চাচা কাহিনী
অবয়ব
‘’চাচা কাহিনী’’ সৈয়দ মুজতবা আলীর অন্যতম বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ। লেখকের ছাত্রজীবনে জার্মানি ও ফ্রান্সে অবস্থানের সময়কার ঘটনা ও বিশেষত জার্মানির বার্লিনের “হিন্দুস্তান হৌস” রেস্তোরাঁয় প্রবাসী বাঙালিদের আড্ডায় চক্রবর্তী চাচা ও অন্যান্য শিক্ষানবিশ তরুণদের গল্পকথন এই গ্রন্থে বিভিন্ন কাহিনী হিসেবে স্থান পেয়েছে। প্রায় প্রতিটি গল্পই বিদেশের পটভূমিতে রচিত। স্বয়ংবরা, কর্নেল, মা-জননী, তীর্থহীনা, বেলতলাতে দু-দুবার, কাফে-দে-জেনি, বিধবা-বিবাহ, রাক্ষসী, পাদটীকা, পুনশ্চ, বেঁচে থাকো সর্দি-কাশি – মোট এগারোটি কাহিনী নিয়েই চাচা কাহিনী রচিত।
উক্তি
[সম্পাদনা]স্বয়ংবরা
[সম্পাদনা]- পান্তা ভাতে কাঁচা লঙ্কা চটকে এক সানকে গিলে এলুম-যেমন জর্মনে বলা যায় না, তেমনি মদ্যসংক্রান্ত ব্লাউ (নীল), বেজফেন্ (টে-টম্বুর), ফল্ (সম্পূর্ণ), বেক্রঙ্কেন (ডুবে- মরা) কথার বাংলা করলেও বাংলা হয় না।
- হৃদয় আমার মধুচক্রের সম
মেয়েগুলো যেন মৌমাছিদের মতো
কত আসে যায় কে রাখে হিসাব বল
ঠেকাতে, তাড়াতে মন মোর নয় রত।
[জার্মান কবিতার অনুবাদ] - ইয়োরোপে cold-blooded খুন হয়, ভারতবর্ষে কোল্ড-ব্লাডেড বিয়ে হয়। এবং দুটোই ভেবে চিন্তে, প্ল্যানমাফিক, প্রিমেডিটেটেড। [চক্রবর্তী চাচার জবানীতে]
- ঘড়েল মাস্টারগুলো জানে যে ছাত্র যখন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, তখন তাকে ভালো করে নির্যাতন করার উপায় হচ্ছে চুপ করে উত্তরের প্রতীক্ষা করা।
কর্নেল
[সম্পাদনা]- ভারতীয় রান্না এমনি উচ্চশ্রেণীর সত্তা যে তার সঙ্গে শুধু ভগবানের তুলনা করা যেতে পারে। ভগবানের অস্তিত্ব যে রকম প্রমাণ করা যায় না, অপ্রমাণও করা যায় না, ভারতীয় রান্নাও জর্মনদের কাছে ঠিক তেমনিতর [যে এর উৎকৃষ্টতা] প্রমাণ বা বাতিল কিছুই করা যায় না।
- মশলা না দিলে আমাদের ঝোল হয়ে যায় আইরিশ স্টু, ডাল হয় লেন্টিল সুপ, তরকারি হয় বয়েল্ড ভেজ, মাছভাজা হয় ফ্রাইড্ ফিশ। আমাদের চতুর্বর্ণ তখন শুধু বর্ণ নয়, রস-গন্ধ-স্বাদ সব কিছু হারিয়ে একই বিস্বাদের আসনে বসেন বলে চণ্ডালের মতো হয়ে যান।
মা-জননী
[সম্পাদনা]- আইন মানুষকে এক পাপের জন্য সাজা দেয় একবার, সমাজ কতবার, কত বৎসর ধরে দেয় তার সন্ধান কোনো কেতাবে লেখা নেই, কোনো বৃহস্পতিও জানেন না।
তীর্থহীনা
[সম্পাদনা]- পুব-বাংলার ভাটিয়ালি গানে আছে রাধা ভেজা কাঠ জ্বালিয়ে ধুয়ো বানিয়ে কৃষ্ণ- বিরহের কান্না কাঁদতেন। শাশুড়ি-ননদী জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ধুয়ো চোখে ঢুকছে বলে চোখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে। শুনেছি বাঙালি মেয়েও নাকি নির্জনে কাঁদবার ঠাঁই না পেলে স্নানের ঘরে কল ছেড়ে দিয়ে তার সঙ্গে হাউহাউ করে কাঁদে। [চাচার জবানীতে]
বেলতলাতে দু-দুবার
[সম্পাদনা]- বড় শহরে মানুষ যে রকম নিঃসঙ্গ অনুভব করে তার সঙ্গে গ্রামের নির্জনতার তুলনা হয় না। গ্রামের নিত্যিকার ডালভাত অরুচি এনে দেয় সত্যি, তবু সেটা শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর পাঁচজনের শেরি-শ্যাম্পেন খাওয়া দেখার চেয়ে অনেক ভালো। [চাচার জবানীতে]
- মেলার পরব সব দেশে একই রকম। তিন মিনিট নাগরদোলায় চক্কর খেয়ে নিলে, ঝপ করে দুটো পানের খিলি মুখে পুরলে (দেশভেদে চকলেট), দুটো সস্তা পুতুল কিনলে, গণৎকারের সামনে হাত পাতলে, না হয় ইয়ারদের সঙ্গে গোট পাকিয়ে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসলে (দেশভেদে ফষ্টিনষ্টি করলে)। অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনে যে ঘন ঘন পট পরিবর্তন সম্ভব হয় না সেইটে মেলার সময় সুদে-আসলে তুলে নেওয়া। যে মেলা যত বেশি মনের ভোল ফেরাবার পাঁচমেশালি দিতে পারে সে মেলার জৌলুশ তত বেশি। তাই বুঝতে পারছ, বড়' শহরে কেন মেলা জমে না। যেখানে মানুষ বারো মাস মুখোস পরে থাকে সেখানে বহুরূপী কল্কে পাবে কেন?
বিধবা-বিবাহ
[সম্পাদনা]- আমাদের দেশের লোক সাদা চামড়ার ভক্ত। যে যত কালো সাদা চামড়ার প্রতি তার মোহ তত বেশি, ইয়োরোপে নাকি কালো চামড়ার আদর ঠিক সেই অনুপাতে। একমাত্র হাবশীরাই শুনেছি আপন চামড়ার কদর বোঝে। তাই সায়েবদের দিকে তারা তাকায় অসীম করুণা নিয়ে-আহা, বেচারিদের ও-রকম ধবলকুষ্ঠ হয় কেন?
রাক্ষসী
[সম্পাদনা]- আমি বললুম, 'সব হিন্দুই একবার স্মোক করে, সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাক আর নাই থাক, সেটা জানেন?'
বললেন, 'কী রকম?'
'তাদের তো পোড়ানো হয়, দেন দে স্মোক।' - মদ খেলে কেউ হয়ে যায় ঝগড়াটে, কেউ বা আরম্ভ করে বদ রসিকতা, কেউ করে খিস্তি, কেউ হয়ে যায় যীশুখ্রীষ্ট-দুনিয়ার তাবৎ দুঃখকষ্ট সে তখন আপন স্কন্ধে তুলে নিতে চায়, আর সবাইকে গায়ে পড়ে টাকা ধার দেয়। পরের দিন অবশ্য চাকরের উপর চালায় চোট-পাট, ভাবে … ঐ শালাই মোকা পেয়ে টাকাটা লোপাট মেরেছে।
পাদটীকা
[সম্পাদনা]- পণ্ডিতমশাই বললেন, 'বেশ বেশ। তবে শোন। মিম্বর উল্লার শালা বলল, লাট-সায়েবের কুত্তাটার পিছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচা হয়। … বলতো দেখি, যদি একটা কুকুরের পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয়, তবে ফি ঠ্যাঙের জন্য কত খরচ হয়?' … তাড়াতাড়ি বললুম, 'আজ্ঞে, পঁচিশ টাকা।' পণ্ডিতমশাই বললেন, 'সাধু, সাধু।' তারপর বললেন, 'উত্তম প্রস্তাব। অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন, আমাদের সকলের জীবনধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুঝি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাটসায়েবের কুকুরের কটা ঠ্যাঙের সমান?’ আমি হতবাক। 'বল না।' আমি মাথা নীচু করে বসে রইলুম। শুধু আমি না, সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ। পণ্ডিতমশাই হুঙ্কার দিয়ে বললেন, 'উত্তর দে!' মূর্খের মতো একবার পণ্ডিতমশায়ের মুখের দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়েছিলুম। দেখি, সে মুখ লজ্জা, তিক্ততা, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গিয়েছে। ক্লাসের সব ছেলে বুঝতে পেরেছে – কেউ বাদ যায়নি – পণ্ডিতমশাই আত্ম-অবমাননার কী নির্মম পরিহাস সর্বাঙ্গে মাখছেন, আমাদের সাক্ষী রেখে।
পুনশ্চ
[সম্পাদনা]- ইতর ব্যাপারে 'যাহা অল্প তাহাই মিষ্ট' হতে পারে, কিন্তু ভদ্রতার ব্যাপারে 'আধিক্যে দোষ নেই।'
- পায়ে হেঁটে গেলে দু মাইল চলতে যা খর্চা, দু লক্ষ মাইল চলতেও তাই।
- ক্রসওয়ার্ড আমি কাগজেই পছন্দ করি, জীবনে নয়।
বেঁচে থাকো সর্দি-কাশি
[সম্পাদনা]- জর্মন ভাষাতেই প্রবাদ আছে, 'ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাত দিনে, না খেলে এক সপ্তায়।'
- যে ব্যামোর দেখবেন সাতান্ন রকমের ওষুধ, বুঝে নেবেন, সে ব্যামো ওষুধে সারে না। [জার্মান ডাক্তারের জবানীতে]
- প্রবাদ আছে, প্রেমে পড়লে বোকা নাকি বুদ্ধিমান হয়ে যায়-প্রিয়াকে পাওয়ার জন্য তখন তার ফন্দি-ফিকিব আর আবিষ্কার কৌশল দেখে পাঁচজনের তাক লেগে যায়, আর বুদ্ধিমান নাকি প্রেমে পড়লে হয়ে যায় একদম গবেট-এমন সব কাণ্ড তখন করে বসে যে দশজন তাজ্জব না মেনে যায় না, এ লোকটা এসব পাগলামি করছে কী করে। [জার্মান ডাক্তারের জবানীতে]
- বেঁচে থাকো সর্দি-কাশি
চিরজীবী হয়ে তুমি।