বিষয়বস্তুতে চলুন

ঝিলিমিলি (নাট্যগ্রন্থ)

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে

ঝিলিমিলি প্রখ্যাত সাহিত্যিক কাজী নজরুল ইসলাম রচিত প্রথম নাট্যগ্রন্থ। এই নাট্যগ্রন্থটি ১৯৩০ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এতে ঝিলিমিলি, সেতুবন্ধ ও শিল্পী নামে তিনটি ছোট নাটক আছে।

সংলাপ

[সম্পাদনা]

গান

হৃদয় যত নিষেধ হানে নয়ন ততই কাঁদে।
দূরে যত পলাতে চাই, নিকট ততই বাঁধে॥
স্বপন-শেষে বিদায়-বেলায়
অলক কাহার জড়ায় গো পায়,
বিধুর কপোল স্মরণ আনায়
ভোরের করুণ চাঁদে॥
বাহির আমার পিছল হল কাহার চোখের জলে।
স্মরণ ততই বারণ জানায় চরণ যত চলে।
পার হতে চাই মরণ-নদী
দাঁড়ায় কে গো দুয়ার রোধি,
আমায় – ওগো বে-দরদি –
ফেলিলে কোন্ ফাঁদে॥

.........


ফিরোজা : এ আমরা কোথায় এসেছি, হাবিব?
হাবিব : (হাসিয়া) ছি, নাম ধরে ডাকতে নেই এখানে! এখানে আসতে হয় নাম ছারিয়ে, সকল নামের দিশা ছড়িয়ে। এখানে হাবিবও আসতে পারে না, ফিরোজাও আসতে পারে না।
ফিরোজা : তবে যে আমরা এসেছি।
হাবিব : একবার চাঁদের জ্যোৎস্না-মুকুরে ভালো করে নিজের মুখ দেখো দেখি।
ফিরোজা : (সভয়ে) এ কী, আমি যে আমায় চিনতে পারছিনে! এ আমি কে?
হাবিব : (হাসিয়া) কার মতো বোধ হয়?
ফিরোজা : এ যেন – এ যেন সকলের মুখ! এ যেন শকুন্তলার, এ যেন মালবিকার, এ যেন মহাশ্বেতার মুখ! এ যেন লায়লির, এ যেন শিরীর মুখ!
হাবিব : সত্যিই তাই, তোমার মুখে আজ নিখিল-বিরহিণী ভিড় করেছে। এখানে আসতে হয় শুধু ‘প্রিয়’ আর ‘প্রিয়া’ হয়ে। এখানে নর-নারী অ-নামিক। এ লোকে নর-নারীর পরিচয়-সংকেত ‘প্রিয়’ আর ‘প্রিয়া’। এখানে ডাকতে হয় শুধু ‘প্রিয়তম’ বলে।
ফিরোজা : (লজ্জায় রাঙিয়া উঠিল, চাঁদকে ঘিরিয়া রামধনুর সাত-রঙা শোভা বিজলির মতো খেলিয়া গেল!) যাও! (কানে কানে) চকোর-চকোরী শুনতে পাবে যে!
হাবিব : শুনুক। ধরায় আমাদের যে কথা কানাকানি হয়ে আছে, তারায় তারায় আজ তারই জানাজানির হুল্লোড় পড়ে গেছে। দেখছ না প্রিয়তম! কত নব নব তারা জন্ম লাভ করল সৃষ্টির নীহারিকা-লোকে, শুধু ওই কানে-কথাটি শুনবার লোভে। ওই কানে-কথা শুনবে বলেই তো চন্দ্রলোকে এত চকোর-চকোরীর ভিড়!
ফিরোজা : এ কোন লোক, প্রিয়তম? (চাঁদ দুলিয়া উঠিল)
হাবিব : দেখলে? চাঁদ দুলে উঠল তোমার ‘প্রিয়তম’ ডাকের নেশায়! …এ স্বপ্ন-লোক।
ফিরোজা : স্বপ্ন-লোক! তাহলে এ-স্বপ্ন টুটে যাবে? আবার তোমায় হারাব?
হাবিব : হয়তো হারাবে, হয়তো হারাবে না; জানিনে। তো … এ স্বপ্ন-লোক এত ক্ষণিক বলেই এত সুন্দর।…না, না, এ স্বপ্ন-লোক চিরদিনের, এ সুন্দরের আকাঙ্ক্ষা-লোক, এর কি মৃত্যু আছে? এর কি শেষ আছে?
ফিরোজা : তবে ভয় হয় কেন? এখনই এর শেষ হয়ে যাবে মনে করে?
হাবিব : ওই শেষের ভয় – ওই হারাবার ভয় আছে বলেই এত মধুর এ-লোক। তাই তো এমন জড়িয়ে ধরে আছি পরস্পরকে। চোখের পাতা ফেললেই এ স্বপ্ন টুটে যাবে ভয়েই তো এমন পলক-হারা হয়ে চোখে চোখে চেয়ে থাকি। ওই হারাবার ভয়েই তো চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-নক্ষত্র এমন বিপুল আবেগে পরস্পর পরস্পরের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না – পায়ে পায়ে ঘুরে ফিরছে।
ফিরোজা : তাহলে এই বেহেশ্‌ত?
হাবিব : এই বেহেশ্‌ত।
ফিরোজা : তাহলে আর যারা বেহেশ্‌তে এসেছে তারা কই? শিরী, লায়লি, জুলেখা? আর ফরহাদ, মজনু, ইউসুফ?
হাবিব : আমাকে ভালো করে দেখো দেখি।
ফিরোজা : (সভয়ে হাবিবকে জড়াইয়া ধরিল) ওগো, একী! তোমার এত বিপুলতা আমি সইতে পারব না। তুমি যেন নিখিল-পুরুষ, তুমি যেন অনন্তকাল ধরে কাঁদছ।
হাবিব : (হাসিয়া ফিরোজার কপোলে তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলি দিয়া মৃদু আঘাত করিতে লাগিল) ভয় নেই, প্রিয়তম! আর একবার দেখো, তুমি যাকে দেখতে চাইবে তাকেই দেখতে পাবে আমার মুখে।
ফিরোজা : (তাকাইয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিল) আচ্ছা বেহেশ্‌তের হুরপরি কই?
হাবিব : তুমি ইচ্ছা করলেই তারা আসবে। এখানে বাসনা দিয়ে তাদের সৃজন করতে হয়।
ফিরোজা : তারাও সব তাহলে আমাদের মধ্যে?
হাবিব : হাঁ, এখানে – এই স্বর্গলোকে – শুধু দুটি নরনারী – তুমি আর আমি – অনন্তকাল ধরে মুখোমুখি বসে আছে। তাদের চোখে পলক নেই। বুঝি পলক পড়লেই বিশ্ব কেঁদে উঠবে। হারিয়ে যাবে সুন্দর এ স্বর্গলোক। হারিয়ে যাব আমি আর তুমি।

.........

গান

স্মরণ-পারের ওগো প্রিয় তোমায় আমি চিনি যেন!
তোমার চাঁদে চিনি আমি, তুমি আমার তারায় চেন॥
নতুন পরিচয়ের লাগি
তারায় তারায় থাকি জাগি
বারে বারে মিলন মাগি
বারে বারে হারাই হেন॥
নতুন চোখের প্রদীপ জ্বালি চেয়ে আছি নিরিবিলি,
খোলো প্রিয় তোমার ধরার বাতায়নের ঝিলিমিলি।
নিবাও নিবু-নিবু বাতি,
ডাকে নতুন তারার সাথি,
ওগো আমার দিবস-রাতি
কাঁদে বিদায়-কাঁদন কেন॥
ফিরোজা : মা! মা! চাঁদের পার হতে ভেসে আসছে ও-গান। ও-গান স্বপন-লোকের, ও-গান বেহশ্‌তের। মা – গো – !
হালিমা : হাবিব! হাবিব! ছুটে আয় বাপ আমার! তোর ফিরোজা চলে যায়। মা! মা আমার রে! (লুটাইয়া পড়িলেন)
হাবিব : (ঝড়ের বেগে দ্বারে করাঘাত হানিয়া) মির্জা সাহেব। দোর খুলুন! খোলো দ্বার! ‘তার’ পেয়েছি। আমি বি. এ পাশ করেছি। খোলো দ্বার। (দ্বারে পদাঘাত করিল, দ্বার ভাঙ্গিয়া পড়িল।) মা! মা! ফিরোজ কই, আমি পাশ করেছি। এই দেখো ‘তার’ – পারদর্শিতার সহিত পাশ!
হালিমা : হাবিব! হাবিব! ফিরোজ আমার চলে গেছে।


চরিত্র

[সম্পাদনা]


ফিরোজা
হালিমা
হাবিব
মীর্জা সাহেব

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]