অরূপরতন ভট্টাচার্য

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে

অরূপরতন ভট্টাচার্য ( ১৯৩৭ - ২ মে, ২০১৩) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি গণিতজ্ঞ। [১] ঊনিশ-বিশ শতকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার যে ধারাটি গড়ে উঠেছিল, সেই ধারার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন তিনি। সহজ সরল ভাষায় নাটকীয় উপস্থাপনায় বিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য কাণ্ড কারখানা তুলে ধরতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। [২]

অরূপরতন ভট্টাচার্যের জন্ম অবিভক্ত বাংলার অধুনা পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর শহরের চিড়িয়াসাই এর প্রখ্যাত পণ্ডিত বংশে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু অধ্যাপক বিজনবিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন তার পিতা। গণিতের অধ্যাপক হিসাবে অরূপরতন কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতার আনন্দমোহন কলেজে। সহকর্মী ছিলেন প্রখ্যাত রবীন্দ্র জীবনীকার অধ্যাপক প্রশান্তকুমার পাল। তারই অনুপ্রেরণায় তিনি বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচনায় উদ্যোগী হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশু কিশোরদের বিজ্ঞান পরিচয়ে বিশ্ব পরিচয় গ্রন্থের পাঠান্তর সংবলিত সংস্করণ নির্মাণ ও জগদানন্দ রায়ের বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার সম্পাদনা করেছেন তিনি। প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানের ইতিহাস ও জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার উপর রচিত প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রন্থটির জন্য খ্যাতি লাভ করেন। আনন্দ বাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর ছোটদের পত্রিকা আনন্দমেলা'র নিয়মিত লেখকও ছিলেন এবং পঞ্চাশটির ও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি রচিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল -বাঙালির বিজ্ঞান ভাবনা ও সাধনা, ম্যাথামেটিক্স কুইজ, সংখ্যার অসংখ্য খেলা, অঙ্ক নিয়ে বুদ্ধি বিচার, রম্য গণিত, ধাঁধা নিয়ে মজার খেলা, বৈঠকি ধাঁধার খেলা, চেতনার সন্ধানে বিজ্ঞান, সেকালে এদেশে বিজ্ঞানচর্চা, রোবট এশিয়া কেমন করে, বিজ্ঞানের রকমফের, অণুপরমাণুর দেশে, আকাশ চেনো, বিজ্ঞানের আলোকে চেতনা ইত্যাদি।

উক্তি[সম্পাদনা]

  • কখনো সন্ধের আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছো? সূর্য অস্ত যাবার পরে অন্ধকার যখন একটু ঘন হয়ে আসে তখন নীল আকাশে তারা ফুটতে শুরু করে। প্রথমে এক, দুই, তিন, হাতে গোনা চলে, তারপর রাত্রির জমাট কালো রূপটি যখন তার ধরে, তখন সমস্ত আকাশ জুড়ে অসংখ্য তারার মেলা বসে যায়। এ সেই গ্রামের হাটের মত। যারা বড় বড় দোকানী, তারা গরুর গাড়ীতে আপন আপন পশরা নিয়ে এল সকাল সকাল—তাদের কাজ অনেক, খুঁটি বাঁধা, দোকান সাজানো ৷ আর যারা ছোট, যাদের পশরা কম, তারা এল অনেক পরে হাতে লাঠি, মাথায় চুপড়ী চাপিয়ে। ফাঁকা জায়গা দেখল, টুপ করে বসে পড়ল সেখানে। আকাশেও তাই, যারা বড়, যারা বেশি উজ্জ্বল, তারা আসে আগে, আকাশে তাদের আমরা প্রথমে দেখতে পাই, যারা ম্লান বা ছোট, লজ্জায়, সঙ্কোচে তারা যেন চলে পিছু পিছু, অনেক উজ্জ্বল তারা ফুটবার পরে সেগুলি আমাদের চোখে ধরা পড়ে ৷
  • সে আজকের কথা নয় ৷ প্রাচীন কালে বিভিন্ন দেশের কৌতূহলী মানুষেরা মহাকাশের এই সব তারাদের নিয়ে বিভিন্ন মূর্তির কল্পনা করেছিলেন ৷এদের মধ্যে মানুষের আকৃতি আছে, আছে জঙ্গলের জীবজন্তু আর আছে প্রাণ নেই এমন কিছু চেনা-জানা বস্তু ।
  • বিভিন্ন মাসের সন্ধের আকাশ তোমরা যদি নিয়মিত লক্ষ্য কর তাহলে সে যুগের মানুষের কল্পনায়-আঁকা সবগুলি আকৃতিই তোমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়বে। তারায় তারায় কল্পিত বলে এক একটি তারকামণ্ডল হিসেবে এদের পরিচয় ৷
  • প্রাচীনকালে যত তারকামণ্ডলের কল্পনা তাদের মধ্যে একটি, নামে না চিনলেও, উজ্জ্বল তারকায় এমন সুন্দরভাবে এটি গঠন করা হয়েছে যে কারোরই দৃষ্টি এড়ায় না ৷
  • সূর্য অস্ত গেলে তারাদের রাজত্ব । সে যুগে পথ চলতে রেল-স্টিমার নেই ৷ উড়ো- জাহাজ নেই । মাঠ-ঘাট-প্রান্তর অতিক্রম করে পথ চলার সময়ে নিশানা ঠিক রাখা দরকার। রাত্রির অন্ধকারে সে নিশানা দিল ধ্রুবতারা। সে স্থির আর আছে সে উত্তর দিকে। ফলে রাত্রির অন্ধকারে মানুষের পথ চলার সে হয়ে দাঁড়াল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী৷
  • আকাশে যখন তোমরা বিভিন্ন তারা আর তারকামণ্ডল লক্ষ্য করবে তখন একটা কথা সকলে মনে রেখো । শীতকাল হচ্ছে আকাশ দেখবার সবচেয়ে অনুকূল সময় । তখন আকাশে মেঘের আনাগোনা নেই । ঝড়, বাদলের উৎপাত নেই, আকাশ স্বচ্ছ, নির্মল, সে সময়ে মহাকাশ তারকার মেলার পরিপূর্ণ রূপটি নিয়ে আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। তারা-ফোটা আকাশ যেমনভাবে দেখতে পাবে, তেমন আর অন্য সময়ে নয়।
  • আকাশে যত তারকা আর তারকামণ্ডল তাদের নিয়ে অনেক বিচিত্র কাহিনী ছড়িয়ে

আছে। রাজা-মহারাজা আর মুনি-ঋষিদের কাহিনী সে সব।

  • সে এমন একটা যুগ যে যুগে ঘড়ি ছিল না, ক্যালেণ্ডার ছিল না, পঞ্জিকা ছিল না । দিন যাচ্ছে, মাস পার হচ্ছে, বছর ঘুরে আসছে—ঋতুরাও চলেছে সঙ্গে সঙ্গে—গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত ৷ আসছে, বিদায় নিচ্ছে । আমাদের পূর্বপুরুষেরা দিনের বিভিন্ন প্রহর জানতেন সূর্যের সাহায্য নিয়ে । সূর্য যখন মাথার উপরে বা মাঝ আকাশের কাছাকাছি তখন মধ্যাহ্ন কাল বা দুপুরবেলা ৷ সূর্য উঠছে পূর্ব আকাশে, তখন ভোরবেলা । আর সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্তে নামছে, সে সময় সন্ধ্যা কাল, রাত্রির সূচনা তখন।
  • দুর্গা পূজা শরৎকালে। কিন্তু সেটাই তো সবচেয়ে বড় খবর নয়। পূজার আয়োজন তার অনেক আগেই । এ যুগের মত সে যুগে নিশ্চয়ই পূজার বিল বই ছাপান হত না৷ সড়কের মোড়ে সার্বজনীন দুর্গোৎসবের ছাপ মারা দড়ি বাঁধা লাল শালু ঝুলত না। তবু বর্ষা শেষ, শরৎ আসছে, পূজার সময় এল বলে, এ খবরটা যে জরুরী তা তো অস্বীকার করা যায় না।
  • সূর্য, চন্দ্রকে তোমরা সবাই দেখো, চলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। দিনের বেলায় সূর্যের উদয় পূর্ব আকাশে, তারপর সারাদিন পশ্চিম দিকে এক পা এক পা করে হেঁটে সন্ধ্যা বেলায় তার পশ্চিম দিগন্তে ডুব দেওয়া ৷ চন্দ্রের উদয়-অস্ত সূর্যের মত অত নিয়ম ধরে নয়৷ কিন্তু তাকেও দেখা যায়, চলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছো তোমরা—তার পূর্ণ আকারটি নিয়ে সে পূর্বের আকাশে উঠে আসে সন্ধ্যাবেলায় তারপর সারারাত ধরে তার পশ্চিমে অভিযান—তাই মাঝরাতে সে মাথার উপরে আর রাতের শেষে সে থাকে পশ্চিম আকাশে, পশ্চিম দিগন্তের কাছাকাছি।
  • চন্দ্র সূর্যের পূর্ব থেকে পশ্চিমের, চোখে দেখা এই গতি ছাড়া মহাকাশে তারকাদের পট- ভূমিতে আরও এক রকমের গতি আছে। পূর্ব থেকে পশ্চিমের গতি এটি নয়—এ হল ঠিক তার উল্টো, পশ্চিম থেকে পূর্বের গতি।
  • সেই প্রাচীন যুগের মানুষেরা লক্ষ্য করেছিলেন চন্দ্র এক এক মাসে এক একটি নির্দিষ্ট নক্ষত্রের পটভূমিতে তার পূর্ণিমা পালন করে ! অর্থাৎ একটি পূর্ণচন্দ্র একটি নির্দিষ্ট নক্ষত্রে। কাল নির্ণয়ের পক্ষে সেইটুকুই যথেষ্ট । মাসের নামগুলিও এলো ওই বিশেষ বিশেষ নক্ষত্রের নাম থেকে। অশ্বিনী নক্ষত্র চান্দ্র পথের প্রথম নক্ষত্র । দেখা গেল যে, একটি নির্দিষ্ট মাসে চন্দ্রের পূর্ণিমা ওই নক্ষত্রের পটভূমিতে। জ্যোতিষীরা সেই মাসটির নাম দিলেন আশ্বিন মাস। বারোটি মাসের নামই এল এ ভাবে । কৃতিকা থেকে কার্তিক মাস ৷ বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ মাস ৷


বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]