সরলা দেবী চৌধুরানী

—সরলা দেবী চৌধুরানী
সরলা দেবী চৌধুরানী (৯ সেপ্টেম্বর ১৮৭২ - ১৮ আগস্ট ১৯৪৫) ছিলেন একজন সাহিত্যিক এবং সমাজসেবক। তিনি সরলা ঘোষাল নামেও পরিচিত ছিলেন।তিনি সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি শতাধিক স্বদেশপ্রেমূলক গান রচনা করেন। তিনি ১৯১০ সালে এলাহাবাদে ভারতের প্রথম মহিলা সংগঠন ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারত স্ত্রী মহামন্ডল’। কলকাতায়ও ‘ভারত স্ত্রীশিক্ষা সদন’ নামে অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভারতী, সখা ও বালক পত্রিকায় রচনা প্রকাশের মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর সাহিত্যিক জীবন। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। অগ্রজা হিরণ্ময়ী দেবীর সঙ্গে যুগ্মভাবে ভারতী পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো, বাঙালির পিতৃধন, ভারত-স্ত্রী-মহামন্ডল, নববর্ষের স্বপ্ন (গল্প), জীবনের ঝরাপাতা (আত্মজীবনী), বেদবাণী (১১ খন্ড), শিবরাত্রি পূজা ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর রচিত একশটি দেশাত্মবোধক গানের একটি সংকলন গ্রন্থ শতগান ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয়।
উক্তি
[সম্পাদনা]- বাড়িতে মেয়েদের মজলিস ভাল করে জমকায়ই না সবাই মিলে এক খাটে না বসলে। শুধু বাঙলা দেশে নয়, পশ্চিমে ও উত্তর-পশ্চিমে ভারতের সর্বত্রই এই। কোথাও বলি পালং, কোথাও খাট, কোথাও খাটিয়া, কোথাও গদি সতরঞ্চিপাতা বৃহৎ তক্তপোষ, কোথাও ঢালা ফরাস বিছানা—জিনিস একই। ছাড়া ছাড়া আলাদা চেয়ারে বসে প্রাচ্যের তৃপ্তি হয় না, একসঙ্গে, কাছাকাছি একটা আসনে বসলে তবে মন ভরে।
- জীবনের ঝরাপাতা- সরলা দেবী চৌধুরানী, পরিচ্ছেদ দুই, প্রকাশক- শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৮
- প্রেমে পড়া জিনিষটা ভারি সহজ, সরল, অবাধ; এবং একটি বহু পুরাতন সত্য আজ সহসা নূতন করিয়া আবিষ্কার করিলাম,―ব্যক্ত প্রেমের প্রথম মুহূর্ত্ত নিরতিশয় মধুর,―মনোরাজ্যে আমার এই আবিষ্কার জড়রাজ্যে কলম্বসের আবিষ্কারের অপেক্ষাও গুরুতর।
- নব-বর্ষের স্বপ্ন - সরলা দেবী, প্রথম পরিচ্ছেদ, প্রকাশক-গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এণ্ড সন্স, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ (১৩২৫ বঙ্গাব্দ) পৃষ্ঠা ৪-৫
- রাজনীতি এমন একটা ক্ষেত্র, যেখানে কোন পুরুষ কোন মেয়ের জন্য ‘seat’ ছাড়তে পরাঙ্মুখ, সবাই ‘আপ-কা-ওয়াস্তে’—
- জীবনের ঝরাপাতা- সরলা দেবী চৌধুরানী, প্রকাশক- শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৫৬-১৫৭
- সেকালে পাল্কীর সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত সংযোগ ছিল। দুচারখানা পাল্কী বাড়ির ভিতরের দেউড়ীতে সর্বদাই মজুদ থাকত। দরকার হলে শুধু বেহারাদের তাদের বাড়ি থেকে ডেকে পাঠালেই হল।
- জীবনের ঝরাপাতা- সরলা দেবী চৌধুরানী, প্রকাশক- শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২৩-২৪
- আমার ষোড়শ জন্মদিনের কথা বেশ মনে পড়ে। লম্বা খাবার টেবিলে নানারকম মিষ্টান্ন ফল ফলু সাজান—মাঝখানে একটা ঝকঝকে রূপার থালার উপর একটি বড় কেকের পাশে পাশে গোল করে ষোলটি মোমবাতি দীপ্যমান। আজ যত বছরের হলুম, এ গৃহে ততগুলি দীপ জ্বলে উঠল আজ—এই সুন্দর ইংরেজী প্রথাটির অনুসরণ দিদির নতুনত্ব—যতদূর মনে পড়ে মেজমামীও কোনদিন এটা করেন নি।
- জীবনের ঝরাপাতা- সরলা দেবী চৌধুরানী, পরিচ্ছেদ আট, প্রকাশক- শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৫২
- বঙ্কিমের স্মৃতি প্রসঙ্গে “বন্দে মাতরম্” গান ও মন্ত্রের স্মৃতি ভেসে না উঠে যায় না। সে গান বঙ্কিম-ভক্তিতে ডোবা আমার প্রাণে প্রথম ফোটেনি। তার ফোটানতে ছিল রবীন্দ্রের হাত। জীবনের প্রথম দিকে কাব্য বা সঙ্গীতের রসগ্রাহিতায় রবীন্দ্রের আত্মপর বিচার ছিল না। যে কবির যেটি ভাল লাগত সেটিতে নিজের সুর বসিয়ে, গেয়ে ও গাইয়ে তার প্রচার করতেন।
- জীবনের ঝরাপাতা- সরলা দেবী চৌধুরানী, পরিচ্ছেদ সাত, প্রকাশক- শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ৪৭
- খুব ভোরে উঠে দুজনে গলা ধরাধরি করে বাড়ির ভিতরের বাগানে গিয়ে শিউলিফুল কুড়িয়ে আনতুম। শুকিয়ে গেলে তার বোঁটা জলে সিদ্ধ করে কাপড় ছোপান হত। সুপ্রভাদিদি ও ঊষাদিদি পরতেন শাড়ি—আমার পরিধান তখনও ইজের জামা। কাপড় রঙাবার জন্যে আর একটি জিনিসও পাওয়া যেত কখনো কখনো বাগানে—নটকানে। কিন্তু তাতে বড়রা দখল জমিয়ে রাখতেন—আমাদের তোলা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল।
- জীবনের ঝরাপাতা- সরলা দেবী চৌধুরানী, পরিচ্ছেদ আট, প্রকাশক- শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ২০
- একদিন পণ্ডিতমশায় আমাকে ও দাদাকে কোণে দাঁড়ানর বদলে শাস্তি দিলেন পড়ার টেবিলের তলায় গিয়ে গুটিসুটি মেরে বসতে। আর হুকুম করলেন—“আজ ব্রজবাবু যখন আসবেন, আমার সঙ্গে গল্পসল্প করবেন, তখন তোমরা ঐখান থেকে তার পায়ে চিমটি কাটবে, তাঁর খুব আমোদ হবে।” একে শাস্তি পাওয়ার লজ্জা তার উপর সেটা নিজে জাহির করা বেহায়াপনার দ্বারা—এই শাস্তির উপর শাস্তি; এই রকম নির্লজ্জ ব্যবহারশীল হতে হওয়া—এইটে ভয়ানক বাজল। পণ্ডিতমশায় মধ্যে মধ্যে আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে গল্প করতেন সেকালের পাঠশালায় গুরুমশায়দের উর্বর মাথায় কত রকমের রোমাঞ্চকর শাস্তির উদ্ভাবনা হত। সে সবের তুলনায় আমরা যে সব শাস্তি পাচ্ছি, এ ত কিছুই নয়। তাঁর রুলের স্পর্শ তো ফুলের স্পর্শ।
- জীবনের ঝরাপাতা- সরলা দেবী চৌধুরানী, পরিচ্ছেদ তিন, প্রকাশক- শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড, প্রকাশস্থান- কলকাতা, প্রকাশসাল- ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), পৃষ্ঠা ১৫