বিষয়বস্তুতে চলুন

ময়ূরকণ্ঠী

উইকিউক্তি, মুক্ত উক্তি-উদ্ধৃতির সংকলন থেকে

ময়ূরকণ্ঠী সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত একটি প্রবন্ধ সংকলন যা ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়। সৈয়দ মুজতবা আলী বিভিন্ন বিষয়ের প্রবন্ধ এই বইয়ে স্থান পেয়েছে। বইটিতে মোট প্রবন্ধের সংখ্যা ৪৩ টি।

উক্তি

[সম্পাদনা]

গুরুদেব

[সম্পাদনা]
  • সবদিকে যাঁর দৃষ্টি তিনিই তো প্রকৃত গুরু এবং তা-ও মৃত্যুর বহু পূর্বে।

বড় দিন

[সম্পাদনা]
  • প্রভু যিশু জন্ম নিলেন খড়বিচুলির মাঝখানে– আর তার পরব হল শ্যাম্পেনে টার্কিতে!!
  • পরাধীন জর্মনি আজ বনে রাজধানী পেয়ে যেন ঘর পেয়েছে একথা অনায়াসে বলা যায়।

'নেভা'র রাধা

[সম্পাদনা]
  • তুর্গেনিয়েফের শৈলীর প্রশংসা করতে গিয়ে এক রুশ সমঝদার বলেছেন, ‘তাঁর শৈলী যেন বোতল থেকে তেল ঢালা হচ্ছে–ইট ফ্লোজ লাইক অয়েল।’
  • ... যে ভালোবেসেছে সমস্ত সত্তা সর্বৈব অস্তিত্ব দিয়ে তার হৃদয় তো তখন ভবিষ্যৎ দেখতে পায়– বিধাতাপুরুষেরই মতো।

ফরাসি-জর্মন

[সম্পাদনা]
  • নিতান্ত তাহারা (জার্মানরা) কোনও জিনিস অর্ধপক রাখিতে চাহে না বলিয়াই এই প্রতিষ্ঠানটিকে (কনসেনট্রেশন ক্যাম্প) পূর্ণ বৈদগ্ধ্যে পৌঁছাইয়াছিল।

এ মেয়ে তো মেয়ে নয়-

[সম্পাদনা]
  • সংবাদপত্রের পাঁজে যারা পোড় খেয়ে ঝামা হয়ে গিয়েছেন, তারা অত্যন্ত আত্মজনের মৃত্যুতেও বিচলিত হন না।

ইঙ্গ-ভারতীয় কথোপকথন

[সম্পাদনা]
  • দেশে-বিদেশে বহুবার দেখিয়াছি যে, ইংরাজ ও ফরাসির প্রশ্নে ভারতীয় সদুত্তর দিতে পারিতেছেন না। তাহার প্রধান কারণ (১) ভারতীয়রা স্বীয় ঐতিহ্য ও বৈদগ্ধ্যের সঙ্গে সুপরিচিত নহেন– ইহার জন্য প্রধানত আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিই দায়ী।
  • ইংরাজ হইয়া বেকন-আণ্ডা না খাইলেই হয়; ফরাসি হইয়া শ্যাম্পেন না খাইলেই হয়; জর্মন হইয়া সসিজ না খাইলেই হয়; বাঙালি হইয়া ইলিশ না খাইলেই হয়, অনশনে প্রাণত্যাগ করিলেও হয়; আত্মহত্যা করিলেও হয়।

শিক্ষা-সংস্কার

[সম্পাদনা]
  • পণ্ডিতেরা একত্র হইয়া এই বিষয়ে (শিক্ষাপদ্ধতি সংস্কার) নানা তর্ক নানা আলোচনা করিবেন; সেইসব পণ্ডিতের নামাবলিতে দেশবিদেশের নানা ডিগ্রি নানা উপাধির লাঞ্ছন অঙ্কিত থাকিবে; নানা ভাষায় নানা কণ্ঠে তাহারা জ্ঞানগর্ভ মতামত প্রকাশ করিবেন। সেখানে আমাদের ক্ষীণ নেটিভ কণ্ঠ পৌঁছিবে এমন দুরাশা আমরা করি না।
  • শিক্ষার এক মূল অঙ্গ ছিল তীর্থভ্রমণ, দেশভ্রমণ বলিলে একই কথা বলা হয়।

কোনও গুণ নেই তার-

[সম্পাদনা]
  • আপন প্রদেশ সম্বন্ধে আমরাই যেমন সর্বপ্রথম গর্ব অনুভব করে ‘সপ্তকোটি কণ্ঠে’ উল্লাসধ্বনি করে উঠেছিলুম, ঠিক তেমনি আমরাই সর্বপ্রথম ক্ষুদ্র প্রাদেশিকতা বর্জন করে পাঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠা-দ্রাবিড়-উৎকল-বঙ্গের ভিতর দিয়ে ভারতভাগ্যবিধাতার রূপ দেখতে চেয়েছিলুম।
  • রাজপুতরা মাছ-মাংস খান, তাই বোধ করি মীরাবাঈ গেয়েছেন–
    ফলমূল খেয়ে হরি যদি মেলে
    তবে হরি হরিণের।
  • বাংলা ভাষা যখন আপন নিজস্বতা খুঁজছিল তখন সে জানত না যে ইংরেজি ফরাসি জর্মন একদা লাতিনের দাস্যবৃত্তি থেকে মুক্তিলাভ করেই যশস্বিনী হয়েছে। বাঙলার এই প্রচেষ্টা ভগবানের দান এবং এই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ জন্মেছিলেন বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথ।
  • কিন্তু একবার ঝগড়া শুরু হয়ে গেলে কাদামাটি ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে দু-চারটে পাথরও ছোঁড়া হয়, তখন মানুষ জানা-অজানাতে অন্যায় কথাও বলে ফেলে।

কালো মেয়ে

[সম্পাদনা]
  • কত করুণ দৃশ্য, কত হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখি প্রতিদিন– সত্য বলতে কি, তাই রাস্তায় বেরুতে ইচ্ছে করে না– কিন্তু যদি জিগ্যেস করেন, সবচেয়ে মর্মন্তুদ আমার কাছে কী লেগেছে, তবে বলব, আমাদের পাড়ার কালো মেয়েটি।
  • কিন্তু, এখন যদি না বলি যে, আমাদের কর্তারা আজ পর্যন্ত দেশের অন্ন-সমস্যা সমাধানের জন্য কিছুই করতে পারেননি, কোনও পরিকল্পনা পর্যন্ত করতে পারেননি, তা হলে অধর্মাচার হবে।
  • আশাটুকুরও সঞ্চার যদি কর্তারা না করতে পারেন, তবে তারা আসন ত্যাগ করে সরে পড়েন না কেন? হায়, অরক্ষণীয়ার অভিসম্পাতকেও এঁরা আর ভয় করেন না!!

ঋতালী

[সম্পাদনা]
  • একদিন নাকি, খানা খেতে খেতে পঞ্চম জর্জ আগা খানকে জিগ্যেস করেন, ‘একথা কি সত্যি, ইয়োর হাইনেস, যে, আপনার চেলারা আপনাকে পুজো করে?’
    আগা খান নাকি উত্তরে বলেছিলেন, ‘তাতে আশ্চর্য হবার কী আছে, ইয়োর ম্যাজেস্টি মানুষ কি গরুকেও পুজো করে না?’

রবীন্দ্র সঙ্গীত ও ইয়োরোপীয় সুরধারা

[সম্পাদনা]
  • আমরা সকলেই পরমানন্দে অন্ধের হস্তীদর্শন করছি কিন্তু আমাদের চরম সান্ত্বনা, এ সংসারের অধিকাংশ অন্ধ আপন আপন যষ্টি ত্যাগ করে বৃহত্তর লোকের ক্ষীণতম আভাস পাওয়ার জন্য অঙ্গুষ্ঠপরিমাণ উদগ্রীব নয়।

শ্রমণ রিয়োকোয়ান

[সম্পাদনা]
  • বাস্তুবাড়ি আমূল ভস্মীভূত হওয়ার পরমুহূর্তেই ক্ষতির পরিমাণটা ঠিক কতদূর হয়েছে অনুমান করা যায় না। যেমন যেমন দিন যায়, এটা-ওটা-সেটার প্রয়োজন হয় তখন গৃহস্থ আস্তে আস্তে বুঝতে পারে তার ক্ষতিটা কতদিক দিয়ে তাকে পঙ্গু করে দিয়ে গিয়েছে।
  • আত্মাভিমান জাগ্রত করার অন্যতম প্রধান পন্থা, জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে সে-ও একদিন উত্তমর্ণ ছিল, ব্যাপক অর্থে সে-ও মহাজন রূপে বহু দেশে সুপরিচিত ছিল।
  • মাছই যখন হয়ে যাবেন তখন জলের কাছে গিয়ে তার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকাই তো প্রশস্ত পন্থা।

প্রব্রজ্যা

[সম্পাদনা]
  • সমুদ্রবক্ষে বারিবর্ষণ তো অহরহ হচ্ছে, শুক্তিরও অভাব নেই। কোটি কোটি বৃষ্টিবিন্দুর ভিতর কোনটি মুক্তায় পরিণত হবে কেউ তো বলতে পারে না, হয়ে যাওয়ার পরেও তো কেউ বলতে পারে না কোন শুক্তি কোন মুক্তায় মুক্তি পেল।

ফুটবল

[সম্পাদনা]
  • সমুদ্রবক্ষে বারিবর্ষণ তো অহরহ হচ্ছে, শুক্তিরও অভাব নেই। কোটি কোটি বৃষ্টিবিন্দুর ভিতর কোনটি মুক্তায় পরিণত হবে কেউ তো বলতে পারে না, হয়ে যাওয়ার পরেও তো কেউ বলতে পারে না কোন শুক্তি কোন মুক্তায় মুক্তি পেল।

বেমক্কা

[সম্পাদনা]
  • বাউল ভাটিয়াল বর্বরতার লক্ষণ কিম্বা বারমাসী যাত্রাগান রসসৃষ্টির পর্যায়ে পড়ে না, একথা বললে আপন রসবোধের অভাব ঢাক পিটিয়ে বলা হয় মাত্র।
  • বেঙ্গল কেমিকেলের আমার এক সুহৃদ গিয়েছিলেন বৃন্দাবন। পাণ্ড দেখালে এক দোলনা– ভক্তিভরে বললে, এ দোলনায় দোল খেতেন রাধাকৃষ্ণ পাশাপাশি বসে। বন্ধুটি নাস্তিক নন, সন্দেহপিশাচ। বললেন, “যে কড়ির সঙ্গে দোলনা ঝোলানো রয়েছে, তাতে তো লেখা রয়েছে, টাটা কোম্পানির নাম; আমি তো জানতুম না, টাটা এত প্রাচীন প্রতিষ্ঠান!’

পরিমল রায়

[সম্পাদনা]
  • পণ্ডিতজনের বিনয় মূর্খের চিত্তজয় করতে সদাই সক্ষম।
  • একটি আড়াই ছত্রের টেলিগ্রামে সব আশা চুরমার হল। কাকে সান্ত্বনা দিই? আমিই সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছিনে।

মপাসাঁ

[সম্পাদনা]
  • মাস্টার হিসেবে আমার জানা আছে, দশখানা বই পড়লে ছেলেরা ভুলে মেরে দেয় ন’খানা। কিম্বা বলতে পারেন পাঁচ দু গুণে দশের শূন্য নেমে হাতে রইবে পেন্সিল!

রামমোহন রায়

[সম্পাদনা]
  • নিপীড়িত হলেই সে ব্যক্তি মহাজন, একথা বলা চলে না, কিন্তু মহাজনমাত্রই নিপীড়িত হন, সে বিষয়ে আমার মনে সন্দেহ নেই।

বিশ্বভারতী

[সম্পাদনা]
  • রাজনৈতিক কিংবা ব্যবসায়ী হতে হলে গণ্ডারের চামড়ার প্রয়োজন– গণ্ডারের চামড়া নিয়ে কোনও কবি আজ পর্যন্ত সার্থক সৃষ্টি করে যেতে পারেননি।

হিন্দু-মুসলমান কোড-বিল

[সম্পাদনা]
  • শাস্ত্রে সব পাওয়া যায়– কোনওকিছুর অনটন নেই। সম্পত্তি বিলিয়ে দিতে চান, না বিলিয়ে দিতে চান; বিয়ে করতে চান, না করতে চান– একখানা কিংবা বিশখানা; পুজো-পাজা করতে চান কিংবা ব্যোম ভোলানাথ বলে বুঁদ হয়ে থাকতে চান, এমনকি মরার পর পরশুরামী স্বর্গে গিয়ে অপ্সরাদের সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করতে চান কিংবা রবিঠাকুরী ‘কোণের প্রদীপ মিলায় যথা জ্যোতিঃ সমুদ্রেই’ হয়ে গিয়ে নিগুণ নির্বাণানন্দ লাভ করতে চান, তাবৎ মালই পাবেন।

উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়

[সম্পাদনা]
  • …কিন্তু এই যে তিনি নির্বাসিতদের নিদারুণ দুঃখ-দুর্দৈবের বহুতর কাহিনী প্রতিবারেই সংক্ষিপ্ততম বর্ণনায় শেষ করে দিয়েছেন এতে করেই আমাদের কল্পনা তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে কত হৃদয়বিদারক ছবি এঁকে আমাদের হৃদয়কে মথিত করেছে কত বেশি। সেটা হল প্রকৃত শক্তিশালী লেখকের লক্ষণ।
  • কোনওরূপে হিন্দুকে মুসলমান ভাণ্ডারীর খানা খাওয়াইয়া তাহার গোঁফ ছাটিয়া দিয়া একবার কলমা পড়াইয়া লইতে পারিলে বেহস্তে যে খোদাতাল্লা তাহাদের জন্য বিশেষ আরামের ব্যবস্থা করিবেন, এ বিশ্বাস প্রায় সকল মোল্লারই আছে।

জয়হে ভারতভাগ্যবিধাতা

[সম্পাদনা]
  • কিন্তু প্রশ্ন অতঃ কিম? অবশ্য বলতে পারেন পরীক্ষা পাস করে জ্ঞানার্জন হল এবং জ্ঞানার্জন স্বয়ংসম্পূর্ণ, আপন মহিমায় স্বপ্রতিষ্ঠিত। এরপর কিছু না করলেও কোনও আপত্তি নেই।
  • স্বাধীনতার ঘোড়া চড়ি আর নাই চড়ি সেটাকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখার জন্য দানাপানির খরচা হবেই হবে।
  • ‘ধন্য সেই জাত, যার কোনও ইতিহাস সেই।’ সে নির্ভয়ে যা কিছু একটা বেছে নিতে পারে।
  • শত মূঢ়তার মাঝখানে যে আমরা আজ কোটিকণ্ঠে ভারত-ভাগ্যবিধাতাকে স্বীকার করে নিলুম– জাতীয়-সঙ্গীত নির্বাচনে পথভ্রান্ত হইনি– এ বড় কম আশার কথা নয়।

নয়রাট

[সম্পাদনা]
  • খাওয়ার যেরকম সীমা আছে, ভালো জিনিস দেখারও একটা সীমা আছে।
  • চাণক্য বান্ধবের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “উৎসবে, ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে যে সঙ্গ দেয় সে বান্ধব।’ আমার বিশ্বাস চাণক্য কখনও বিয়ে করেনি। তা না হলে তিনি ‘রাজদ্বারে’ না বলে ‘জায়াদ্বারে’ বলতেন।
  • আমার লোভ মাত্র একটি জিনিসের প্রতি– অবসর। যখনই দেখি, লোকটার দু পয়সা আছে অর্থাৎ পেটের দায়ে তাকে দিনের বেশির ভাগ সময় এবং সর্বপ্রকারের শক্তি এবং ক্ষমতা বিক্রি করে দিতে হচ্ছে না, তখন তাকে আমি হিংসে করি।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]