রফিকুল ইসলাম (অধ্যাপক)
অবয়ব
রফিকুল ইসলাম (জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৩৪- ৩০ নভেম্বর ২০২১) ছিলেন বাংলাদেশি লেখক এবং দেশের প্রথম নজরুল গবেষক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক ও অত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। তিনি স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে পুরস্কৃত করে। ২০০৩ সালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর’ বই লিখে লেখক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান।
উক্তি
[সম্পাদনা]- সততার সঙ্গে অনুসন্ধান করার বিকল্প নেই।
- শিক্ষকের জীবনে দুটো কাজ—‘গবেষণা ও শিক্ষকতা, আমি আজন্ম শিক্ষক।’ জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থেকে তিনি ‘কিছু একটা’ করার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি বলতেন, ‘আমি চাই আমার অভিজ্ঞতা থেকে যদি একটা ভালো কিছু যোগ করা যায়।’
- আমি ৪৮-এর ভাষা আন্দোলন দেখেছি। আর ৫২-তে ভাষা আন্দোলন করেছি। সেসময়ের অধিকাংশ ছবি আমার তোলা।
- আজন্ম শিক্ষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম উদিসা ইসলাম, ৩০ নভেম্বর ২০২১, বাংলা ট্রিবিউন
- ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনটা মূলতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা করেছেন। কিন্তু '৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা যোগ দিয়েছেন। তখন সর্বস্তরের অংশগ্রহণ ছিল না। সর্বস্তরের ছিল ২১ ফেব্রুয়ারির গুলি চলার পর।
- ৮টা ও ৮টা ষোলটা ফিল্ম তোলা… ষোলটার বেশি ছবি তুলতে পারি নাই। যার ফলে গুলি চলার পরে প্রথম যে লাশটা মেডিকেল কলেজের ওয়ার্ডবয়রা এনে রাখলো, সেটা রফিকউদ্দিন আহমেদের লাশ। তার মাথা থেকে মগজ বের হয়ে আসছিল আর বুলেটের সেই ছবিটা আমি তুলতে পারি নাই। সেই ছবিটা আমানুল হক সাহেব তুলেছেন। কিন্তু ঐ লাশটা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা গুম করে ফেলে।
- আমি ছিলাম ছবি তোলার জন্য। তখন তো আর এখনকার মত মানুষের কাছে ক্যামেরা ছিল না। আমার কাছে একটা ক্যামেরা ছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল ক্যামেরায় মাত্র ৮টা ছবি একবারে তোলা যেত। তার পরে রোল চেঞ্জ করতে হতো।
- ভাষা আন্দোলনের সময় নিয়ে রফিকুল ইসলামের সাক্ষাৎকার বেবী মওদুদ, ২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১১, বিডিনিউজ
- এই যে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন, এটা আমাদেরকে আরও অসাম্প্রদায়িক করেছে। মানুষে মানুষে কেবলমাত্র বিশ্বাসের কারণে এই যে হানাহানি এবং এই যে ঘৃণা এটা যে কত অবাস্তব, এটা ছেলেবেলায় মনে গেঁথে গেছে। ছেলেবেলা থেকে আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠেছি। চারিদিকটায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার এই বিভীষিকা দেখে, এর বিরুদ্ধে ওই দাঙ্গার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের মধ্যে একটা ঘৃণা জন্মগ্রহণ করেছে।
- ভাষার দাবির জন্য গুলি চলতে পারে, এটা আমাদের ধারণার অতীত ছিল।
- আমার মনে হয়, আমি জন্মগতভাবে শিক্ষক। একজন শিক্ষকের জীবনে দুটি কর্ম। একটি হচ্ছে গবেষণা, আরেকটি হচ্ছে শিক্ষকতা। আমার জীবনে ১৯৫৭ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত আমি আমার গবেষণা জীবন ও শিক্ষকতা জীবন চালিয়ে যাচ্ছি।
- নজরুল যে শুধু জাতীয় কবি নন, নজরুলের ভেতরে যে আন্তর্জাতিকতা আছে এবং সেই আন্তর্জাতিকতা যে মানবসাম্যের, মানব সংহতির জন্য।
- শিক্ষকতাই আমাকে সুস্থ রেখেছে, এটাই আমাকে জীবিত রেখেছে। এবং আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একজন শিক্ষক হিসাবে, একজন গবেষক হিসাবে থাকতে চাই।
- অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: শিক্ষক, সংগ্রামী আর সাধকের প্রতিকৃতি মাসুম বিল্লাহ, ৩০শে নভেম্বর ২০২১, বিডিনিউজ
- তবে শহীদ মিনার বাঙালি চেতনার এমন এক প্রতীক, পশ্চিম পাকিস্তানিরা যা আজীবন দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। কাজেই প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপনে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হতো।
- কলাভবনের সামনের বটগাছটা দেখেছেন? এটা আসল গাছটা নয়, জানেন। মুক্তিযুদ্ধের পর সিনেটর কেনেডি এসেছিলেন। তাকে দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কেটে ফেলা আসল গাছটির একটি অংশ লাগানো হয়। তবে এভাবে কি চাইলেই একটা গাছ কেটে ফেলা যায়? শিকড় তো রয়েই যায়।
- অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২০, ফারজানা তাসনিম পিঙ্কি, রোর মিডিয়া
- ভাষাসৈনিক আবার কী! বলা যায় ভাষাকর্মী বা ভাষা-সংগ্রামী। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু মানুষ শব্দটা চালু করেছেন। এরা মূলত বাহাদুরি নিতে চেয়েছেন। ভাষাসৈনিক শব্দটা কারোই ব্যবহার করা উচিৎ নয়। সেসময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল চার থেকে পাঁচ কোটি। ছোট-বড় সবাই তো ভাষা সংগ্রামে ছিল।
- আমাদের জাগরণের প্রথম সুর তোলেন নজরুল: অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ইমরান মাহফুজ, নভেম্বর ৩০শে নভেম্বর ২০২১, দ্য ডেইলি ষ্টার বাংলা
- কেন ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখেই বাংলা ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল? কারণ সেইদিন পূর্ব বাংলার আইনসভায় বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা। তখন আইনসভা বসত জগন্নাথ হলের অ্যাসেম্বিলি হলে। যেটা ভেঙ্গে পড়েছিল। সেই জন্য ২১ তারিখ। এই তারিখে বাজেট অধিবেশন বসবে, আমরা সেখানে গিয়ে স্মারকলিপি পেশ করব যে, আপনারা পাকিস্তান সরকারের কাছে এবং পাকিস্তান গণ-পরিষদের কাছে এই প্রস্তাব পাশ করেন, যেন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয়, সেই জন্য।
- আমি বাসায় আসতে না আসতেই আইবি (তৎকালীন পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) থেকে দুটো লোক এসে হাজির! -বলে, আপনি ছবি তুলেছেন? আমি বললাম, না। আমি ছবি তুলব কোত্থেকে আমার তো ফিল্মই ছিল না। -বলে, আপনার ক্যামেরা ছিল সঙ্গে। আমি বললাম, ক্যামেরা ছিল, ফিল্ম ছাড়া ক্যামেরায় কি ছবি ওঠে? (নিজেকে ও সেই তোলা ছবিগুলোকে বাঁচানোর জন্য বললাম) আমি ক্যামেরা দিয়ে দিলাম যে দেখেন! তো ওরা ক্যামেরা খুলে দেখল ভেতরে কোন ফিল্ম নেই।
- কয়জন লোককে ভাষা সৈনিক বলাটা ঠিক না। ঠিক না এই জন্য যে, ২১ তারিখে গুলি চলার পর সমস্ত ঢাকার মানুষ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এবং ২২শে ফেব্রুয়ারি ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ২৪ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে আন্দোলন চলেছে। সবাইতো ভাষা সৈনিক! শুধু কয়েকজন লোককে ভাষা সৈনিক কেন বলব? আমি এটার বিরোধী।
- মুক্তিযোদ্ধা হল তারা, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে। আর যারা দাবীদার, আরো আশেপাশের লোকজন আমি তাদের কোন মূল্য দেই না। যারা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ, তাদের সন্তানরা যেত। যে কোন দিন গ্রামের সীমানা পার হয় নাই, সে কোথায় সীমান্ত পেরিয়ে কোথায় কোথায় চলে গেছে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে যুদ্ধ করেছে। ওরা হচ্ছে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। সে দিন যারা গুলির সামনে শোভাযাত্রা করেছে। যারা গুলি মানেনি, লাঠি মানেনি, টিয়ার গ্যাস মানেনি, তারা হচ্ছে সত্যিকারের যোদ্ধা। আমি ছবি তুলেছি কয়েকটা আমার কি বাহাদুরী? আমার কি অবদান আছে বলেন?
- ভাষা সংগ্রামীদের ভাষা সৈনিক বলা - এটা কিছু লোক উদ্দেশ্যমূলক ভাবে এই শব্দটা চালু করেছে। কিছু বাহাদুরী নিতে চেয়েছে। যারা, যাদের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের কোন সম্পর্ক ছিল না। অর্থাৎ তারা মাঠে নামেনি। যারা সভায় আসেনি, শোভাযাত্রায় আসেনি, লাঠি খায়নি, টিয়ার খায়নি, গুলি খায়নি, সেই ধরনের কিছু লোক, যারা গা বাঁচিয়ে নিজেরা দুরে দুরে ছিল তারা পরবর্তীকালে যখন ভাষা আন্দোলন স্বীকৃতি পেল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা হল তখন, তারা নাম কেনার জন্য স্বাধীনতার পর তারা নিজেদের নামের পাশে ভাষা সৈনিক কথাটি জুড়ে দিল। এগুলো সব মতলববাজ! ফেরেববাজ এগুলো! এদের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের কোন সম্পর্ক নেই।
- ‘ছাত্রজীবনে শখের ক্যামেরাতেই ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক ছবি উঠে আসে’ তারিকুল ইসলাম মাসুম, ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯, চ্যানেল আই
- আবদুল কাদিরের মতো গবেষক একটি দেশে কমই হয়। তার নজরুল চর্চা ও গবেষণার পরিধি বহু বিস্তৃত। নজরুলের আলোচনায় তার নাম অনিবার্যভাবে আসে। নজরুলের যে ছন্নছাড়া জীবন, সে জীবনে আবদুল কাদির না থাকলে নজরুল রচনাবলী হারিয়ে যেত।
- ১৯৫৮ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক, আমারই তত্ত্বাবধানে ‘নজরুল-গবেষণা কেন্দ্র’ থেকে চার গবেষক নজরুলের নানা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এর বাইরে লেকচার সিরিজ চালু ছিল। এতে দেশ-বিদেশের লেখক-গবেষকরা আসতেন, আলোচনা হতো। গবেষণার পাশাপাশি প্রকাশনা হতো। বর্তমানে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশে নজরুল নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মান কমে যেতে শুরু করে।
- নানা কারণে নজরুল ঢাকায় আসতে চাইলে কবিকে পাকিস্তান সরকার আসতে দেয়নি। এর মধ্যে আমি যতক্ষণ সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম নজরুল শান্তভাবে বসেছিলেন। অসহায় লাগছিল তাকে। আমার অস্বস্তি লাগছিল। বিদ্রোহী কবিকে এমন দেখব প্রত্যাশা করিনি। কারণ, আমাদের জাগরণের প্রথম সুর তিনিই তোলেন।
- আমাদের জাগরণের প্রথম সুর তোলেন নজরুল: অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ইমরান মাহফুজ, ২৪শে মে ২০২১, দ্য ডেইলি ষ্টার বাংলা
- ঈর্ষা করি সংগীত মাধ্যমকে। কণ্ঠ নেই, তাই গাইতে পারি নি। তবে ছাত্রজীবনে এস্রাজ, তারসানাই এবং দিলরুবা শিখেছি ওস্তাদ ফুলজুরি খান সাহেবের কাছে। পিয়ানো শিখেছি মার্কিন মহিলা এলাইন বিগেলুর কাছে।
- রফিকুল ইসলাম: ভাষা আন্দোলন ও নজরুল গবেষণায় অনন্য ২য় ডিসেম্বর ২০২১, অন্যদিন
- শুধু শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা নয়, শুধু ডিগ্রি নয়। প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ চাই।আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত একটি প্রজন্ম দেখতে চাই।এই প্রজন্মের কাছ থেকে দেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যা কিছু মহান এই প্রজন্মের মধ্যে তার প্রতিফলন যেন পাই।
- একসময় আামদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনার্স, মাষ্টার্স এগুলো ছিল ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতি।পরবর্তীকালে আমরা সেমিস্টার সিস্টেমে পরিবর্তিত হই। এটি মার্কিন শিক্ষা পদ্ধতি অনুসারে।আমাদের নিজস্ব প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের অবশ্যই খুঁজে পেতে হবে।এখন শিক্ষার অনেক সম্প্রসারণ হয়েছে, কিন্তু মান আশানুরূপ হয়নি। কাজেই শুধু শিক্ষার সম্প্রসারণ নয় , শিক্ষার যেমন তার গুণগত পরিবর্তন এবং সে মানেরও উন্নতি প্রয়োজন। তাহলে মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি স্বাধীন দেশরূপে বাংলাদেশ আরও অনেক অগ্রসর হতে পারবে।
- বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বের হবে, তারা যাতে দেশের সেবায় সহায়ক হতে পারে। দেশের উন্নতির জন্যে তারা যেন কাজ করতে পারে। আমরা যেন শিক্ষিত বেকার সৃষ্টি না করি। আমরা যেন শিক্ষিত যারা সত্যি সত্যি দেশের কাজে লাগবেন, দেশের উন্নতির কাজে সে ধরনের প্রজন্ম যেন সৃষ্টি করতে পারি।
- শিক্ষা অর্থ শুধু ক্লাস নয়, পরীক্ষা নয়, খাতা দেখা নয়।শিক্ষা অর্থ পাঠ, শিক্ষা অর্থ গবেষণা, শিক্ষা অর্থ প্রকাশনা।শিক্ষা অর্থ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ।
- রফিকুল ইসলাম স্যার ও কিছু স্মৃতিকথা জেবউননেছা, ১৬ই এপ্রিল ২০২২, যোগসূত্র
রফিকুল ইসলাম (অধ্যাপক) সম্পর্কে উক্তি
[সম্পাদনা]- সবাই নিজেকে নিয়ে মজা করতে পারেন না। রাশভারী রফিকুল ইসলামকে জন্মস্থান কোথায় জিজ্ঞেস করলে তিনি মৃদু হেসে বলতেন, ‘কোনও এক রেলওয়ে জংশনে।’ সেটা কেন বলছেন তার ব্যাখ্যাও দিতেন। তাদের পৈতৃক নিবাস চাঁদপুরের মতলব। বাবা চিকিৎসক ছিলেন রেলওয়েতে। বিভিন্ন জংশনে তার কাজ ছিল। ফলে যেকোনও একটা রেলওয়ে জংশনে তার জন্ম।
- আজন্ম শিক্ষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম উদিসা ইসলাম, ৩০ নভেম্বর ২০২১, বাংলা ট্রিবিউন
- বাংলার দুর্ভিক্ষ, ভাষা আন্দোলন, বাঙালির স্বাধিকারের লড়াই কিংবা জাতিসত্ত্বার সংগ্রামের অগ্নিসাক্ষী জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের ইতিহাসকেই গ্রন্থিত করে গেছেন তার লেখায়। সেই রফিকুল ইসলামই আবার নিজেকে উৎসর্গ করেছেন নজরুল সাধনায়। বিদ্রোহী কবির প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেছেন তিনি, চেষ্টা করেছেন তার কর্মের আন্তর্জাতিকীকরণের।
- ইতিহাসের কালপর্বে তার তার বহুমুখী ভূমিকার কথা স্মরণ করে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, “তিনি অনেকগুলো প্রথম কিছুর সাক্ষী, যেগুলো তিনি ক্যামেরায় বন্দি করেছেন। আমরা আদি ছবি পেশাদার ক্যামেরাম্যানদের কাছে পাই, কিন্তু অ্যাকাডেমিক কারও ক্যামেরায় যদি পাই, সেটা তিনিই তুলে ধরেছেন।”
- বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নূরুল হুদা বলেন, “রফিকুল ইসলামই বাংলাদেশের প্রথম গবেষক, যিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য কর্মের ওপর পিএইচডি করেছেন। বিদ্রোহী কবির প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী তার হাত দিয়েই এসেছে। তারপর নজরুল চর্চাকে সারা বাংলাদেশে এবং বাংলাভাষা ছাড়াও পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিলেন।
- আজকে যে আমরা বলি, নজরুল সারা পৃথিবীর কবি, ভয়েস অব দ্য ওয়ার্ল্ড, ভয়েস অব হিউম্যান ওয়াননেস অ্যান্ড ফ্রিডম, এটা বাইরের গবেষকরাও বলছেন, মানবিক একতা এবং মানবিক স্বাধীনতার কবি, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম প্রথম এই যুক্তি দিয়েছিলেন।
- অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: শিক্ষক, সংগ্রামী আর সাধকের প্রতিকৃতি মাসুম বিল্লাহ, ৩০শে নভেম্বর ২০২১, বিডিনিউজ
- তবে রফিকুল ইসলামের সামনে বসে ওই মুহূর্তে নিজেকে এক অজ্ঞ শিশু ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিল না তাঁর। এমন একজনের সামনে তিনি বসেছিলেন, যিনি এই ইতিহাসের সমস্তটাই নিজের চোখে দেখেছেন। তিনি এই আন্দোলনের এক সক্রিয় অংশগ্রহণকারীও বটে। আন্দোলনের দিনগুলোতে হারিয়েছেন বন্ধুদের। তাঁর কাছে সেই দিনগুলো কোনো সুদূর অতীত নয়, বরং তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ।
- অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম: বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২০, ফারজানা তাসনিম পিঙ্কি, রোর মিডিয়া
- তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রথম নজরুল অধ্যাপক ও নজরুল-গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের অসংখ্য দুর্লভ ছবি তুলেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতন ও কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল তাকে।
- আমাদের জাগরণের প্রথম সুর তোলেন নজরুল: অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ইমরান মাহফুজ, নভেম্বর ৩০শে নভেম্বর ২০২১, দ্য ডেইলি ষ্টার বাংলা
- চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন রফিকুল ইসলাম। দর্শনা কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সদালাপী ও উদার মনের মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের প্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি।
- পুলিশের গুলিতে রফিক শহীদ হলে দুঃখভরে সহপাঠীসহ আরও কয়েকজনকে বলেছিলেন, তাঁর নামও রফিক।
- রফিকুল ইসলাম শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৭) থেকে।, ১১ই মার্চ ২০১৫, প্রথম আলো
- রফিকুল ইসলামের বাবা মোঃ জুলফিকার আলী ছিলেন একজন রেলওয়ে ডাক্তার। তাই রফিকুলের শৈশব-কৈশোর ও তরুণবেলা কাটে দেশের নানা জায়গায়।
- তিনবার তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসেন। প্রথমবার ১৯৭০ সালে অসুস্থতার কারণে, ১৯৭১-এর ২৫-২৭ মার্চ জহুরুল হক সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় আবাসের বাসিন্দা হিসেবে সশস্ত্র পাকিস্তানি হামলা থেকে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বন্দিশিবিরে আটক অবস্থায়।
- রফিকুল ইসলাম: ভাষা আন্দোলন ও নজরুল গবেষণায় অনন্য ২য় ডিসেম্বর ২০২১, অন্যদিন
- গুণীজন হারানোর বেদনা সইতে হয়। সৃষ্টির অমোঘ নিয়ম মানতে হয়। রফিকুল ইসলাম স্যার বিদ্রোহী কবি নজরুল গবেষক ছিলেন, নজরুলের কবিতার চরণ দিয়ে শেষ করব রফিকুল ইসলাম স্যারের স্মৃতিকথা:
• | ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে! |
- রফিকুল ইসলাম স্যার ও কিছু স্মৃতিকথা জেবউননেছা, ১৬ই এপ্রিল ২০২২, যোগসূত্র
- জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম কর্মের মাধ্যমে নিজেকে পরিণত করেছিলেন দেশের বাতিঘরে। বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশ ও প্রসারে কাজ করে গেছেন সারাজীবন। দৈহিক মৃত্যু হলেও এ দেশের মানুষদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিকর্মে।
- আনিস স্যার চলে গেলেন, রফিক স্যার চলে গেলেন। আমরা সত্যিই অভিবাবক শূন্য হয়ে পড়লাম। বাঙালির ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, প্রতিটি সংগ্রামে, সংকটে, স্বাধীকার, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র- প্রতিটি সংগ্রামে তিনি ছিলেন এমন এক বাতিঘর, যিনি জাতিকে পথ দেখিয়েছেন। - ওবায়দুল কাদের
- অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের মৃত্যুতে দেশ একজন মহান শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীকে হারালো। তিনি ভাষা সংগ্রামী ছিলেন, তার হাত ধরেই নজরুল ইনস্টিটিউট গঠিত হয়েছিল এবং তিনি জাতিকে সবসময় পথ দেখিয়েছেন। - তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ
- ‘অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বেঁচে থাকবেন কর্মের মাঝে’ ১লা ডিসেম্বর ২০২১, সমকাল
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে অধ্যাপনার এক পর্যায়ে রফিকুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নজরুলের সাহিত্যিক ভূমিকা তথা ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, খুন-জখম, হত্যা, শোষণ, জুলুম, নিপীড়ন, সামাজিক ভেদ-বিভেদ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, স্বাধীনতার স্বপ্ন প্রভৃতি বিষয়ে নজরুলের অসামান্য ও অগ্রগন্য অবদান তাঁকে নজরুল বিষয়ে কৌতূহলী করে তোলে। নজরুলের মানবিক প্রেমের রোমান্টিক কবিতা ও গান, গণজাগরণের চিন্তা, ইসলামী ও হিন্দু ভাবাদর্শের গানে তিনি প্রাণিত হন।
- রফিকুল ইসলামের গবেষণা ও প্রকাশনার একটি বড় অংশ নজরুল কেন্দ্রিক। নজরুলের জীবন ও সৃষ্টিভিত্তিক এসব রচনাবলি অত্যন্ত উচ্চ স্তরের। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক নজরুল গবেষক। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম দীর্ঘ ছয় দশকের বেশি সময় ধরে নজরুল গবেষণায় কাজ করেছেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ধরা যায় জাতীয় কবির সবচেয়ে তথ্যবহুল জীবনীগ্রন্থ রচনা, নজরুল নির্দেশিকা, নজরুলের সুস্থাবস্থায় করা গানের স্বরলিপি উদ্ধার, কবির হস্তলিপি ও দুর্লভ আলোকচিত্র সংগ্রহ।
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল অধ্যাপক পদ সৃষ্টির পরপরই চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীর নগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা হয়। প্রত্যেক ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা কেন্দ্র চালু করা হয়। এসব গবেষণ কেন্দ্রগুলোতে নজরুলের নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করা হয়ে থাকে।
- রফিকুল ইসলাম: নজরুল-লাবণ্যের ছায়া ৮ই জানুয়ারি ২০২২, পত্রদূত
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]উইকিপিডিয়ায় রফিকুল ইসলাম সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।