সধবার একাদশী
অবয়ব
"সধবার একাদশী" হলো ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার দীনবন্ধু মিত্র রচিত একটি প্রহসনমূলক নাটক। তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজের উচ্চশ্রেণীর ব্যক্তি বর্গের চাল-চরিত্র সুচারুভাবে নাটকটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সংলাপ
[সম্পাদনা]- হা! জগদীশ্বর! (রোদন) আমি কি অপরাধ করিছি, আমাকে অধর্ম্মাকর মদিরাহস্তে নিপাতিত কল্যে? যে পিতা চৈত্রের রৌদ্রে, জ্যৈষ্ঠের নিদাঘে, শ্রাবণের বর্ষায়, পৌষের শীতে মুমূর্ষু হইয়া আমার আহার আহরণ করেছেন, সে পিতা এখন আমায় দেখ্লে চক্ষু মুদিত করেন, যে জননী আমাকে বক্ষে ধারণ করিয়া রাখিতেন এবং মুখ চুম্বন করিতে করিতে আপনাকে ধন্য বিবেচনা কত্তেন, সেই জননী এখন আমায় দেখ্লে আপনাকে হত-ভাগিনী বলে কপালে করাঘাত করেন; যে শ্বশুর আমাকে জামাতা করে আপনাকে কৃতার্থ বোধ করেছিলেন, তিনি এখন আমাকে দেখ্লে মুখ ফিরিয়ে বসেন; শাশুড়ী আমায় দেখলে তনয়ার বৈধব্য কামনা করেন; শালী শালাজ আমায় দেখলে হাঁসেন-দাঁতে মিসি মধুর হাঁসি। তুমি কে, চাও কি, কাঁদো কেন?- আমি সকলের ঘৃণাস্পদ, আমি জঘন্যতার জলনিধি, আমি আপনার কুচরিত্রে আপনি কম্পিত হই; কিন্তু সুধাংশুবদনী আমাকে একদিনও অবজ্ঞা করেন নাই, রূঢ় বাক্যও বলেন নাই, আমার জন্যে প্রাণেশ্বরী কারো কাছে মুখ দেখাতে পারেন না, আমার নিন্দা শুনতে হয় বলে কারো কাছে বসেন না। আহা! আমার নেশা হয়েছে বটে, কিন্তু আমি বেশ দেখ্তে পাচ্চি, আমার কথা নিয়ে সকলে কানাকানি করছে, কুরঙ্গনয়নী কার্য্যান্তর-ব্যপদেশে প্রাসাদের প্রান্তভাগে বিজন স্থানে করকপোল হয়ে ভাবনাপ্রবাহে ভাসমানা আছেন, আলুলায়িত কেশ, লুন্ঠিত অঞ্চল, অশ্রুবারি নথের মুক্তার গায় মুক্তার ন্যায় দুলিতেছে, কেহ আসচে কি না, এক এক বার মুখ ফিরিয়ে দেখচেন। - মদ কি ছাড়বো! আমি ছাড়তে পারি বাবা, ও আমায় ছাড়ে কই? সে কালে ভূতে পেতো, এখন মদে পায়- ডাক্ ওজা, ডাক্ ওজা, ঝাঁড়ুয়ে আমার মদ ছাড়ুয়ে দেক্- আমি সুরধনী সভায় নাম লেখাব, কারে কথা শুনবো না; সভাপতি খুড়ো মদের গঙ্গামায়রা, গঙ্গামায়রা ভূত ছাড়াতে পারে, সভাপতি খুড়ো মদ ছাড়াতে পারে- বাবা, ভূতের ওজা আপনি সব খেয়ে বলে ভূতে খেয়ে গিয়েছে দেখ বাবা, তুমি আপনি খেয়ে যেন আমাদের দোষ দিও না।
- কেনা: আমি ঘুস খাই নে।
নিম: কেন?
কেনা: লোকে নিন্দে করবে আর সাহেবরা কর্ম্ম ছাড়য়ে দেবে।
নিম: ঘুস্ খেতে তোমার প্রেজুডিস্ নাই?
কেনা: ঘুসের আবার প্রেজুডিস্ কি, এ ত আর মদ নয়?
নিম: হেসোনা বাবা, আমি জানি, হিন্দুরা যেমন প্রেজুডিস্ বশতঃ মদ খায় না, তেমনি অনেক হাকিম প্রেজুডিস্ বশতঃ ঘুস খায় না। তুমি লেখাপড়া শিখেছ, তোমার প্রেজুডিস্ গিয়েছে, কেবল অর্দ্ধচন্দ্রের ভয়েতে ঘুস খাও না- তুমি সাধু পুরুষ, প্রেজুডিস্ ছেড়ে দিয়ে বেস করেছ।
নকু: আপনার বেশ্যালয় গতিবিধি আছে?
নিম: প্রেজুডিস নাই।
কেনা: আমি কখন বেশ্যালয় যাই না, ওতে পাপ হয়।
- অট: নিমচাঁদ ওঠ, বাবা না আসতে আসতে আমরা বাগানে যাই, যে মার খেইচি, অনেক ব্রান্ডি না খেলে বেদনা যাবে না।
নিম: কি বোল বলিলে বাবা বলো আর বার,
মৃত দেহে হলো মম জীবন সঞ্চার।
মাতালের মান তুমি, গণিকার গতি,
সধবার একাদশী, তুমি যার পতি।