অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
অবয়ব
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১ মার্চ ১৮৬১ — ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০) হলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি ইতিহাসবেত্তা ও সমাজকর্মী। তিনি বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তৎকালীন নেতৃস্থানীয় আইনজীবী ছিলেন। মানবিক জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, বিশেষ করে ইতিহাস, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি, চিত্রকলা এবং প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ধারণা করা হয় তার বিচক্ষণতায় প্রভাবিত হয়েই শরৎকুমার রায় বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি এবং বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
উক্তি
[সম্পাদনা]- ভারতবর্ষ একটি অতিবিস্তৃত মহাদেশ, বহু সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন দেশের একত্র সমাবেশে অসীম রহস্যের আধার হইয়া, এতকাল নীরবে কাল যাপন করিতেছিল। তাহার অতি পুরাতন ভূস্তর নিহিত পূর্বতন কীর্তি চিহ্ন অনাবিস্কৃত এবং অনালোচিত থাকিয়া, প্রকৃত তথ্যের সন্ধান প্রদান করিতে পারিতনা। তজ্জন্য ইউরোপীয়গণ ভারত পুরাতত্ত্বের প্রাচীনত্ত্ব সম্বন্ধে অনেক অলীক অনুমানের অবতারণা করিয়া আসিতেছিল এবং কোণ স্থলে অকস্মাৎ কোণ পুরাকীর্তি আবিস্কৃত হইলে তাহার মূলানুসন্ধানের জন্য যথাযোগ্য আয়োজন না করিয়াই, তাহাকে হয় ব্যাবিলনের, না হয় মিশরের, না হয় গ্রীস, রোমের প্রভাবচিহ্ন বলিয়া ব্যাখা করিতে চাহিতেন। তথাপি কোণ কোণ মনিষী ভারত স্থাপত্যের মধ্যে কোনপ্রকার পরপ্রভাবের চিহ্ন লক্ষ্য করিতে না পারিয়া, ভারতবর্ষকে প্রহেলিকাময় মনে করিতে বাধ্য হইত।
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ -এর বঙ্গভূমী ও বাঙ্গালি পরিচ্ছেদ -এর অন্তর্গত মানব সভ্যতার আদি উদ্ভবক্ষেত্র উপপরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় -এর পত্রিকা মানসী ও মর্ম্মবাণী -র ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায় রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ
- অতীতের সহিত বর্তমানের সম্বন্ধ আকস্মিক সম্বন্ধ হইতে পারে না। এখন যে সকল লোক-ব্যবহার প্রচলিত আছে, তাহার কিছু কিছু নিতান্ত আধুনিক কালে উদ্ভাবিত হইয়া থাকিলেও, অধিকাংশ লোক ব্যবহার যে স্মরণাতীত পুরাকাল হইতে কালস্রোতের সঙ্গে প্রবাহিত হইয়া আসিয়াছে, তাহাতে সংশয় প্রকাশের কারণ নাই। তাহার যথাযোগ্য বিশ্লেষণ-কার্য্য সুসম্পাদিত হইলে, বর্তমানের মধ্যেই চির পুরাতনের অনেক সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যাইতে পারে।
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ -এর বঙ্গভূমী ও বাঙ্গালি পরিচ্ছেদ -এর অন্তর্গত মানব সভ্যতার আদি উদ্ভবক্ষেত্র উপপরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় -এর পত্রিকা মানসী ও মর্ম্মবাণী -র ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায় রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল।অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ
- দিবসের এক ভাগ ইতিহাসের এবং পুরাণের অনুশীলনে যাপন করিবার প্রাচীন ব্যবস্থার মধ্যে স্পষ্টই দেখিতে পাওয়া যায় যে ইতিহাস এবং পুরাণ দুইটি পৃথক বিষয় বলিয়া পরিচিত ছিল, নচেৎ পৃথক ভাবে দুইটি উল্লিখিত হইত না।
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ -এর বঙ্গভূমী ও বাঙ্গালি পরিচ্ছেদ -এর অন্তর্গত মানব সভ্যতার আদি উদ্ভবক্ষেত্র উপপরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় -এর পত্রিকা মানসী ও মর্ম্মবাণী -র ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায় রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল।অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ
- যাহারা বাংলা দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে অনেক বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত হইতে লজ্জাবোধ করে ; তাহারা বলে বাংলা দেশে জন্মগ্রহণ করিলেই বাঙ্গালী হয় না। যাহাদের মাতৃভাষা বাঙ্গালা, তাহাদের মধ্যেও কেহ কেহ বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত হইতে ইতস্ততঃ করিয়া থাকে ; তাহারা বলে বাংলা ভাষায় কথাবার্তা কহিলেই বাঙ্গালী হয় না। তবে কাহাকে বাঙ্গালী বলিব?
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ -এর বঙ্গভূমী ও বাঙ্গালি পরিচ্ছেদ -এর অন্তর্গত বাঙ্গালী উপপরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত। প্রবাসী পত্রিকায় ১৩০৮ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ্য সংখ্যায় রচনাটি প্রকাশিত হয়। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ
- যাহারা স্মরণাতীত কাল হইতে বাঙ্গালা দেশে বংশানুক্রমে বাস করিয়া আসিতেছে, কদাপি বাঙ্গালার চতুঃসীমার বাহিরে পদার্পণ করে নাই, কেবল তাহারাই কি বাঙ্গালী? সে হিসাবে গারো কুকী এবং সাঁওতালেরাই খাঁটি বাঙ্গালী! বঙ্গবাসী ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য প্রভৃতি সভ্যজাতি বিদেশাগত উপনিবেশনিবাসী মাত্র।
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ -এর বঙ্গভূমী ও বাঙ্গালি পরিচ্ছেদ -এর অন্তর্গত বাঙ্গালী উপপরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত। প্রবাসী পত্রিকায় ১৩০৮ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ্য সংখ্যায় রচনাটি প্রকাশিত হয়। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ
- জন্মস্থান এবং মাতৃভাষা লইয়া বিচার করিতে হইলে বঙ্গদেশপ্রসূত বঙ্গভাষাভাষী ব্যক্তিমাত্রকেই এখন বাঙ্গালী বলিয়া অভিহিত করিতে হইবে। কাহার পূর্বপুরুষ কোন অজ্ঞাত পুরাকালে বঙ্গদেশে প্রথম পদার্পণ করিয়াছিলেন, সে কথা এখন বিচার করিবার প্রয়োজন নাই।
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ -এর বঙ্গভূমী ও বাঙ্গালি পরিচ্ছেদ -এর অন্তর্গত বাঙ্গালী উপপরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত। প্রবাসী পত্রিকায় ১৩০৮ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ্য সংখ্যায় রচনাটি প্রকাশিত হয়। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ
- যাহারা সমুদ্রতীরে বাস করে, তাহারা কৌতূহল ও বিস্ময়ে অভিভূত হইয়াই প্রথমে সমুদ্রবেলায় বিচরণ করে, পরে কুলে কুলে পরিভ্রমণ ও ক্রমশঃ সমুদ্রবক্ষে বিচরণ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পোতাদি নির্ম্মাণ করিতে থাকে ; অবশেষে সমুদ্রই তাহাদের শৌর্য্য বীর্য্য ও ধনাগমের নিদান হইয়া পড়ে–স্থলপথ অপেক্ষা জলপথেই অধিক অনুরাগ বর্দ্ধিত হইতে থাকে। নিত্য নূতন দেশে পদার্পণ নিত্য অপরিজ্ঞাত পূর্ব্ব শোভাসন্দর্শন, নিত্য নবোৎসাহে ধনাহরণ, এবং নিত্য নবকীৰ্ত্তি সংস্থাপনের লোভে সমুদ্রকূলনিবাসী মানবসমাজ সমদ্রভ্রমণে সুদক্ষ হইয়া উঠে।
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ -এর বঙ্গভূমী ও বাঙ্গালি পরিচ্ছেদ -এর অন্তর্গত বাঙ্গালী উপপরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত। প্রবাসী পত্রিকায় ১৩০৮ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ্য সংখ্যায় রচনাটি প্রকাশিত হয়। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ
- অখণ্ড মহাকালকে খণ্ড খণ্ড করিয়া লইয়া তাহারই এক অংশকে অতীত বলি, এক অংশকে বর্তমান বলি, আর এক অংশকে ভবিষ্যৎ বলি। প্রকৃতপক্ষে, তাহাদের মধ্যে এক অখণ্ড যোগসূত্র বর্তমান আছে। ইতিহাস সেই যোগসূত্রের সন্ধান প্রদান করে।
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ -এর বঙ্গভূমী ও বাঙ্গালি পরিচ্ছেদ -এর অন্তর্গত বাঙ্গালীর আদর্শ উপপরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত। সাহিত্য পত্রিকার ১৩২৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রচনাটি। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ
- অধঃপতনের কাল প্রকৃত সঙ্কটকাল নয়; কিন্তু অভ্যুদয়ের কালই প্রকৃত সঙ্কটকাল। আমরা এক দিন না একদিন অবশ্যই উঠিব, জগতের জনসমাজের মধ্যে দশ জনের এক জন হইয়া উঠিব। কিন্তু কেমন হইয়া উঠিব? আমরা কি দৈত্যদানবের মতো ক্ষমাশূন্য বাহুবল লইয়া বসুন্ধরা হইতে সকল সভ্যতা, সকল শৃঙ্খলা, সকল উন্নতি চিরপদদলিত করিতে করিতে, প্রচণ্ড তাণ্ডবে জলস্থল কম্পান্বিত করিয়া উঠিব? অথবা জগতের সম্মুখে মানবতার মহান আদর্শ সুসংস্থাপিত করিবার জন্য ধর্ম্মের নামে, সত্যের নামে, প্রীতির নামে, পবিত্রতার নামে, মনুষ্যত্বের নামে, – প্রসন্ননয়নে প্রবুদ্ধ হইয়া উঠিব? আমরা কোন আদর্শের অনুগামী হইব, তাহার উপরই তাহা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করিবে। তাই বলিয়াছি, অভ্যুদয়ের কালই প্রকৃত সঙ্কটকাল।
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ -এর বঙ্গভূমী ও বাঙ্গালি পরিচ্ছেদ -এর অন্তর্গত বাঙ্গালীর আদর্শ উপপরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত। সাহিত্য পত্রিকার ১৩২৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রচনাটি। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ
- ভাঙ্গা নহে, গড়া ; গড়া নহে, সংশোধন ; সংশোধন নহে, সংস্কার ; সংস্কার নহে, চিরাগতকে নবাগতের সঙ্গে সুসঙ্গতভাবে খাপ খাওয়াইয়া লওয়া, ইহাই যে যক্তিযুক্ত কার্য্য, বিচারবুদ্ধি তাহারই পক্ষ সমর্থন করিবে। তাহাই প্রকৃত লক্ষ্য বলিয়া সকলের নিকটেই প্রতিভাত হইবে।
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ -এর বঙ্গভূমী ও বাঙ্গালি পরিচ্ছেদ -এর অন্তর্গত বাঙ্গালীর আদর্শ উপপরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত। সাহিত্য পত্রিকার ১৩২৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রচনাটি। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ
- আজ যাহা ইতিহাসের কথা, একদিন তাহা প্রতিদিবসের শাসনতত্ত্বের কথা ছিল; আজ যাহা প্রতিদিবসের শাসনতত্ত্বের কথা, কালে তাহাই আবার ইতিহাসের কথা বলিয়া পরিচিত হইবে।
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ -এর বঙ্গভূমী ও বাঙ্গালি পরিচ্ছেদ -এর অন্তর্গত বাঙ্গালীর আদর্শ উপপরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত। সাহিত্য পত্রিকার ১৩২৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রচনাটি। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ
- অতীতের কথা ও বর্তমানের কথা, একই পর্যায়ের কথা; কেবল কালের পার্থক্যে একটির নাম ইতিহাস, অন্যটির নাম অন্য কিছু। সুতরাং অতীতকে বুঝিবার চেষ্টা বর্ত্তমানকে বুঝাইবার চেষ্টার নামান্তর মাত্র।
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ -এর বঙ্গভূমী ও বাঙ্গালি পরিচ্ছেদ -এর অন্তর্গত বাঙ্গালীর আদর্শ উপপরিচ্ছেদ থেকে সংগৃহীত। সাহিত্য পত্রিকার ১৩২৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রচনাটি।অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রচনা সংগ্রহ
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]উইকিপিডিয়ায় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ রয়েছে।