বিষয়বস্তুতে চলুন

হুমায়ূন আহমেদ

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে
হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ - ১৯ জুলাই ২০১২) ছিলেন একজন বাংলাদেশি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক বলে গণ্য করা হয়। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। অন্য দিকে তিনি আধুনিক বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও তিনি সমাদৃত। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। তার বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত।

উক্তি

[সম্পাদনা]
  • ভালোবাসা একটা পাখি। যখন খাঁচায় থাকে তখন মানুষ তাকে মুক্ত করে দিতে চায়। আর যখন খোলা আকাশে তাকে ডানা ঝাপটাতে দেখে তখন খাঁচায় বন্দী করতে চায়।
  • ভালোবাসা ও ঘৃনা দুটাই মানুষের চোখে লেখা থাকে।
  • পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। ভালবাসার অত্যাচার হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক অত্যাচার। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলা যায় না, শুধু সহ্য করে নিতে হয়।
  • এই পৃথিবীতে প্রায় সবাই, তার থেকে বিপরীত স্বভাবের মানুষের সাথে প্রেমে পড়ে।”
  • যদি আপনি অন্তর থেকে কাউকে চান, জেনে রাখুন সেই মানুষটিও আপনাকে ভেবেই ঘুমাতে যায়।
  • কাউকে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসার মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা আছে। নিজেকে তখন তুচ্ছ এবং সামান্য মনে হয়। এই ব্যাপারটা নিজেকে ছোট করে দেয়।
  • যে ভালবাসা যত গোপন, সেই ভালবাসা তত গভীর।
  • কাউকে ভালোবাসলে বেশি কাছে যাবার চেষ্টা করতে নাই।
  • প্রত্যেক ভালবাসায় দুইজন সুখী হলেও তৃতীয় একজন অবশ্যই কষ্ট পাবেই, এটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম।
  • ভালোবাসার মাঝে হালকা ভয় থাকলে, সেই ভালোবাসা মধূর হয়। কেননা, হারানোর ভয়ে প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা আরও বেড়ে যায়।
  • যে জিনিস চোখের সামনে থাকে তাকে আমরা ভুলে যাই। যে ভালোবাসা সব সময় আমাদের ঘিরে রাখে। তার কথা আমাদের মনে থাকে না…. মনে থাকে হঠাৎ আসা ভালোবাসার কথা।
  • বাঙালিকে বেশি প্রশংসা করতে নেই। প্রশংসা করলেই বাঙালি এক লাফে আকাশে উঠে যায়।
  • যে ভালোবাসা না চাইতে পাওয়া যায়, তার প্রতি কোনো মোহ থাকে না।
  • দুঃসময়ে কোনো অপমান গায়ে মাখতে হয় না।
  • মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলোই পৃথিবীর আসল রূপ দেখতে পায়।
  • যে জিনিস চোখের সামনে থাকে তাকে আমরা ভুলে যাই। যে ভালোবাসা সব সময় আমাদের ঘিরে রাখে। তার কথা আমাদের মনে থাকে না.... মনে থাকে হঠাৎ আসা ভালোবাসার কথা।
  • কল্পনা শক্তি আছে বলেই সে মিথ্যা বলতে পারে। যে মানুষ মিথ্যা বলতে পারে না, সে সৃষ্টিশীল মানুষ না, রোবট টাইপ মানুষ।
  • পৃথিবীর সব মেয়েদের ভেতর অলৌকিক একটা ক্ষমতা থাকে। কোনও পুরুষ তার প্রেমে পড়লে মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝতে পারে। এই ক্ষমতা পুরুষদের নেই। তাদের কানের কাছে মুখ নিয়ে কোনও মেয়ে যদি বলে- ‘শোন আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। আমি মরে যাচ্ছি।’ তারপরেও পুরুষ মানুষ বোঝে না। সে ভাবে মেয়েটা বোধ হয় এপেন্ডিসাইটিসের ব্যাথায় মরে যাচ্ছে!
  • মানুষের কষ্ট দেখাও কষ্টের কাজ।
  • মেয়েদের আসল পরীক্ষা হচ্ছে সংসার, ঐ পরীক্ষায় পাশ করতে পারলে সব পাশ!
  • গাধা এক ধরনের আদরের ডাক। অপরিচিত বা অর্ধ-পরিচিতদের গাধা বলা যাবে না। বললে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। প্রিয় বন্ধুদেরই গাধা বলা যায়। এতে প্রিয় বন্ধুরা রাগ করে না বরং খুশি হয়।
  • মিথ্যা বলা মানে আত্মার ক্ষয়। জন্মের সময় মানুষ বিশাল এক আত্মা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। মিথ্যা বলতে যখন শুরু করে তখন আত্মার ক্ষয় হতে থাকে। বৃদ্ধ বয়সে দেখা যায়, আত্মার পুরোটাই ক্ষয় হয়ে গেছে।
  • কাজল ছাড়া মেয়ে দুধ ছাড়া চায়ের মতো।
  • দুঃসময়ে কোনো অপমান গায়ে মাখতে হয় না।
  • মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলোই পৃথিবীর আসল রূপ দেখতে পায়।
  • মানুষ এবং পশু যে বন্ধু খোঁজে তা না, তারা প্রভুও খোঁজে। "
    • দেয়াল
  • "এই পৃথিবীতে মূল্যবান শুধু মানুষের জীবন। আর সবই মূল্যহীন। "
    • দেয়াল
  • "কিছু বিদ্যা মানুষের ভিতর থাকে। সে নিজেও তা জানে না। "
    • দেয়াল
  • "যে লাঠি দিয়ে অন্ধ মানুষ পথ চলে সেই লাঠি দিয়ে মানুষও খুন করা যায়। "
    • দেয়াল
  • "মানব জাতির স্বভাব হচ্ছে সে সত্যের চেয়ে মিথ্যার আশ্রয়ে নিজেকে নিরাপদ মনে করে।"
    • দেয়াল
  • গল্প-উপন্যাস হলো অল্পবয়েসী মেয়েদের মাথা খারাপের মন্ত্র।"
    • দেয়াল
  • দাদাজানের সঙ্গে আমার তেমন কথা হতো না। তিনি সারাক্ষণ ট্রানজিস্টারে খবর শুনতেন। মাঝে মাঝে তিন মাইল দূরে হামিদ কুতুবি নামের এক পীর সাহেবের আস্তানায় যেতেন। তিনি এই পীরের মুরিদ হয়েছিলেন। যখন ট্রানজিস্টার শুনতেন না, তখন পীর সাহেবের দেওয়া দোয়া জপ করতেন। দাদাজান আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। প্রতিদিনই তাঁর আতঙ্ক বাড়ছিল। রাতে তিনি ঘুমুতে পারতেন না। সারা রাত বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে থাকতেন। ভবিষ্যৎ জানার জন্যে তিনি এক রাতে ইস্তেখারা করলেন। ইস্তেখারায় দেখলেন, একটা প্রকাণ্ড ধবধবে সাদা পাখি যার চোখ টকটকে লাল, সে আকাশ থেকে নেমে আমার চুল কামড়ে ধরে আকাশে উঠে গেছে। আমি চিৎকার করছি, বাঁচাও! বাঁচাও! দাদাজান আমাকে বাঁচাও। দাদাজান আমাকে বাঁচানোর জন্যে হেলিকপ্টারে করে উঠে গেলেন। সেই হেলিকপ্টার আবার চালাচ্ছে একজন পাকিস্তানি পাইলট। হেলিকপ্টার চালাবার ফাকে ফাকে সে পিস্তল দিয়ে পাখিটাকে গুলি করছে। কোনো গুলি পাখির গায়ে লাগছে না। লাগছে অবন্তির গালে। দাদাজানের পীর হামিদ কুতুবি স্বপ্নের তাবীর করলেন। কী তাবীর তা দাদাজান আমাকে বললেন না, তবে তিনি আরও অস্থির হয়ে পড়লেন। চারদিক থেকে তখন ভয়ংকর সব খবর আসতে শুরু করেছে। মিলিটারিরা গানবোট নিয়ে আসছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নির্বিচারে মানুষ মারছে, অল্পবয়সী মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এইসব। একসময় আমাদের অঞ্চলে মিলিটারি চলে এল।...
    • দেয়াল
  • মীরু ফুপুর মাথার ওপর শাড়ি দিয়ে দিল। সুলতানা জড়ানো গলায় বললেন, তুই কি নাসেরকে বিয়ে করবি? হ্যাঁ বলার দরকার নেই। চুপ করে থাকলেই বুঝব তোর অমত নেই। - ফুপু ঘুমাও। তাহলে তোর মত আছে? আলহামদুলিল্লাহ। মীরু বলল, তুমি বলেছিলে চুপ করে থাকলেই বুঝবে আমার মত আছে। আমি কিন্তু চুপ করে থাকিনি। আমি কথা বলেছি। আমি বলেছি, ফুপু ঘুমাও। সুলতানা বললেন, তোর মত থাকুক বা না থাকুক নাসেরের সঙ্গেই তোর বিয়ে হবে। আমি ইস্তেখারা করে এই জিনিস পেয়েছি। - কি করে এই জিনিস পেয়েছ? - ইস্তেখারা। দোয়া-কালাম পড়ে স্বপ্নে ভবিষ্যৎ জানার একটা পদ্ধতি। - কি দেখেছিলে স্বপ্নে? স্বপ্নে দেখেছি তোরা দুইজন এক থালায় ভাত খাচ্ছিস। চীনা মাটির বড় একটা থালা। - এক থালায় ভাত খাওয়া স্বপ্নে দেখলে কি বিয়ে হয়? - ইস্তেখারার স্বপ্নগুলি আসে প্রতীকের মত। প্রতীক ব্যাখ্যা করতে হয়। আমার ব্যাখ্যায় এইটাই আসে। তোর ব্যাখ্যা কি? - আমার ব্যাখ্যা হল তুমি মনেপ্রাণে চাচ্ছ নাসের সাহেবের সঙ্গে আমার বিয়ে হোক। চাচ্ছ বলেই স্বপ্নে এই জিনিস দেখেছ। উইশফুল থিংকিং থেকে উইসফুল ড্রিমিং। ফুপু তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ? সুলতানা জবাব দিলেন না। তিনি আসলেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
    • রোদনভরা এ বসন্ত
  • মৃত মানুষকে জিজ্ঞেস করার উপায় আছে। একে বলে ইস্তেখারা। দোয়া দরুদ পড়ে ঘুমাতে হয়। উত্তর-দক্ষিণে পাক পবিত্র হয়ে শুতে হয়। মুখ থাকে কাবার দিকে ফিরানো।
    • লিলুয়া বাতাস
  • সোবাহানের বাবা ছেলের বিয়ের পরদিন এসে উপস্থিত হলেন। তাঁকে চেনার উপায় নেই। মুখভর্তি দাড়ি গোঁফ। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা বাবরি চুল। চিরুনি দিয়ে আঁচড়ালে টপ টপ করে সেখান থেকে উকুন পড়ে। সেসব উকুনের সাইজও প্রকাণ্ড। উকুন মারার ব্যাপারে তিনি খুব উৎসাহিত হয়ে পড়লেন। ঠিক কতগুলি উকুন মারা পড়েছে তার। হিসাব রাখতে লাগলেন। যেমন একদিন সর্বমোট সাতাত্তরটি উকুন মারা পড়ে। এটিই সবচেয়ে বড় রেকর্ড। তিনি এই খবরটি হাসিমুখে অনেককেই দিলেন, যেন এটা তাঁর। বিরাট একটা সাফল্য। বড় ছেলের বিয়ের ব্যাপারেও তিনি দারুণ উৎসাহ প্রকাশ করতে থাকেন। মেয়েটি যে অত্যন্ত সুলক্ষণা এই কথা অসংখ্যবার বলতে লাগলেন। তিনি নাকি ইস্তেখারা করে এই বিয়ের কথা জানতে পেরেই ছুটে এসেছেন। তাঁকে সময় অসময়ে বালিকা পুত্রবধূটির সঙ্গে গল্পগুজব করতে দেখা গেল। প্রায় বছর খানিক তিনি থাকলেন, তারপর আবার গেলেন এবং তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। ফরিদ আলি আইএ পাশ করলেন। বিএ ক্লাসে ভর্তি হলেন এবং বিএ পরীক্ষায় যথাসময়ে ফেল করলেন। সোবাহান আইএ পাশ করল। ঢাকা শহরে চাকরির চেষ্টা করতে লাগল। কলেজে ভর্তি হয়ে তেমন কোনো পড়াশোনা ছাড়াই একসময় বিএ পাস করে ফেলল।
    • অরণ্য
  • যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে সম্রাট ব্যস্ত। মিত্র রাজাদের কাছে সাহায্য চেয়ে সম্রাটের চিঠি নিয়ে রাজদূতরা যাচ্ছেন। তিনি নিজের ভাইদের সঙ্গে ঘনঘন বৈঠক করছেন। মীর্জা কামরান পবিত্র কোরান শরীফে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছেন, তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে সম্রাটের ডানহাত হয়ে কাজ করবেন। মীর্জা কামরানকে নিয়ে সম্রাটের সামান্য আশঙ্কা ছিল। সেই আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। রাজজ্যোতিষীদের শুভক্ষণ বের করতে বলা হয়েছে। সম্রাট নিজে ইস্তেখারা নামাজ পড়েছেন। ইস্তেখারার নামাজের পর অজু করে ঘুমিয়ে পড়লে স্বপ্নে নির্দেশ আসে। স্বপ্নে যা দেখা যায়। তার সবটাই প্রতীকী। এই প্রতীকের অর্থ-উদ্ধার বেশিরভাগ সময় কঠিন হয়। সম্রাট স্বপ্নে দেখেছেন। ধবধবে সাদা একটা বক গাছে বসেছে। গাছের পাতা খাচ্ছে। স্বপ্নের তফসিরকারীরা স্বপ্নের অর্থ করেছেন। এইভাবে-বক মাংসাশী। সে জীবন্ত মাছ, পোকামাকড় ধরে ধরে খায়। স্বপ্নে সে তার স্বভাব পরিবর্তন করে তৃণভোজী হয়ে গাছের পাতা খাচ্ছে। প্রতীকীভাবে বক হলো শের শাহ। কারণ সে পাখির মতোই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। বক যেমন ধবল সাদা, শের শাহ’র মাথার পাগড়িও ধবল সাদা। স্বপ্নের পূর্ণাঙ্গ অর্থ—বক তার স্বভাব পরিবর্তন করেছে। অর্থাৎ শের শাহ স্বভাব পরিবর্তন করেছে। এই পরিবর্তন হবে যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে। রাজদরবারের সবাই স্বপ্নের তফসিরে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। শুধু আচার্য হরিশংকর মৌন রইলেন। সম্রাট বললেন, আচার্য হরিশংকর, আপনি চুপ করে আছেন কেন? স্বপ্নের এই ব্যাখ্যার বিষয়ে আপনার কি কিছু বলার আছে? আচার্য হরিশংকর বললেন, আমার বলার আছে। তবে আমি মৌন থাকতে চাচ্ছি। জ্ঞানীদের সামনে কথা বলার অর্থ নিজের মূর্খতা ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা। হুমায়ূন বললেন, আপনার বক্তব্য আমি শুনতে চাচ্ছি। হরিশংকর বললেন, আমি মনে করি এই বক সম্রাট নিজে। সম্রাটের অন্তর অতি পবিত্র। পবিত্রতার রঙ সাদা। বকও সাদা। বক মাছ না খেয়ে পাতা খাচ্ছে, কারণ সে কৌশল পরিবর্তন করেছে। স্বপ্নের মাধ্যমে সম্রাটকে যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন করতে বলা হচ্ছে। হুমায়ূন বললেন, আপনার ব্যাখ্যা আমি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলাম। যুদ্ধযাত্রায় আপনি আমার সঙ্গী হবেন। হরিশংকর বললেন, সম্রাট যে আদেশ করবেন তা-ই হবে। তবে আমার উপস্থিতি আপনার জন্যে অমঙ্গলস্বরূপ। আমাকে রাজধানীতে রেখে যাওয়াই আপনার জন্যে শুভ হবে। শুভদিন দেখে হুমায়ূন শের শাহকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে যুদ্ধযাত্রা করলেন। শেষ মুহুর্তে মীর্জা কামরান সরে দাঁড়ালেন। কারণ নদীর এক মাছ খেয়ে তিনি পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। বিছানা থেকে উঠে বসার ক্ষমতাও নেই। এই অবস্থায় যুদ্ধযাত্রা করা যায় না। তবে তিনি পাঁচ শ ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দিলেন। তারা কিছুদূর গিয়ে পাঞ্জাবে ফিরে এল। সম্ভবত এরকম নির্দেশই তাদের উপর ছিল। হুয়ায়ূন ভাইকে একটি চিঠি পাঠিয়ে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখলেন। চিঠিতে লেখা– ভাই কামরান, তোমার অসুখের খবর শুনে ব্যথিত বোধ করছি। আমার ব্যথা আরও প্রবল হয়েছে, কারণ শের শাহ্ নামক দস্যুর পরাজয় তুমি নিজের চোখে দেখতে পেলে না। যুদ্ধক্ষেত্রে আমি কল্পনা করে নেব তুমি আমার পাশেই আছ। কল্পনার শক্তি বাস্তবের চেয়ে কম না। আমার প্রধান ভরসা কল্পনার তুমি এবং তোপখানার দুই প্রধান উস্তাদ আহমাদ রুমী ও হোসেন খলিফা। শুধু এই দুজনই কামান দেগে শের শাহ’র বাহিনীকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে। আমি তোমার আশু রোগমুক্তি কামনা করছি। আশা করছি তুমি তোমার বিজয়ী ভ্রাতাকে অভ্যর্থ্যনা করার জন্যে তোরণ নির্মাণ করে অপেক্ষা করবে। যদি দ্রুত আরোগ্য লাভ করো, তাহলে বড়ভাইকে সাহায্য করার জন্যে কনৌজে চলে আসবে। - তোমার বড়ভাই, হুমায়ূন মীর্জা।" সম্রাট এই চিঠি সম্রাট হিসেবে লিখলেন না। ভাইয়ের কাছে ভাইয়ের চিঠি গেল। সম্রাটের সীলমোহর চিঠিতে পড়ল না। কামরান মীর্জা অসুস্থের ভান করলেন। বড় বড় হেকিমরা তার কাছে আসা-যাওয়া করতে লাগল। হেকিমরা ঘোষণা করলেন, কামরান মীর্জাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে। এই জঘন্য কাজ কে করেছে তা জানার চেষ্টা শুরু হলো। সন্দেহ অন্তঃপুরের দিকে। রাজপরিবারের নারীরা আতঙ্কে দিন কাটাতে লাগলেন। এবারের যুদ্ধে হুমায়ূন কোনো রাজপরিবারের মহিলা সদস্য নিয়ে যান নি। কামরানের আদেশে তাদের সবাইকে গৃহবন্দি করা হলো। কামরান মীর্জা বিছানায় শুয়ে শুয়েই আমীরদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করতে লাগলেন। সব আমীরকে একসঙ্গে ডেকে বৈঠক না, আলাদা আলাদা বৈঠক। এক বৈঠকে আচার্য হরিশংকরের ডাক পড়ল। তিনি দিল্লী থেকে লাহোরে এসেছেন অসুস্থ মীর্জা কামরানের শারীরিক কুশল জানার জন্যে। - মীর্জা কামরান বললেন, শুনেছি আমার বড়ভাই আপনার সূক্ষ্ম বুদ্ধি এবং জ্ঞানের একজন সমাজদার। - হরিশংকর বললেন, সম্রাট হাতি, আমি সামান্য মূষিক। - যুদ্ধক্ষেত্রে হাতি মারা পড়ে। মুষিকের কিছু হয় না। - হরিশংকর বললেন, হাতির মৃত্যুতে যায় আসে, মুষিকের মৃত্যুতে কিছু যায় আসে না বলেই মূষিকের কিছু হয় না। - আপনার কী ধারণা? সম্রাট শের শাহকে পরাজিত করতে পারবেন? - আমি কি নিৰ্ভয়ে আমার মতামত জানাব? - অবশ্যই। - সম্রাট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবেন। - কারণ? - প্রধান কারণ আপনি। আপনি না থাকায় তার মনোেবল ভেঙে গেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে মনোবলের বিরাট ভূমিকা আছে। মীর্জা কামরান বললেন, আচার্য হরিশংকর! সম্রাট বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছেন। তাঁর আছে বিশাল গোলন্দাজ বাহিনী। - শের শাহ’র কূটবুদ্ধির কাছে বিশাল গোলন্দাজ বাহিনী দাঁড়াতেই পারবে না, হুমায়ূন পরাজিত এবং নিহত হবেন। - নিহত হবেন? - প্রথমবার ভাগ্যগুণে প্ৰাণে বেঁচে গেছেন। ভাগ্য বারবার সাহায্য করে না। - সম্রাট পরাজিত হলে দিল্লীর সিংহাসনের কী হবে? - নির্ভর করছে আপনার কর্মকাণ্ডের উপর। আপনি যদি অসুস্থতার ভান করে বিছানায় শুয়ে থাকেন, তাহলে দিল্লীর সিংহাসন চলে যাবে শের শাহ’র হাতে। আর আপনি যদি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন, সৈন্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন তাহলে দিল্লীর সিংহাসন আপনার। - আপনি কি আমার উজিরদের একজন হতে রাজি আছেন? - না। - না কেন?- "যতদিন সম্রাট জীবিত ততদিনই আমি সম্রাটের অনুগত নফর। কোনো কারণে সম্রাটের প্রাণহানি হলে আমি আপনার প্রস্তাব বিবেচনা করব। তার আগে না।" আছরের নামাজের পরপর মীর্জা কামরান বিছানা ছেড়ে উঠলেন। ঘোষণা করলেন, আল্লাহপাকের অসীম করুণায় তিনি রোগমুক্ত হয়েছেন। তিনি রোগমুক্তি-স্নান করে মাগরেবের নামাজ আদায় করার প্রস্তুতি নিলেন। রোগমুক্তি উপলক্ষে রাজমহিষীরা সবাই উপহার পেলেন। যারা গৃহবন্দি ছিলেন, তাদের বন্দিদশা দূর হলো। সর্ব সাধারণের কাছে গেল। তিন হাজার রৌপ্য মুদ্রা। আমীররা খেলাত পেলেন। আচার্য হরিশংকরকে দেওয়া হলো রত্নখচিত ভোজালি।
    • বাদশাহ নামদার
  • যতই দিন যাচ্ছে মিলিটারির ওপর বঙ্গবন্ধু ততই বিরক্ত হচ্ছেন। মিলিটারি হচ্ছে দানববিশেষ। পাকিস্তানি মিলিটারি যেমন দানব, বাংলাদেশি মিলিটারিও তা-ই। সেন্টমার্টিন আইল্যান্ড যদি কোনো কারণে স্বাধীন হয়, তাদের মিলিটারি হয়, তারাও হবে দানব। বঙ্গবন্ধু পঁচিশ বছরের জন্যে ভারতের সঙ্গে দেশরক্ষা চুক্তি করেছেন। এখন আর মিলিটারির প্রয়োজন নেই। ধীরে ধীরে মিলিটারিদের ক্ষমতা খর্ব করতে হবে। এমনভাবে করতে হবে যেন এরা বুঝতেও না পারে। এক ভোরবেলা ঘুম ভেঙে এরা দেখবে, তাদের বুটের নিচে মাটি নেই। বুটের নিচে চোরাবালি। তারা ধীরে ধীরে চোরাবালিতে ডুবতে থাকবে। দানবকে মানব বানানোর এই একটাই উপায়। পাইপ হাতে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। এখন এক এক করে দর্শনার্থী বিদায় করার পালা। সেদিন তিনি যাদের সঙ্গে দেখা করলেন এবং যে ব্যবস্থা নিলেন তার তালিকা দেওয়া হলো- ১. নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগার মোজাম্মেলের আত্মীয়স্বজন: মোজাম্মেল ধরা পড়েছে মেজর নাসেরের হাতে। স্থান টঙ্গি। বঙ্গবন্ধু ঘরে ঢোকামাত্র মোজাম্মেলের বাবা ও দুই বঙ্গবন্ধুর পায়ে পড়ল। টঙ্গী আওয়ামী লীগের সভাপতিও পায়ে ধরার চেষ্টা ব পেলেন না। পা মোজাম্মেলের আত্মীয়স্বজনের চেষ্টা করলেন। পা খুঁজে বঙ্গবন্ধু বললেন, ঘটনা কী বলো? টঙ্গি আওয়ামী লীগের সভাপতি বললেন, আমাদের মোজাম্মেল মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছে। মেজর নাসের তাকে ধরেছে। নাসের বলেছে, তিন লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দিবে। মিথ্যা মামলাটা কী? মোজাম্মেলের বাবা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, খুনের মামলা লাগায়ে দিয়েছে। টঙ্গী আওয়ামী লীগের সভাপতি বললেন, এই মেজর আওয়ামী লীগ শুনলেই তারাবাতির মতো জ্বলে ওঠে। সে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে টঙ্গিতে আমি কোনো আওয়ামী লীগের বদ রাখব না। বঙ্গবন্ধু! আমি নিজেও এখন ভয়ে অস্থির। টঙ্গিতে থাকি না। ঢাকায় চলে এসেছি। (ক্রন্দন) বঙ্গবন্ধু বললেন, কান্দিস না। কান্দার মতো কিছু ঘটে নাই। আমি এখনো বেঁচে আছি। মরে যাই নাই। ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিনি মোজাম্মেলকে তাৎক্ষণিকভাবে ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন। মেজর নাসেরকে টঙ্গি থেকে সরিয়ে দেওয়ার জরুরি নির্দেশ দেওয়া হলো। মূল ঘটনা (সূত্র: Bangladesh Legacy of Blood, Anthony Mascarenhaas) এক নবদম্পতি গাড়িতে করে যাচ্ছিল। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মোজাম্মেল দলবলসহ গাড়ি আটক করে। গাড়ির ড্রাইভার ও নববিবাহিত তরুণীর স্বামীকে হত্যা করে। মেয়েটিকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে। মেয়েটির রক্তাক্ত ডেড বডি তিন দিন পর টঙ্গি ব্রিজের নিচে পাওয়া যায়। মেজর নাসেরের হাতে মোজাম্মেল ধরা পড়ার পর মোজাম্মেল বলল, ঝামেলা না করে আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাকে তিন লাখ টাকা দেব। বিষয়টা সরকারি পর্যায়ে নেবেন না। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমি ছাড়া পাব। আপনি পড়বেন বিপদে। আমি তুচ্ছ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে জড়াতে চাই না। মেজর নাসের বললেন, এটা তুচ্ছ বিষয়? মোজাম্মেল জবাব দিল না। উদাস চোখে তাকাল।-মেজর নাসের বললেন, আমি অবশ্যই তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার ব্যবস্থা করব। তোমার তিন লাখ টাকা তুমি তোমার গুহ্যদ্বারে ঢুকিয়ে রাখো।-মোজাম্মেল বলল, দেখা যাক-মোজাম্মেল ছাড়া পেয়ে মেজর নাসেরকে তার বাসায় পাকা কাঠাল খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছিল।
    • দেয়াল, পৃষ্ঠা; ৮৫, ৮৬
  • যে ঈশ্বরকে নিয়ে মানুষের এত টানাটানি তিনি অধরাই রয়ে গেলেন। তিনি আর ধরা দিলেন না। ধরাছোয়ার বাইরেই রয়ে গেলেন।
    • কাঠপেন্সিল
  • এই বাসার সবাই কেমন সুস্থ মানুষের মত আচরণ করছে। এমনটা বেশিদিন চলতে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো।
    • মিস মিলি, আজ রবিবার
  • জামিল চাচা: (নামাজ শেষে কোরআন তেলাওয়াত করার পর মতিকে বলেন) বুঝলি মতি, আল্লাহ বিশ্বজগৎকে আর মানুষকে তার ভালোবাসার কারণে সৃষ্টি করেছেন। এখন বল দেখি, ভালোবাসা বলতে তুই কি বুঝিস? মতি: ভালোবাসা হইলো স্বামী স্ত্রীর মইধ্যকার একটা লজ্জা শরমের বিষয় কিন্তু এইটার দরকার আছে। জামিল চাচা: (বজ্রাহত বিস্মিত রক্তচক্ষু অবস্থায়) মতি তুই এই মুহুর্তে আমার সামনে থেকে চলে যা... এই কে আছিস, এক বালতি পানি নিয়ে আয়, আমার মাথায় পানি ঢাল্...
    • আজ রবিবার
  • ধর্মকর্ম: (বাংলা ভাষার অতি বিচিত্র বিষয় হলো শব্দের দ্বৈততা গল্পগুজব, ফলমূল, হাসিঠাট্টা, খেলাধুলা। ধর্ম শব্দটি বেশিরভাগ সময়ই কর্মের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। সম্ভবত কর্মকে আমরা ধর্মের সমার্থক ভাবি।) আমি এসেছি অতি কঠিন গৌড়া মুসলিম পরিবেশ থেকে। আমার দাদা মাওলানা আজিমুদ্দিন আহমেদ ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক। তাঁর বাবা জাহাঙ্গির মুনশি ছিলেন পীর মানুষ। আমার দাদার বাড়ি' মৌলবিবাড়ি' নামে এখনো পরিচিত। ছোটবেলায় দেখেছি দাদার বাড়ির মূল অংশে বড় বড় পর্দা ঝুলছে। পর্দার আড়ালে থাকতেন মহিলারা। তাদের কণ্ঠস্বর পুরুষদের শোনা নিষিদ্ধ ছিল বিধায় তারা ফিসফিস করে কথা বলতেন। হাতে চুড়ি পরতেন না। চুড়ির রিনঝিন শব্দও পরপুরুষদের শোনা নিষিদ্ধ। দাদাজান বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন হাততালির মাধ্যমে। এক হাততালির অর্থ- পানি খাবেন। দুই হাততালি- পান তামাক ইত্যাদি। একবার বড় ঈদ উপলক্ষে দাদার বাড়িতে গিয়েছি। আমার বয়স ছয় কিংবা সাত। দাদাজান ডেকে পাঠালেন। বললেন, কলেমা তৈয়ব পড়। আমি বললাম, জানি না তো। দাদাজানের মুখ গম্ভীর হলো। দাদিজান আবার তাৎক্ষণিক শাস্তির পক্ষে। তিনি বললেন, পুলারে শাস্তি দেন। শাস্তি দেন। ধামড়া পুলা, কলেমা জানে না। দাদাজান বিরক্তমুখে বললেন, সে ছোট মানুষ। শাস্তি তার প্রাপ্য না। শাস্তি তার বাবা-মা'র প্রাপ্য। বাবা-মার শাস্তি হয়েছিল কি না আমি জানি না। দাদা-দাদির কাছ থেকে মুক্তি পাচ্ছি এতেই আমি খুশি। ছুটে বের হতে যাচ্ছি, দাদাজান আটকালেন। কঠিন এক নির্দেশ জারি করলেন। এই নির্দেশে আমি সব জায়গায় যেতে পারব, একটা বিশেষ বাড়িতে যেতে পারব না। এই বিশেষ বাড়িটা দাদার বাড়ি থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজের মতো দূরে। গাছপালায় ঢাকা সুন্দর বাড়ি। বাড়ির সামনে টলটলা পানির দিঘি। আমি অবাক হয়ে বললাম, ওই বাড়িতে কেন যাব না? দাদিজান সঙ্গে সঙ্গে বললেন, পুলা বেশি কথা কয়। এরে শাস্তি দেন। শাস্তি দেন। ধামড়া পুলা, মুখে মুখে কথা। দাদাজান শাস্তির দিকে গেলেন না। শীতল গলায় বললেন, ওই বাড়িতে ধর্মের নামে বেদাত হয়। ওই বাড়ি মুসলমানদের জন্যে নিষিদ্ধ। দিনের বেলা যাওয়া যাবে। সন্ধ্যার পর না। আমি ছোটচাচাকে ধরলাম যেন ওই বাড়িতে যেতে পারি। ছোটচাচা বললেন নিয়ে যাবেন। ওই বাড়ির বিষয়ে ছোটচাচার কাছ থেকে যা জানলাম তা হলো ওই বাড়ি মুসলমান বাড়ি। তবে তারা অন্যরকম মুসলমান। সন্ধ্যার পর পুরুষ মানুষরা নাচে। ঘটনা কী জানার জন্যে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই। সারাটা দিন ছটফটানির ভেতর দিয়ে গেল। সন্ধ্যা মিলাবার পর ছোটচাচার সঙ্গে ওই বাড়ির বৈঠকখানায় উপস্থিত হলাম। বাড়ির প্রধান শান্ত সৌম্য চেহারার এক বৃদ্ধ আমাকে কোলে নিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, ফয়জুরের ছেলে আসছে। ফয়জুরের বড় পুলা আসছে। এরে কিছু খাইতে দাও। সন্ধ্যার পর বৈঠকখানায় সত্যি সত্যি পুরুষদের নাচ শুরু হলো। ঘুরে ঘুরে নাচ। নাচের সঙ্গে সবাই মিলে একসঙ্গে বলছে 'আল্লাহু আল্লাহ'। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের ভেতর মক্ততা দেখা দিল। একজন অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। কেউ তাকে নিয়ে মাথা ঘামাল না। সবাই তাকে পাশ কাটিয়ে চক্রাকারে ঘুরে নাচতেই থাকল। ছোটচাচা গলা নামিয়ে আমাকে কানে কানে বললেন, একটা মাত্র পড়েছে। আরও পড়ব। বুপধাপ কইরা পড়ব। দেখ মজা। ছোটচাচার কথা শেষ হওয়ার আগেই ধুপ করে আরো একজন পড়ে গেল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তখন কিছুই বুঝিনি, এখন মনে হচ্ছে এরা কি কোনোভাবে সুফিবাদের সঙ্গে যুক্ত? ড্যান্সিং দরবেশ? এদের পোশাক সে রকম না, লুঙ্গি-গামছা পরা মানুষ। কিন্তু নৃত্যের ভঙ্গি এবং জিগির তো একই রকম। ড্যান্সিং দরবেশদের মধ্যে একসময় আবেশ তৈরি হয়। তারাও মূর্ছিত হয়ে পড়ে যান। এখানেও তো তাই হচ্ছে। সমস্যা হলো বাংলাদেশের অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুফিবাদ আসবেইবা কীভাবে? কে এনেছে? কেন এনেছে? যখন কলেজে পড়ি (১৯৬৬) তখন কিছু খোঁজখবর বের করার চেষ্টা করেছি। এই বিশেষ ধরনের আরাধনা কে প্রথম শুরু করেন? এইসব। উত্তর পাইনি। তাদের একজনের সঙ্গে কথাবার্তার নমুনা দিচ্ছি। প্রশ্ন: নাচতে নাচতে আপনি দেখলাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তখন কী হয়? উত্তর: ভাবে চইলা যাই। প্রশ্ন: কী রকম ভাব উত্তর: অন্য দুনিয়ার ভাব। প্রশ্ন: পরিষ্কার করে বলুন। উত্তর: বলতে পারব না। ভাবের বিষয়। প্রশ্ন: চোখের সামনে কিছু দেখেন? উত্তর: ভাব দেখি। উনারে দেখি। প্রশ্ন: উনারে দেখেন মানে কী? উনি কে? উত্তর: উনি ভাব। - সুফিবাদের উৎস হিসেবে ধরা হয় নবীজি (দ.)- এর সঙ্গে জিব্রাইল আলায়েস সালামের সরাসরি সাক্ষাতের হাদিস থেকে। একদিন নবীজি (দ.) বসে ছিলেন। মানুষের রূপ ধরে জিব্রাইল আলায়েস সালাম তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। তিনটি বিষয় নিয়ে কথা বললেন। একটি হলো- নিবেদন (Submission, ইসলাম), আরেকটি হলো বিশ্বাস (Faith, ঈমান), তার তৃতীয়টি হলো সুন্দর কর্মসাধন (Doing the beautiful) প্রথম দুটি ইসলাম এবং ঈমান, ধর্মের পাঁচজন্তের মধ্যে আছে। তৃতীয়টি নেই। এই তৃতীয়টি থেকেই সুফিবাদের শুরু। সুফিবাদ বিষয়ে আমার জান শুধু যে ভাসাভাসা তা নয়, ভাসাভাসার চেয়েও ভাসাভাসা। দোষ আমার না। দোষ সুফিবাদের দুর্বোধ্যতা এবং জটিলতার। সুফি সাধকদের রচনা পাঠ করেছি। তেমন কিছু বুঝিনি। পশ্চিমাদের লেখা সুফিবাদের বইগুলো জটিলতা বৃদ্ধি করেছে, কমাতে পারেনি। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে সুফিবাদ বলছে 'I was Hidden Treasure, so I loved to be known. Hence I created the creatures that I might be known. [আমি ছিলাম লুকানো রত্ন। নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছা হলো। আমি সৃষ্টি করলাম যাতে প্রকাশিত হই।] সুফিবাদের একটি ধারণা হলো সৃষ্টিকর্তা মানুষকে করুণা করেন এবং ভালোবাসেন। মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসতে পারবে কিন্তু করুণা করতে পারবে না। ভালোবাসা দু' দিকেই চলাচল করতে সক্ষম, করুণার গতি শুধুই একমুখী। একইভাবে মানুষ পশুপাখিকে ভালোবাসতে পারবে, করুণা করতে পারবে। পশুপাখি মানুষকে ভালোবাসতে পারবে। করুণা করতে পারবে না। রিয়েলিটি বা বাস্তবতা নিয়ে সুফিদের অনেক বিশুদ্ধ চিন্তা আছে। তাদের চিন্তার সঙ্গে আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তার কিছু মিল আছে। সুফিরা বলেন, আমাদের দৃশ্যমান জগৎ অবাস্তব। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই বাস্তব। সুফিরা বলেন, সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমে আমরা দেখি, সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমেই আমরা শুনি। সুফিদের আরাধনার মূল বিষয়টি আমার পছন্দের। তাঁরা প্রার্থনা করেন- 'Show me the things as they are. [বস্তুগুলো যে- রকম আমাকে সে- রকম দেখাও। তাঁদের প্রার্থনার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, আমরা বস্তুগুলো যে-রকম দেখছি আসলে সে-রকম না। জববষরঃ র সমস্যা চলে আসছে। মূসা (আঃ)- এর সঙ্গে আল্লাহপাকের সাক্ষাতের ঘটনার সুফি ব্যাখ্যা আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে। পাঠকদের সঙ্গে সুফি ব্যাখ্যা ভাগাভাগি করতে চাচ্ছি। তুর পর্বতের সামনে এই সাক্ষাতের ঘটনা ঘটে। তুর পর্বত কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে মুসা (আ.) মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুফি ব্যাখ্যা হলো, একমাত্র আল্লাহ বাস্তব আর সবই অবাস্তব। কাজেই বাস্তব আল্লাহর উপস্থিতিতে অবাস্তব পাহাড় মিলিয়ে গেল। আমি কি ধর্মকর্ম বিষয়টা যথেষ্ট জটিল করার চেষ্টা চালাচ্ছি? মনে হয় তাই। সহজিয়া ধারায় চলে আসা যাক। সুফিদের কথা বাদ। নিজের কথা বলি। ধর্ম নিয়ে আমার আগ্রহ খানিকটা আছে। সিলেট যাব, হজরত শাহজালাল (র.) এর মাজারে কিছু সময় কাটাব না তা কখনো হবে না। রাজশাহী যাওয়া মানেই নিশিরাতে শাহ মখদুমের মাজার শরীফে উপস্থিত হওয়া। পাঠকদের হজরত শাহ মখদুম সম্পর্কে একটি অন্যরকম তথ্য দিই। তাঁর জীবনী লেখা হয় ফারসি ভাষাতে। মোগল সম্রাট হুমায়ুনের আদেশে এই জীবনী ফারসি থেকে বাংলা তরজমা করা হয়। এই বাংলা তরজমা আদি বাংলা গদ্যের নিদর্শন হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রদের পাঠ্য ছিল। বইটি একসময় বাংলাদেশ বুক কর্পোরেশন প্রকাশ করেছিল। আমার কাছে একটি কপি ছিল। বিটিভির নওয়াজেশ আলী খান পড়তে নিয়ে ফেরত দেননি। বইটির দ্বিতীয় কপি জোগাড় করতে পারিনি। (ফাউন্টেনপেন লেখায় যাঁরা আমার সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো নিয়ে ফেরত দেননি তাদের নাম প্রকাশ করা হবে। কাজেই সাবধান। আমার আরেকটি প্রিয় গ্রন্থ মিসরের গভর্নরকে লেখা হজরত আলীর চিঠি কালের কন্ঠের সম্পাদক আবেদ খান পাঁচ বছর আগে নিয়েছেন। এখনো ফেরত দেননি।) পূর্বকথায় ফিরে যাই। আমি যে শুধু ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের মাজারে যাই তা কিন্তু না। যে-কোনো ধর্মের তীর্থস্থানগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ। এই আগ্রহ নিয়েই পাবনা শহরে অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমে একদিন উপস্থিত হলাম। ইনি কথাশিল্পী শীর্ষেন্দুর ঠাকুর। তাঁর প্রতিটি বইতেই থাকবে র:স্থা যা অনুকূল ঠাকুরের সঙ্গে সম্পর্কিত। শীর্ষেন্দুর জবানিতে_একসময় তিনি জীবন সম্পর্কে পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আত্মহননের কথা চিন্তা করছিলেন। তখন অনুকুল ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। অনুকূল ঠাকুর হাত দিয়ে শীর্ষেন্দুকে স্পর্শ করা মাত্র কিন্তু একটা ঘটে গেল। শীর্ষেন্দু জীবনের প্রতি মমতা ফিরে পেলেন। তাঁর লেখালেখির শুরুও এরপ থেকেই। অনুকুল ঠাকুরের আশ্রমের সেবায়েতরা আমাকে যথেষ্ট খাতির-যত্ন করলেন। দুপুরে তাদের সঙ্গে খাবার খেলাম। আশ্রমের প্রধান অনুকূল ঠাকুরের বিশাল এক তৈলচিত্রের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মুগ্ধ গলায় বললেন, ঠাকুরের রহস্যটা একটু দেখুন স্যার। আপনি যেখানেই দাঁড়ান না কেন মনে হবে ঠাকুর আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। উত্তরে দাঁড়ান কিংবা পুবে দাঁড়ান, ঠাকুরের দৃষ্টি আপনার দিকে। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, সরাসরি ক্যামেরা লেন্সের দিকে তাকিয়ে আপনি যদি একটি ছবি তোলেন সেই ছবিতেও একই ব্যাপার হবে। সবকিছুতে মহিমা আরোপ না করাই ভালো। সেবায়েত আমার কথায় মন খারাপ করলেও বিষয়টি স্বীকার করলেন। অনেক বছর আগে নেপালে হনুমানজির মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে ঢুকতে দেওয়া হলো না। হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া সেখানে কেউ যেতে পারবে না। মন্দিরের একজন সেবায়েতের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো মানুষটা বুদ্ধিমান। আমি তাঁকে কাছে ডেকে বললাম, ভাই, মন্দিরের কাছে কিছু কুকুর খেতে পাচ্ছি। ওরা মন্দিরের চারপাশে ঘুরতে পারবে, তার আমি মানুষ হয়ে যেতে পারব না। এটা কি ঠিক? তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। আমি অবশ্যি শেষ পর্যন্ত যাইনি। কেন জানি হঠাৎ করে মন ওঠে গেল। আমাদের অতি পবিত্র স্থান মক্কা শরীফে অমুসলমানদের দেওয়া হয় না। আমাদের নবীজি (দ.)- এর জীবদ্দশায় অনেক অমুসলমান সেখানে বাস করতেন। কাবার কাছে যেতেন। তাদের ওপর কোনোরকম বিধিনিষেধ ছিল বলে আমি বইপত্রে পড়িনি। ধর্ম আমাদের উদার করবে। অনুদার করবে কেন? পাদটীকা: প্রশ্ন: মুসলমান মাত্রই বেতের নামাজের কথা জানেন। তিন রাকাত নামাজ। বেতের শব্দের অর্থ বেজোড়। এক একটি বেজোড় সংখ্যা। এক রাকাতের নামাজ কি পড়া যায়? উত্তর: হ্যাঁ যায়। (আমি মনগড়া কথা বলছি না। জেনেশুনেই বলছি।)
    • ফাউন্টেনপেন, ৭-১০
  • পবিত্র কোরান শরিফে সূরা তাকবীরে জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যা বিষয়ে আয়াত নাজেল হলো। কেয়ামতের বর্ণনা দিতে দিতে পরম করুণাময় বললেন- "সূর্য যখন তার প্রভা হারাবে, যখন নক্ষত্র খসে পড়বে, পর্বতমালা অপসারিত হবে। যখন পূর্ণ গর্ভা উষ্ট্রী উপেক্ষিত হবে, যখন বন্যপশুরা একত্রিত হবে, যখন সমুদ্র স্ফীত হবে, দেহে যখন আত্মা পুনঃসংযোজিত হবে, তখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাস করা হবে-কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?" যে মহামানব করুণাময়ের এই বাণী আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন, আমি এক অকৃতী তাঁর জীবনী আপনাদের জন্যে লেখার বাসনা করেছি। সব মানুষের পিতৃঋণ-মাতৃঋণ থাকে। নবীজির কাছেও আমাদের ঋণ আছে। সেই বিপুল ঋণ শোধের অতি অক্ষম চেষ্টা। ভুলভ্রান্তি যদি কিছু করে ফেলি তার জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি পরম করুণাময়ের কাছে। তিনি তো ক্ষমা করার জন্যেই আছেন। ক্ষমা প্রার্থনা করছি নবীজির কাছেও। তাঁর কাছেও আছে ক্ষমার অথৈ সাগর।
    • নবীজি, লীলাবতীর মৃত্যু

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]