অরণ্য
অবয়ব
অরণ্য বা বন বা জঙ্গল হলো ঘন বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদের দ্বারা ঘেরা একটি এলাকা। অরণ্য অনেক প্রাণীর লালনক্ষেত্র হিসেবে যেমন কাজ করে তেমনি আবার বিভিন্ন নদী-নালার পথ পরিবর্তন, মাটি সংরক্ষণের কাজও করে। পৃথিবীর জীবমণ্ডলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো অরণ্য।
উক্তি
[সম্পাদনা]- অরণ্য কয়, ওগো বাতাস, নাহি জানি বুঝি কি নাই বুঝি
তোমার ভাষায় কাহার চরণ পূজি।
বাতাস বলে, হে অরণ্য, আমার ভাষা বোঝো বা নাই বোঝো,
আমি জানি কাহার মিলন খোঁজো;
সেই বসন্ত এলো পথে, আমি কেবল সুর জাগাতে পারি
তাহার পূর্ণতারি॥- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাতাস কবিতা, পূরবী- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩২ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১০১
- মৃগ অন্বেষণে ইতস্ততঃ বিস্তর ভ্রমণ পূর্ব্বক, পরিশেষে, গভীর অরণ্যে প্রবেশ করিয়া, তিনি বয়স্যগণের সঙ্গভ্রষ্ট হইলেন। সায়ংকাল উপস্থিত হইল। তখন সে ব্যক্তি, কোন্ পথে গেলে, অরণ্য হইতে বহির্গত হইয়া, লোকালয়ে উপস্থিত হইতে পারিবেন, তাহার কিছুই নির্ণয় করিতে পারিলেন না, বয়স্যগণের নাম নির্দেশে করিয়া, উচ্চৈঃস্বরে বারংবার আহ্বান করিতে লাগিলেন, কিন্তু কাহারও উত্তর পাইলেন না।
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বর্ব্বরজাতির সৌজন্য, আখ্যানমঞ্জরী (প্রথম ভাগ) - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশক-শ্রীকার্ত্তিক চন্দ্র দে, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫৮
- অতি বিস্তৃত অরণ্য। অরণ্যমধ্যে অধিকাংশ বৃক্ষই শাল, কিন্তু তদ্ভিন্ন আরও অনেকজাতীয় গাছ আছে। গাছের মাথায় মাথায় পাতায় পাতায় মিশামিশি হইয়া অনন্ত শ্রেণী চলিয়াছে।
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আনন্দমঠ (দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রকাশক- শ্রীউমাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকাশস্থান- চুঁচুড়া, প্রকাশসাল- ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ (১২৯০ বঙ্গাব্দ),পৃষ্ঠা ১
- অ-র-ণ্য এই কটা অক্ষর জুড়ে দিলেই মূর্তিমান অরণ্যটা আমাদের চোখ দিয়ে সাঁ করে গিয়ে আজকাল প্রবেশ করে মনে, কিন্তু ভাষা যখন অক্ষরমূর্তি ধরেনি, শব্দমূর্তি দৃশ্যমূর্তিতে চলেছে তখন দেখি শুধু অরণ্য এইটে বাচন মাত্র করে দিয়েই ঋষির ভাষা স্তব্ধ হচ্ছে না, কিন্তু ছন্দে সুরে, অরণ্যের ভাষা শব্দ আর নানা রহস্য ধরে ধরে তবে অরণ্যের সত্তা আবিষ্কার কর্তে কর্তে চলেছে ঋষির ভাষা জিজ্ঞাসা আর বিস্ময়ের ভিতর দিয়ে—
- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিল্প ও ভাষা, বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৬২-৬৩
- প্রশস্ত বালুতটের প্রান্তে বড়ো বড়ো ঝাউগাছের অরণ্য; এই অরণ্যের এক সীমায় কালানদী নামে এক ক্ষুদ্র নদী তাহার দুই গিরিবন্ধুর উপকূলরেখার মাঝখান দিয়া সমুদ্রে আসিয়া মিশিয়াছে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কারোয়ার, জীবন-স্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৪৫
- অরণ্যের এই মহা-নিস্তব্ধতার মধ্যে, নৈশজীবনের স্পন্দন ও বিকাশ বেশ অনুভব করা যায়। এই অরণ্য কত শত মৃগের বিচরণভূমি;কেহ বা শত্রুভয়ে সতর্ক হইয়া চারি দিক নিরীক্ষণ করিতেছে, কেহ বা আহার-অন্বেষণে প্রবৃত্ত। একটু ছায়া নড়িলেই না জানি কত মৃগের কান খাড়া হইয়া উঠে—কত মৃগের চক্ষু-তারা বিস্ফারিত হয়।* * * এই রহস্যময় বনপথটি বরাবর সিধা চলিয়াছে; ইহা ম্লান ধূসরবর্ণ, আর ইহার দুইধারে কৃষ্ণবর্ণ তরু-প্রাচীর। উহার সম্মুখে, পশ্চাতে, চতুর্দ্দিকে যোজন-ব্যাপী দুর্ভেদ্য জটিল শাখাজাল বিস্তৃত হইয়া অরণ্য-ভূমিকে কিরূপ পীড়ন করিতেছে, তাহা সহজেই অনুমান করা যায়।
- পিয়ের-লোটি, সিংহলে, ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ, পিয়ের-লোটির ফরাসী থেকে অনুবাদ, অনুবাদক- জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১০
- যে ব্যক্তি আশাকে দাসী করিয়া সকল ক্লেশের মস্তকে পদার্পণ করিয়াছে তাহারই জীবন সার্থক এবং যদি সংসারে কেহ সুখী থাকে তবে সে ব্যক্তিই যথার্থ সুখী। অতএব অদ্যই আমি সংসারাশ্রমে জলাঞ্জলি দিয়া অরণ্যে গিয়া জগদীশ্বরের আরাধনায় প্রবৃত্ত হইব। এই নিশ্চয় করিয়া চিরঞ্জীব মিথিলা পরিত্যাগপূর্ব্বক অরণ্য প্রবেশ করিল।
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অষ্টম উপাখ্যান, বেতালপঞ্চবিংশতি - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নবম সংস্করণ, প্রকাশক- সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ (১২৭৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫
- সকলে মিলিয়া আনন্দ-রব করিতে করিতে শিকারে গমন করিল। অরণ্যে প্রবেশ করিয়া গাছের ডাল ভাঙ্গিয়া, পাতা ছিঁড়িয়া, পাখী মারিয়া, পশু মারিয়া, ভয়বিহ্বল পলাতক পশুদিগের পশ্চাৎধাবিত হইয়া অরণ্য তোলপাড় করিতে লাগিল। এই সুপ্রভাতে অরণ্যবাসী নিরীহ পশু পক্ষীদিগের আকুল ক্রন্দন আর শিকারীদিগের পৈশাচিক উন্মত্ত চীৎকার ধ্বনি যতদুর গেল—বিদীর্ণ করিয়া তুলিল, কেবল মতি অরণ্য মহাকালের মত উদাস ভাবে এই সুখ দুঃখের প্রতি অবিচলিত দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল, —তাহার প্রাণে সে হাসি কান্না বিন্দুমাত্র স্পর্শ করিল না।
- স্বর্ণকুমারী দেবী, মিবাররাজ, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, মিবাররাজ-স্বর্ণকুমারী দেবী, মুদ্রক- আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্র, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ (১২৯৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪-৫
- পাহাড়ের উপর বিজয়গড়। বিজয়গড়ের অরণ্য গড়ের কাছাকাছি গিয়া শেষ হইয়াছে। অরণ্য হইতে বাহির হইয়া রঘুপতি সহসা দেখিলেন, দীর্ঘ পাষাণদুর্গ যেন নীল আকাশে হেলান দিয়া দাঁড়াইয়া আছে। অরণ্য যেমন তাহার সহস্র তরুজালে প্রচ্ছন্ন, দুর্গ, তেমনি আপনার পাষাণের মধ্যে আপনি রুদ্ধ। অরণ্য সাবধানী, দুর্গ সতর্ক। অরণ্য ব্যাঘ্রের মতো গুঁড়ি মারিয়া লেজ পাকাইয়া বসিয়া আছে, দুর্গ সিংহের মতো কেশর ফুলাইয়া ঘাড় বাঁকাইয়া দাঁড়াইয়া আছে। অরণ্য মাটিতে কান পাতিয়া শুনিতেছে, দুর্গ আকাশে মাথা তুলিয়া দেখিতেছে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজর্ষি, একবিংশ পরিচ্ছেদ, রাজর্ষি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৮ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৭৫
- চিন্তাভারাক্রান্ত মনকে শান্তি দান করিতেই যেন, সুদৃশ্য ভাগীরথীর তীরে আগমন করিলেন। সেখানে আসিয়া দেখিলেন— পরপারেই সেই অরণ্য। সেই বনদেবীর বাসস্থান। পূর্ব্বদিনের স্মৃতি জ্বলন্তভাবে তাঁহাকে অভিভূত করিয়া ফেলিল। ভাবিতে ভাবিতে তিনি যে পুনরায় সেই অরণ্যের দিকেই চলিতেছেন—তাহা নিজেই বুঝিতে পারিলেন না। অজ্ঞাত তাড়িতশক্তির প্রভাবেই যেন পদে পদে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। অরণ্যে আসিয়া তাঁহার চমক ভাঙ্গিল,—কিন্তু তখন আর ফিরিয়া যাইতে পা উঠিল না—
- স্বর্ণকুমারী দেবী, ছিন্নমুকুল, চতুর্থ পরিচ্ছেদ, ছিন্নমুকুল-স্বর্ণকুমারী দেবী, চতুর্থ সংস্করণ, প্রকাশক- কান্তিক প্রেস, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩২০ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২১
- আর মনে ক'রো আকাশে আছে এক ধ্রুব নক্ষত্র
নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ,
অরণ্যের মর্মরধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা,
আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন।- সুকান্ত ভট্টাচার্য, ঐতিহাসিক, ছাড়পত্র- সুকান্ত ভট্টাচার্য, প্রকাশক- সারস্বত লাইব্রেরী, কলিকাতা, পুনর্মুদ্রণ- জ্যৈষ্ঠ ১৩৬২, পৃষ্ঠা ৫৪
- তরুণ যুগের মানুষহীন পৃথিবীতে পঙ্কস্তরের উপর যে অরণ্য ছিল বিস্তৃত সেই অরণ্য বহুলক্ষ বৎসর ধরে প্রতিদিন সূর্যতেজ সঞ্চয় করে এসেছে আপন বৃক্ষরাজির মজ্জায়। সেই-সব অরণ্য ভূগর্ভে তলিয়ে গিয়ে রূপান্তরিত অবস্থায় বহুযুগ প্রচ্ছন্ন ছিল। সেই পাতালের দ্বার যেদিন উদঘাটিত হল, অকস্মাৎ মানুষ শত শত বৎসরের অব্যবহৃত সূর্যতেজকে পাথুরে কয়লার আকারে লাভ করল আপন কাজে; তখনই নূতন বল নিয়ে বিশ্ববিজয়ী আধুনিক যুগ দেখা দিল।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নারী, কালান্তর - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক- বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, প্রকাশসাল- ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ (১৪২৫ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৬৮
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]উইকিপিডিয়ায় অরণ্য সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।
উইকিঅভিধানে অরণ্য শব্দটি খুঁজুন।