিয় যে তোমার, বাঁচাবে যারে, নেবে মোর প্রাণঋণ-- তাহারি সঙ্গে তোমারি বক্ষে বাঁধা রব চিরদিন মরণডোরে। কেমনে ছাড়িবে মোরে, ওগো সুন্দরী॥
শ্যামা। এতদিন তুমি সখা, চাহ নি কিছু; নীরবে ছিলে করি নয়ন নিচু। রাজ-অঙ্গুরী মম করিলাম দান, তোমারে দিলাম মোর শেষ সম্মান। তব বীর-হাতে এই ভূষণের সাথে আমার প্রণাম যাক তব পিছু পিছু।” — শ্যামা, দ্বিতীয় দৃশ্য।
- “সখী। কোন্ অপরূপ স্বর্গের আলো
দেখা দিল রে প্রলয়রাত্রি ভেদি দুর্দিন দুর্যোগে, মরণমহিমা ভীষণের বাজালো বাঁশি। অকরুণ নির্মম ভুবনে দেখিনু এ কী সহসা-- কোন্ আপনা-সমর্পণ, মুখে নির্ভয় হাসি।” — শ্যামা, দ্বিতীয় দৃশ্য।
- “বজ্রসেন। এ কী আনন্দ, আহা--
হৃদয়ে দেহে ঘুচালে মম সকল বন্ধ। দুঃখ আমার আজি হল যে ধন্য, মৃত্যুগহনে লাগে অমৃতসুগন্ধ। এলে কারাগারে রজনীর পারে উষাসম মুক্তিরূপা অয়ি লক্ষ্ণী দয়াময়ী।
শ্যামা। বোলো না, বোলো না, বোলো না, আমি দয়াময়ী। মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা। বোলো না। এ কারাপ্রাচীরে শিলা আছে যত নহে তা কঠিন আমার মতো। আমি দয়াময়ী! মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা।
বজ্রসেন। জেনো প্রেম চিরঋণী আপনারি হরষে, জেনো, প্রিয়ে। সব পাপ ক্ষমা করি ঋণশোধ করে সে। কলঙ্ক যাহা আছে, দূর হয় তার কাছে, কালিমার 'পরে তার অমৃত সে বরসে॥” — শ্যামা, তৃতীয় দৃশ্য।
- “সখী। কোন্ বাঁধনের গ্রন্থি বাঁধিল দুই অজানারে
এ কী সংশয়েরি অন্ধকারে। দিশাহারা হাওয়ায় তরঙ্গদোলায় মিলনতরণীখানি ধায় রে কোন্ বিচ্ছেদের পারে॥” — শ্যামা, চতুর্থ দৃশ্য।
- “বজ্রসেন। হৃদয় বসন্তবনে যে মাধুরী বিকাশিল
সেই প্রেম সেই মালিকায় রূপ নিল, রূপ নিল। এই ফুলহারে প্রেয়সী তোমারে বরণ করি অক্ষয় মধুর সুধাময় হোক মিলনবিভাবরী। প্রেয়সী তোমায় প্রাণবেদিকায় প্রেমের পূজায় বরণ করি॥ কহো কহো মোরে প্রিয়ে, আমারে করেছ মুক্ত কী সম্পদ দিয়ে। অয়ি বিদেশিনী, তোমার কাছে আমি কত ঋণে ঋণী।
শ্যামা। নহে নহে নহে-- সে কথা এখন নহে।
সহচরী। নীরবে থাকিস সখী,ও তুই নীরবে থাকিস। তোর প্রেমেতে আছে যে কাঁটা তারে আপন বুকে বিঁধিয়ে রাখিস। দয়িতেরে দিয়েছিলি সুধা, আজিও তাহে মেটে নি ক্ষুধা-- এখনি তাহে মিশাবি কি বিষ। যে জ্বলনে তুই মরিবি মরমে মরমে কেন তারে বাহিরে ডাকিস॥” — শ্যামা, চতুর্থ দৃশ্য।
- “শ্যামা। তোমা লাগি যা করেছি
কঠিন সে কাজ, আরো সুকঠিন আজ তোমারে সে কথা বলা। বালক কিশোর উত্তীয় তার নাম, ব্যর্থ প্রেমে মোর মত্ত অধীর; মোর অনুনয়ে তব চুরি-অপবাদ নিজ-'পরে লয়ে সঁপেছে আপন প্রাণ।
বজ্রসেন। কাঁদিতে হবে রে, রে পাপিষ্ঠা, জীবনে পাবি না শান্তি। ভাঙিবে ভাঙিবে কলুষনীড় বজ্র-আঘাতে।
শ্যামা। ক্ষমা করো নাথ, ক্ষমা করো। এ পাপের যে অভিসম্পাত হোক বিধাতার হাতে নিদারুণতর। তুমি ক্ষমা করো, তুমি ক্ষমা করো।
বজ্রসেন। এ জন্মের লাগি তোর পাপমূল্যে কেনা মহাপাপভাগী এ জীবন করিলি ধিক্কৃত। কলঙ্কিনী ধিক্ নিশ্বাস মোর তোর কাছে ঋণী।
শ্যামা। তোমার কাছে দোষ করি নাই। দোষ করি নাই। দোষী আমি বিধাতার পায়ে, তিনি করিবেন রোষ-- সহিব নীরবে। তুমি যদি না করো দয়া সবে না, সবে না,সবে না॥” — শ্যামা, চতুর্থ দৃশ্য।
- “বজ্রসেন। এসো এসো এসো প্রিয়ে,
মরণলোক হতে নূতন প্রাণ নিয়ে।
শ্যামা। এসেছি প্রিয়তম, ক্ষমো মোরে ক্ষমো। গেল না গেল না কেন কঠিন পরান মম-- তব নিঠুর করুণ করে! ক্ষমো মোরে।” — শ্যামা, চতুর্থ দৃশ্য।
উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত
[সম্পাদনা]মায়াবনবিহারিণী হরিণী
গহনস্বপনসঞ্চারিণী,
কেন তারে ধরিবারে করি পণ
অকারণ।
থাক্ থাক্, নিজ-মনে দূরেতে,
আমি শুধু বাঁশরির সুরেতে
পরশ করিব ওর প্রাণমন
অকারণ॥
চমকিবে ফাগুনের পবনে,
পশিবে আকাশবাণী শ্রবণে,
চিত্ত আকুল হবে অনুখন
অকারণ।
দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব--
বাঁধনবিহীন সেই যে বাঁধন
অকারণ॥
প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে
বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও।
ভুলিব ভাবনা পিছনে চাব না,
পাল তুলে দাও, দাও দাও।
প্রবল পবনে তরঙ্গ তুলিল--
হৃদয় দুলিল, দুলিল দুলিল,
পাগল হে নাবিক,
ভুলাও দিগ্বিদিক,
পাল তুলে দাও, দাও দাও॥
ক্ষমিতে পারিলাম না যে
ক্ষমো হে মম দীনতা,
পাপীজনশরণ প্রভু।
মরিছে তাপে মরিছে লাজে
প্রেমের বলহীনতা--
ক্ষমো হে মম দীনতা,
পাপীজনশরণ প্রভু।
প্রিয়ারে নিতে পারি নি বুকে,
প্রেমেরে আমি হেনেছি,
পাপীরে দিতে শাস্তি শুধু
পাপেরে ডেকে এনেছি।
জানি গো তুমি ক্ষমিবে তারে
যে অভাগিনী পাপের ভারে
চরণে তব বিনতা।
ক্ষমিবে না, ক্ষমিবে না
আমার ক্ষমাহীনতা,
পাপীজনশরণ প্রভু॥
চরিত্রসমূহ
[সম্পাদনা]- বজ্রসেন
- শ্যামা
- বন্ধু
- কোটাল
- সখীরা
- উত্তীয়
- সহচরী
- পল্লীরমণী
- প্রহরীগণ
- নেপথ্যে[১]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ রবীন্দ্র নাটক সমগ্র (অখণ্ড), সেপ্টেম্বর ২০১৫, ষষ্ঠ প্রকাশ, কামিনী প্রকাশালয়।