দেবদাস (উপন্যাস)

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে

দেবদাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি প্রণয়ধর্মী বাংলা উপন্যাস। দেবদাস উপন্যাসের রচনার সমাপ্তিকাল ১৯০০ সালের সেপ্টেম্বর মাস কিন্তু ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসে দেবদাস তৎকালীন ব্রাহ্মণ জমিদার বংশের সন্তান আর পার্বতী(পারু) এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই দেবদাস ও পার্বতীর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব যা পরবর্তীতে প্রেমের রূপ নেয়। পার্বতীর মা দেবদাসের মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব আনলেও দুটি পরিবারের মধ্যে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার ফারাক থাকায় তাদের মধ্যে বিয়ে হয়নি। দেবদাস কলকাতায় চলে আসে। আর পার্বতীর হাতিপোতা গ্ৰামে ভুবন চৌধুরী নামে এক জমিদারের সাথে বিয়ে হয়। কলকাতায় এসে চুনীলালের সাথে দেবদাসের বন্ধুত্ব হয় ও তার মাধ্যমে সে চন্দ্রমুখী নামে এক বাঈজীর সাথে পরিচিত হয়। বাঈজী দেবদাসের প্রেমে পড়ে। দেবদাসের মনে প্রতিনিয়ত পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর তুলনা হতে থাকে। হতাশাগ্ৰস্ত দেবদাস অত্যধিক মদ্যপান শুরু করলে তার শরীর ক্রমশ ভে‌‌ঙে পড়ে। আসন্ন মৃত্যুর কথা অনুভব করে দেবদাস হাতিপোতা গ্ৰামে পার্বতীকে দেখার জন্য র‌ওনা হয়। পার্বতীর বাড়ির সামনে পৌঁছে, এক অন্ধকার শীতের রাতে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে দেবদাসের মৃত্যু হয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে দেবদাসই প্রথম উপন্যাস, যেখানে ট্র্যাজেডিই প্রধান উপজীব্য।

উক্তি[সম্পাদনা]

  • কাদায় সমস্ত রাস্তা পরিপূর্ণ। গরুর গাড়ি হটর হটর করিয়া চলিল। কোথাও নামিয়া চাকা ঠেলিতে হইল, কোথাও গরু দুটোকে নির্দয়রূপে প্রহার করিতে হইল—যেমন করিয়াই হোক, এ ষোল ক্রোশ পথ অতিক্রম করিতেই হইবে। হুহু করিয়া ঠাণ্ডা বাতাস বহিতেছিল। আজও তাহার সন্ধ্যার পর প্রবল জ্বর দেখা দিল। সে সভয়ে প্রশ্ন করিল, গাড়োয়ান, আর কত পথ? গাড়োয়ান জবাব দিল, এখনো আট-দশ কোশ আছে বাবু।
    • দেবদাস উপন্যাসের ষোড়শ পরিচ্ছেদ, দেবদাস- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- প্রদীপকুমার সরকার, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১০৫
  • মানুষ এমনি দুঃসময়ের মাঝে আশা-নিরাশার কূলকিনারা যখন দেখিতে পায় না, তখন দুর্বল মন বড় ভয়ে ভয়ে আশার দিকটাই চাপিয়া ধরিয়া থাকে। যেটা হইলে তাহার মঙ্গল, সেইটাই আশা করে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সেই দিক পানেই নিতান্ত উৎসুক নয়নে চাহিয়া দেখিতে চাহে।
    • দেবদাস উপন্যাসের সপ্তম পরিচ্ছেদ, দেবদাস- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- প্রদীপকুমার সরকার, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৩৬
  • সতর্ক এবং অভিজ্ঞ লোকদিগের স্বভাব এই যে, তাহারা চক্ষুর নিমিষে কোন দ্রব্যের দোষগুণ সম্বন্ধে দৃঢ় মতামত প্রকাশ করে না—সবটুকুর বিচার না করিয়া, সবটুকুর ধারণা করিয়া লয় না; দুটো দিক দেখিয়া চারিদিকের কথা কহে না। কিন্তু আর একরকমের লোক আছে, যাহারা ঠিক ইহার উলটা। কোন জিনিস বেশীক্ষণ ধরিয়া চিন্তা করার ধৈর্য ইহাদের নাই, কোন-কিছু হাতে পড়িবামাত্র স্থির করিয়া ফেলে—ইহা ভাল কিংবা মন্দ; তলাইয়া দেখিবার পরিশ্রমটুকু ইহারা বিশ্বাসের জোরে চালাইয়া লয়।
    • দেবদাস উপন্যাসের অষ্টম পরিচ্ছেদ, দেবদাস- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- প্রদীপকুমার সরকার, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪১
  • কাল পত্র আসিয়াছিল। আজ সে মহেন্দ্রকে ডাকিয়া কহিল, দুটো পালকি আর বত্রিশ জন কাহার চাই, আমি এখনি তালসোনাপুরে যাব। মহেন্দ্র আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, পালকি বেহারা আনিয়ে দিচ্চি, কিন্তু দুটো কেন মা?
    • দেবদাস উপন্যাসের চতুর্দশ পরিচ্ছেদ, দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ,প্রথম প্রকাশ- মাঘ-১৩৫৪, প্রকাশক- সরকার এ্যাণ্ড কোং, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮৭-৮৮
  • এ-সকল লোক যে জগতে কাজ করিতে পারে না তাহা নহে, বরঞ্চ অনেক সময় বেশী কাজ করে। অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন হইলে ইহাদিগকে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে দেখিতে পাওয়া যায়। আর না হইলে অবনতির গভীর কন্দরে চিরদিনের জন্য শুইয়া পড়ে; আর উঠিতে পারে না, আর বসিতে পারে না, আর আলোকের পানে চাহিয়া দেখে না; নিশ্চল, মৃত জড়পিণ্ডের মতো পড়িয়া থাকে। এই শ্রেণীর মানুষ দেবদাস।
    • দেবদাস উপন্যাসের অষ্টম পরিচ্ছেদ, দেবদাস- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- প্রদীপকুমার সরকার, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪১
  • জোর করিয়ে প্রতিজ্ঞা করানটা কি ভাল, না, তাতে বিশেষ লাভ আছে? আজকার প্রতিজ্ঞা কাল হয়ত থাকবে না—
    • দেবদাস উপন্যাসের দ্বাদশ পরিচ্ছেদ, দেবদাস- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- প্রদীপকুমার সরকার, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৭১
  • অখ্যাতি করতেও তোমরা, সুখ্যাতি করতেও তোমরা। তোমাদের যা বলবার—অনায়াসে বল; কিন্তু তারা তা পারে না। নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে পারে না; পারলেও, তা সবাই বোঝে না। কেননা, বড় অস্পষ্ট হয়—তোমাদের মুখের কাছে চাপা পড়ে যায়। তার পরে অখ্যাতিটাই লোকের মুখে মুখে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে।
    • দেবদাস উপন্যাসের ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ, দেবদাস- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- প্রদীপকুমার সরকার, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৭৮
  • যাহার আশা আছে, সে একরকম করিয়া ভাবে; আর যাহার আশা নাই, সে অন্যরকম ভাবে। পূর্বোক্ত ভাবনার মধ্যে সজীবতা আছে, সুখ আছে, তৃপ্তি আছে, দুঃখ আছে, উৎকণ্ঠা আছে; তাই মানুষকে শ্রান্ত করিয়া আনে—বেশীক্ষণ ভাবিতে পারে না। কিন্তু আশাহীনের সুখ নাই, দুঃখ নাই, উৎকণ্ঠা নাই, অথচ তৃপ্তি আছে। চোখ দিয়া জলও পড়ে, গভীরতাও আছে—কিন্তু নিত্য নূতন করিয়া মর্মভেদ করে না। হালকা মেঘের মতো যথা-তথা ভাসিয়া চলে। যেখানে বাতাস লাগে না, সেখানে দাঁড়ায়; আর যেখানে লাগে, সেখান হইতে সরিয়া যায়; তন্ময় মন উদ্বেগহীন চিন্তায় একটা সার্থকতা লাভ করে।
    • দেবদাস উপন্যাসের চতুর্দশ পরিচ্ছেদ, দেবদাস- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- প্রদীপকুমার সরকার, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮৫
  • শিক্ষা বিদ্যা বুদ্ধি জ্ঞান উন্নতি—যা কিছু, সব সুখের জন্য। যেমন করেই দেখ না কেন, নিজের সুখ বাড়ানো ছাড়া এসকল আর কিছুই নয়—
    • দেবদাস উপন্যাসের সপ্তম পরিচ্ছেদ, দেবদাস- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশক- প্রদীপকুমার সরকার, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪০
  • শুধু দেবদাসের জন্য বড় কষ্ট হয়। তোমরা যে-কেহ এ কাহিনী পড়িবে, হয়ত আমাদেরই মতো দুঃখ পাইবে। তবু যদি কখনো দেবদাসের মতো এমন হতভাগ্য, অসংযমী পাপিষ্ঠের সহিত পরিচয় ঘটে, তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও। প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হোক, যেন তাহার মতো এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে। মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহ-করস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে—যেন একটিও করুণার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও এক ফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।
    • দেবদাস উপন্যাসের ষোড়শ পরিচ্ছেদ, দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ, প্রথম প্রকাশ- মাঘ-১৩৫৪, প্রকাশক- সরকার এ্যাণ্ড কোং, কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১১০

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]